চিত্রনাট্য পড়ে আমরা তো সবাই খুব খুশি।
উত্তম আর মিসেস সেনও প্রশংসা করলেন।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য একটা বিষয়ে।
শুধু নায়ক আর নায়িকাকে নিয়ে তো ছবি হয় না। পাশাপাশি আরও অনেক চরিত্রের সমাবেশ ঘটাতে হয়। নৃপেনদাও তা-ই করেছেন। ছোট-বড় নানা চরিত্রের সঙ্গে আরও দুটো চরিত্র এঁকেছেন, ছবিতে যাঁরা অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকবেন। গুরুত্বও খুব।
প্রথমটির কথায় পরে আসব। কারণ, সমস্যাটা তাঁকে নিয়েই।
দ্বিতীয় চরিত্রটি এক খবরের কাগজের রিপোর্টারের। নায়কের বন্ধু। চঞ্চল, স্মার্ট— কথা বললেই মুখ দিয়ে খই ফোটে। অনিল, মানে অনিল চট্টোপাধ্যায় আমাদের বন্ধুলোক— তাকে খুব মানাবে। ঠিক করলাম, ওকেই গিয়ে ধরব। বলা বাহুল্য, অনিল এক কথায় রাজি হয়ে গেল।
এবার আসল সমস্যা, অর্থাৎ প্রথম চরিত্রটি।
এক রাশভারী খবরের কাগজের মালিক। দোর্দণ্ডপ্রতাপ, কিন্তু কথাবার্তায় অসাধারণ সংযম। ব্যক্তিত্ব এতটাই যে, তাঁর মুখোমুখি হতে সকলেই থরহরিকম্প। এদিকে বাড়িতে তাঁর সম্পূর্ণ অন্য চেহারা। স্ত্রী নেই, গত হয়েছেন। থাকবার মধ্যে একটিমাত্র মেয়ে— বাবার কাছ থেকে অগাধ প্রশ্রয় আর স্নেহ পেয়ে যার মাথাটি বিগড়ে গেছে। মেয়েটি থেকে থেকেই নানারকম সমস্যা তৈরি করে। বাবাকে সামলাতে হয় সেসব।
চরিত্রের এই যে ড্যুয়ালিটি, অর্থাৎ পরস্পরবিরোধী দুটি ভাব, সকলেই একমত হলাম, এর জন্যে একমাত্র আর্টিস্ট হতে পারেন ছবি বিশ্বাস।
কিন্তু তাঁর সঙ্গে তো আমাদের পরিচয়ই নেই, ঘেঁষব কী করে? তার ওপর তিনি মহাব্যস্ত, ডেট পাওয়াই মুশকিল। তৃতীয়ত এবং সব থেকে বড় কথা, তাঁর সম্মানদক্ষিণাও সবাইকে ছাড়িয়ে। এদিকে আমরা করতে চলেছি একটা লো-বাজেটের ছবি, উত্তম আর মিসেস সেনের দৌলতে।
ছবি বিশ্বাস যে কোন মাপের শিল্পী, তা নতুন করে বলা বাহুল্যমাত্র! অজস্র বাংলা ছবিকে একাই তিনি উতরে দিয়েছেন। ‘শশীবাবুর সংসার’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, বা ‘জলসাঘর’ যাঁরা দেখেছেন, আশা করি একমত হবেন। কিন্তু কী করে পৌঁছব তাঁর কাছে? আমাদেরই বা পাত্তা দেবেন কেন উনি?
অতএব খোঁজ পড়ল, এমন কে আছে, যাকে ধরে ছবি বিশ্বাসের কাছে পৌঁছনো যায়।
দিনের পর দিন যায়, তেমন লোক আর খুঁজে পাই না। হঠাৎ একদিন বসুশ্রী সিনেমার কফি হাউসে অনিলের সঙ্গে দেখা। সব শুনে ও বলল, ‘আরে, এ আবার একটা সমস্যা নাকি? তেমন লোক তো হাতের মুঠোয়।’
— ‘কে?’
