ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথডটা বলুন তো! পারবেন না? ক্রিকেটভক্ত আপনি নন, পাক্কা আইপিএলের জার্সি গাই!
‘সোনার কেল্লা’ সিনেমায় ক’বার ময়ূর ডেকেছিল? জানো না! তুমি ব্যাটা গুটখাখোর। পর পর আটবার ‘ম’ আর ‘মো’ একসঙ্গে আওড়ান, এবার বলুন এর পর কোন শব্দটা মাথায় আসছে? ‘চিত্তে’ নয়? বাঙালি আপনি নন, আপনি নেপালি! সুডোকু খেলতে-খেলতে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে পারবে? পারবে না? কীসের হিন্দু, যা পাকিস্তানে যা!
এক লাইনে জাজমেন্ট পেয়ে গায়ে লাগল? সে কী! পহেলগাঁও সন্ত্রাসে তো এভাবেই জঙ্গিরা হিন্দু-মুসলিম চিনে নিয়েছিল বলে খবর। ‘কলমা পড়না আতা হ্যায়?’ এই একটি প্রশ্ন দিয়েই নাকি তারা যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল, এবং বুঝে নিয়েছিল সেই মানুষগুলোর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা। ঘটনাচক্রে এক-দু’জন হিন্দু নাকি বেঁচে গিয়েছিলেন কলমা জানার খাতিরে। এবং এই ঘটনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া, বিদ্বেষ, দেশজুড়ে মুসলিম দেখে মব লিঞ্চিং, গণপ্রহার, গোমাংস খাওনের সন্দেহে হত্যা আর পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার অনাবিল আনন্দ আর অজানা নয়।
কিন্তু, এখন যদি বলি, এই ভারতেই আজও এমন এক মুসলিম সম্প্রদায় রয়েছে, যারা এখনও ঠিকমতো কলমা জানে না, যাদের খাদ্যাভ্যাসে গোমাংস থাকলেও গরু উপাস্য, পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ আদায় মানে না বোঝে না ভাবে না ভয় পায় না, যাদের ইসলামিয়ত স্বয়ং তথাকথিত পার্শ্ববর্তী সিদ্ধ মুসলিমরা গ্রহণ করতে তো পারেইনি, এমনকী হজম করতে পারেনি হিন্দুরাও এবং যৎপরনাস্তি গণহত্যার আয়োজন করেছে এই না-মুসলিম-না-হিন্দুদের জন্য— এখনও স্বাভাবিকতা ধরে রাখবেন? সে-অর্থে কোনও গণহত্যাই সম্পূর্ণত সফল হয় না। গণহত্যার সাক্ষী, তার প্রস্তুতির প্রত্যক্ষদর্শী, তার আবির্ভাবের চাপানউতোর পাওয়া জীবন্ত দলিল হয়ে একাধিক মানুষ ঠিক থেকে যায় আড়ালে। কেউ পালটা বিদ্বেষের বীজ বপন করে, কেউ শান্তির পথে হাত বাড়ায়, কেউ ক্ষমাকে বেছে নেয় নিজের শান্তির খাতিরে, আর কেউ-কেউ আছে ‘লাখোঁ মে এক’, যারা কেবল এক-গোড়ালি জলের সুন্দরটুকু নিয়েও নিভৃতে কাঁদে ও সর্বসমক্ষে কাঁদায়। যেমন ওই না-হিন্দু-না-মুসলিমদের ভিড়ে দূরবর্তী একজন সেই তজুরবা নিয়ে গেয়ে ওঠে গজল ‘অব কে হম বিছড়ে, তো শায়েদ কভি খাবোঁ মে মিলে, জিস তরাহ শুখে হুয়ে ফুল কিতাবোঁ মে মিলে’— শ্রোতা প্রেমের বিরহবেদনায় কণ্টকাকীর্ণ হয়, কিন্তু শব্দের ভিতরে, সেই গায়কের শ্বাস ও অ্যাহেসাস উভয়ের সুঅভ্যন্তরে, সুর রোপণের করাল গভীরে ডুবলে দেখা যাবে আদপে তড়পাচ্ছে এক বিশ বছরের কিশোর, যাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে তার এতকালের স্নেহময় সাকিন, পালিয়ে বাঁচতে হচ্ছে তাদের থেকে যাদের সে আপন ভেবেছিল।
