পত্রালাপে জর্জদা

letters of Debabrata Biswas

জর্জ বিশ্বাস, ওরফে দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল বর্ধমান নিবাসী অনন্তরাম চট্টোপাধ্যায়ের, যিনি রবীন্দ্রসংগীতের আর-এক কিংবদন্তী শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। প্রসঙ্গত, তিনি ছিলেন আমার বাবা অঞ্জনকুমার মৈত্রর বন্ধু। সে-সূত্রেই আমাদের পরিবারের সঙ্গে আলাপ। অনন্তকাকু পেশায় ছিলেন রেডিওলজিস্ট, তা সত্ত্বেও আনাগোনা ছিল শিল্প-সংস্কৃতি মহলে। খুব ভাল ছবি তুলতেন, গান-বাজনার প্রতি ছিল অসম্ভব আকর্ষণ! বেনারসে থাকাকালীন পাঁচ বছর পণ্ডিত রবিশঙ্করের কাছে সেতার শিখেছিলেন। খুব ভাল ঠুমরিও গাইতেন। ওরকম গুণী মানুষ খুব কমই দেখা যায়।

১৯৫৩ সালের শেষদিকে অনন্তকাকু এবং ওঁর দুই বোন চিঠি লেখেন দেবব্রত বিশ্বাসকে; উদ্দেশ্য, ওঁর সঙ্গে দেখা করা। উনিও সময় দিলেন, চিঠির উত্তরে বললেন, ‘বেশ, তোমরা তিন ভাইবোন অমুকদিনে এসো মেট্রো সিনেমার সামনে, আমি অপেক্ষায় থাকব।’ বাবার বন্ধু আর তাঁর বোনরা তো হাতে চাঁদ পেলেন! নির্ধারিত দিনে তাঁরা গেলেন কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসকে কোথাও দেখতে পেলেন না। শুধু চোখে পড়ল ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একজন লোক কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন, মুখে পান। ওঁরা নিরাশ হলেন, কোথাও দেবব্রত বিশ্বাসকে দেখতে পেলেন না। মনে করলেন উনি বোধহয় আসেননি। যখন মনখারাপ করে ফিরে আসছেন, শুনতে পেলেন উদাত্ত কণ্ঠে হাসি। ধুতি পরিহিত, কাঁধে ঝোলা এক ভদ্রলোক ওপার বাংলার ভাষায় বলে উঠলেন, ‘আমি জর্জ বিশ্বাস, তোমরা মনে করেছিলে হয়তো একজন সুদর্শন চেহারার মানুষকে দেখবে।’ তারপর বললেন, ‘কোথায় বসে কথা বলা যায়, এখন তাই বলো।’ তিন ভাইবোন একসঙ্গে বলে উঠল, যদি আমাদের বাড়িতে একটু পায়ের ধুলো দেন!

আরও পড়ুন: এলআইসি অফিসে জর্জ নামটির চল ছিল না, দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে নিয়ে গিয়ে বাবা আলাপ করিয়েছিলেন এক আশ্চর্য কথা বলে! লিখছেন মৃদুল দাশগুপ্ত…

বাড়িতে গেলেন জর্জ বিশ্বাস, বাড়ির গান-বাজনার পরিবেশ দেখে আর সবার সঙ্গে আলাপ করে ভীষণ খুশি হলেন, কথা দিলেন আবার আসবেন কিন্তু একটা শর্তও আরোপ করলেন। বললেন, আসব, কিন্তু চা আর তার সঙ্গে পান প্রস্তুত রেখো। সেই শুরু, তারপর থেকে জর্জ বিশ্বাস এই চট্টোপাধ্যায় পরিবারেরই একজন হয়ে উঠলেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে, বাবার বন্ধু অনন্তকাকুর দুই বোনের ডাকনাম ছিল পলি এবং মলি। তাঁদের সঙ্গেই পত্রালাপ চলত জর্জ বিশ্বাসের। পত্রালাপের পাশাপাশি দুই বোন গান শেখা শুরু করেছিলেন ওঁর কাছে। সে-সময়ে চট্টোপাধ্যায় পরিবার থাকত উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার অঞ্চলে। বাড়িতে দেবব্রত বিশ্বাসের আগমন মানেই গান, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া। এমন অনাবিল আনন্দ বোধহয় আজকের ডিজিটাল যুগে আর পাওয়া যাবে না! অনেক পরে এই চট্টোপাধ্যায় পরিবার বর্ধমানে বসবাস শুরু করে, কিন্তু স্থান পরিবর্তনের জন্য জর্জ বিশ্বাস বিচ্ছিন্ন হয়ে যাননি এই পরিবার থেকে। গান গাইতে যখন দেশের বাইরেও গেছেন তখনও এঁদের তিন ভাইবোনের সঙ্গে পত্রালাপ জারি রেখেছিলেন।

