বৃক্ষ-মানব সংলাপ

Representative Image

১৪৮৪-’৮৫ সাধারণাব্দে রচিত বিজয়গুপ্ত-র ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে নারদ জানান শিবকে, চণ্ডিকা (শিবের স্ত্রী) ‘সরযূর দক্ষিণ কূলে’ বানিয়েছেন ‘পুষ্পের বাগান’। রাত্রিকাল হলেই দেবী সেই বাগানে ডাকিনী সহযোগে মাতেন খেলায়। গুপ্তকবির ভাষায়: ‘রাত্রি কাল হইলে ডাকিনী হইয়া মিলি।/ সেই পুষ্পবনে দেবী নিত্য করে কেলি।’ শুনে এমন বাণী,  শিবেরও চাখতে ইচ্ছা করে স্থানমাহাত্ম্যের স্বাদ। অতঃপর, বলদে চেপে চণ্ডীকে ফাঁকি দিয়ে পুষ্প প্রদেশে হাজির হন শিব। আর সেই বনে, ভ্রমরের গুঞ্জনে, গন্ধে আর বিচিত্র ফুলের সমাহারে আদিদেব উঠলেন মেতে। সুরম্য উদ্যানে দুই পক্ষীর কাম কৌতুক দেখে পীড়িত হলেন ত্রিলোচন। কবির বয়ানে: ‘কে বুঝে দৈবের গতি, যে  দেব সৃষ্টির পতি,/ হেন শিব পীড়িত মদন।।/ কামে ব্যাকুল শিব, কাতর চঞ্চল জীব,/ রতিরসে করে ঢস মস।’ প্রকৃতি এবং দুই অ-মানুষ (পাখি) সত্তা মহাদেবের মনে কাম-বাসনার জন্ম দিয়েছে। আর এই বাসনার বহিঃপকাশ হিসাবে শিব শ্রীফল বৃক্ষকে বেছে নেন। বিজয় গুপ্তের কথায়: ‘অতি কামে হইয়া ভোল,/ শ্রীফল বৃক্ষে দিল কোল,/ আচম্বিতে খসিল মহারস।।’ বেলগাছ-কে কাম-বাসনায় আলিঙ্গন করলেন শিব, ঘর্ষণ থেকে এল মিলনজাত সুখ এবং অন্তিমে শুক্রক্ষরণ (‘মহারস’)। 

যৌনসুখের দুনিয়ায় অ-মানুষ সত্তার উপস্থিতি নজর কাড়ার মতো। অবশ্য আমাদের সামজিক কাঠামোয় যেখানে পুরুষে পুরুষে, নারীতে নারীতে সম্পর্কই গ্রহণযোগ্য নয়— সেখানে অ-মানুষ ঢের দূরের কথা।

অনেকগুলি জরুরি বয়ান লুকিয়ে আছে বিজয়গুপ্তর বয়ানে। গাছপালার সঙ্গে শুধু যে শিবেরই বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে তা নয়, দেবী চণ্ডীও উদ্ভিদ-জীবনের সঙ্গে বিশেষ সম্পৃক্ত। সর্বোপরি, বেলগাছ-কে একমাত্রিকভাবে নারীর বিকল্প রূপ ভাবা মস্ত ভুল হবে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে বানু সুব্রহ্মণ্যম-এর গ্রন্থ ‘Botany of Empire: Plant Worlds and the Scientific Legacies of Colonialism’। বানু প্রশ্ন তুলেছেন, কেমন করে ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে গভীরভাবে বাঁধা পড়েছে বৃক্ষজীবন। আর এই জাঁতাকলের লৌহদাঁত চিনতে বানু ফিরেছেন, আঠারো শতকের সুইডিশ বিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াসের কাছে। লিনিয়াসের ট্যাক্সোনমি তথা সুশৃঙ্খলিতভাবে শ্রেণিবিন্যাসের বিশেষ পদ্ধতি পাল্টে দিয়েছে গাছপালার ভবিষ্যৎ। গাছপালাকে মানুষের আদলে পুরুষ-নারীর দ্বৈততায় বিভক্ত করলেন লিনিয়াস। এই অ্যানথ্রোপোমরফিক কল্পনায় ফুলের পুংকেশর (stamens) চিহ্নিত হল পুরুষ এবং স্বামী হিসেবে, আর গর্ভকেশর (pistils) হয়ে উঠল নারী তথা ঘরের বউ। নিষেক (fertilization)-কর্মটিকে মিলিয়ে দেওয়া হল বিয়ের পরের ফুলশয্যার সঙ্গে। 

