আঠাশ বছর বয়সেই তিনি ‘ঠাকুরদা’ শিরোপা পান শান্তিনিকেতনে। মস্ত বড় পণ্ডিত। কিন্তু স্বভাবের মধ্যে তাঁর ছিল এমন এক সরস নবীনতা, যে তাঁকে সহজেই রবীন্দ্রনাথের ‘শারদোৎসব’ নাটকের বালকদলের শিরোমণি মনে করা যেত। ১৯০৮ সালে শান্তিনিকেতন আশ্রমের কাজে যোগ দেন পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০)। চম্বা এস্টেটের সম্মানজনক ও নিশ্চিত আর্থিক প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করে অপেক্ষাকৃত কম বেতনে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মাচর্যাশ্রমে যখন তিনি যুক্ত হলেন তখন আশ্রম-বিদ্যালয়ের বয়স মাত্র সাত। তারপর তিনি বাকি জীবন কাটিয়ে গেছেন শান্তিনিকেতন আর বিশ্বভারতীর নানা ভূমিকায়। একসময়ে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের গুরুদায়িত্বও পালন করতে হয় তাঁকে।
ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শুরুর (১৯০১) কয়েকটা বছর ঠিক আনন্দনিকেতন হয়ে ওঠার অবকাশ পায়নি শান্তিনিকেতন। মৃণালিনী দেবীর অকালপ্রয়াণ-সহ নানা কারণেই তার শুরুর সময়টা ছিল বিঘ্নবহুল। ১৯০৭-০৮ সাল থেকে শান্তিনিকেতন আশ্রমের চরিত্রের একটা পরিবর্তন আসতে থাকে। ছেলেদের প্রিয় ‘দিন্দা’ (দিনেন্দ্রনাথ)-র গানের চাবিতে তখন খুলে যাচ্ছে আনন্দের নন্দনকানন। যোগ দিচ্ছেন ক্ষিতিমোহন এবং ক্ষিতিমোহনের কাশীপর্বের বন্ধু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত বিধুশেখর। ১৯০৮ সালেই ‘শারদোৎসব’ নাটক লেখা হচ্ছে আশ্রমের বালকদের অভিনয়ের জন্য। আজ ‘শান্তিনিকেতন ধারার সংস্কৃতি’ বলতে যা বোঝায়, একেবারে সূচনার মুহূর্তেই প্রতিষ্ঠানের সেই সাংস্কৃতিক বিশেষত্বগুলি অতিনির্দিষ্ট হয়ে গড়ে ওঠেনি। একটা বিবর্তনের ধারাপথেই তার ক্রমিক বিকাশ হয়েছিল। আর সেই বিকাশ যে এককভাবে রবীন্দ্রনাথই ঘটিয়েছিলেন তা-ও নয়। নানা মানুষের অবদান জুড়ে আছে এই আশ্রমের নিজস্বতার বিকাশ-প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্তে। আর তাতে পণ্ডিত ক্ষিতিমোহনের অবদান ছিল বিশেষ ভাবেই উল্লেখযোগ্য।
দু’জনেই প্রাচীন শাস্ত্রজ্ঞ হলেও, ক্ষিতিমোহন আর বিধুশেখরের ব্যক্তিত্বের গড়নের কিছু ফারাক ছিল। ক্ষিতিমোহনের ব্যক্তিত্বে শাস্ত্রীয় প্রজ্ঞার সঙ্গে যুক্ত ছিল অননুকরণীয় এক রসিক মন। প্রাচীন শাস্ত্রমন্থন করে তার মধ্য থেকে নান্দনিক সম্ভাবনা উন্মোচন করার ক্ষেত্রে ক্ষিতিমোহনের জুড়ি মেলা ভার ছিল। অনেকেই মনে করেন, শান্তিনিকেতনের নান্দনিকতার বিকাশ বুঝি বিশ্বভারতী পর্বেরই একান্ত বিশেষত্ব। কথাটা সর্বাংশে অনুমোদনযোগ্য নয়। ‘শান্তিনিকেতনের নান্দনিকতা’ বলতে যদি স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত সামষ্টিক কোনও জীবনকলা ও প্রকরণ-বিশেষ বোঝায়, তাহলে তার সূচনা হয়েছিল আশ্রমের মাঙ্গলিক প্রকরণ-আয়োজনের সূত্রেই।