‘শায়েদ’ শব্দটির গায়কিতে কান পাতলে আমরা দেখব সুরের ভিব্রাটোয় ধরা দিচ্ছে সাক্ষাৎ প্রলয় অস্থিরতা, সতীকে হারিয়ে শিব ঠিক যেভাবে অস্থির হয়ে ওঠে, ভূমি হারিয়ে গরিব যেভাবে কপাল চাপড়ায়, মাকে হারিয়ে সন্তান যেমন হয়রান হয়ে ওঠে, জীবন থেকে এতকালের চেনা বাড়ি-চেনা মাঠ চলে গেলে যেভাবে শৈশব বিভ্রান্ত হয়ে যায়— ঠিক সেই বিভ্রান্তিরই বিষ ওই না-হিন্দু-না-মুসলিম স্মৃতিবহন করা গায়ক শায়ের-এ সুর দিতে গিয়ে ভূপালি রাগের শুদ্ধ ধৈবতে ইনজেক্ট করে দেন, তাতে কোমল মোচড় দিয়ে। ভূপালি-র প্রেমময় স্মরণানন্দে আছড়ে পড়ে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা— এই ক্লীব বিচ্ছেদ একান্ত শৈশবের। কোথাও উৎখাত, কোথাও উচ্ছেদ, তো কোথাও কাঁটাতারের জখম দিয়ে ঘেরা। এই ঘা এত ভেতরের যে বোঝা যায় না, কেবলই অস্তিত্ব সংকট বলে চেনা যায় মাত্র; আর তা কোষে-কোষে ছড়িয়ে আছে মেও মুসলিম সম্প্রদায়ের। যার অন্যতম অজানা শরিক এক গজল সম্রাট। কিন্তু সেই সম্রাটকে চিনতে গেলে তার অন্তর্হিত ফকিরিতে আরও একটু ডুবব না আমরা?
অদ্ভুত এই মেও মুসলিম (না কি মেও হিন্দু বলব?)। আদ্যন্ত সংসারী, জমিজিরেত চাষবাসে মগ্নমনোহর, মনে বানজারা, সুরে-গানে দিনভর কাটে-কাটে রক্ত পড়ে না। বস্তুত, ইউনান উপত্যকা পেরিয়ে ভারত ভূখণ্ডে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে মুসলিম সম্রাটদের আধিপত্য বিস্তার ঘটছে যখন সেই একাদশ শতকে, রাজস্থানের রাজপুতানা যখন টলোমলো, সেই সময়ে লহু-লহু বিরোধ-বাতাসে গান-প্রেম-শায়েরির শান্তিদর্শনে মজে গিয়ে ধর্ম-অধর্মের বিভেদ ঘেঁটে শুক্তুনি করে মিশে গিয়েছিল এই মেও-রা। রাজস্থানের বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে এবং মূলত মেওয়াট অঞ্চলে সাকিন গড়েছিল, থাকতে চেয়েছিল যুদ্ধবিগ্রহ থেকে অলক্ষে অদূরে, রাজপুত বিক্রমের ভিতর সুফিকে মিলিয়ে শান্তিবাসনা করেছিল কিছু— এটুকুই পাপ। সেই প্রান্ত জুড়ে কখনও হাজির হয়ে গিয়েছিলেন খাজা নিজামুদ্দিন আউলিয়া, নইমুদ্দিন চিস্তি— এক এক সুফি সন্ত কিংবদন্তি। আর ভারত ভূখণ্ডের নরম মাটির পথকে মনে রেখে জন্ম নিয়েছিল আরেক উত্তর-ভারতীয় রাগ সংগীতের ঘরানা— কলাওয়ান্ত্। বরোদা থেকে ইন্দোর, বদলামপুর থেকে ছতরপুর, পাঞ্জাব