প্রথমেই একটা সেট-পিস চেজ সিক্যুয়েন্স। গুপ্তচর শিরোমণি জেমস বন্ড তাড়া করেছে কাউকে, বা কোনও ভিলেন তাড়া করেছে বন্ডকে। এবং অবধারিতভাবেই শেষ মুহূর্তে বন্ডের উপস্থিত বুদ্ধির জোরে অক্কা পাবে দুষ্টু লোক আর পর্দা জুড়ে লাফাতে থাকবে একটা আলোর বল। আর সেই আলোর বলের মাঝে পর্দার একদিক থেকে অন্য দিকে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ ফোর্থ ওয়াল ভেঙে যেন সোজা ঘুরেই গুলি করবে বন্ড। একটা রক্ত-রঙের ঢেউ নামতে থাকবে পর্দা জুড়ে। শুরু হবে জন ব্যারির অবিস্মরণীয় জেমস বন্ড থিম মিউজিক, ট্যারাং ট্যা…রাং। আর তারপর শুরু হবে টাইটেল সিক্যুয়েন্স। সেখানে বিখ্যাত কোনও গায়ক বা গায়িকার গানের সঙ্গে পর্দায় নারী, সুরা, বন্দুক আর মৃত্যুর হাতছানি। জেমস বন্ডের ছবি মানেই অন্তহীন বয়ঃসন্ধির ফ্যান্টাসি, গিল্টি প্লেজারের মোচ্ছব। অন্তত অনেক দিন পর্যন্ত তাই ছিল।
পর্দায় জেমস বন্ডের যাত্রা শুরু ‘ডক্টর নো’ দিয়ে। শন কনারির তখন তেমন নামডাক হয়নি। কিন্তু বন্ডের দুর্দান্ত অ্যাকশন, চোখা সংলাপ, কনারির কমিক টাইমিং, দুধর্ষ দুশমন আর শঙ্খ হাতে বিকিনি পরিহিতা উরসুলা অ্যানড্রেসকে দেখে সেই যে বন্ড ফিভারের শুরু— তা আজও অব্যাহত, যদিও অন্য অবতারে। সে-কথায় পরে আসছি।

আরও পড়ুন : গুপ্তচরদের সংকেতে লুকিয়ে ভাষার নানা মারপ্যাঁচ? ‘স্পাই’ সংখ্যায় লিখছেন ঋত্বিক মল্লিক…
অসুর যত ভয়ংকর,তাকে সংহার করে দেবতার তত মহিমা। জেমস বন্ডের ছবির প্রধান আকর্ষণ তার ‘ওভার দ্য টপ’ ভিলেনের দল। বিচিত্র তাদের অত্যাচারের কৌশল, মারণাস্ত্রের সম্ভার, আর রকমারি স্যাঙাৎ আর ভ্যাম্প। কোল্ড ওয়ারের যুগে প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল সোভিয়েত রাশিয়া ও তার সহযোগী কমিউনিস্ট দেশগুলো। তারা পৃথিবীর দখল নিতে চায় ছলে-বলে-কৌশলে। কিন্তু প্রতিবারই তাদের সে প্ল্যান ভেস্তে দেয় জিরো জিরো সেভেন জেমস বন্ড, যে কিনা লাইসেন্সড টু কিল। অর্থাৎ সাত খুন মাফ, এমনকী, সাতশো খুনও মাফ। তার মাথার ওপরে আছেন ‘এম’, এমআই সিক্সের (ব্রিটিশ সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস) প্রধান। আছে তার সেক্রেটারি মিস মানিপেনি, যার সঙ্গে বন্ড চুটিয়ে ফ্লার্ট করে। কিন্তু মানিপেনিও জানে, বন্ড অনেক বড় খেলোয়াড়, সাদামাটা মানিপেনিকে সে সিরিয়াসলি নেবে না কখনও। আর আছে ‘কিউ’, গ্যাজেট উইজার্ড। জেমস বন্ডের সঙ্গের লাইটার নেহাত লাইটার নয়, প্রয়োজনে ক্যামেরা, বন্দুক যা খুশি হতে পারে। গাড়ি মুহূর্তে ভোল পাল্টে হয়ে যেতে পারে সাবমেরিন। বা এক্সজস্ট পাইপের কাছ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে ছোট কামানের সারি। এমনকী, নিরীহ কলম বা হাতঘড়ি সময় বুঝে বোমা হয়ে ঘাবড়ে দিতে পারে প্রতিপক্ষকে। অনেকটা রূপকথার মতো। রাজপুত্র অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পথে যা যা কুড়িয়ে পাবে, পরে দেখা যাবে, রাক্ষস বধে সেগুলোই কাজে লেগে যাচ্ছে। ছবিতেও বন্ডকে কিউ যা যা নতুন গ্যাজেটস এবং মারণাস্ত্র দেবে, দেখা যাবে, ঘটনাচক্রে সবগুলোই মোক্ষম সময় কাজে লেগে যাবে।