— ‘কেন? আমাদের নৃপতিদা। ছবিদার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওঁকে ধরলেই তো সব প্রবলেম সলভ্ড।’
নৃপতিদা? মানে আমাদের রোগা-পটকা কমেডিয়ান? এত লোক থাকতে উনি কিনা দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছবি বিশ্বাসের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’!
নৃপতিদা, অর্থাৎ নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, বাংলা ছায়াছবির দর্শকদের কাছে দারুণ প্রিয় একটা নাম। পর্দায় ওঁর কাণ্ডকারখানা দেখে সবাই হেসে কুটিপাটি হয়।
অনিলের কথা শুনে আমরা গিয়ে নৃপতিদাকে ধরলাম।
পুরো বৃত্তান্ত শুনে একগাল হেসে উনি বললেন, ‘এই কথা? আরে দূর, আমি ছবিকে বলে দেব। তোরা সিধে চলে যা, কিচ্ছু আটকাবে না।’
আশ্বস্ত হতে না পেরে আবদার ধরলাম, ‘আপনিও একটু কষ্ট করে চলুন না আমাদের সঙ্গে। খুব অসুবিধে হবে?’
নৃপতিদা এমনিতে মাটির মানুষ, আগে থেকেই খাতির ছিল আমাদের সঙ্গে। আমাদের ভালওবাসতেন খুব। বললেন, ‘মুশকিলে ফেললি। ও যা ব্যস্ত মানুষ, দেখি কবে একটু সকাল-সকাল ওর শুটিং প্যাক-আপ হয়।’
তিন দিনও কাটেনি, সুখবর এল। নৃপতিদা নিজেই এসে বললেন, ‘ওরে, তোরা তো দেখছি চাঁদ-কপালে রে! পরশু ও আউটডোর শুটিং করবে কলকাতার রাস্তাঘাটে। সুয্যি ডুবে গেলেই আউটডোরও খতম। তার মানে বিকেলেই ও বাড়িতে ফিরে আসবে। এক কাজ কর। পরশু ঠিক সন্ধে সাড়ে ছ’টায় টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর সামনে চলে আয় তোরা। আমি এসে তোদের নিয়ে যাব।’
নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে দিলীপবাবু আর আমি ট্রাম ডিপোর সামনে হাজির। শীতকাল। অন্ধকার নেমে এসেছে অনেক আগেই। কিন্তু কোথায় নৃপতিদা?
দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। মিনিট পঁচিশ পরে উনি এলেন একটা সাইকেল রিকশায় চড়ে। পেছনে আরও একটা খালি রিকশা।
— ‘ওঠ, ওঠ। একদম রেডি হয়েই এসেছি। উঠে পড়।’
এই বলে আমাকে ডেকে নিলেন ওঁর পাশে। দিলীপবাবুর রিকশা চলল পেছন পেছন।
এই শীতেও নৃপতিদার পরনে শুধু ঘিয়ে রংয়ের পাতলা সিল্কের পাঞ্জাবি আর পাজামা। গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজছেন। বোঝা গেল, দারুণ মুড-এ আছেন।
রাস্তার দু’পাশে চাপ চাপ অন্ধকার। এখানে ওখানে কাছে-দূরে দু’একটা টিমটিমে আলো, হালকা কুয়াশা ভেদ করে ভৌতিক দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে আমাদের দিকে।
দু’পাশেই উদ্বাস্তুদের কলোনি। পুকুর, কলাগাছের ঝাড়, মাঝেমধ্যে দু’একটা পাকা বাড়ি— ব্যস, এই পর্যন্ত।
হঠাৎ নৃপতিদা একটা কাণ্ড করে বসলেন। নিজের লিকলিকে একখানা পা সটান চালকের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আরে চল না। কুইক কুইক। সোজা নাকতলা।’
আমি ভাবলাম, সর্বনাশ! এই বুঝি চালকটি রুখে উঠে বলে, ‘করছেন কী? ভদ্দরলোকের ছেলে, রিকশা চালিয়ে খাই বলে কি আপনার বাপের চাকর নাকি?’
কিন্তু না। তেমন কিছুই ঘটল না। উল্টে, আমার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে নৃপতিদা হেসে বলে উঠলেন, ‘আরে এরা তো সবাই আমার ফ্রেন্ড রে৷ রোজ এভাবে যাতায়াত করি।’ বলে রিকশাওয়ালাকে, ‘কী রে? কিছু মাইন্ড করলি নাকি?’