থেকে নেপাল— উপনিবেশ ভারতের প্রিন্সলি স্টেটের রাজাদের দরবারে-দরবারে গমগম করে বিহ্বল করে ফেরে এই ঘরানার গায়কি। উস্তাদ আজিম খান এবং ইসমাইল খান, ঘরানার অন্যতম দুই জ্যোতিষ্ক। যদিও, কোথাও যেন তা কিঞ্চিৎ দূরতর, সমকালীন উত্তরপ্রদেশের উস্তাদ আবদুল করিম খাঁ বা ইন্দোরের উস্তাদ আমির খাঁ বা আগ্রার উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ-র মতো নাম করে না লোকে, মনে রাখে না, ওয়াহ্-ওয়াহ্ বলে ক্যায়াবাত করে, তবু আড়ালে কোন এক ফিসফাস! কেন? ধর্মের বাঁধাধরা পরিচয়ে ঢুকতে চাই না বলে? তবু, জীবন চলিষ্ণু। শিল্প তো কঠিন সময়েই তার আসল চেকনাই-রোশনাই দেখায়, কলাওয়ান্ত্-ও তার কলাকৃতিতে মনে থাকবে!

তবু হায়, মনে রাখার দ্বন্দ্ব, পরাধীনতার কাছে তব সলিলমাত্র। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক। ভারত ভূখণ্ড তখন অসহযোগ আন্দোলনের শান্ত উত্তাপে ফুটছে, জনগণ এই প্রথম যেন পেয়েছে এমন একজন নেতাকে যাঁকে ঘিরে দেশের ছবি আঁকা যায়, জাতির অভিভাবক ভাবা যায়। বাবার মতো ভাল। সেই নেতৃত্বের উচ্চারণে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে ‘স্বরাজ’-এর ধারণা, ভাবনা। কিন্তু, সেখানে এত ঐক্যবাণী যে, জাতির নিরিখে এতদিন যারা মুলুকভাগের অপেক্ষায় ছিল, সেসব পণ্ড হয়ে যাচ্ছে। কিছু তো একটা করতে হবে! তাই মুসলিম আগ্রাসনের নিস্তরঙ্গ অতীতে নবতরঙ্গ আনার প্রয়াসে শুরু হল আর্য সমাজের ‘শুদ্ধি সংগঠন’। উত্তর ভারত জুড়ে তহসিল ঢুঁড়ে আপাত শান্ত বেখবর প্রান্তরে সূচের মতো ঢুকে মুসলিম ধরে-ধরে প্রথমে মুণ্ডন ও মস্তিষ্কমাঝে টিকি, তারপর গায়ত্রী মন্ত্র পড়িয়ে গঙ্গাস্নান এবং তদ্পরবর্তী বলপূর্বক বরাহমাংস ভক্ষণে বাধ্য করা— এই ছিল প্রক্রিয়া। কিন্তু তারা চমকে গেল মেওয়াট প্রান্তে এসে। এ তো সত্য সেলুকাস! এ কেমন মুসলিম, এদের বৈকালিক গানের আসরে পঙ্ক্তিতে-পঙ্ক্তিতে এক-একদিন মহাভারতের এক-একটা পর্বের আখ্যান বইছে, পদবি মুসলিম কিন্তু নাম হিন্দু গোত্রীয়, এ কী দেখছি! এরা তো উত্তর ভারতীয় হিন্দুদের মতোই পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করে না। আবার, প্রখর গ্রীষ্মদিনে জলের আশায় ব্রাহ্মণ ও খাজা ডেকে একসঙ্গে কুয়ো পুজো করে! এদের রাখলে তো ভারতে ভাইচারা বেড়ে যাবে, তা তো হতে দেওয়া যায় না। তাই, পীড়ন সেই শুরু হলই সংখ্যাগরিষ্ঠের। আর তার বিপ্রতীপে ইসলামিয়ত জাগানোর আয়োজনও বাড়তে থাকল, এমন শান্ত-স্নিগ্ধ অঞ্চলে জন্ম নিল তবলিঘি জামাত, ইটের বদলে পাটকেল উপমা সফল হল কিন্তু মাঝে পুড়ল যে-নরম মাটি, তার খেয়াল কে রাখে!
