সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, সমাজমাধ্যমেই আজকাল অধিকাংশ মানুষের ওঠাবসা। ফেসবুক, ইনস্টা, ইউটিউবে দিনরাত বিভোর হয়ে সামাজিক হয়ে ওঠা যায় না, সে-কথা জেনে-বুঝেই কিন্তু নতুন প্রজন্ম, যুবসমাজ থেকে মাঝবয়সিদের সচেতন সমর্পণ সেই সামাজিক মাধ্যমেই। দীর্ঘদিনের এই অভ্যাস, ভাবনাচিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল প্রভাবিত করতে পারে। ফলত, প্রভাবিত মস্তিষ্কের বদলে যাওয়া অন্তর্গত রসায়নের নির্দেশে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবনাচিন্তা আবার নতুনভাবে পরিচালিত করে সেই মানুষটিকেই। তারপর অ্যাড্রিনালিন-নির্ভর ক্যারিকেচার-বিনোদনকেই উচ্চমার্গের শিল্প হিসেবে তারা বেছে নেয়। মিডিয়ার নির্মাণ করা মধ্যমেধার সেলিব্রিটিই তাদের কাছে হয়ে ওঠেন প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী।
ইট-ক্রিকেট-স্লিপ-ক্রিকেট সাম্রাজ্যে বিরাট কোহলি মোটেই মধ্যমেধার নন। তিনি সেরাদের তালিকায়। ইনস্টাগ্রামে তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা ২৭ কোটি ছাড়িয়েছে। এই ২৭ কোটির মধ্যে সকলেই যে ক্রিকেট ভালবাসেন, তা কিন্তু নয়, খেলার অ-আ-ক-খ না জেনেও তারা আসলে ‘বিরাট কোহলি’-কে ফলো করেন। তাঁর স্ত্রী জনপ্রিয় বলিউড অভিনেত্রী অনুষ্কা শর্মা। প্রবল গ্যাম্বলিং সংস্কৃতির মাধ্যম ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ওরফে ‘আইপিএল’-এর সঙ্গে বহুকাল হল যুক্ত ‘রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু’-র প্রাক্তন অধিনায়ক বিরাট। কিছুদিন আগেই তিনি অনুষ্কার সঙ্গে গিয়েছিলেন অযোধ্যার হনুমান গড়ি মন্দিরে। তার আগে তাঁকে দেখা গিয়েছিল বৃন্দাবনে সাধু প্রেমানন্দ গোবিন্দ শরণজির আশীর্বাদ নিতে। আধ্যাত্মিক এই আদান-প্রদানের পরেই তিনি আবার ড্রিম-ইলেভেন নামের ‘আইপিএল-জুয়া’-র বিজ্ঞাপনের প্রধান মুখ। অতএব, আমাদের প্রথমেই বুঝে নিতে হবে যে, ভক্তদের কাছে বিরাট বলতে শুধু তাঁর কভার ড্রাইভ বা স্কোয়ের কাট নয়, হেয়ারকাট, বলিউড, অযধ্যা, ড্রিম ইলেভেন, বৃন্দাবন, ব্র্যান্ড থেকে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু অবধি তাঁর পুরো ছবিটাই কভার করে।
এই বিরাট মাপের কোহলির বিরুদ্ধেই থানায় অভিযোগ দায়ের করলেন সমাজকর্মী এইচএম বেঙ্কটেশ। গত বুধবার বেঙ্গালুরুতে আরসিবি-র আইপিএল উৎসবে পদপিষ্ট হয়ে ১১ জনের মৃত্যুর জন্য কোহলিকেই দায়ী করেছেন তিনি। বেঙ্গালুরুর এম. চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে আইপিএল ২০২৫-এ রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর জয়োৎসব চলাকালে, প্রায় দুই থেকে তিন লক্ষ মানুষ ভিড় করে স্টেডিয়ামের ৩৫,০০০ আসনের গেটের দিকে। গেট ভেঙে পড়ে। কোনওরকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সেই উথলে ওঠা উন্মত্ত ভক্তির চাপে মারা যান ১১ জন, আহত হন ৫৬। এই ঘটনার পরেই অনুষ্কা এবং সন্তানদের নিয়ে কোহলি নাকি লন্ডনের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছেন, এমনটাও শোনা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন : ডিজিটাল আর্কাইভ কি কখনও ফিজিকাল আর্কাইভের বিকল্প হতে পারে?
