অপরিমিত ক্ষমতার দোসর হিসেবে সবসময়ে পাশে রাখা চাই অ-সামান্য করুণার বোধ। করুণা যেখানে ছিঁটেফোঁটাও নেই, কেবল ওই ক্ষমতাই আছে, সেখান থেকেই জন্ম হয় দানবের। শিল্পবিপ্লব-উত্তর পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থায় মানুষ আর পশুর সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে একেবারে এইরকম। যে-কোনও প্রাণী যদি তাদের ইতিহাস লিখতে পারত, তার পুরাণ, লোককথা লিখতে পারত, তবে তার আখ্যানে দানবের চেহারাটা হত অবিকল মানুষের মতো। ঠিক আমার কিংবা আপনার মতো দেখতে। আমাদের দুধ, ডিম, মাংস, চামড়া-সহ প্রতিটা অ্যানিমাল-ইন্ডাস্ট্রি এক-একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। এর প্রতিটাতেই নির্বিচারে প্রাণী হত্যা করা হয় বলেই এ-কথা বলছি, তা কিন্তু নয়। আসলে এর প্রতিটাতেই নির্বিচারে এমন ব্যবস্থা করা আছে, যাতে মৃত্যু-মুহূর্তটাই হয়ে থাকে প্রাণী-জীবনের সবচেয়ে স্বস্তির মুহূর্ত, মৃত্যু-ঘটনাটাই হয়ে থাকে সবচেয়ে সকরুণ আশীর্বাদ— ওদের মৃত্যুকে নয়, বেঁচে-থাকাকেই এমন ক্রুর, এমন কল্পনাতীত নির্মম করে তুলতে পেরেছি আমরা সবাই মিলে।
যে-প্রাণী জলচর, তার জলে মিশিয়েছি বিষ, জঙ্গলে যে-থাকে, তার ঘর দিয়েছি উজাড় করে। কে দিয়েছে? আমি। আমি, যে কনজিউমার, আমার ব্যবহৃত প্রায়-প্রতিটা জিনিসে মিশে আছে অত্যাচার আর শোষণের বীভৎস কিন্তু অ-কথিত বৃত্তান্ত। আমার শ্যাম্পু আর সাবান, আমার ব্যাগ আর বেল্ট, আমার ব্যাডমিন্টনের শাটল কক, আমার তবলা আর ঢাকের আচ্ছাদন, আমার শীতপোষাক আর বুটজুতো। মানুষের ‘সভ্যতা’ গড়েই উঠেছে অন্য প্রাণীকে এক্সপ্লয়েট করতে-করতে। তারপর সে-ঘটনা এতই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে— এইসব কিছুর মধ্যে আদৌ-যে কোনও শোষণ-চিহ্ন আছে সেটাই মানুষের সমবেত ভাবনা-জগৎ থেকে একেবারে মুছে দেওয়া হয়েছে। যেন সমস্ত প্রাণীকুলের সৃষ্টিই হয়েছে মানুষের ভোগ-উপকরণের কাঁচামাল হয়ে ধন্য হবার জন্য। বিজ্ঞান ধীরে-ধীরে যতই এসবের বিকল্প ব্যবস্থার জোগান দিক না কেন, এক্সপ্লয়টেশন আমরা এত সহজে থামাতে যাব কোন দুঃখে!
আরও পড়ুন: নতুন ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনই এখন নতুন বাস্তবতা! লিখছেন পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা ও আয়ুষ জোশি…
চিনচিলা নামে একদল প্রাণী আছে, বুঝলেন, সে-যে কী বজ্জাত, ভাবা যায় না! ইঁদুর আর খরগোশের মাঝামাঝি একরকমের দেখতে। কিন্তু এদের গায়ের লোম স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে ঘন আর সবচেয়ে নরম। তুলতুলে, আহা মরি, মখমল হেন! ফলে বুঝতেই পারছেন, মানুষের শীতপোষাক বানানোর কাজে এর মেলা কদর। গুগল করে দেখবেন, চিনচিলার লোম দিয়ে বানানো পোষাকের দাম নাকি ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়! অবিশ্যি কমেও মেলে, পঞ্চাশ-ষাট হাজারে, তবে সে খানিক ভেজাল মেশানো। এ তো বাজারেরই নিয়ম, যার যেমন পকেট, তার তেমন জ্যাকেট।