কলাভবন (১৯১৯)-এর প্রদীপ জ্বালার আগে সলতে পাকাবার পর্বটা শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৯০৭-০৮ সালেই।
‘মাঙ্গলিকতা’ শব্দটির সঙ্গে অবশ্য জড়িয়ে থাকে একরকম ধর্মীয়, শাস্ত্রীয় বা লোকাচারগত অনুশীলনের অর্থদ্যোতনা। তার সঙ্গে ‘নান্দনিকতা’র সম্পর্ক কী? ধরা যাক, আম্রপল্লব শোভিত পূর্ণঘট একটি মাঙ্গলিক চিহ্ন। কিন্তু এই চিহ্নের একটি নান্দনিক মূল্যও থাকতে পারে। ধর্মীয় অনুষঙ্গ থেকে মুক্ত করে এটিকে একটি নান্দনিক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। শান্তিনিকেতনের উৎসব-অনুষ্ঠানের প্রকরণ উদ্ভাবনে এইখানেই ছিল ক্ষিতিমোহনের বিশেষ অবদান।

একটা সময় ছিল, যখন শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবেও উচ্চারিত হত মন্ত্র। সবাই জানেন শান্তিনিকেতনের ঋতু-উৎসব ‘দোল’ বা ‘হোলি’ নয়; নিতান্তই একটা ঋতু-উৎসব। ক্ষিতিমোহন হয়তো সেই উৎসবের মধ্যে জুড়ে দিতেন সংস্কৃত শাস্ত্র বা কাব্য থেকে কোনও-কোনও মন্ত্র, শ্লোক, বা স্তোত্র। ক্ষিতিমোহন প্রাচীন সাহিত্যের ‘বসন্তভাবনা’ নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন। যেমন বসন্তোৎসবের অনুষ্ঠানে ক্ষিতিমোহন ‘কৃষ্ণযজুর্বেদ’-এর ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’র অন্তর্গত ‘বসন্তম্ ঋতুনাংপ্রীণামি। / স মা প্রীতঃপ্রীণাতু।’ (‘বসন্তকে যদি চিন্ময় সাধনায় পূর্ণ করিয়া দিতে পারি তবে বসন্ত ঋতুও প্রসন্ন হইয়া আমাকে সর্ব পরিপূর্ণতায়পরিতৃপ্ত করিয়া দিবেন।’)— এইরকম মন্ত্র জুড়ে দিতেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন ‘নিবিড় অন্তরতর বসন্ত’কে উপলব্ধি করেছিলেন; ক্ষিতিমোহনের ‘চিন্ময়বসন্ত’ও তেমন ধারার। প্রতিটি ঋতুর নিজস্ব রাগরংকে উপলব্ধি করতে পারলে, এবং তার সঙ্গে ব্যক্তি ও সমষ্টি মানুষের চিত্তের সম্মিলন ঘটাতে পারলেই— এইসব ঋতু-উৎসব আয়োজন সার্থক হয়। প্রাচীন ভারতবর্ষের শিল্পচেতনামাঙ্গলিক ও নান্দনিক— এইদুইকে একটিসমবিন্দুতে মেলাতে প্রয়াস করেছিল। ‘ভারতশিল্পের ত্রৈগুণ্য’ প্রবন্ধে ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ থেকে উদ্ধৃত করে ক্ষিতিমোহন দেখিয়েছিলেন, ‘আত্মা’র ‘ছন্দোময়’ হয়ে ওঠাই হল শিল্পের পরম লক্ষ্য। মাঙ্গলিক চিহ্ন এভাবেই হয়তো উত্তীর্ণ হতে পারে আচার-নিরপেক্ষ কোনও নন্দনভুবনে। শুরুর দিকের শান্তিনিকেতন নৈষ্ঠিক তপোবন থেকে এভাবেই রূপান্তরিত হয়েছিল কালিদাসের কাব্যের তপোবনে। রবীন্দ্রনাথের ‘তপোবন’ প্রবন্ধে (১৩১৬) হয়তো এই কথার তাৎপর্য স্পষ্ট হবে।
