কে প্রথম…

Tenzing Norgay after the Summit

দুনিয়ার আকাশছোঁয়া ঔৎসুক্য থাকলেও এভারেস্ট জয়ের পর স্পোর্টসম্যান স্পিরিটকে সামনে রেখে ’কে প্রথম’, তা নিয়ে তেনজিং বা হিলারি কোনও বিবৃতি দেননি। ১৯৫৩ সালের ফার্স্ট সামিটের পর দলনেতা জন হান্ট-ও বলেছিলেন, ‘যৌথভাবে।’ 

লোকে শুনবে কেন? ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, সে-সময়ের নববিশ্বের যাবতীয় অভিযানের জায়গিরদার, মহা শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। অন্য একটি বিষয়ে। হিলারি ও হান্টকে নাইটহুড দিলেন কুইন এলিজাবেথ দ্বিতীয়। তেনজিংয়ের গলায় জুটল মেডেল। এই অসাম্য নিয়ে নিন্দা হয়েছিল। ঠিক পাঁচ বছর আগে ব্রিটিশকে ভাগানো হয়েছে। রাগ তখনও যায়নি বোধহয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নাকি তেনজিংয়ের নাইটহুডের সুপারিশ করতে রাজি হননি।

সেকালে এত খবর লোকে তেমন রাখত না। সুখবর ছড়িয়ে পড়তেই নেপালে, ভারতে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। তেনজিংয়ের জন্ম তো নেপালে, তাহলে ইন্ডিয়ার এত উল্লাসের কারণ কী? ব্যাপার আছে। তেনজিংয়ের ছেলে জামলিং-এর বইতে বলেছেন, ওঁর জন্ম তিব্বতে। শিশু তেনজিং নেপালের খুম্বু অঞ্চলে গিয়েছিলেন  এক শেরপা পরিবারের জন্য ফাইফরমাশ খাটতে। তেনজিংকে থ্যাংবোচে মনাস্ট্রিতে পাঠানো হয়েছিল লামা হতে। পোষায়নি। ১৩টি ভাই-বোনের মধ্যে এগারো নম্বর এই চাইল্ড লেবার বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। প্রথমে কাঠমান্ডু। পরে দার্জিলিংয়ে। কাছের তু-সং বস্তিতে মিশে যান স্থানীয় নেপালিদের মধ্যে। বয়স তখন উনিশ। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার নাগরিকত্ব ম্যানেজ করে ফেলেন। হয়ে যান আমাদের।

তাহলে গোলমাল কোথায়? ওই ঐতিহাসিক ঘটনায় পশ্চিমি অভিযাত্রীদের সঙ্গে উচ্চমানের এক পোর্টারের নাম জড়িয়ে থাকাটা সভ্যজগতের বীরদের কাছে অস্বস্তিকর হওয়াই স্বাভাবিক। 

আরও পড়ুন : আর তিন বছর বাঁচলে তেনজিংকে নিয়ে গোটা পৃথিবী গর্বিত হবে ভবিষ্যতে, বলেছিলেন লামা-রা!
লিখছেন তমাল মজুমদার…