এমনই অস্থির সময়ে, ১৯২৭-এ, কলাওয়ান্ত্ ঘরানার পীঠ লুনা গ্রামে, আজিম খাঁ-র সাকিনে জন্ম নিল স্থির মেদুর এক বালক। মেহদি নাম রাখা হল তার। ঘরানার সে ষোড়শ উত্তরাধিকার। ছ’বছর বয়স হতে-না-হতেই ওয়ালিদ আর চাচার সংসর্গে শুরু হল রেওয়াজ। রাগ সংগীত মানে শ্বাস ধরে রাখার খেলা, তাই চাই কঠোর ব্যায়াম। সকালে দু’হাজার বৈঠক, পনেরোশো ডন, তিন-চার মাইল দৌড়, তারপর পালোয়ানদের সঙ্গে কুস্তি; পালোয়ানদের প্রতি চাচা ইসমাইলের কড়া নির্দেশ— ততক্ষণ জাপটে ধরে থাকো, যতক্ষণ না ছেলের দমবন্ধ হয়ে আসে। এভাবেই হয়ে ওঠা পোক্ত ছেলে, মেহদি একদিন বরোদার রাজার দরবারে মাত্র আট বছর বয়সে ঠুমরি পরিবেশন করে ফেলল। তারপর দরবারে-দরবারে ডাক। চাচা-বাবার সঙ্গে এক-দেড় বছরের জন্য বেরিয়ে পড়া, এ-রাজ্য ও-রাজ্য, তারপর আবার ফিরে এসে ওই ছোট্ট ঘরে সন্ধেবেলায় সকলে ঘুমিয়ে পড়ে মাত্র ধিমে তালে তানপুরা বাজিয়ে মন্দ্র সপ্তকে সরগম রেওয়াজ, এমন সেই গাঢ় সুর, সাধনও হবে সুর পৌঁছে যাবে কানে, ঘুম পাড়িয়ে দেবে, ঘুম ভাঙাবে না। আর তা চলত ভোরের আগে অবধি। সে-সময়ে রাগ সংগীতের অন্যতম ফনকারা উস্তাদ আমির খাঁ-র কানে অবধি পৌঁছে গিয়েছে এই ছেলের প্রতিভা। তবে শুধু সংগীত নয়, আরও এক সাধ ছেলের মনকে ধেয়ে নিয়ে যায়। গাড়ি, ইঞ্জিন, পেট্রোলের গন্ধ। রাজারাজড়াদের প্রাসাদে পৌঁছে সেই মনোরম ঝুপড়ি নয়, আয়েশ নয়, উত্তম খানাপিনা নয়— তাকে টানে দুর্দান্ত সব গাড়ি। খোলনলচে খুলে দেখতে ইচ্ছে হয়, এলাকায় তার জন্য নিন্দেমন্দও কম হয় না, উস্তাদের ছেলে মেকানিক হবে ছোঃ! উস্তাদও খানিক বিরক্ত, কিন্তু তিনি তখনও জানেন না পুত্রের এই কৌতূহলই খুব শিগগির তাঁদের সংসারের ঘানি টানতে সাহয্য করতে চলেছে।

ততদিনে মেহদি-র বয়সে আঠেরো নেমে এসেছে। উজ্জ্বল চোখে সে দেখছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ, তখনও অবিভক্ত ভারত জুড়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলন, জাতীয়তাবাদের নীল নকশা, করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে, পাশের রাজ্য গুজরাতে শিল্প হরতাল, সুদূর বাংলায় তেভাগা, আর আনাচকানাচে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা; মাঝে অস্তিত্ব সংকট