পকেটে হাত দিয়ে দেখা গেল, মানিব্যাগ আনা হয়নি। বুকপকেটে যে-টাকা পড়ে রয়েছে, তাই দিয়ে বাসের টিকিট দূরস্থান, একটা বিড়ি কেনারও তো পয়সা থাকবে না! সিগারেটের কথা বাদই দেওয়া যাক। অগত্যা হাঁটা। বালিগঞ্জ থেকে শ্যামবাজার। ধোঁয়া ছাড়া। একপেট খিদে নিয়ে। পৌঁছেও যাওয়া যেত গন্তব্যে। দিব্য। এমন গল্প তো তৈরিও হয়েছে, ছয়-সাত-আটের দশক পর্যন্ত। তৈরি হত, কারণ সময়টা তো তেমনই ছিল। কারণ, সহায় হিসেবে জুটেও যেত কেউ-না-কেউ। ‘ইন্দ্রাণী’-র উত্তমকুমারের কথাই ভাবুন, ডিগ্রিতে ঝলমল করা সার্টিফিকেট নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন যখন বুঝেই উঠতে পারছেন না, তখন ঠিক এসে জুটে যাচ্ছেন ছবি বিশ্বাস; সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে একেবারে অন্য, এক নতুন জীবনের সন্ধানও দিয়ে দিচ্ছেন। বিনা প্রশ্নে তাঁর সঙ্গে চলেও যান উত্তমকুমার। ভরসা থাকুক, এইটুকু প্রত্যয় যে রয়েছে সেখানে!
ফলে, ‘এমারজেন্সি’-র বোধটুকু, জীবনে হোক বা পথে-ঘাটে, ছিল অন্যতর। সরকারিভাবে এমারজেন্সি ঘোষণা যেভাবে উত্তাল করেছিল সময় ও সমাজ, যে-কারফিউর সময়ে রাস্তাজোড়া হুটারের শব্দ তখন বেজেছে জনগণের মগজে, মধ্যরাতে বাড়ির সামনে পুলিশ জিপের আনাগোনা দেখলে নিখোঁজ ছেলের বাড়ির লোকও উদ্গ্রীব হয়ে যেভাবে তাকিয়েছে জানলা দিয়ে— সেই আতঙ্ক, দুশ্চিন্তার মেঘ চেনেনি এই একুশ শতকীয় প্রজন্ম। কিন্তু সেই বৃহত্তর, ব্যাপ্ত এমারজেন্সির মধ্যেও, মানুষের এটুকু শান্তি কি ছিল না, যে, মিনিটে-মিনিটে তাকে তৎপর হতে হবে না? কোনও না-কোনও সাইরেন শঙ্খর মতো তাকে কেউ না কেউ ঠিক উদ্ধার করতে পারে? রাস্তা হারিয়ে ফেললে পথ বাতলে দেবে কেউ, কেউ হয়তো দু’টাকা বাড়িয়ে দেবে এক ভাঁড় চা খাওয়ার জন্য।
ক্রমশ, লকডাউনের রাস্তার মতোই, ফাঁকা হয়ে গিয়েছে আমাদের পরিসরটা। হাঁটতে-হাঁটতে, বাসে-ট্রামে যেতে-যেতে, মেট্রোয়, উৎসবে-ব্যসনে আমাদের সঙ্গী হয়েছে স্মার্টফোন, সে তো বেশ কয়েক বছর হতে চলল। সেই নয়ের দশক থেকে ক্রমশ মোবাইল জিনিসটা যখন আমাদের হাতে আসতে শুরু করল, তখনও আমরা বুঝিনি, ওই খুদে যন্ত্রটার সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়াটা ঠিক কেমন হবে। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় একবার একটি আলোচনাসভায় একটি অপূর্ব অনুষঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন, এই প্রসঙ্গে সেটা মনে পড়ে যায়। একুশ শতকের শুরুতে বলিউডের একটি অতি-জনপ্রিয় ছবি বুঝিয়ে দেয়, মোবাইল ব্যাপারটা ছুঁচ হয়ে ঢুকে থাকলেও, ফাল হয়েই বেরবে ক্রমে। ‘কহো না পেয়ার হ্যায়’ হৃতিক রোশনকে ভারতীয় দর্শকের মনেপ্রাণে প্রতিষ্ঠা করল, এই গুরুত্বটা যেমন আছে; তেমনই এই ছবির ক্লাইম্যাক্সে আসলে সময়-বদলের এক অন্য সূচকও রয়েছে, যা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় সেদিন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এই ছবির কেন্দ্রে যে-হত্যারহস্য, সিনেমার ক্লাইম্যাক্সে তার সমাধান করে নায়ক নয়, একটি নোকিয়া মোবাইল।