প্রাচীন ভারতের মাঙ্গলিক নানা চিহ্নের মধ্য দিয়ে যে নান্দনিকতার বা শিল্পচেতনারই একরকম প্রকাশ ঘটে তা বিশ শতকের প্রথম প্রহরে রচিত গিরীশচন্দ্র বেদান্ততীর্থের প্রাচীন শিল্প-পরিচয় বইয়ের নিবন্ধগুলিতে এবং অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-কৃত ওই গ্রন্থের বিস্তারিত ভূমিকার মধ্যে উল্লিখিত হয়েছে। ‘শিল্প’ বা আর্ট যে ভারতবর্ষেরও আদি অর্জন; তা কোনওভাবেই কেবল পাশ্চাত্যাগত একটি ভাবকল্প নয়; এইটিই ওই ভূমিকার মধ্যে নিদর্শনসহ বিশেষ করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শান্তিনিকেতনে এই ভাবনা ররূপায়ণে ক্ষিতিমোহন সেনকে অগ্রণী আশ্রমিক মনে করা যায়। ক্ষিতিমোহনের প্রয়াণের পর একটি স্মৃতিলেখে বিশ্বভারতী পর্বের শান্তিনিকেতনের নান্দনিকতার অন্যতম পুরোধা নন্দলাল বসুও লিখেছিলেন, ‘আজ এইখানকার [শান্তিনিকেতনের] উৎসব অনুষ্ঠানের যে পরিপূর্ণ রূপ দেখতে পাই, তাহার পিছনে ক্ষিতিমোহনবাবুর দান অপরিসীম।’ ১৯০৮ সালে শান্তিনিকেতনের বর্ষামঙ্গলের সূচনার কথা স্বমুখে বলেছেন ক্ষিতিমোহন তাঁর একটি স্মৃতিচারণায়। তিনি লিখছেন: ‘মনে আছে একদিন বর্ষার সন্ধ্যা। কয়েকজন গুরুদেবের চারিদিকে ঘিরিয়া বসিয়া আছি। বর্ষার অজস্রতায় একটি গভীর ভাব সকলের মনকে পাইয়া বসিয়াছে। গুরুদেব বলিলেন— যদি আমরা প্রকৃতির প্রত্যেকটি ঋতুকে অন্তরের মধ্যে উপলব্ধি করিতে পারি তবেই আমাদের চিত্তের সব দৈন্য দূর হয়, অন্তরাত্মা ঐশ্বর্যময় হইয়া উঠে। প্রাচীনকালে আমাদের পিতামহেরা হয়তো এই তত্ত্ব জানিতেন। তাই প্রাচীনকালের আয়োজনের মধ্যে ঋতুতে ঋতুতে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করার যে উৎসব ছিল তাহার একটু অবশেষ এখনও খোঁজ করিলে ধরা পড়ে। আমরাও যদি ঋতুতে ঋতুতে নব নব ভাবে উৎসব করি তবে কেমন হয়?’
সেই সব উৎসবে ক্ষিতিমোহনের কী ভূমিকা ছিল? উৎসবের প্রকরণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেই মূলত ভূমিকা পালন করতেন ক্ষিতিমোহন। প্রাচীন শাস্ত্রের ভিত্তির উপর তিনি নির্দেশ করতেন নতুন নান্দনিক সম্ভাবনার অভিমুখ।