হিমালয়ে আনাগোনা-সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত কর্মকাণ্ডের পীঠস্থান তখন দার্জিলিং। কর্মঠ, অকুতোভয়, নম্র স্বভাবের তেনজিং প্রথমে আদি ও পরে নেটিভ সাহেবদের পছন্দের শেরপা হয়ে ওঠেন। শেরপা-রা পাহাড়ের, বরফের গন্ধ চেনে। ওদের ছাড়া হিমালয়ে মস্তানি করা যায় না। তেনজিংয়ের মতো মানুষদের কোলে চেপে হিরো হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ, এটি সবার জানা ছিল। ‘৫৩-র এভারেস্টের আগেও তেনজিং বহু অভিযানে ডাক পেয়েছিলেন ’হাই অল্টিচিউড পোর্টার’ হিসেবে। ১৯৩৫ সালে এরিক শিপটনের এভারেস্ট রেকনাসেন্স অভিযানে ছিলেন। ১৯৩৬ জন মরিসের অভিযানেও। ১৯৪৭ সালে সামিটে ব্যর্থ আর এক বিদেশি অভিযানেও। তেনজিং তখন অপরিহার্য। ১৯৫০, ১৯৫১, সেখানেও তেনজিং। একবার তো প্রায় ছুঁয়েই ফেলেছিলেন। ল্যামবার্ট আর তেনজিং ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন শীর্ষের মাত্র তিনশো মিটার দূর থেকে। সাহেবদের বহু ব্যাপার নিয়ে সমালোচনা যুক্তিসংগত। কিন্তু লোক চিনতে এরা ভুল করত না। অতএব তেনজিং। হিলারি নিজেও চেয়েছিলেন তেনজিংকে। খাদে পড়ে গিয়েছিলেন। উদ্ধার করেছিলেন তেনজিং। একটা কৃতজ্ঞতার ব্যাপার ছিল নিশ্চয়ই। হান্টের রিপোর্টে রয়েছে, ১৯৫৩ সালে তেনজিংয়ের বয়স ছিল ৩৯। তেনজিংয়ের বাবা ছিলেন মেষপালক। মা, দোকমো কিঞ্জোম তেরোটি সন্তানের মধ্যে এগারোতম পুত্রের কাণ্ড দেখে যেতে পেরেছিলেন। অন্য সন্তানদের অনেকেই অকালে মারা গিয়েছিলেন। 

সেই মহা ঘটনার পর দুনিয়ার কাছে তেনজিং নোরগের উত্তরণ হল একজন সম্মানিত মানুষ হিসেবে। এঁর সম্পর্কে খোঁজখবর শুরু হল। আসল নাম— নামগিয়াল ওয়াংদি। রংবুক মনাস্ট্রির প্রধান লামা তার নাম রেখেছিলেন নওয়াং তেনজিং নোরবু। হিসেব করে দেখা গিয়েছে, তেনজিংয়ের জন্মসাল ১৯১৪। উনি নিজে অবহিত ছিলেন না জন্মতারিখ সম্পর্কে। পরে, এভারেস্টের মাথায়  প্রথমবার পা রাখার মহাদিবসকে, অর্থাৎ, মে মাসের ঊনত্রিশ তারিখকে  নিজেই জন্মদিন পালনের শুভক্ষণ হিসেবে ঘোষণা করে দেন।

শীর্ষ থেকে দেখা, ছবি : এডমন্ড হিলারি (সৌজন্য : লাইফ পত্রিকা)

আর্ট কালচার, আইটি ছাড়া বাঙালিদের কিস্যু হয় না— এই মতবাদের বিরুদ্ধে একটু কথা বলা যেতে পারে এখানে। প্রথমেই রাধানাথ শিকদার। সেসময় নাম ছিল Peak XV। সার্ভেয়ার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া স্যার জর্জ এভারেস্ট খুঁজে বের করেন তরুণ অঙ্কবিদ রাধানাথকে। ১৮৫২ সালে রাধানাথ সর্বপ্রথম এভারেস্টের উচ্চতা মেপে দিয়েছিলেন অঙ্ক  করে। মাথায় না চড়েই। এর পর একশো বছর পেরিয়েছে। পৃথিবীর মাথায় পা রেখেছে মানুষ। তার নাম হয়েছে এভারেস্ট। রাধাচূড়া হলে আরও মানানসই হতো। ‘৫৩-র পর থেকে এভারেস্ট আর স্রেফ পাহাড় থাকেনি। হয়ে উঠেছে, ‘মাস্ট গো টু দ্য টপ, টু দ্য টপ, টু দ্য টপ।’ হাইয়েস্ট বলে কথা। তেনজিং হিলারির সাউথ ফেসের পর উত্তর দিক থেকে, তিব্বত, যা এখন চীন, সেদিক থেকেও অভিযান হয়েছে, হয়ে চলেছে আজও। শুধু পর্বতারোহী নয়, শৌখিন ট্রেকাররাও এভারেস্ট তীর্থে এসেছে লাখে লাখে। দক্ষিণের বেস ক্যাম্পে পৌঁছেছে, দর্শন সেরে এসেছে আমার মতো অনভিজ্ঞ অনেকেই। কাঠমান্ডু থেকে প্লেনে লুকলা, তারপর ঝলমলে হাঁটা পথে বেস ক্যাম্প পৌঁছে পাশে কালাপাত্থরে উঠে পড়লেই চোখের সামনে রাজা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের ফুল ভিউ।