বলাই বাহুল্য, নির্দিষ্ট কিছু ট্রোপ, টেম্পলেট আর সেটপিস, যে কোনও ফিল্ম ফ্র্যাঞ্চাইজির মতো জেমস বন্ডের ছবিগুলোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এমনি এমনি তো লঙ্গেস্ট রানিং ফিল্ম ফ্র্যাঞ্চাইজির তকমা পায়নি। আর আছে ভিলেনের দল। ড. নো, ব্লোফেল্ড, স্কারামাঙ্গা, ইলেকট্রা কিং, কানানগা, লে শিফ্রে, গোল্ডফিঙ্গার, রাউল সিলভা, কামাল খান, জোরিন, ভিলেনের ছড়াছড়ি। আর তাদের চরিত্রে বাছা হয়েছে দুঁদে সব অভিনেতাদের। ওয়াইজম্যানের ড. নো দিয়ে শুরু। এরপর ক্রিস্টোফার লি, ক্রিস্টোফার ওয়ালকেন, সিন বিম, ম্যাড মিকেলসন, হেভিয়ার বারদেম, ক্রিস্তোফ ওয়ালজ, অ্যান্ড্রু স্কট, রামি মালেক— তাবড় তাবড় অভিনেতারা বন্ডের ভিলেন হয়েছে।


দীর্ঘ তেষট্টি বছরে জেমস বন্ডের অভিনেতাও পাল্টে গেছে বারছয়েক। শন কনারি দিয়ে শুরু। তারপর রজার মুর, টিমোথি ডাল্টন, পিয়ার্স ব্রসনান হয়ে ড্যানিয়েল ক্রেইগ। মাঝে একটা ছবিতে জর্জ ল্যাজেনবি বন্ড হয়েছিল। আর ডেভিড নিভেন ‘ক্যাসিনো রয়াল’ নামের একটি বন্ড ছবির স্পুফে জেমস বন্ডের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেখানে আবার ভিলেন হয়েছিলেন উডি অ্যালেন। তবে বন্ডের ছবি বলতে যা বোঝায়, এটা ঠিক সে গোত্রে পড়ে না।
শুধু ভিলেন নিধনে নয়, রমণীমোহনেও বন্ডের বা সহযোগীদের চমৎকার সব ওয়ান লাইনার আছে। ‘টুমরো নেভার ডায়েজ’ ছবিতে পিয়ার্স ব্রসনান তার স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ভাষার টিচার দিদিমণির সঙ্গে ফ্রেঞ্চ কিস করতে করতে জানায়, ‘আই অলওয়েজ এনজয়েড স্টাডিইং আ নিউ টাং।’ বলাই বাহুল্য, সাধে কি ওই ছবিতেই মিস মানিপেনি বন্ডের দুষ্টুমির দিকে ইঙ্গিত করে বলে, ‘ইউ অলওয়েজ ওয়ার আ কানিং লিঙ্গুইস্ট, জেমস।’ ধূর্ত ভাষাবিদ যে বলতে চাচ্ছে না, সে তো বোঝাই যাচ্ছে।
বন্ডের ছবির আরেকটা আকর্ষণ হল, দু-রকম মানে হয়, এমন চোখা সংলাপ। ‘গোল্ডফিঙ্গার’ ছবিতে এক সুন্দরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে তার চোখের মধ্যে বন্ড দেখে, পিছনে আততায়ী উদ্যত। চকিতে তাকে ঘায়েল করে পাশের বাথটবে ফেলে পাশে থাকা বৈদ্যুতিক ল্যাম্প জলে ফেলে তাকে খুন করে নির্বিকার মুখে বলে ওঠে, ‘শকিং, পজিটিভলি শকিং!’ ‘থান্ডারবল’-এ সমুদ্র সৈকতে ভিলেনের স্যাঙাতকে স্পিয়ার গান দিয়ে মেরে ওই একই ভাবে বন্ডরূপী শন কনারি বলে ওঠে, ‘আই থিঙ্ক হি গট দ্য পয়েন্ট।’ ‘লিভ অ্যান্ড লেট ডাই’ ছবির ভিলেন কানানগার মৃত্যু তো, আরও যাকে বলে, স্পেক্টাকুলার। তার মুখের মধ্যে কিউ-র দেওয়া গ্যাস পেলেট ঢুকিয়ে দেয় বন্ড। ব্যস, বেলুনের মতো ঢোল হয়ে ফুলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় কানানগা। বন্ড বলে, ‘হি অলওয়েজ ডিড হ্যাভ অ্যান ইনফ্লেটেড ওপিনিয়ন অব হিমসেল্ফ।’ শুধু ভিলেন নিধনে নয়, রমণীমোহনেও বন্ডের বা সহযোগীদের চমৎকার সব ওয়ান লাইনার আছে। ‘টুমরো নেভার ডায়েজ’ ছবিতে পিয়ার্স ব্রসনান তার স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ভাষার টিচার দিদিমণির সঙ্গে ফ্রেঞ্চ কিস করতে করতে জানায়, ‘আই অলওয়েজ এনজয়েড স্টাডিইং আ নিউ টাং।’ বলাই বাহুল্য, সাধে কি ওই ছবিতেই মিস মানিপেনি বন্ডের দুষ্টুমির দিকে ইঙ্গিত করে বলে, ‘ইউ অলওয়েজ ওয়ার আ কানিং লিঙ্গুইস্ট, জেমস।’ ধূর্ত ভাষাবিদ যে বলতে চাচ্ছে না, সে তো বোঝাই যাচ্ছে।

আদতে জেমস বন্ড হল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার কমিউনিস্ট জুজু দেখা ম্যাকার্থি জমানার পরে-পরেই পুরুষ আধিপত্যবাদের আইকন। সারা পৃথিবীর রক্ষাকর্তা বিগ ব্রাদার আমেরিকা। কোল্ড ওয়ারে তাদের সহযোগী ইউকে। তাদের সিক্রেট সার্ভিস এমআই সিক্সের কর্মী জেমস বন্ড। নারীরা তার কাছে গ্যাজেটসের মতো। প্রয়োজনে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলতে দ্বিধা করে না সে। তাই বন্ড গার্লদের নাম হয় পুসি গ্যালোর, হানি রাইডার।
কোল্ড ওয়ারের সেই সাজো সাজো যুগে সোভিয়েত ব্লকের কাউকে ভিলেন সাজানো অনেক সহজ ছিল। এইডস-পূর্ববর্তী যুগে ঘন ঘন শয্যাসঙ্গিনী বদলানো ক্যাসানোভা-প্রতিম জেমস বন্ডকে গণ ফ্যান্টাসির আইকন করে তোলাও সহজ ছিল। কিন্তু দিনকাল অত সাদাকালো নেই। বিশ্বরাজনীতিতে বহু বদল এসেছে। ঘটে গেছে ৯/১১ ও আরও বহু রকমের হাড় হিম করা ঘটনা। তাই বদল এসেছে বন্ডের চরিত্রায়ণে। হ্যাপি গো লাকি, ফ্ল্যামবয়েন্ট তুখড় স্মার্ট নায়ক, যার কুক্ষিগত দুধর্ষ সব অস্ত্রশস্ত্র আর ফিউচারিস্টিক গ্যাজেটস— যে ভিলেনের সঙ্গে ঝাড়পিটের ফাঁকে বো-টাই ঠিক করে নেয়, দেখে নেয় টাক্সিডো নিভাঁজ কি না, যে তার ড্রাই মার্টিনি ‘নাড়িয়ে, কিন্তু না ঝাঁকিয়ে’ খেতে পছন্দ করে, আত্মপরিচয় জাহির করে ‘দ্য নেম ইজ বন্ড, জেমস বন্ড’ বলে, এবং সুযোগ পেলেই সুন্দরীদের শয্যালগ্ন হয়, সেই বন্ড আস্তে আস্তে বিদায় নিয়েছে।
সেই জায়গা নিয়েছে অনেক পলিটিকালি কারেক্ট, অ্যাংস্ট-দীর্ণ, প্রেমে বিশ্বস্ত, মানবিক ব্রুডিং টাইপের জেমস বন্ড। আগের প্রধান বন্ড অভিনেতারা শন কনারি, রজার মুর, টিমোথি ডাল্টন, পিয়ার্স ব্রসনান— সবার চুল কালো ছিল। শেষতম বন্ড ড্যানিয়েল ক্রেইগ ব্লন্ড। শুধু এই বাহ্যিক পরিবর্তন ছাড়াও চরিত্রগতভাবেও বন্ডের পরিবর্তন হয়েছে। শুনছি কালো কোনও অভিনেতাকে আগামী দিনে বন্ডের ভূমিকায় দেখা যেতে পারে। ইদ্রিস এলবার নাম তো অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। মহিলা বন্ডের কথাও শোনা যাচ্ছে। পতন-অভ্যুদয়ের মাঝে বন্ডের পন্থা বদল হতে হতে বেশি পলিটিকালি কারেক্ট হতে গিয়ে শেষে প্রোবায়োটিক কোলেস্টেরল-ফ্রি ফুচকা না হয়ে যায়, এই যা আশঙ্কা।