আগেই বলেছি, ক্ষিতিমোহন কাশীতে জীবনের প্রথমভাগের অনেকটা সময় অতিবাহিত করেছিলেন। তাঁর শাস্ত্রশিক্ষাও সম্পন্ন হয়েছিল মূলত কাশীর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। কাশীর আবহ তাঁকে রক্ষণশীল শাস্ত্রী বানায়নি, বরং একজন গ্রহিষ্ণু উদার চিত্তের মানুষ হিসেবে তাঁর জীবনেররসদ জুগিয়েছিল। ক্ষিতিমোহন-কন্যা অমিতা সেন তাঁর পিতৃদেব সম্পর্কে বলতে গিয়ে একজায়গায় লিখেছেন, ‘বাবা তো ধর্মতান্ত্রিকতা মানতেন না, কিন্তু যা আছে সব দেখতে হবে এই ছিল তাঁর মত। কাশীতে বিশ্বনাথের ভোরবেলার আরতি মেয়েদের দেখতে নিয়ে যেতে তাঁর আপত্তি হয়নি।’ বস্তুতই কাশী তাঁকে শিখিয়েছিল জ্ঞানের পথের মুক্ত পথিক হতে। ক্ষিতিমোহন এই পথের প্রব্রজ্যাই জীবনের সাধনমন্ত্র হিসেবে অঙ্গীকার করে নিয়েছিলেন। ভারী শাস্ত্রের রাজপথের সঙ্গে এইজন্যই তিনি সহজে মিলিয়ে নিতে পেরেছিলেন লৌকিক মহল্লার অকুলীন মার্গকেও। বেদ-উপনিষদের পাশাপাশি মধ্যযুগের মরমিয়া ভক্তিমার্গ ও লোকমার্গেও তিনি অনায়াস পদচারণ করেছিলেন। একরকম আত্মদীক্ষিত মন নিয়ে বেদ-উপনিষদের অন্তর্নিহিত ইস্থেটিকসকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়ে শনাক্ত করতে শিখেছিলেন বলেই তাঁর লেখা পড়ে মনে হয় আমাদের। শাস্ত্রজ্ঞানের সঙ্গে এই যে একটি রসগ্রাহী মনের সংশ্লেষণ— এইটিই ক্ষিতিমোহনকে অনন্য করে তুলেছিল। তাঁর সেই অনন্যতার অন্যতম রূপায়ণ ক্ষেত্র ছিল শান্তিনিকেতন।
ক্ষিতিমোহন ঠিক কীভাবে দেশীয় মঙ্গল-উৎসবের মধ্যে নান্দনিকতার সংযোগ ঘটিয়েছিলেন; কীভাবে তা হয়ে উঠেছিল সেই ঔপনিবেশিক সময়ের একরকম সাংস্কৃতিক প্রতিভাষ্য— তা সেইসময়ের আশ্রম-শিক্ষক প্রমদারঞ্জন ঘোষের স্মৃতিআলেখ্যসূত্রে আমাদের কাছে বেশ স্পষ্ট ধরা পড়ে। তাঁর বক্তব্য, এই যে সভা-সমিতিতে বিদেশি কায়দার টেবিল-চেয়ার দিয়ে আসর সাজানোর পরিবর্তে শান্তিনিকেতনে বেদিসজ্জার একটা নিজস্ব রীতি গড়ে উঠেছিল, ‘দেশ এজন্য ক্ষিতিবাবুর নিকট ঋণী।’ উক্তিটির মধ্যে গভীর একটা সাংস্কৃতিক সংকেত লুকিয়ে আছে। ক্ষিতিমোহন কাশীতে দেখেছিলেন, সেখানকার পুরাণকথকদের জন্য সুসজ্জিত ব্যাসবেদি বা ব্যাসাসন রচিত হত। সেখানে অধিষ্ঠিত হলে পুরাণকথকদের মাল্যচন্দনে ভূষিত করে বরণ করে নেওয়া হত। ভারতীয় সমাজেলোকশিক্ষার ক্ষেত্রে এই কথকঠাকুরদের খুবই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। আবহমান ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক কাশীর এই কথকঠাকুরদের জন্য রচিত ব্যাসাসনের সজ্জা-প্রকরণ প্রসঙ্গে প্রমদারঞ্জনকে অনুসরণ করে প্রখ্যাত ক্ষিতিমোহন-গবেষক প্রণতি মুখোপাধ্যায় লিখেছেন:
