আচার্য পান্নালাল ঘোষ ছিলেন ব্রিটিশ শাসনাধীন, অবিভক্ত ভারতের বরিশালের মানুষ। কীর্তনখোলা নদীর পাশে ওঁর শৈশব কেটেছে। শোনা যায়, ওই নদীতে একদিন, একটি বাঁশি ভেসে যাচ্ছিল। সেই বাঁশিটি তিনি কুড়িয়ে নেন। বাঁশিটি যখন বাজাতে চেষ্টা করছেন, সেই সময়ে এক সাধুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সেই সন্ন্যাসী ওঁকে বলেন, তুমি এটা কুড়িয়ে পেয়েছ, এটাই তোমার যন্ত্র। একথা পান্নালাল ঘোষ নিজেও বলেছেন।
একদম প্রথমে ওঁর সংগীতশিক্ষা কীভাবে হয়েছিল, আমার ঠিক জানা নেই। কিন্তু সংগীতের আগ্রহ ওঁর সবিশেষভাবে ছিল। ব্রিটিশ আমলে তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, এবং ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে তৎপরতার অভিযোগে ওঁকে পালিয়ে যেতে হয়। পালিয়ে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতায় আসার পর একটি ব্যায়ামাগারে পান্নালাল ঘোষ মুষ্টিযুদ্ধ শেখাতেন। একইসঙ্গে তিনি সংগীতশিক্ষালাভের দিকে ঝোঁকেন। সেযুগের এক মস্ত শিল্পী এবং গুরু খুশি মহম্মদের কাছে তিনি তালিম নেন। খুশি মহম্মদ বাজাতেন হারমোনিয়াম। এখানে প্রশ্ন ওঠে, পান্নালাল ঘোষ কি প্রথমে হারমোনিয়াম বাজাতেন? এর উত্তর জানা নেই। সেই সময় কলকাতার খিদিরপুর অঞ্চলে একটি বাঁশঝাড় ছিল। পান্নালাল সেখান থেকে বাঁশ কেটে এনে বাঁশি বানানো শুরু করেন। অর্থাৎ, এই সময় পান্নালাল কেবলই সংগীতশিক্ষা করেননি, তিনি যন্ত্র উদ্ভাবন করতেন, এবং সেই যন্ত্র বাঁশি। এই জন্যই তিনি বিরল প্রতিভা।
পান্নালাল ঘোষের তৈরি বাঁশিগুলি জরুরি। কেন? ভারতীয় বাঁশির কিছু সমস্যা ছিল। বিশেষ বিশেষ কিছু ছিদ্র না থাকার দরুন বাঁশি বাজাতে অসুবিধে হত বাঁশুরিয়ার। পান্নালাল ঘোষ সেই সমস্যাটাকে কিছুটা অতিক্রম করেন। বাঁশির গঠনকে আরও উন্নত করে তোলেন। ওঁর তৈরি বাঁশি ক্রোমাটিক স্কেলটাকে আরও ভালভাবে ধরতে পারত। ক্রোমাটিক স্কেল মানে, যেখানে শুদ্ধ, কোমল ইত্যাদি স্বরগুলি। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে বাঁশি এখনও পাল্টে পাল্টে বাজাতে হয়। অন্যদিকে, পাশ্চাত্যের বাঁশি অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত।
পান্নালাল ঘোষ অনেকের কাছেই সংগীতশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, আকাশবাণী কলকাতা থেকে যখন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি হয়েছিল, তখন সেই অনুষ্ঠানের শিল্পীতালিকায় পান্নালালের প্রথম গুরু খুশি মহম্মদের নাম পাওয়া যায়। যাই হোক, পান্নালাল সাফল্যের সঙ্গে ইংরেজ পুলিশের চোখে ধুলো দিতে পারলেন। পুলিশ আর ওঁকে গ্রেপ্তার করল না। ইতোমধ্যে, বাঁশির পাশাপাশি পান্নালাল ঘোষ, ছ’তারের তানপুরা, যার নাম তানপুরী, সুরপেটি ইত্যাদি যন্ত্র বানিয়েছিলেন। সুরপেটি একটি বেলোযুক্ত যন্ত্র, যেখানে শার্প নোটগুলো একটু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখন এর চল কমলেও, যন্ত্রটি এখনও বাজানো হয়।