নিয়ে কার জন্য অশ্রুপাত করবে ভেবে-না-পাওয়া মেহদি দেখছে তাদের জন্য একের পর এক রাজদরবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ডাক আসছে না গান গাওয়ার মাসের পর মাস। ১৯৪৬-এর নোয়াখালির দাঙ্গা যেন সমস্ত মাত্রা ছাড়াল। বাংলার গ্রামে-গ্রামে হিন্দুদের ধর্মান্তকরণের আখ্যান ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতো, যার সম্ভবত তীব্রতর আঁচ পড়ল মেও মুসলিমদের কাছেই। আর ততদিনে হিন্দু মহাসভা আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এই আখ্যান পোক্তভাবে বিশ্বাস করিয়ে দিতে পেরেছে, ভারতে মুসলিমদের ঠাঁই দেওয়া যাবে না। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশের প্রান্ত জুড়ে সেই রাজাদের ভূমিকায় ধরে ধরে মুসলিম নিধন শুরু হল, যারা কিনা এক সময়ে এদেরই গান শুনে ক্যায়াবাত বলেছিল, ইনাম দিয়েছিল, খেয়াল রেখেছিল।
১৯৪৮-এ মহাত্মার হত্যা হল যখন, সবার আগে গুজব ছড়াল, এই কাজ কোনও মেও মুসলিমেরই যেহেতু এই সময়কালে পৃথক ‘মেওস্তান’-এর দাবি উঠেছিল কট্টর কিছু মেও নেতৃত্বের মধ্যে, তারা ভগ্নাসন্ন দেশকে আরও বিচ্ছিন্ন করতে চায়। যদিও সকলেই জানত, মহাত্মা আসলে কাদের পথের কাঁটা। সেই গুজবে আরও হাওয়া দিয়ে স্বয়ং বল্লভভাই প্যাটেল রাজাদের নিয়ে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে নির্দেশ দিলেন, নোয়াখালি ও পাঞ্জাবের দাঙ্গার বদলা হিসাবে মেও মুসলিমদের গণহত্যা একটা উচিত শিক্ষা হতে পারে— এই দাবি কোনও গুজব নয়, সটান নথি-সহ ও বয়ান রেখেছেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও ভারতবিদ ইয়ান কোপল্যান্ড। যদিও, এসব সুচারুভাবে ঢাকা দেওয়া এখন। কিন্তু এই গণহত্যার আঁচ সম্ভবত কোনও রাজার সুবাদেই পেয়েছিলেন উস্তাদ আজিম খাঁ, ইসমাইল খাঁ। দেশভাগের ঘোষণা যখন মাউন্টব্যাটেন করে ফেললেন ’৪৭-এর নিদাঘ বসন্তে, তেমনই এক দিন আজিম সাব বাড়ি ফিরে ছেলে মেহদির উদ্দেশে বললেন— অনেক দিন সিংহাসনে কাটল, অব লকড়ি কে উপর রহেনা হোগা মিয়াঁ, মিস্ত্রি বননা হোগা, পর গায়েঙ্গে তো ভিখ মাংনে কে লিয়ে নেহি। ফকির হোঙ্গে, পর উস্তাদ কি নবাবি না ছুটে। ’৭৭ সালের এক সাক্ষাৎকারে যখন গজল সম্রাট মেহদি হাসান এই কথাগুলি উচ্চারণ করছেন, তখন তাঁর গলা বুজে আসছে, চোখ ভারী হয়ে আছে যে, শুনে বুঝতে পারা যায়।
