সমুদ্রের খিদে…

Text From a Short Story

যে-দিন জানতে পেরেছিলাম, ইস্কুল বয়সের বন্ধু পুরীর সমুদ্র থেকে বোতলে ভরে এনেছে লোনাজল, এবং বাড়ির বাথরুমের চৌবাচ্চায় জল উপুড় করে ভেবেছে, এই শান্ত জলেও ঢেউ হবে,­­ সে-দিন থেকেই আমার সমুদ্র-ধারণা জেগে উঠেছিল।

অনেক জ্বরের দিনে, অনেক শীতের রাতে ঘুমের মধ্যে— আমি শুনতে পেতাম নীল ঢেউয়ের শব্দ, নৈশ-ট্রেনের আওয়াজ, আমিষ ভাতের হোটেলে ভাত ও লোনা মাছ রান্নার ধ্বনি। সমুদ্র এ-ভাবে আমাকে ডাক পাঠাত দুরুহ সংকেতে। চরম সূর্যাস্তে একা বসে ওই রূপ দেখলে আনন্দিত হবে মন, এ-রকম ভাবতাম।

আরও পড়ুন : ভারতের সামুদ্রিক ইতিহাস নিয়ে আমরা খুব বেশি জানতে পারি না, কারণ বিগত হাজার বছর ভারতে সামুদ্রিক বাণিজ্যের কাজটা আসলে সম্পন্ন করেছেন ভিনদেশি জাতিরা। লিখছেন দেবদত্ত পট্টনায়েক

বিধবা ঠাকুমা তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে গেছিল জগন্নাথ দর্শনে। সমুদ্র স্নানে তার কোলে এসে লেগেছিল, পিছল কাঠের মতো এক বস্তু, জলে ভেজা গবাদি পশুর গর্ভফুল ভেবে ঠাকুমা শিউরে, ডাঙায় উঠে আসেন এবং পরে আক্ষেপের সঙ্গে ভাবেন নিয়ে এলে হত, দারুব্রহ্মের কাঠও তো হতে পারত। এই আক্ষেপ থেকেই নাতির নামকরণে পুরীর সমুদ্র গড়িয়ে দিয়েছিলেন। কোমল বাতাসে সমুদ্রের ঝাউবনের মতো এইসব ফিসফাসে শৈশব থেকেই আমি আলোড়িত হতাম।

আমার জীবনে সমুদ্র অন্যরকম হয়ে এল প্রথম সমুদ্র দর্শনে নয়, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর লেখা ‘সমুদ্র’ গল্পটির সূত্রে। প্রবল গরমের দিনে, একটু বিকেল ঘেঁষা সময়ে, আমি অনেক সময় নিয়ে, আস্তে-আস্তে বাড়ির ছাদে বসে গল্পটি পড়েছিলাম। গল্পটি যত এগোচ্ছিল, আমার এতদিনের সমস্ত সমুদ্র-বোধ ধীরে-ধীরে গলে যাচ্ছিল; ঘেমে উঠছিলাম নিমের ছায়ায়। গল্পটি পড়ার ‘আগের আমি’ ও ‘পরের আমি’ সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলাম।

‘সমুদ্র’ গল্পটি তিনজন চরিত্রকে নিয়ে রচিত, থুড়ি চারজনকে নিয়ে। গল্পের কথক, হেনা, মামা এবং স্বয়ং সমুদ্র নিজে।

সুখী দম্পতি দু’জন সমুদ্রে বেড়াতে এসেছে। প্রাকৃতিক বিরাটের কাছে গেলে একধরনের ক্ষুদ্রতার বোধ খসে পড়ে— এ-কথা আমরা সকলেই জানি। সমুদ্রে এসে, কথক অর্থাৎ হেনার স্বামী— সমুদ্রকে প্রবল ভালোবেসে ফেলে; ফেনার মোহ ও অন্ধকারে মুখ ডুবে যায়। জলের বিরাটত্বকে উপলব্ধি করে। এতটাই বিশাল হয়ে ওঠে সে-উপলব্ধি যে, ভুলে যায় স্ত্রীকে, স্ত্রীর শরীরকেও। সারাক্ষণ সমুদ্রের গর্জন মন দিয়ে, কান পেতে শোনে।

প্রাকৃতিক কোনও বিশালতার কাছে সে সমুদ্র বা পাহাড় যাইহোক, সেখানে গেলে মনের বিষাদ দূর হয়, নিজেকে তুচ্ছ লাগে, বিরাটের ধারণাও পাওয়া যায়, এ-সব শুনে এসেছি, জেনে এসেছি। কিন্তু এই গল্প এ-ধারণা তছনছ করে দেয়। নিজের স্ত্রীকে তুচ্ছ মনে হয়, বিরক্ত লাগে, অতি ধীরে ঘৃণা আসে। কলকাতাতে কখনও এ-রকম মনে হয় না, কিন্তু এখানে এসে বউকে ঘুমন্ত কুকুর ও খরগোশ বলে মনে হয়। অবচেতনের আদিম অন্ধকার বেরিয়ে আসতে থাকে গল্পের পৃষ্ঠার পরতে-পরতে।

গল্প যত এগোতে থাকে সমুদ্রকে আর সমুদ্র বলে মনে হয় না। মনে হয়, বিরাট এক জীব ফেনার দাঁত নিয়ে এগিয়ে আসছে। প্রাগৈতিহাসিক বিরাট এক জীব যেন এই জলরাশি।দিনের বিভিন্ন সময়ে আস্তে-আস্তে জলের রূপ বদলে যায়। দিনের বিভিন্ন আলোতে ও ছায়াতে।কথকের নিজের নারীর থেকেও, নারী শরীরের থেকেও সমুদ্র বিরাট ও বিশাল হয়ে উঠতে থাকে।