দেবব্রত বিশ্বাস যখন শহর বা রাজ্যের বাইরে থাকতেন, তখন কোনও কারণে ব্যস্ত থাকলে নিজের জায়গায় ফিরে এসে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব তিন ভাইবোনের চিঠির উত্তর দিতেন। প্রতিটি চিঠিতেই থাকত সেখানকার খবর এবং আন্তরিকতার স্পর্শ। পলি ও মলিকে লেখা একটি চিঠিতে তাঁদের প্রিয় জর্জদা লিখেছেন, পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকায় তিনি তাঁর এই দুই প্ৰিয় ছাত্রীকে চিঠির উত্তর দিতে পারেননি বলে লজ্জিত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামে গান গাইবার এবং সেখানকার মুসলমান শ্রোতাদের কাছে অভুতপূর্ব ভালবাসা এবং সম্মান পাওয়ার বিষয়টিও তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন। মাদ্রাজ থেকে একটি চিঠি তিনি লিখেছিলেন কৌতুক করে। তাতে পলি-মলিকে জর্জদা লিখেছেন, ‘আমার সব খবরই যখন তোরা ঠিক মত পাচ্ছিস তখন আর চিঠি লিখার কোন দরকারই নেই? আর এক জায়গায় লিখেছেন, ‘তোরা মঞ্জুশ্রীর চিঠি পেয়েছিস জেনে আমার আনন্দ হচ্ছে, সে আর কলকাতায় ফিরবে না জেনে আমারও আর ইচ্ছে নেই ফেরার।’ (মঞ্জুশ্রী চাকি সরকার) অন্য একটি চিঠিতে লিখেছেন আপাতত তিনি কলকাতাতেই আছেন কিন্তু শনিবার রাতের পরে তিনি বাইরে চলে যাবেন কিন্তু কোথায় যাবেন সেটা এখন বলতে চাইছেন না, তবে তাঁর এই দুই আপনজন যদি চিঠি লেখে তাহলে যেন এই ঠিকানায় লেখে, চিঠির মাঝে দক্ষিণ ভারতের ব্যাঙ্গালোর শহরের একটি ঠিকানা দিয়েছেন। এহেন চিঠি থেকে মানুষ দেবব্রত বিশ্বাসকে চিনতে বা বুঝতে সুবিধে হবে তাঁর অনুরাগীদের। পত্র সাহিত্য, পত্রালাপ, নববর্ষের বা বিজয়ার চিঠি আজ ইতিহাস! ডিজিটাল যুগে এখন সব ডিজিটাল আদান-প্রদান। তবু এই ধরনের সব পুরনো চিঠি অতীতের উষ্ণতা বহন করে আর সেইসব পত্রের লেখক যদি দেবব্রত বিশ্বাসের মতো মানুষ হন তাহলে শুধু চিঠির প্রাপক কেন আমরাও সমৃদ্ধ হই।

অনন্তকাকু যখনই বর্ধমান থেকে কলকাতায় আসতেন তখন দক্ষিণ কলকাতার মনোহরপুকুর রোডে আমাদের বাড়িতে উঠতেন, আমাদের বাড়ির খুব কাছেই রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ত্রিকোণ পার্ক সংলগ্ন দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে যেতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। মনে আছে দেবব্রত বিশ্বাস তাঁকে ‘ভুলু’ বলে ডাকতেন। ওটি ছিল অনন্তকাকুর ডাকনাম। তিন ভাইবোনকে লেখা জর্জ বিশ্বাসের এই অমূল্য চিঠিগুলি কয়েক বছর আগে আমার হাতে আসে অনন্তকাকুর কন্যা অনিন্দিতা করের সৌজন্যে, যিনি আমাদের কাছে শৈশব থেকে ‘মানাদি’ বলেই পরিচিত।

পত্র ১

পত্র ২

পত্র ৩

পত্র ৪