দেশভাগ ঘোষণা হতে-না-হতেই প্রায় শূন্য হাতে কলাওয়ান্ত্ ঘরানা স্বাধীন ভারত ভূখণ্ড ছেড়ে পাড়ি দিল পাকিস্তানের উদ্দেশে, সেই বাস্তুভিটে রাতারাতি ছেড়ে যাওয়ার বেদনা যত না দুঃখ দিয়েছিল বিশ বছরের মেহদিকে, তার চেয়েও হয়রান করেছিল কি তাকে এই ভাবনা, যে, স্বয়ং সংগীত তাকে ছেড়ে চলে গেল না তো? বস্তুত সেরকমই তো হয়েছিল! পাকিস্তানের সাহিওয়াল জেলার চিচাওয়াতনি তহসিলে এক চাচার বাড়িতে ঠাঁই হল কলাওয়ান্ত্দের। আর অদূরে সাইকেল-গাড়ি-ট্রাক্টর সারাইয়ের দোকানে দু’মুঠো পেটপূর্তির লাগি নিজের উৎসাহকে যথাসম্ভব ভাললাগা দিয়ে মানিয়েগুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় মেকানিকের কাজে ঢুকে পড়তে হল মেহদিকে। পাড়ায় তখন তার পরিচয় মিস্ত্রি হাসান। অদ্ভুত প্রতিভা তার। সাইলেন্সারের কাছে নাক রেখে ধোঁয়ার গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারে, সেই গাড়ি কত মাইল চলেছে! সঠিক মানের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যায় সেই আন্দাজ। আর তার চেয়েও বড় প্রতিভা— ট্রাক্টরের ভুটভুট ধোঁয়ার তালকে যেমন খুশি মাত্রায় ভেঙে, কখনও তিন-চার, কখনও চার-চার, কখনও পাঁচ-পাঁচে বেমালুম বানিয়ে ফেলে তান গেয়ে যায়, সঙ্গে পানার টক্কায় সমের আঘাত এসে কখনও তেহাইকে প্রজ্জ্বলিত করে, কখনও খালিকে একা বানিয়ে আবার পালায় গমক হয়ে।
মেহদির এই প্রতিভায় চমকিত হয়ে নিকটস্থ ভাওলপুরের রাজা পাকিস্তানের তৎকালীন ফোর্ড কোম্পানির ম্যানেজারকে নিয়ে এসেছিলেন। ফোর্ডের সেই তরুণ ম্যানেজার মেহদিকে বছরে ৩০০০ পাউন্ড মাইনে, লন্ডনে ফ্রি-তে বাড়ি ও গাড়ির বন্দোবস্ত-সহ চাকরির প্রস্তাব দেওয়া সত্ত্বেও মেহদি স্মিতহাস্যে সেই লোভনীয় প্রস্তাবকে অস্বীকার করে। এই অর্থ, এই বিলাস, এই প্রাচুর্য তো তার লক্ষ্য নয়! সে বুক ভরে গাইতে চায়। কেবলই গাইতে চায়। কিন্তু গায়ককে তার গান শ্রোতা অবধি পৌঁছে দিতে কী লাগে? শুধু বাতাস, খোলা বাতাস। যানবাহনের হাসপাতাল থেকে তা পাকিস্তান রেডিয়ো অবধি পৌঁছতে আরও দশটা বছর লেগে গেলেও, মেহদি হাসান যখন এলেন, সেই আসা— দের আয়ে, দুরস্ত আয়ে ছাড়া আর কী!