অভিজিৎ গুপ্তর সাক্ষাৎকার…
বিরাট যখন লন্ডনে, তখন ভারতে আরসিবি, জয়োৎসবের দায়িত্বে থাকা ডিএনএ এন্টারটেনমেন্ট, কর্নাটক রাজ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে বেঙ্গালুরু পুলিশ। পুলিশের বেশ কিছু শীর্ষকর্তা ছাড়াও ইতিমধ্যে বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনারকে সাসপেন্ড করেছেন কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া। সরকারের দিকে আঙুল তুলেছে কর্নাটক ক্রিকেট সংস্থা, আর অন্যদিকে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন কর্নাটকের উপমুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার। তিনি বলেছেন, ‘আমি বিজেপি-র লোকদের কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে চাই না। আমি শুধু কর্নাটক ও দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে চাই। বিজেপির লোকরা সব বাজে কথা বলে— এদের অনেকেই এই নোংরা ঘটনার নেপথ্যের কারিগর।’
কারিগর! কে কারিগর? কী সেই টান, যেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এত মানুষের এই বিরাট উন্মাদনা?
‘Society of the Spectacle’-এ ফরাসি দার্শনিক গি দ্যবো লিখেছিলেন: ‘The spectacle is not a collection of images, but a social relation among people, mediated by images.’
সোজা কথায়, চিন্নাস্বামীর ট্র্যাজেডি শুধুমাত্র অ-ব্যবস্থাপনার ফল নয়, বরং এক প্রতীকি অর্থনীতির পরিণাম, যেখানে বাস্তবতাকে প্রতিস্থাপন করেছে ছবি, মিথ, এবং লাগামছাড়া উন্মাদনা। ভক্তরা কেবল আরসিবি নামের একটি দলকে নয়, তারা আসলে ছুঁতে চাইছিলেন কোহলিকে, এক বলিউড অভিনেত্রীর নিখাদ ভালবাসাকে, হিন্দু ধর্মপ্রাণ বিশ্ববিজয়ের আজকের প্রতীককে— পবিত্র, মহান, ঈশ্বরতুল্য এক মুহূর্তকে।

মিডিয়া, তা সামাজিক হোক বা অসামাজিক, মোটা টাকার বিনিময়ে ক্ষমতার নির্দেশে ঘটনা, ব্যক্তি, তীব্র হিংসা আর উন্মাদনা উসকে দেওয়া স্পেকট্যাকল নির্মাণ করে চলেছে নিরন্তর। আর এই স্পেকট্যাকল সামাজিক সম্পর্ককে গড়ে তুলছে মারাত্মক এক নতুন মোড়কে। এই ট্র্যাজেডি সেই নির্মাণ করা তথ্য-সন্ত্রাসেরই ফল। কোহলি ও অনুষ্কার অযোধ্যার হনুমান গড়ি মন্দির দর্শন ও বৃন্দাবনে সাধু প্রেমানন্দ গোবিন্দ শরণজির কাছে আশীর্বাদ নেওয়ার ছবিতে সোশ্যাল মিডিয়া ভরে উঠেছিল। ভক্তি ও জনপ্রিয়তার মিশ্র প্রতিভূ সেই ছবি অজান্তেই ছাপ ফেলেছে বিরাটের ২৭ কোটি ফলোয়ারদের মনে। এই প্রভাব হয়তো আগামীর কোনও এক ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দেখা দেবে, আমরা জানতেও পারব না। এই ছবি ও এই ছবিকে ঘিরে এই মিডিয়া থেকে সেই মিডিয়ার আলোড়ন কোনও একক ঈশ্বরভক্তির প্রদর্শনী নয়। গভীর পরিকল্পনায় এই ঘটনার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ক্রিকেট, বলিউড এবং আধ্যাত্মিকতার শক্তিশালী এক ত্রিবেণী সঙ্গম।