কিন্তু এই ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’-এর একটা অন্য দিকও আছে। ‘একদিন আচানক’ বা ‘একদিন প্রতিদিন’-এর এমারজেন্সিটার কথা ভাবুন! বাড়ির কেউ বাড়ি ফিরছে না, এদিকে রাত গড়িয়ে যাচ্ছে, এই সংকট পরিবারের অন্দরমহল থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে পাড়ায়, পুলিশস্টেশনে কিংবা মর্গে। কিন্তু এখন কি আখ্যানটা খুব একটা বদলে যেত? হয়তো একটা মোবাইল আছে হাতের কাছে, কিন্তু তারপর? ফোন করে কতবার আমরাও তো ফোন সুইচড অফ পেয়েছি আত্মজনদের! তখন কি মৃণাল সেনের ওই দমচাপা টেনশন আমাদেরও গ্রাস করেনি? মোবাইল থাকা ও না-থাকা কি সমান হয়ে যায়নি তখন?
ইদানীং, এআই-ঝড় আসার পর, ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে চোখ রাখলেই এমন বিজ্ঞাপন আপনার চোখে পড়তে বাধ্য, আপনার পার্টনার কার সঙ্গে কোথায় কফি খাচ্ছে, দেখে নিন; বা, আপনার এমন ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট আছে, যা আপনিও জানেন না। আপনার ব্যক্তিগত ডেটা যে আদতে আর আপনার নয়, তা জানানোতে কোনও রাখঢাকও নেই এখন। কিন্তু এখনও, ফোনে কারও সাড়া না পেলে কী করবেন, যার কাছে ফোন নেই, তার কাছে পৌঁছবেন কী করে, তার কোনও হদিশ এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার খোচড় অ্যাপগুলো দিতে পারবে কি?
এমারজেন্সিটা ভেবে দেখুন। প্রলয়ংকর ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রাস্তাঘাট আটকে যাচ্ছে, বাস এগোতে পারছে না। বাড়ি ফেরার কথা ন’টায়, বাজতে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে দশটা। এদিকে ফোনে চার্জ কমতে-কমতে প্রায় শূন্য আবিষ্কারের দোরগোড়ায়। বাস যাবে আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট। তারপর হয়তো আরও দশ মিনিট হাঁটতে হবে। এই সময়টা বাড়ির ফোন আসবে না ভেবে আপনি নিশ্চিন্ত হবেন, না কি, যাকে বলে ‘প্যানিক’, তা গ্রাস করবে আপনাকে?
উলটোদিকে, রাস্তায় যে আছে, তারও এমারজেন্সিটা ভেবে দেখুন। প্রলয়ংকর ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রাস্তাঘাট আটকে যাচ্ছে, বাস এগোতে পারছে না। বাড়ি ফেরার কথা ন’টায়, বাজতে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে দশটা। এদিকে ফোনে চার্জ কমতে-কমতে প্রায় শূন্য আবিষ্কারের দোরগোড়ায়। বাস যাবে আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট। তারপর হয়তো আরও দশ মিনিট হাঁটতে হবে। এই সময়টা বাড়ির ফোন আসবে না ভেবে আপনি নিশ্চিন্ত হবেন, না কি, যাকে বলে ‘প্যানিক’, তা গ্রাস করবে আপনাকে?