আজকের দুনিয়ায় পিক ক্লাইম্বিংয়ের চ্যালেঞ্জ কিছুটা লঘু হয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি, নিরাপত্তা থাকায়, ট্যাঁকের জোর ঝাকলে শীর্ষে পৌঁছনো সহজতর হয়েছে। পাশাপাশি, নেপালে এভারেস্টের ‘ওপরে তুলে দেওয়ার’ ব্যবসা, বেনিয়ম, তদুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে দুর্ঘটনার-ও শেষ নেই। এতদসত্ত্বেও এভারেস্ট চর্চা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঙালিদের মধ্যেও এভারেস্ট জয়ের কৃতিত্ব একাধিক। এদের প্রত্যেককেই যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আবার মাথায় চড়ে কী লাভ?’ উত্তরটা অবশ্যই আসবে, ম্যালোরির বিখ্যাত উক্তি, ‘বিকজ ইট ইজ দেয়ার।’

এভারেস্ট নেপালের বৃহত্তম ইন্ডাস্ট্রি। র-মেটিরিয়ালের দরকার নেই। উৎপাদনের ঝামেলা নেই। টপ ক্লাস কোয়ালিটি। তেনজিংরা ওই সাফল্য না পেলে এভারেস্টের পথে এত মানুষ এগোতেন না। এই মুহূর্তে সারা দুনিয়া ঝেঁটিয়ে আসা মানুষের ট্র্যাফিক জ্যাম, প্লাস্টিক বর্জ্যের উৎপাত, ক্রমাগত পরিষ্কারের অভিযান সবকিছুই অব্যাহত রয়েছে।

বাঁ দিকে : জর্জ লোয়ে ও তেনজিং, জুতো পরীক্ষা করছেন।  
ডান  দিকে :  দার্জিলিং এইচ এম আই তে তেনজিংয়ের মূর্তি 

আজকের দুনিয়ায় পিক ক্লাইম্বিংয়ের চ্যালেঞ্জ কিছুটা লঘু হয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি, নিরাপত্তা থাকায়, ট্যাঁকের জোর ঝাকলে শীর্ষে পৌঁছনো সহজতর হয়েছে। পাশাপাশি, নেপালে এভারেস্টের ‘ওপরে তুলে দেওয়ার’ ব্যবসা, বেনিয়ম, তদুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে দুর্ঘটনার-ও শেষ নেই। এতদসত্ত্বেও এভারেস্ট চর্চা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঙালিদের মধ্যেও এভারেস্ট জয়ের কৃতিত্ব একাধিক। এদের প্রত্যেককেই যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আবার মাথায় চড়ে কী লাভ?’ উত্তরটা অবশ্যই আসবে, ম্যালোরির বিখ্যাত উক্তি, ‘বিকজ ইট ইজ দেয়ার।’

তেনজিং-এ ফিরি। ১৯৫৩-র অভিযান। ২৬ মে। টম বুরদিলন ও চার্লস ইভান্স সাউথ কোল ছুঁয়ে ফেলেছিলেন। ইভান্সের অক্সিজেন সাপ্লাই যন্ত্রে গোলমাল দেখা দেয়। নেতার নির্দেশে তেনজিং ও হিলারি এগতে শুরু করেন। ২৮ মে থিতু হন ২৭,৯০০ ফিটে। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে সামান্য উঠে, তারপর আবার নামতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় একটি ৪০ ফিটের পাথর। তার গায়ে একটা ফাটল খুঁজে পান হিলারি। আইস অ্যাক্স দিয়ে বরফ ভেঙে পা রাখার রাস্তা বের করেন। চিমনি স্টাইলে পেরিয়ে যান মোক্ষম বাধা। তারপর তেনজিং। পরে এই পাথরের নাম রাখা হয় ‘হিলারি স্টেপ’। সেটি অতিক্রম করার পর বাকি পথ তুলনায় সহজ ছিল। সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ দু’জনে পৌঁছন ২৯,০২৮ ফিটে। যার পর আর উত্তরণের সুযোগ ছিল না। ক্যামেরা ছিল হিলারির কাছে। কোডাক রেটিনা টাইপ ১১৮। সেখান থেকে চারপাশের দৃশ্যাবলি তোলা হল, সাফল্যের প্রমাণ হিসেবে। আর উঠল সেই বিখ্যাত ছবি।  দুনিয়ার শীর্ষে পতাকা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন তেনজিং নোরগে। হিলারির ছবি কোথায়? তোলা হয়নি। তেনজিং তুলে দিতে চেয়েছিলেন। হিলারি রাজি হননি। আজও সেটি এক রহস্য। অনেক ব্রিটিশ মাতব্বররা বলে থাকেন, তেনজিং ক্যামেরা ব্যবহার করতে জানতেনই না।