আজকের সেলিব্রিটিরা কেবল ক্রিকেট খেলেন না, তাঁরা আশীর্বাদ দেন এবং পানও। স্ক্রিন ছাড়িয়ে তাঁরা হয়ে ওঠেন আত্মার আধ্যাত্মিক অভিভাবক। খেলার মাঠ বদলে যায় তীর্থস্থানে, গ্যালারির ভিড় হয়ে ওঠে এক ধর্মীয় সমাবেশ আর আদপে অর্থহীন, অতিরিক্ত স্পেকট্যাকল-আক্রান্ত মানসিক বোঝাই হয়ে দাঁড়ায় মৃত্যুর কারণ। কোহলি, শাহরুখ, তেন্ডুলকর ইত্যাদি রক্তমাংসের ব্যক্তিরা রূপ নিয়েছেন এক নির্মিত দেবতার, যাঁরা দারিদ্র-গ্যাস-অম্বল-পেটখারাপের দুনিয়ার বাসিন্দাই নন।
সেলিব্রিটিকে ঘিরে এই মহাযজ্ঞ মানুষের মনোযোগকে গভীরতর স্তরে জড়ায়, কেবল পারফরম্যান্সে নয়, ধর্মীয় ক্যারিশমায়, যা গণ-মনস্তত্ত্বকে বিশেষ একদিকে জারিত করে, চালিত করে।
আসলে স্পেকট্যাকল হিসেবে ভিরুশকার প্রচার কেবল বিজ্ঞাপন নয়, মিথ গঠনের এক প্রক্রিয়া। ভিরুশকা আমাদের কেবল কী কিনতে হবে শেখান না, বরং শেখান কীভাবে ভালবাসতে হবে, কীভাবে পরিবার গড়তে হবে, এমনকী. কীভাবে মাথা নত করতে হবে ঈশ্বরের কাছে। তাঁরা আমাদের কাছে স্রেফ সুদর্শন পণ্য নন, সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যা হয়ে ওঠেন। এবং সেই ব্যাখ্যা, দিনের পর দিন, আমাদের বাস্তব চাওয়া-পাওয়ার জায়গাটিকেই আচ্ছন্ন করে তোলে।
আরসিবি আর বিরাট ভক্তদের পায়ে পিষে মারা গিয়েছে আরও এক ভক্ত, ১৫ বছর বয়সি দিব্যাংশী। যখন তাঁর পরিবার এফআইআর দায়ের করাতে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন, তখন আরসিবি-র ব্র্যান্ড ভ্যালু নতুন উচ্চতায় উঠছে। ‘কোরুজ’ নামের একটি তথ্য-ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম জানিয়েছে, ২০২৫ সালে আরসিবি-ই হবে সবচেয়ে মূল্যবান আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি। মূল্য ১৪০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ১২০০ কোটি ছুঁই-ছুঁই হলেও আরসিবি নিহতদের পরিবারকে ১০ লক্ষ আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।
#WATCH | Bengaluru Stampede | Karnataka Dy CM DK Shivakumar says, "This should not have happened and we never expected such a big crowd…The stadium's capacity is 35,000 but more than 3 lakh people were there…Gates (of the stadium) have been broken…We apologise for this… pic.twitter.com/UXFezW8AuU
— ANI (@ANI) June 4, 2025