‘শান্তিনিকেতনে এই রীতির প্রচলন করতেই সভার রূপ একেবারেই বদলে গেল, প্রাচীন যুগের ঐশ্বর্যের আভাস ফুটল তাতে। সাজানো ব্যাসবেদি, সভাপ্রধান যেখানে বসবেন, তার সামনে আলপনা, পাশে ধূপ-দীপ-গন্ধ পুষ্পের অর্ঘ্য, মালাচন্দনে সভাপতি ও অন্যান্য প্রধান ব্যক্তিদের বরণ পুরাণকথক-অর্চনার ধারা অনুসরণ করে।…ক্ষিতিমোহন প্রাচীন শাস্ত্রবিধি অনুসারে আশ্রমের ছেলেদের দিয়ে আলপনা করাতেন।’
বৈদিক যুগে যজ্ঞের বেদি নির্মাণের বিবিধ প্রকরণের মধ্যে যে একটি বিশেষ শৈল্পিক ‘ভাষা’ ছিল, ক্ষিতিমোহন তা উপলব্ধি করেছিলেন। ক্ষিতিমোহন নিজেই একজায়গায় লিখেছেন, ‘পঞ্চগুড়িকায় ও নানা রেখায় আলপনারও নিজস্ব ভাষা একদিন ছিল। দুঃখের বিষয় তা আমরা ভুলে গেছি। বৈদিক যজ্ঞে ইষ্টক সাজাবারও একটা ভাষা ছিল, তার অর্থও আমরা ভুলে গেছি।’ প্রণতি মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, এবিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ক্ষিতিমোহনের আক্ষেপবিধুর আলোচনাও হত। কলাভবন পর্বে শান্তিনিকেতনের আলপনা একটি নিজস্বতা মণ্ডিত শিল্পকলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ‘আনন্দ সর্বকাজে’বইতে ক্ষিতিমোহন-কন্যা অমিতা সেন লিখেছেন, শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসবের (সূচনা ১৯২৮) আলপনা-অঙ্কন করবার আগে শিল্পী নন্দলাল এসেছিলেন ক্ষিতিমোহনের কাছে। অমিতা সেন লিখছেন, ক্ষিতিমোহন নন্দলালকে ‘পুরাকালে হলকর্ষণের উপযোগী উৎসবসজ্জার বিবরণ সহ মাঙ্গলিক শ্লোক পাঠ করে শোনালেন… আর নন্দলাল তা কাগজে লিখে নিলেন। সেই অনুসারে উৎসব অঙ্গন সাজালেন তিনি।’ শুধু এই একবার নয়। ‘শান্তিনিকেতনের নানা উৎসব উপলক্ষে এমনিভাবেই নন্দলাল আসতেন ক্ষিতিমোহনের কাছে, এক একউৎসবে এক এক দ্রব্যে এক এক ভাবে সাজানো পুরাকালের রীতির কথা জেনে নিতেন তিনি।’ প্রাচীন শাস্ত্রকে নতুন শৈল্পিক আয়োজনে এইভাবে জুড়ে নেওয়ার মধ্যেই ছিল শান্তিনিকেতন সংস্কৃতির আধুনিকতা। ক্ষিতিমোহন ছিলেন তার যোগসূত্র।
বিশ্বভারতীর সূচনা পর্বে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও শাস্ত্রের পুনরুদ্ধারে নিয়োজিত হয়েছিলেন বিধুশেখর। বিধুশেখরের অন্বেষণ ক্ষেত্র ছিল বৃহত্তর অর্থে সুপ্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান-ঐশ্বর্যের দৈশিক ও কালিক বিস্তারে। আর পথিক ক্ষিতিমোহন আত্মনিয়োগ করেছিলেন মধ্যযুগের মরমিয়া সাধনার ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের যুক্তবেণীর উৎসমূলে। বিধুশেখর যখন পুথিপৃষ্ঠায় পেরিয়ে যাচ্ছেন তিব্বতভূমির বন্ধুরতার দিকে, তখন ক্ষিতিমোহনের মুসাফির মন পর্যটনে যাচ্ছে হয়তো উত্তর ও পশ্চিম ভারতবর্ষ পেরিয়ে মধ্যএশিয়ার গুলবাগিচা পর্যন্ত!