তা, এহেন উপকারী প্রাণীটি নাকি মানুষের পোষাক-হয়ে-ওঠার ঠেলায় লুপ্ত হয়ে যাবার মুখে। কী অসভ্যতা বলুন তো! ওই নরম জ্যাকেট কি তাহলে আমরা পরব না? পরব না ওই নরম জ্যাকেট? একটা স্ট্যান্ডার্ড জ্যাকেট বানাতে শ-দেড়েক চিনিচিলা মারলেই চলে যায়। এইটুকুতেই লুপ্ত হয়ে যাওয়ার কী আছে! শোনা যায়, ওদের পায়ুদেশে ইলেকট্রিক তার ঢুকিয়ে শক দিয়ে (Electrocution) মারলে নাকি লোমের টেক্সচার সবচেয়ে মোলায়েম থাকে। মিনিট দুয়েক ওরা আর্ত চিৎকার করে, তারপর সব ঠান্ডা। ইয়ে, মানে গরম। সত্যি খুব গরম হয় ওই জ্যাকেটগুলো।
চিৎকারের কথায় মনে পড়ল, জন্তুরা তো সেইজন্যেই জন্তু যে উপকার করলেও তার মর্ম বোঝে না, কেবলই চেঁচায়। যেমন হাঁস। ইউরোপ, আমেরিকা, চিনদেশে একদল হাঁসকে ক’দিন ধরে খুব ঠেসে খাওয়ানো হয়। জোর করে, গলা টিপে, মুখে একটা রড ঢুকিয়ে, তুই খাবি না তোর বাপ খাবে বলতে-বলতে মিষ্টি করে খাওয়ানো যাকে বলে। তার ফলে ওদের লিভারটা খুব দ্রুত সাধারণ অবস্থা থেকে প্রায় দশ গুণ বড় হয়ে যায়। মানুষের ফ্যাটি-লিভার হলে পেটে কী-যে অসম্ভব ব্যথা হয়, সে যাঁদের হয়েছে তাঁরা জানেন। হাঁসেদের যা-হয় তার কাছ অবশ্য এইসব ‘ফ্যাটি লিভার’-টিভার নস্যি। আদর করে খাইয়ে খাইয়ে আমরা বেলুনের মতো ফুলিয়ে দিই ওদের লিভার। তখন হাঁসেদের গলায় আর পেটে অসম্ভব যন্ত্রণা হতে থাকে আর ওরা চিল্লাতে থাকে। আরে, জানোয়ার, তোরা কী করে জানবি এর মহিমা! সেই লিভারটা কেটে বার করে এনে তৈরি হয় এক মহার্ঘ্য ফরাসি কুইজিন, তার নাম ‘ফুয়া গ্রা’ (Foie Gras)। নামটাও কী সুন্দর, যেন হলিউড তারকার ব্যবহৃত পারফিউম! আর স্বাদও নাকি একেবারে স্বর্গীয়! মানুষের স্বর্গ-রচনায় প্রাণীদের এই আকুল আত্মোৎসর্গ ইতিহাসে নিশ্চয়ই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।


গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া তো আছেই, ওদের আমরা জন্মই ‘দিই’ আমাদের ভোগে লাগাব বলে, তার সঙ্গে কুমীর, অজগর, অস্ট্রিচ— যার কথা মনে আসে নাম করে ফেলুন, গায়ে যদি তার শক্ত চামড়া থাকে, জানবেন তাকে কেটেকুটে আমরা আমাদের ব্যাগ-ট্যাগ বানিয়ে থাকি নিত্য। স্টিংরে (Stingray) নামে এক সামুদ্রিক মাছ আছে, তার গায়ের চামড়া বেশ কড়া-টাইপ। ব্যাস, তাকেই-বা ছাড়া হবে কোন যুক্তিতে? একটা ব্যাগ বানাতে মাত্র খান-পনেরো স্টিংরে লাগে।
১৭৪১ সালে আলাস্কার কাছাকাছি দেখা মিলল এক নতুন প্রাণীর, মানুষ আগে তার অস্তিত্বের কথা জানত না। তার নাম ‘স্টেলার সি কাউ’, বৈজ্ঞানিক নাম Hydrodamalis gigas। এখন দেখুন, এই-যে মানুষ তার একটা ঘ্যামা বৈজ্ঞানিক নাম পর্যন্ত দিয়ে ধন্য করল, আর বিনিময়ে সামান্য কিছু চাইলে কি খুব অন্যায় করা হবে? দেখা গেল, প্রাণীটি চেহারায় বেশ বড়োসড়ো হলে কী হবে, মাংস তার ভারী নরম। তারপর দেখা গেল, তার শরীরে এত চর্বি যে তাই দিয়ে রান্না করা, আলো জ্বালানো এইসব কাজও হতে পারে। তারপরে বোঝা গেল, এর চামড়াটাও এত সুন্দর যে তাকে ছাড়িয়ে নিলে নৌকার পাল, জাহাজের দড়ি এবং অবশ্যই শীতপোষাক বানাতে খুবই কাজে দেবে। কিন্তু এতে শেষ না, এর সঙ্গে আরও খান-দুই তথ্য যদি যোগ করে নেন তাহলে বুঝবেন এদের অস্তিত্বের মধ্যেই প্রকৃতির এক নিশ্চিত অভিপ্রায় পুরে দেওয়া ছিল আসলে। এক, এরা খুব ধীরে ধীরে চলে। আর দুই, সবসময়ই ঝাঁক বেঁধে চলা এদের স্বভাব। ধরা যাচ্ছে অভিপ্রায়টা? মানুষ যাতে সহজে এদের মারতে পারে, বিশেষ কষ্ট করতে না-হয় বেচারা মানুষকে, দেখুন তারই কি বন্দোবস্ত করে রাখা নেই? ফলে মাংস খেয়ে, আলো জ্বালিয়ে, মহার্ঘ্য শীতপোষাক বানিয়ে দিব্যি দিন কাটছিল। ও মা, মাত্র সাতাশ বছর যেতে-না-যেতেই, ১৭৬৮ সাল নাগাদ টের পাওয়া গেল, পৃথিবীতে আর-একটাও স্টেলার সি-কাউ নেই! একটাও না। পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে গেছে তারা। মাত্র ২৭ বছরে কত আলো জ্বালাতে পেরেছি আমরা, ভাবুন একবার!

এসব দেখে ভরসা জাগে। মানুষ-যে এত করিতকর্মা, এটা জেনে মানুষ হিসেবে গর্বও হয়, বিশ্বাসও জোরালো হয়ে ওঠে। এই নীল মায়াবী গ্রহকে মানুষের অবর্ণনীয় অত্যাচার যে খুব বেশিদিন সহ্য করতে হবে না, তার আগেই মানুষ নিজেকে-সহ সব কিছুকেই শেষ করে এই পৃথিবীকে ঠিক শান্তি দেবে, সেই সুদিনের আশা সুদূর-পরাহত নয় বলেই আজকাল মনে হয়।ভাল লাগে বেশ।
প্রচ্ছদের ছবি: ব্যাঙ্কসি