বাঁ দিকে : জর্জ লোয়ে ও তেনজিং, জুতো পরীক্ষা করছেন।  
ডান  দিকে :  দার্জিলিং এইচ এম আই তে তেনজিংয়ের মূর্তি 

ফেরাটা বা নেমে আসাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় বরফে নিজেদের পায়ের ছাপ মিলিয়ে যাওয়ায়। কোনওমতে কিছুটা নামার পর দেখা পাওয়া যায় উঠে আসা অন্য সতীর্থদের সঙ্গে। তার মধ্যে ছিলেন জর্জ লোয়ে। সাফল্যের পর সুস্থ শরীরে দুই হিরো এবং দলের বাকি সবাই ফিরে আসতেই অভিনন্দন, সংবর্ধনার পাশাপাশি ‘সেই প্রশ্নটি’ বর্ষিত হতে শুরু করল।

১৯৫৪ সালে দার্জিলিং-এ তৈরি হল হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট— যার প্রথম ফিল্ড ডিরেক্টর হলেন তেনজিং। ১৯৭৮ সালে তৈরি করলেন ’তেনজিং নোরগে অ্যাডভেঞ্চার্স’। পরে সেটি চালাতেন তেনজিং-এর ছেলে জামলিং। উনিও এভারেস্টিয়ার, ১৯৯৬ সালে।

এই এভারেস্ট তেনজিংদের বদলে ম্যালোরি-আরভিনেরও হতে পারত। ১৯২৪ সালে। শৃঙ্গের ঢিল ছোড়া দূরত্বে পৌঁছেও তারা সফল হননি। সামিট থেকে ৮০০ ফিট খাড়াই দূরত্ব। সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যান চিরকালের মতো। এরপর থেকে ওঁদের অনুসন্ধান চলেছে ক্রমাগত। এখন পাওয়া যাচ্ছে দেহাবশেষ। খোঁজ চলছে আরভিনের ক্যামেরার। দুনিয়া তাকিয়ে আছে তার এক্সপোজড  ফিল্মের দিকে। ওঁরা শীর্ষে পৌঁছননি— এমন প্রমাণ হয়নি এখনও। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ফেরার পথেও। সেক্ষেত্রে প্রথম এভারেস্টের ইতিহাসটা নতুন করে লিখতে হতে পারে।

হিলারি, হান্ট ও তেনজিং  

তেনজিংয়ের দেহাবসান ৭১ বছর বয়সে, দার্জিলিংয়ে। ৯ মে। ১৯৮৬। 

সমতলের মানুষ-অধ্যুষিত মলিনতার কতটা ওপরে উঠলে তা কিছুটা স্বস্তির, শান্তির নিঃস্বাস ফেলা যেতে পারে, কেউ জানে না। সব তর্ক থেমে গিয়েছিল ১৯৫৫ সালে। যখন নিজের আত্মজীবনীতে শেরপা সমাজের সর্বকালের সেরা হিরো, স্পোর্টিং স্পিরিটের আইকনিক ব্যক্তিত্ব তেনজিং জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘সামিটের সময় তিরিশ ফিট রোপ ছিল আমাদের হাতে। আমরা পরস্পরকে বেঁধে রেখেছিলাম। তখন আমাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল ছ’ফিট। দৌড়ে গিয়ে আগে উঠে পড়ার কথা মনেও আসেনি। এভারেস্টে প্রথম পা রাখেন হিলারি। তারপর আমি।’