বস্তুত রবীন্দ্রপ্রয়াণের পরও উদ্ভাবনী প্রজ্ঞায় শান্তিনিকেতনের মাঙ্গলিক তথা নান্দনিক সুরটিকে ধরে রেখে চলেছিলেন ক্ষিতিমোহন। ১৯৪৪ সালে নবআঙ্গিকের ‘শিল্পোৎসব’-এর প্রবর্তনা তেমন একটি উদ্ভাবনী নিদর্শন।
ক্ষিতিমোহন বুঝতে পারছিলেন, গোটা অনুষ্ঠানটিকেই শান্তিনিকেতন ধারার নিজস্ব শৈলীতে রূপান্তরিত করতে হবে। ১৯৪৪ সাল থেকে সেই নতুন শৈলীর শিল্পোৎসবের আত্মপ্রকাশ ঘটল শ্রীনিকেতনে। ক্ষিতিমোহন বেদমন্ত্র নির্বাচন করলেন। বেছে নিলেন প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্ররচনা ও গান। হিন্দু পুরাণের দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা শ্রীনিকেতনের শিল্পোৎসবে হয়ে উঠলেন এই ছন্দোময় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রচয়িতা, বিশ্বশিল্পী। তাঁর প্রণামমন্ত্র উচ্চারিত হল: ‘ওঁ শিল্পানিশংসন্তি দেবশিল্পানি।’ যে-মন্ত্রে বলা হচ্ছে, ‘মানবের শিল্পসাধনা যজ্ঞেরই সমতুল্য। আত্মার সংস্কৃতির জন্যই মানবের এই শিল্পসাধনা। ইহার দ্বারা সাধক আপন আত্মাকে বিশ্বছন্দে ছন্দোময় করিয়া তোলেন।’
বিশ্বভারতীর সূচনা পর্বে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও শাস্ত্রের পুনরুদ্ধারে নিয়োজিত হয়েছিলেন বিধুশেখর। বিধুশেখরের অন্বেষণ ক্ষেত্র ছিল বৃহত্তর অর্থে সুপ্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান-ঐশ্বর্যের দৈশিক ও কালিক বিস্তারে। আর পথিক ক্ষিতিমোহন আত্মনিয়োগ করেছিলেন মধ্যযুগের মরমিয়া সাধনার ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের যুক্তবেণীর উৎসমূলে। বিধুশেখর যখন পুথিপৃষ্ঠায় পেরিয়ে যাচ্ছেন তিব্বতভূমির বন্ধুরতার দিকে, তখন ক্ষিতিমোহনের মুসাফির মন পর্যটনে যাচ্ছে হয়তো উত্তর ও পশ্চিম ভারতবর্ষ পেরিয়ে মধ্যএশিয়ার গুলবাগিচা পর্যন্ত!
‘মাঙ্গলিকতা’ একসময়ে ‘জীর্ণ আচারের মরুবালুরাশি’ হয়ে ওঠে আমাদের ক্লিষ্ট অভ্যাসের পৌনঃপুনিকতায়। এমন জীর্ণতা গ্রাস করতে পারে তথাকথিত ‘নান্দনিকতা’কেও, যদি তা ওই অভ্যাসের অলাতচক্রে নিরন্তর আবর্তিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে অবশ্যনান্দনিকতা একটি নিত্যজায়মান মুক্তিপ্রস্থান। অপরপক্ষে চিহ্নবন্দিত্ব একরকম পৌত্তলিকতা। চিহ্নের পৌত্তলিকতা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন প্রজ্ঞাজারিত উদ্ভাবনার। শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে আশ্রমের ‘ঠাকুরদা’ ক্ষিতিমোহন আরও অনেকের সহযোগে মাঙ্গলিকতাকে মুক্তি দিয়েছিলেন সেই নান্দনিকপ্রবর্তনায়। যার প্রেরণামূলে অবশ্যই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
সহায়ক গ্রন্থ:
অমিতা সেন, আনন্দ সর্বকাজে, কলকাতা, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ১৪২৪ সং
ক্ষিতিমোহন সেন, ভারত পরিক্রমা, কলকাতা, পুনশ্চ, ২০২০ পু.মু.
গিরীশচন্দ্রবেদান্ততীর্থ, প্রাচীন শিল্প-পরিচয়, কলকাতা, সুবর্ণরেখা, ১৩৭৯ সং
প্রণতি মুখোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন ও অর্ধশতাব্দীর শান্তিনিকেতন, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৯
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্যপ্রবেশক দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা, বিশ্বভারতীগ্রন্থনবিভাগ, ১৯৪৯
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী, কলকাতা, বিশ্বভারতীগ্রন্থনবিভাগ, ১৪০৭ সং
প্রমদারঞ্জন ঘোষ, আমার দেখা রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর শান্তিনিকেতন, কলকাতা, লালমাটি, ২০১৫ সং
প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী ষষ্ঠ খণ্ড, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৪১৪ মু.
প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনীসপ্তম খণ্ড, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৪১৪ মু.
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ : আশ্রয় ও আশ্রম, কলকাতা, গাঙচিল, ২০১৫
সুশীলকুমার মণ্ডল, বিশ্বভারতীরউৎসব, শান্তিনিকেতন, পরিবেশক সুবর্ণরেখা, ১৪১৬ মু.
*লেখক বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেনআফিফফুয়াদ সম্পাদিত ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকার ‘ক্ষিতিমোহন সেন’ বিশেষ সংখ্যায় (২০২২)।