মৃত্যুকে ক্ষতিপূরণের চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়, যেখানে আমাদের ভালবাসা ও শোক এখন পণ্যের বিক্রি বাড়ায়। গেটের সামনে মৃত্যু, পুঁজির নিরিখে নেহাত একটি ‘ভাইরাল ঘটনা’। এই ঘটনা সংক্রান্ত সমস্ত লেখাপত্র, ভিডিও, নিউজ বাইটের ফাঁকফোকর দিয়ে প্রকট হয়ে উঠবে ভিরুষ্কার মিউচুয়াল ফান্ডের বিজ্ঞাপন। সময়ের স্ক্রলিং-এ এগারোটি মৃত্যু আস্তে আস্তে মানুষের মন থেকে মুছে যাবে, আর সিনেমা, রোম্যান্স, জাতীয়তাবাদ এবং আধ্যাত্মিকতার নিখুঁত মিশ্রণ হিসেবে ভিরুষ্কা আবারও জনমানসে হয়ে উঠবেন আদর্শ এক যুগল। দিব্যাংশীর মতোই কয়েক কোটি মানুষ ভিরুশকা-র এনডোর্স করা পণ্যটি কিনে নেবেন, কারণ সেই পণ্যের ভেতর অঙ্গীভূত হয়ে রয়েছে এমন এক প্রেমকাহিনি, যা পরিপূর্ণ, আধ্যাত্মিক, স্বাস্থ্য-সচেতন, আভিজাত্যে মোড়া দেশপ্রেম-চেতনায় রঙিন। যেহেতু ভিরুষ্কার প্রেমের ছায়ায় প্রতিটি পণ্য হয়ে ওঠে আবেগ, মূল্যবোধ ও নৈতিক স্বীকৃতিতে ভরপুর, ফলে সেই পণ্যের ভেতর জমে থাকা প্রকৃত শ্রম যেমন পোশাক-শ্রমিক, কৃষক, বয়নশিল্পী, কিংবা ডেলিভারি বয় বা গার্লদের অবদান অদৃশ্য হয়ে যায়। দৃশ্যমান থাকে কেবল তারকার ঝকঝকে চকচকে লাইফস্টাইল, এক স্বপ্নময় জীবনদর্শন। জীবন-সংগ্রামে প্রতিদিন পিষ্ট হওয়া সেই পোশাকশ্রমিক, কৃষক, বয়নশিল্পী, কিংবা ডেলিভারি কর্মীরাই ধরাছোঁয়ার বাইরে স্বপ্নময় এক জীবনের সাময়িক স্বাদে মেতে উঠতে আবারও শামিল হবেন আগামীর কোনও বিজয়োৎসবে।

আসলে স্পেকট্যাকল হিসেবে ভিরুশকার প্রচার কেবল বিজ্ঞাপন নয়, মিথ গঠনের এক প্রক্রিয়া। ভিরুশকা আমাদের কেবল কী কিনতে হবে শেখান না, বরং শেখান কীভাবে ভালবাসতে হবে, কীভাবে পরিবার গড়তে হবে, এমনকী. কীভাবে মাথা নত করতে হবে ঈশ্বরের কাছে। তাঁরা আমাদের কাছে স্রেফ সুদর্শন পণ্য নন, সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যা হয়ে ওঠেন। এবং সেই ব্যাখ্যা, দিনের পর দিন, আমাদের বাস্তব চাওয়া-পাওয়ার জায়গাটিকেই আচ্ছন্ন করে তোলে। বিরাট এক আচ্ছন্নতায় আমরা বুঝতেই পারি না, ভালবাসা, আশীর্বাদ এখন ব্র্যান্ড ক্যাম্পেনের অংশমাত্র। আর নিরন্তর ক্যাম্পেনে এই যুগল হয়ে ওঠেন, নিখুঁত পবিত্র এক জুটি। তাঁদের দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত হয়ে ওঠে শাস্ত্রীয় উপদেশ, আর ঠিক তখনই ‘পুঁজিবাদ’ নামের সামাজিক সম্পর্কটি ঢুকে পড়ে, গেঁথে যায় বিপুল সংখ্যার সাধারণ মানুষের অন্তঃচেতনায়, স্বপ্নে, আকাঙ্ক্ষায়, পরিচয়ে।
সাধারণ মানুষ বলতে, যাঁরা পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন, মারা যেতে পারতেন বা আগামীতে মারা যাবেন। মত্ত মানুষ, ব্যর্থ মানুষ এখন আজবরকম সস্তা। মাতিয়ে তারপর শুষে, অতঃপর পিষে ছড়িয়ে দিলেই পারত।