ঈশ্বরের সেতার

Vilayat Khan

ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ সাহেব এমন একজন শিল্পী, যাঁকে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত ঘরানার— ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের একজন হিসেবে শ্রদ্ধা করি। আমাদের ছোটবেলা থেকে যেসব সংগীতশিল্পীদের শুনে আমরা বড় হয়েছি, যাঁরা ওই সময় থেকেই কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছেন, যাঁরা আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন, গানবাজনা তার উৎকর্ষের কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, তা বুঝিয়েছেন— তাঁদের মধ্যে অন্যতম ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ সাহেব।

সেতার বাদ্যযন্ত্রটিকে যে জায়গায় উনি নিয়ে গিয়েছেন, ওঁকে নিয়ে কিছু বলার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই, তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি, কারণ ওঁর যেটুকু সংস্পর্শে আমি এসেছি, যেটুকু স্নেহ, ভালবাসা, আশীর্বাদ ওঁর থেকে পেয়েছি, তা আজীবন আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। ওঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ওস্তাদ সুজাত খাঁ সাহেব আমার বন্ধু, আমরা অনেকবার স্টেজ শেয়ার করে অনুষ্ঠানও করেছি।

আরও পড়ুন: কেন পান্নালাল ঘোষ নির্মিত বাঁশি পাশ্চাত্যর থেকে আলাদা? লিখছেন কবীর সুমন…

ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেব, ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ সাহেব, বিলায়েৎ খাঁ সাহেব, পণ্ডিত রবিশঙ্কর— এঁদের সংস্পর্শে আসতে পেরেছি, এটা আমার জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি। মনে পড়ে, উনি একটি তথ্যচিত্রর সংগীতায়োজন করেছিলেন, সেখানে আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে ডেকেছিলেন। বেশ ক’দিন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ওঁর থেকে শেখার, বিশেষত সংগীতের আবেদন বিষয়ে অনেক সমৃদ্ধ হয়েছি ওঁর থেকে। সেটা নয়ের দশকের প্রথমদিক। উনি আমাকে বিশেষভাবে ডেকেছিলেন এবং সেখানে অ্যারেঞ্জার ছিলেন আর-একজন কিংবদন্তি শিল্পী, অলোকনাথ দে। অলোকদা আমাকে একদিন হঠাৎ ফোন করে বললেন, বিলায়েৎ খাঁ সাহেব তোমার কথা বলেছেন। আমার থেকে নানাকিছু শুনতেও চেয়েছিলেন খাঁ সাহেব, মনে পড়ে।

ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ

এর আগে-পরেও ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, উনি আমার বাজনা শুনেছেন। ওঁর কম্পোজিশনে বাজনাও বাজিয়েছিলাম আমি, সেটা রয়ে গেছে। সেই ক’দিনের অভিজ্ঞতা আমার কাছে চিরস্মরণীয়। আর ওঁর যে বলার বা বিশ্লেষণ করার ধরন, তার মধ্যে নিটোল গল্প বলার যে আমেজ, তার আশ্চর্য এক জাদু ছিল! সেটাই ওঁর বাজনার মধ্যে প্রতিফলিত হত, সেটা যাঁরা শুনেছেন, সত্যিই ভোলা যায় না। একইসঙ্গে কী তাঁর দর্শন! আমরা ওঁর এমন-এমন বাজনা শুনেছি ছোটবেলা থেকে, সে অকল্পনীয়! কোন স্তরে এঁরা সাধনা করেছেন, সেই সাধনার ফল কী, তা আমরা অনুধাবন করতে পারি! একটা সময়ে আমরা পাগল ছিলাম ওঁর বাজনা শোনার জন্য।

প্রকৃত বাঙালি ছিলেন ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ। তিনি সুরের মায়ায় উচ্চাঙ্গ সংগীতকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্ব-দরবারে। ওঁর কথা তো বলে শেষ করা যায় না, তবে যতদিন ভারতে সেতার থাকবে, ততদিন ওঁর নাম উচ্চশিখরেই বিরাজ করবে। এর মূল কারণ উনি এক নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন সেতারে।