‘আপনার ফোনটা কেড়ে নিলেই আপনি শেষ’, এক বাইক-চালক একবার বলেছিলেন আমাকে। এমনিতেই বাইকে জড়সড়, তার মধ্যে এমন হুমকি পেলে তো কেলেঙ্কারি কাণ্ড! কিন্তু না, চমকানোর জন্য কথাটা বলেননি ভদ্রলোক। বলতে চাইছিলেন, এটাই এখন বাস্তবতা। কথাটা ভুল তো নয়! আমরা দিনে-দিনে ক্যাশলেস হচ্ছি। কলকাতা শহরে এখন অটো থেকে মুদির দোকান, ফাস্ট ফুড সেন্টার থেকে বাজার— কোথাওই কিউআর কোড এমন কিছু বিরল ঘটনা নয়। তাই স্মার্টফোনই ভরসা। এবার ধরুন, অ্যাপ ক্যাবে উঠেছেন, নামার সময়ে হঠাৎ দেখলেন ইন্টারনেট হাপিশ। বা চার্জের অবস্থা সঙ্গিন। পে করার জন্য যেই খুলবেন অ্যাপটা, সঙ্গে-সঙ্গে ফোন ঝাঁপ ফেলবে। ওদিকে ক্যাশের সঙ্গে আপনি ক্যারিটা জোড়েন না আর, ফলে কী করবেন তখন? পাড়ার কচুরির দোকানে ফোন নিয়েই চলে গেলেন কলার তুলে, কেত মেরে তো খুচরো টাকাও রাখেননি সঙ্গে। এবার গিয়ে কচুরি-জিলিপি সাঁটানোর পর দেখলেন, এইসব পে-ওয়ালের ধারই ধারেন না কচুরির দোকানের মালিক। আপনার তোলা কলার ধরার আগেই তো আপনাকে চম্পট দিতে হবে!
শুনতে খানিক অ-সিরিয়াস লাগতেই পারে, কিন্তু প্রতিটি সমস্যাই গূঢ়। এখন কথাটা হচ্ছে, স্মার্টফোনের এই বাড়বাড়ন্ত আমাদের এমারজেন্সি চুকিয়ে দেওয়ার ধান্দাতেই, অথচ, সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে এই একমাত্র কমরেড আপনাকে ফাঁসিয়ে দিলে আপনার বিপদ ঠেকাবে কে?
উৎপলকুমার বসু নাকি কোথাও গেলে সঙ্গে রাখতেন একটিমাত্র রেডিয়ো, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, বহির্জগতের সঙ্গে ওইটুকুই তাঁর যোগাযোগ। ধরা যাক, আপনিও বেড়াতে গিয়ে ভাবছেন. প্রকৃতির কোলে খানিকটা সময় কাটাবেন ফোন ছাড়াই। সেই সুযোগে বসের ফোন, টিম মিটিংয়ের অতল জলের আহ্বান গেল ফসকে। আপনি কি আদৌ তেমন বেপরোয়া যে, থোড়াই কেয়ার বলে এড়িয়ে যাবেন?
কাজেই, কান্নাকাটি-হল্লাহাটির সময় একেবারেই ফুরিয়ে যায়নি, এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ফোনে না পাওয়া কি সবসময়ই ফোনের সমস্যায়? সবসময় তা নয় আদৌ। কারণ, দিনের শেষে, ফোন না ধরা, আদতে এক রকমের যৌন অভ্যেস। কারণ, সেই আড়ালটুকু, এই উদাসীন মস্তানি, আপনার একান্ত। কোনও এমারজেন্সিই তখন আপনাকে আর স্পর্শ করছে না। একইভাবে, হালের ‘ঘোস্টিং’-এর ভৌতিকতাই হোক, বা ব্লক করে দেওয়ার সংঘাত-প্রবণতা— তার মধ্যে জরুরি অবস্থার তাৎক্ষণিকতা আছে বটে, কিন্তু ক্রমশ তা শীতল হয়ে ওঠে, রোজকার অভ্যেসবশেই মেনে নিতে হয়, যে-টেলিফোন আসার কথা, তা আর কোনওদিনই আসবে না।