এরপর পান্নালালের মুম্বই যাত্রা। সেখানে বাবা আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তাঁর কাছে হত্যে দিয়ে পড়েন পান্নালাল। বাবা আলাউদ্দীন তাঁকে শিষ্যের মর্যাদা দেন। পান্নালাল ঘোষ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাবা আলাউদ্দীন খাঁ বলেছিলেন তাঁকে, চেনা রাগগুলি থেকে যদি একটি করে স্বর বাদ দেওয়া হয়, বা স্বর যোগ দেওয়া হয়, কেমন হতে পারে তা? এইভাবে পান্নালাল ঘোষের রাগসৃষ্টি শুরু হয়। নুপূরধ্বনি রাগ সৃষ্টি করেন তিনি। নুপূরধ্বনি হল সা, শুদ্ধ রে, কোমল গা, পা, কোমল নি, সা। এটি আরোহণ। অবরোহণ হচ্ছে, সা, কোমল নি, গা, কোমল পা, শুদ্ধ নি, সা। অর্থাৎ, হংসধ্বনি রাগের অবয়বে একটু বদল আনলেন তিনি কোমল স্বরের সাহায্যে। কুমারী বলে একটি রাগও তিনি সৃষ্টি করেন, শ্রী রাগ থেকে। ভীমপলশ্রী রাগকে একটু পাল্টে দিয়ে তৈরি করেন শুক্লাপলাশ। দীপাবলি রাগ নামে একটি অপূর্ব রাগ সৃষ্টি করেন। বাবা আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবের উদ্দীপনাতেই এই রাগগুলি সৃষ্টি করেন পান্নালাল।

কেসকর সাহেব দিল্লিতে নিয়ে যান পান্নালালকে। সেখানে আকাশবাণীতে তিনি চাকরি পান। বি.ভি. কেসকরকে আমাদের মনে রাখা উচিত। খুব কম লোকই মনে রাখেন। এখানকার অনেক শিল্পীই পান্নালাল ঘোষ ও পান্নালালের সৃষ্ট রাগগুলি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না।
বাঁশি বাজিয়ে হিসেবে নাম ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। ভারত সরকার তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে থাকেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল ঘরকুনো। তিনি চেয়েছিলেন এই কলকাতায় ফিরে আসতে। আমরা এতই হতভাগ্য, তাঁর বিরুদ্ধে নানা কূট রাজনীতি শুরু হল। তিনি, এত বড় শিল্পী হয়েও পাত্তা পেলেন না। একথা কেবলই মিথ বা স্মৃতি নয়, বাস্তব সত্য, যে পান্নালাল ঘোষকে রীতিমতো অনটনে ভুগতে হয়। খবর পেয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় বেতার ও তথ্যমন্ত্রী, এখন প্রয়াত, বি.ভি কেসকর সাহেব খবর পান, প্রায় না খেয়ে রয়েছেন পান্নালাল। তিনি চলে আসেন পান্নালালের সঙ্গে দেখা করতে। পান্নালালের স্ত্রী তাঁকে এককাপ চা খাইয়েছিলেন, পাশের বাড়ির থেকে সরঞ্জাম নিয়ে এসে, এতটাই অভাবে তখন রয়েছেন ওঁরা। প্রসঙ্গত, এই স্ত্রীয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহের কারণে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়েছিল, যাঁর নাম নুপূর, যিনি অতি অল্পবয়সে মারা যান। তাঁর নামেই নুপূরধ্বনি সৃষ্টি।
কেসকর সাহেব দিল্লিতে নিয়ে যান পান্নালালকে। সেখানে আকাশবাণীতে তিনি চাকরি পান। বি.ভি. কেসকরকে আমাদের মনে রাখা উচিত। খুব কম লোকই মনে রাখেন। এখানকার অনেক শিল্পীই পান্নালাল ঘোষ ও পান্নালালের সৃষ্ট রাগগুলি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না। মহারাষ্ট্রে অনেকেই কিন্তু এখনও দীপাবলি রাগ বাজান, দীপাবলির সময় এই রাগ বাজানো হয়। কলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে সম্মান দেয়নি। অথচ, মুম্বইয়ের বিখ্যাত সংগীতকার নৌশাদ আলি সাহেব তাঁকে একটি ভজন ‘পঙ্ঘট মে’ শীর্ষক একটি ভজনের জন্য তাঁকে মুম্বই নিয়ে যান।
একথা আমি সগর্বে জানাতে পারি, সংগীতাচার্য পান্নালাল ঘোষের সৃষ্টি করা রাগের ওপর বাংলা ভাষায় কেউ বন্দিশ সৃষ্টি করেননি, আমি ছাড়া। মহারাষ্ট্রে কিন্তু হয়েছে। বাংলার পাঠ্যপুস্তকে পান্নালাল ঘোষের উল্লেখ নেই। মহারাষ্ট্রের পাঠ্যপুস্তকে কিন্তু তাঁর উল্লেখ রয়েছে।