আরও পড়ুন : বাঘে-মানুষে সংঘাতে দোষী আসলে কারা? লিখছেন তিষ্য দাশগুপ্ত…

কিন্তু গাছপালার যৌনজীবন তো এই মানুষী জীবনের অনুরূপ নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উদ্ভিদ-জীবন পুরুষ-নারীর দ্বৈততায় বিভক্ত নয়। গাছপালা সাধারণত উভলিঙ্গ (hermaphroditic) বা একলিঙ্গ (monoecious) হয়। বেশিরভাগ উদ্ভিদের ফুলে পুংকেশর এবং গর্ভকেশর দুই থাকে। 

যে বেলগাছে আলিঙ্গন সুখ পেয়েছিলেন শিব, সেই বেলের ফুল কোনওভাবেই একমাত্রিক নারীরূপ নয়। বেলগাছের ফুল উভলিঙ্গ। পুংকেশর এবং গর্ভকেশর দুইয়ের অবস্থান সেখানে। শিব নারীর অভাবে তাঁর কামবাসনার জন্য যখন বেলগাছকে বেছে নন, তখন সেই সম্পর্ককে মানুষী যৌনকল্পনায় রূপান্তর একেবারেই অবান্তর ভাবনা। অন্যদিকে দেবী চণ্ডীর সঙ্গে গাছপালার সক্রিয় সম্পর্কটিও বাতিল হবে নতুন ঔপনিবেশিক শিক্ষায়। কর্নেল রবার্ট কিড ১৭৮৬, মার্চ মাসে কলকাতায় গড়ে তুললেন বোটানিক্যাল গার্ডেন। ১৭৯৩ সালে উইলিয়াম রক্সবার্গ যোগ দিলেন এই বাগানের তত্ত্বাবধানে। একটু পরেই উইলিয়াম কেরি মাঠে নামবেন গাছেদের জীবন বুঝতে। বলতে চাইছি, ঔপনিবেশিক ক্ষমতার নতুন করে উদ্ভিদ-জীবনকে বোঝার প্রক্রিয়া ভীষণরকম পিতৃতান্ত্রিক। নারীর উপস্থিতি সেখানে শূন্য বলা চলে।

শিব ও সতী, বৃক্ষতলে

তবে একধরনের বাগান সংস্কৃতির সঙ্গে নারীদের সম্পর্ক গড়ে উঠল বিনোদন এবং নতুন গার্হস্থ্য প্রয়োজনের ভিত্তিতে। যদিও চণ্ডীর ‘পুষ্পের বাগান’-এর সঙ্গে উনিশ শতকের মহিলাদের বাগান-ভাবনার আসমান-জমিন ফারাক। পৃথকত্বের অনেক অক্ষ রয়েছে, কিন্তু আপাতত চিনতে চাইলে একটি, উনিশ শতকে মহিলাদের বাগান-ভাবনার সঙ্গে বিনোদন, প্রয়োজন এবং সুরক্ষার গভীর সম্পর্ক। অন্যদিকে চণ্ডীর সখীদের সঙ্গে বাগানে বিলাস, এই সুরক্ষা নামক কবজার বিরুদ্ধে আত্মসুখের যাত্রা। 