গল্পে মামা চরিত্রটিও আশ্চর্যরকম ভাবে এসেছে। হোটেলের খোঁজ এনে দেওয়া, ক্লান্ত ও ধ্বস্ত, চব্বিশ ঘন্টার জন্য সমুদ্র দেখতে এসে, কুড়ি বছর ধরে রয়ে যাওয়া, না ঘুমিয়ে সমুদ্র দেখা রহস্যময় একজন মানুষ। এই মানুষটির গল্পে যে মোচড় আসে তা অভাবনীয়।

গল্পটিতে গল্পকার মাত্র কয়েকটি লাইনে রামায়ণের প্রসঙ্গ এনেছিলেন। রামায়ণকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে দেখা হয়েছে, বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে এই গল্পে দেখা হয় আশ্চর্য এক কুহকে। সীতা উদ্ধারের পরেও রাম ও সীতার দাম্পত্য জীবন সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকেনি— সমুদ্রকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্যই, সমুদ্রকে শাসন করতে চাওয়ার ইচ্ছে থেকেই পুড়ে যায় রাম-সীতার সুখী সংসার!

এইটুকু বলেই লেখক দেখিয়েছেন, কীভাবে হেনা ও তার স্বামীর জীবন দু’জন-দু’জনের কাছে অন্যরকম হয়ে উঠতে থাকে সমুদ্র সৈকতে এসে; দাম্পত্য জীবনের জলছবি কেঁপে যায়। লোনা হাওয়ার সমুদ্র কথকের শিরায় ঢুকে পড়তে থাকে, মগজে ছাপ ফেলতে থাকে। মামার ও সমুদ্রের সাহচর্য কথককে অন্যরকম করে দেয়। স্বাভাবিক জীবন অস্বাভাবিকতার দিকে নিয়ে চলে যায়। স্ত্রীর প্রতি ঘৃণা এসে পিঁপড়ের মতো বাসা বাঁধে।

পড়তে-পড়তে হঠাৎ— সমুদ্রকে আমার মনে হতে থাকে কোনও পুরুষ প্রভু; আর মামা যেন অনুগত একান্ত-অনুচর। প্রভুর রূপ বর্ণণা ও স্তুতিতে মোহগ্রস্ত হয়ে থাকে। সমুদ্রকে কেক, ডিমের বড়া, অ্যালসেশিয়ন কুকুর এনে ছুঁড়ে দেয় খেতে।

রামায়ণকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে দেখা হয়েছে, বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে এই গল্পে দেখা হয় আশ্চর্য এক কুহকে। সীতা উদ্ধারের পরেও রাম ও সীতার দাম্পত্য জীবন সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকেনি— সমুদ্রকে খেপিয়ে তোলার জন্যই, সমুদ্রকে শাসন করতে চাওয়ার ইচ্ছে থেকেই পুড়ে যায় রাম-সীতার সুখী সংসার!

পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারা সজীব ও বিরাট জন্তুর মতো সমুদ্র জীবন্ত সব খায়। গল্প শেষে জানা যায়, সেই মামা নিজের স্ত্রীকে অবধি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ওই অগাধ নীল জলে।

না বুঝতে পেরে, অবচেতনে ওই বোধ চারিয়ে যেতে শুরু করে কথকের ভিতরে। একদিন নিজের স্ত্রী হেনাকে ঠেলে ফেলে দিতে যায় জলে। হেনা ধাক্কা মেরে ওঠে ডাঙায়। কথকের সম্বিত ফেরে ফিরতি পথে। মামা বিরক্ত হয়— কেন কথক তার মতোই বউকে জলে বিসর্জন দিতে পারল না। গল্পের এখানটাতে এসে পড়া থামিয়ে কিছুক্ষণ বসেছিলাম।

সমুদ্র একজন পুরুষ, প্রাগৈতিহাসিক জীব বা প্রভু নয় গল্পের সঙ্গে-সঙ্গে, সময়ে-সময়ে সে বদলে যায় নানা রূপে। কথক কলকাতার শান্ত একজন মানুষ। সমুদ্র ও মামার সাপেক্ষে এসে কীভাবে তার রক্তের ভিতর ঘুলিয়ে ওঠে আদিম এক না বলতে পারা বোধ। নিজের অজান্তে সুক্ষ্ম খুনীর মতো সে নিজের স্ত্রীকে সমুদ্রজলে ঠেলে দিতে যায়। যদিও পরে সম্বিত ফিরে আসে কিন্তু তাতে মামা বিরক্ত হয়। মামা চেয়েছিল সমুদ্র আবার নতুন এক নারীমাংস পাক। হনহন করে হেঁটে মামা ডাঙার দিকে উঠে চলে যায়।

গল্প পড়ে নিজের মুখের ছায়া আয়নায় দেখতে ভয় হয়। সহ্যাতীত দম বন্ধ করা এক অনুভূতি ছেয়েছিল দেহমন। এ ঠিক ভয় নয়, প্রকাশহীন এক অনুভব যা সমুদ্র জলের মতোই লোনা।

গল্প পড়ার অনুভব মৃত্যু অবধি মনে থাকবে আমার। ভুলব না, নিমের ছায়ায় বসে সেই অপার্থিব সামুদ্রিক বোধ। ‘সমুদ্র’ পড়ার পর থেকে দুধের সরের মতো ফেনা নিয়ে জেগে থাকা সমুদ্রকে আর সবসময় সৌন্দর্যময় লাগে না। ফেনার আড়ালে দেখে ফেলি তার দাঁত। ওই তো  বালির কাছে অনবরত ঝিনুক প্রসব করে অসীম খিদেতে সমুদ্র গজরাচ্ছে আর ছটফট করছে।