— ‘কী যে বলেন বাবু!’ হেসে সে জবাব দেয়৷
অনেকটা পথ পেরিয়ে অবশেষে নাকতলা। পথের বাঁ-পাশে পাঁচিল-ঘেরা একটা দশাসই বাড়ি। গেট পেরোলেই ডানদিকে একটা গোলাপ বাগান। বাগান আর বাড়ির মাঝখান দিয়ে সরু একটা নুড়ি-বিছানো পথ। সেই পথ দিয়ে মসমস করে এগিয়ে আমরা একটা দরজার সামনে থামলাম। পাল্লা দুটো খোলা। ভেতরে মৃদু আলো।
— ‘ছবি আছ নাকি? ও ছবি!’ নৃপতিদা হাঁক পাড়লেন।
ভেতর থেকে ভেসে এল একটা গমগমে আওয়াজ, ‘আরে এসো এসো। আজ এত ফর্মালিটি কীসের?’
— ‘সঙ্গে আরও দু’জন আছে যে।’
— ‘তো কী হয়েছে? ওঁরাও আসবেন৷ নিয়ে এসো ভেতরে।’
দুরুদুরু বুকে আমরা ঢুকে পড়লাম।
সেই সন্ধে-রাতটার কথা জীবনে কোনওদিন ভুলব না।
আধো-অন্ধকারে ডোবা একটা ঘর, প্রায় হলঘরই বলা চলে। একপাশে ভারী ভারী সোফা সেট, সেন্টার টেবিল, আরও পাঁচমিশেলি ফার্নিচার। দু’একটা আলমারি। একটা হ্যাট র্যাক। সম্পূর্ণ উল্টোদিকে দেওয়াল চেপে একখানা গদি পাতা চৌকি। মাথার কাছে সবেধন নীলমণি ইলেকট্রিক বালবটা। সেই আলোয়, চৌকিতে আধ-শোওয়া হয়ে পানের বাটা থেকে পান সাজছেন গৃহস্বামী— সম্রাট ছবি বিশ্বাস।
আমাদের দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। সেই বহু-পরিচিত অভিব্যক্তি, বহু ছবিতে যেটা ব্যবহার করে নিজের অভিনীত চরিত্রের গুরুগাম্ভীর্য এক ঝলকে দর্শকের মনের মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন।
— ‘কী ব্যাপার? এরা?’
আমাদের মুখ খোলার কোনও প্রশ্নই ছিল না। কথা ছিল নৃপতিদাই পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবেন। নৃপতিদা আরম্ভই করলেন একেবারে পঞ্চম থেকে।
— ‘বুঝলে ছবি, আমি তো একেবারে হতবাক হয়ে গেছি এদের দেখে। এমন সৎ, পরিশ্রমী, ট্যালেন্টেড ছেলে তুমি লাখেও একটা খুঁজে পাবে না’, বলে এমন গুণবর্ণনা শুরু করে দিলেন যে লজ্জায় আমাদের কান গরম হয়ে গেল। ‘আর কী একটা ছবির সাবজেক্ট বেছেছে, আহাহা! শুধু নিজের রোলটা একবার শুনে দেখো তুমি, আহাহা, কী রোল!’ আরও বিস্তর ‘আহাহা’ জুড়ে এমন একটা ছবি তৈরি করলেন, যেন আমাদের পুরো চিত্রনাট্যই ওঁর একেবারে কণ্ঠস্থ। কিন্তু আমরা তো জানি, কী গল্প, কী চিত্রনাট্যের একটা বর্ণও ওঁর জানা নেই। কিন্তু ওঁকে থামায় কে?
আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আরে, দাঁড়িয়ে কেন? বোস বোস, ওই সোফা দুটোয় বোস। ব্যস, কথাবার্তা তো হয়েই গেল। আমি যাই, দোতলায় একটু বউদির সঙ্গে গল্প করে আসি।’
বলে, আমাদের একেবারে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে ওপাশের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন।
ছবি বিশ্বাস তখনও পান সেজে চলেছেন। নৃপতিদার অত লম্বা-চওড়া সার্টিফিকেট আদৌ ওঁর মনে রেখাপাত করেছে কি না, বোঝবার উপায় নেই। একবারও তাকাচ্ছেন না আমাদের দিকে।
আমরা বোকার মতো দূরের সোফায় বসে আছি, আধো অন্ধকারে।
বসে আছি তো বসেই আছি।
মনের মধ্যে প্রবল উৎকণ্ঠা, কী হয় কী হয়। এরকম পরিস্থিতিতে ছোট ছোট আওয়াজগুলোও অনেক জোরালো হয়ে কানে বেঁধে।
বাইরের গোলাপ বাগান থেকে ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসছে। রাস্তা দিয়ে বোধহয় একটা সাইকেল রিকশা চলে গেল। ঘরের দেয়ালে ঘড়িটার টিক টিক শব্দ যেন হাতুড়ির আওয়াজ। পানের বাটার টুকটাক শব্দ যেন লাউড স্পিকারের ভেতর দিয়ে আসছে।
কতক্ষণ যে এইভাবে কাটল কে জানে।
হঠাৎ ভারিক্কি গলার আওয়াজ ভেসে এল।
— ‘ছবি বানানো হচ্ছে?’
শুকনো গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোতে চাইছে না, তবু কোনও রকমে বললাম— ‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’
আবার সব চুপচাপ। যেন পান সাজার মতো জরুরি কাজ এই দুনিয়ায় আর কিছু নেই।
নৃপতিদার ওপর রাগ হতে লাগল। ঠিক এই সময় দোতলায় গিয়ে গল্প না করলেই যেন চলছিল না।
আবার ভাববাচ্যে সেই জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর।
— ‘কবে থেকে শুরু হবে বলে ভাবা হচ্ছে?’
— ‘আজ্ঞে, উত্তম আর মিসেস সেন দু’জনেই বলেছেন আগে আপনার ডেট পাওয়া গেলে, সেই অনুযায়ী ওঁরা অ্যাডজাস্ট করবেন।’
— ‘টোটাল ক’দিনের কাজ এই চরিত্রটার? মানে, আমি যদি আদৌ রাজি হই করতে?’
— ‘আজ্ঞে, চোদ্দো-পনেরো দিনের মতো।’
— ‘হুম। তা, ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে কাজ করবার ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু আমার রেমিউনারেশনটা জানা আছে তো?’ তারপর কেটে কেটে বললেন, ‘পার ডে ওয়ান থাউজ্যান্ড রুপিজ।’
বলে, প্রায় নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে আমাদের প্রতিক্রিয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেব কী, আমাদের তো আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে।
তখনকার দিনে দৈনিক এক হাজার টাকা! সর্বনাশ! কম বাজেটের ছবি আমাদের, এত টাকা দেব কোথা থেকে?
সম্রাট আবার নিশ্চিন্তে পান সাজতে বসলেন। হঠাৎ, কিছুক্ষণ পরে, খুব জোরে হাঁচলেন একবার৷
— ‘হ্যাঁচ্চো৷’
তারপর, আমাদের দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলেন।
— ‘ঠিক আছে। ওই হাঁচির দৌলতে পাঁচশো টাকা কমে গেল।’
আমাদের তখন আর পায় কে? দিনে পাঁচশো টাকা করে— ঠিক আছে, ওটা কষ্টেসৃষ্টে দিতে পারব আমরা। আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করার আগেই হঠাৎ আবার শোনা গেল তাঁর গলা।
— ‘এবার কীসের জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছে? আর একটা হাঁচির জন্যে?’
আমরা ছুটে গিয়ে ওঁর পায়ের ধুলো দিলাম। উনি বললেন, ‘থাক থাক।’ তারপর এতক্ষণকার ভাববাচ্য ছেড়ে সিধে কর্তৃবাচ্যে নেমে এসে বললেন,
— ‘ছবিটা মন দিয়ে করিস।’
মুহূর্তের মধ্যে মহামহিম ছবি বিশ্বাস আমাদের কাছে ‘ছবিদা’ হয়ে উঠলেন।