বরাদ্দ করা হয়েছিল মাত্র পাঁচ মিনিটের স্লট। একটা গজল। কিন্তু, সেই গজল গাইতে-গাইতে মাহল এমন তৈরি হল, মৌতাত ছড়াল এমন যে, বারো মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তা থামালেন না পাকিস্তান রেডিয়োর তৎকালীন ও প্রথম স্টেশন ডিরেক্টর জুলফিকার আলি বুখারি। আর তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। সমকালের একের পর এক কিংবদন্তি শায়ের ফৈয়জ আহম্মদ ফৈয়জ, পারভিন শাকির, হসরত মোহানি, আহমেদ ফরজ, কাতিল শিফাই, নাসির কাজমি তাঁর জন্য নগমা লিখে দিয়েছেন অকাতরে। পাকিস্তান নবরূপে পরিচিত হয়ে উঠল তাঁর গজলে, গজল পেল বৈচিত্রময় রাগের আশ্রয়, কলাওয়ান্ত্ ঘরানা বেঁচে রইল এভাবে— ভারতের কাছে তিনি হয়ে উঠলেন পরমপ্রিয় পড়শি, গুলজার লিখলেন— ‘সপনোঁ কি সরহদ হোতি নেহি, আঁখো কো ভিসা নেহি লগতা, বন্ধ আঁখো সে রোজ চলা যাতা হুঁ সরহদ পার মেহদি হাসান সে মিলনে…।’ শুধু কি তাই? ১৯৬৫-তে ভারত-পাক দ্বন্দ্ব মিটতে-না-মিটতেই ১৯৭৭-এ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী আয়োজন করে মেহদি হাসানকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত সরকারের তরফে তাঁকে সম্মানিত করা হল কে. এল. সায়গল পুরস্কারে। এখানেই থামল না, একান্ত ব্যক্তিগত আসরে বাজপেয়ীর বাড়িতে গান গাইলেন মেহদি হাসান।
আজকের সময়ে এসব স্বপ্নেও পাপ, অপরাধ ঠাওর হবে। লতা মঙ্গেশকর যেমন মেহদি হাসানের উদ্দেশে বলেছিলেন, তাঁর গলায় ভগবান বাস করেন, তেমন কোনও কথায় হয়তো দেশদ্রোহিতার দায় এসে পড়বে। আর এরকম সময়ে, মেহদি হাসানকে পহেলগাঁওয়ের উপত্যকায় দাঁড় করিয়ে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কলমা জানো? তিনি হয়তো তাঁর সরু গোঁফের সেই স্মিত হাসিতে গেয়ে উঠবেন ‘কভি ম্যায় সোচতা হুঁ, কুছ না কুছ কহুঁ, ফির ইয়ে সোচতা হুঁ, কিঁউ না চুপ রহুঁ’, ঠিক যেমনভাবে তাঁকে যখন ভরা গানের আসরে একদা এক শ্রোতা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী এমন দুঃখ তাঁকে জড়িয়ে আছে যে এত দরদ তাঁর গানে, থম মেরে গিয়েছিলেন, গলা ভারী হয়ে গিয়েছিল, মজা করে বলেছিলেন, মেরা তো বেগম হ্যায়, মেরা কোই গম নেহি। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলেছিলেন, কোথায় দুঃখ, কোনও দুঃখ তো নেই! আপনারা আসলে জানেন না, যে-কোনও সুগভীর অনুভূতিকেই আদপে দুঃখের মতো দেখতে। বিছড়না এক মাসুমিয়ত হ্যায়, শিব কি তরহা। আসলে ভয়। দর্দ সে আপ ডরতে হ্যায়। উসকে লিয়ে মন কো সাফ রখনা পড়তা হ্যায়, উয়ো তো মুসিবত কা কাম হ্যায় না! পহেলে ফকির হোনা পড়তা হ্যায় জনাব, একদম ফকিরি লানা পড়তা হ্যায়। তারপর হাসি, হারমোনিয়ামে হারমোনির মৌতাত তুলে গেয়ে উঠেছিলেন গজল সম্রাট— গুলোঁ মে রং ভরে…
১৩ জুন, মেহদি হাসানের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মনে মনে সেই সুগভীর অনুভূতির কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করি যদি, শৈশব আর শৈশব নাকাল করবে আমাদের? দেশভাগ দেখব? দাঙ্গা দেখব? বিদ্বেষের বিষ? মেহদির মতো সুন্দরটুকু ছেঁকে তাতে রং ভরে ভরে আরও অজস্র মনে-মনে ছড়িয়ে দিতে পারব তো?