শিবের বেলগাছের সঙ্গে শৃঙ্গার এবং শুক্রপতনের গল্পটা আরও খানিক এগিয়ে নেওয়া যাক। শুক্রের পতনেই ক্ষান্ত হলেন না শিব। ক্ষরিত শুক্রকে বাম হাতে ধরে ভাবলেন, সঙ্গে নেই চণ্ডী, তাহলে এই ‘অগ্নি’ কে ধারণ করবে? গুপ্ত  কবির  বয়ান: ‘খসিল অক্ষয় ধন, চমকিত  ত্রিলোচন,/ বাম হস্তে ধরিল সন্ধানে।/ চন্দ্র হাতে মনে করি, সঙ্গে না আনিলাম গৌরী,/ এ অগ্নি ধরিবে কোন জনে।।’ খেয়াল করা দরকার, বিজয়গুপ্তের বয়ানে আলাদা করে শুক্র বা বীর্য শব্দের ব্যবহার হয়নি, বরং বদলে ‘মহারস’, ‘চন্দ্র’ বা ‘অগ্নি’-র উপস্থিতি রয়েছে।

বেশ কয়েকটি জরুরি পর্যবেক্ষণ রয়েছে এখানে। প্রথমত, ক্ষরিত শুক্রের সঙ্গে মানুষের শারীরিক উপস্থিতির সম্পর্ক কেমন? কথাটা আরও একটু খোলসা করে বললে, ক্ষরিত শুক্রের সঙ্গে মানুষের গোপনতম আচার-আচরণ কেমন? দূর থেকে দেখলে এই ঘটনা ঘৃণ্য মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে এই আচরণের অভিব্যক্তিই শুক্রের সঙ্গে ব্যক্তি আমির সম্পর্কের সমীকরণ নির্ধারণ করে। বলে রাখা ভাল, শিবকে ব্যক্তি বা মানুষ সম্বোধনের মাধ্যমে তার দেবত্বকে অস্বীকার করা হচ্ছে না, শুধুমাত্র দেবতা এবং মানুষের শারীরিক একত্বের চিহ্নকে চিনতে চাওয়া হয়েছে।

একধরনের বাগান সংস্কৃতির সঙ্গে নারীদের সম্পর্ক গড়ে উঠল বিনোদন এবং নতুন গার্হস্থ্য প্রয়োজনের ভিত্তিতে। যদিও চণ্ডীর ‘পুষ্পের বাগান’-এর সঙ্গে উনিশ শতকের মহিলাদের বাগান-ভাবনার আসমান-জমিন ফারাক। পৃথকত্বের অনেক অক্ষ রয়েছে, কিন্তু আপাতত চিনতে চাইলে একটি, উনিশ শতকে মহিলাদের বাগান-ভাবনার সঙ্গে বিনোদন, প্রয়োজন এবং সুরক্ষার গভীর সম্পর্ক। অন্যদিকে চণ্ডীর সখীদের সঙ্গে বাগানে বিলাস, এই সুরক্ষা নামক কবজার বিরুদ্ধে আত্মসুখের যাত্রা। 

দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিও খেয়াল করার মতো, শিব এমন এক যৌন অন্বেষণে যাত্রা করেছিলেন, যার ফলাফল পূর্ব-নির্দিষ্ট। শিব জানতেন, এই যৌন অভিযানে শুক্রের গন্তব্যের কোনও আধার থাকবে না। তবু মহারস পতন মুহূর্তে ধারণ করার  জন্য গৌরীকে মনে পড়া বুঝিয়ে দেয়,  ব্রাহ্মণ্যবাদী কামজীবনের নির্দিষ্ট চাহিদা। যেখানে কামের অনিবার্য পরিণতি সন্তান উৎপাদন। একদিকে যৌন ফ্যান্টাসির অসীম আহ্বান অন্যদিকে সীমা মেনে চলা তাগিদ, এই উভয় জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে শিবের কামবাসনা। তবু এক্ষেত্রে  বেলগাছ সেই প্রতীক হয়ে থাকে, যা ফ্যান্টাসির দুনিয়াকে যেমন প্রসারিত করে, তেমনই ব্রাহ্মণ্যবাদীর নির্দিষ্ট চাহিদার কাছে মোক্ষম বাধা।  

ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবনায় আশ্রয়হীন শুক্র বড় শত্তুর। না থাকলে বীর্যের স্থায়ী নির্দিষ্ট গন্তব্য, পতন হবে সামাজিক শৃঙ্খল। অগত্যা চাই এমন আধার, যার  সোহাগে  প্রাণবন্ত হয়ে তৈরি হবে নতুন দেহ। কিন্তু সব সময় শুক্রের শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে না ক্ষমতা-কাঠামো। ‘শৃঙ্গাররসাষ্টক’, ‘শৃঙ্গারতিলক’ এবং ‘পুষ্পবাণ-বিলাস’ চতুর্থ-পঞ্চম শতকের কবি  কালিদাসের নামে পরিচিতি পেলেও পণ্ডিতরা এই বিশ্বাসে মেরেছেন কোপ। ‘শৃঙ্গারতিলক’ কাব্যেই মেলে দুই সখীর  আলাপন: জানতে চায় একজন অন্যজনের থেকে, কেন কপোলতলে কস্তুরীরচিত পত্ররচনা ঠিক তেমনই আছে, স্তনতটের থেকে মুছে যায়নি চন্দন, অধরের তাম্বুলরাগও স্খলিত হয়নি। ব্যাপার কী? তুমি নিজে কুপিতা হয়েছিলে, না তোমার পতি বালক? এমন সরেস জিজ্ঞাসার দিলখোলা উত্তর দেয় স্বামী-সোহাগ-বঞ্চিতা কন্যা। জানায় সে: না, রতিগৃহে গিয়ে কুপিতা হয়নি, স্বামীও বালক নয়। কিন্তু নবযৌবনা, সচকিতা এবং কন্দর্পগর্বহারিণী তাকে দেখামাত্র (প্রবাসপ্রত্যাগত) স্বামীর শুক্রপাত [‘মুক্তোদৈত্য-গুরুঃ প্রিয়েণ সহসানঙ্গপ্রসঙ্গঃ কুতঃ’] হল। অতএব রতিক্রিয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠেনা। এই শুক্রপাত পুরুষটির ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে ততখানি সম্পৃক্ত নয়, যতটা পরিস্থিতি-ঘটিত যৌন কামনার  সঙ্গে সংযুক্ত। শুক্রের বিষয়ীসত্তা কেমন হতে পারে, তার বড় সাক্ষ্য এই সন্দর্ভ। শুক্র নিজে কী চায়, এই প্রশ্নটি বিশেষ হয়ে ওঠে প্রবাস-প্রত্যাগত পুরুষটির আখ্যানে। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র যতই শুক্র ধারণের জন্য আধারের বিধান দিক, শুক্র নিজেই  সেই বিধান ভেঙে নিজের অস্তিত্ব জানান দেবে।  

শুক্র, মানুষের শরীর এবং বৃক্ষজীবনের এই আন্তঃসম্পর্ক নানাভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে ভারতের প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক অতীতে। কালিদাস-এর ‘বিক্রমোর্বশীয়ম্‌’ নাটকে মিলবে, ঊর্বশীর বিরহে কেমন করে লতাপাতার সঙ্গে এক ধরনের শৃঙ্গার বাসনা জন্ম হচ্ছে পুরুরবার মনে। পুরুরবা-র লতাপাতার প্রতি কামনাকে শুধুমাত্র ঊর্বশীর বিকল্প ভাবলে ভুল হবে। রয়েছে এখানে বৃক্ষ, শুক্র এবং মানব-শরীরের ভিন্ন ভিন্ন নিজস্ব ঝোঁক।