‘সুপারি’ কিলার

Reference image of Pan Masala

৩১ মে। তামাক-বিরোধী দিবস। আমাদের দেশে দিবসের অভাব নেই; এবং সেই দিবসকে ঘিরে এক-দিবসীয় দেদার আলোচনা, এবেলা-ওবেলা মেলা সেমিনার, সহস্র সংকল্প উড়ো খইয়ের মতো উড়তে থাকে। তারপর আবার যেই-কে-সেই। ৩১ মে দিকে-দিকে তামাকের বিরুদ্ধে প্রচুর বাক্য বর্ষিত হবে। অনেক খ্যাতনামারা সমাজমাধ্যমে সামাজিক নীতি মেনে সোশ্যাল মেসেজ দেবেন। কেউ-কেউ আবার ধুমধাম করে তাঁর ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার বৈরাগ্য বা না-ছাড়তে পারার প্রবল আসক্তিতে ছদ্ম আত্ম-বিরক্তির সঙ্গে বাকিদের ফুসফুসের কল্যাণ কামনায় ধোঁয়া-ধোঁয়া কিছু কথা ছাড়বেন। কিন্তু এসব বছর-বছর পরিচিত ছড়ানো-ছিটানো চিত্র ছাড়িয়ে আমরা যদি একটু তামাকের অন্দরমহলে যাই, তাহলে দেখব সম্পূর্ণ ক্ষতিকারক হয়েও কোন অন্ধি-সন্ধিতে তামাম দেশে তামাকের বিপুল রাজ-রাজত্ব।

নেশার রাজ্যে তামাকের প্রাচীনত্ব, আধিপত্য ও রকমারিত্ব অনস্বীকার্য। তামাক বহুরূপে বিকশিত। ধূমপান ছাড়াও তামাক চিবিয়ে খেলে জর্দা, ঠোঁটের ফাঁকে বা দন্তমঞ্জন রূপে গুল, আর নাকে ঠুসলে নস্যি। তবে এখন নস্যি ব্যবহারকারীর সংখ্যা নস্যিতে ঠেকেছে। দাঁতের মাজন বা ঠোঁটের ফাঁকে গুল বা গুড়াকুর ব্যবহার বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলায় বেশি হলেও সর্বত্রে নয়। শুকনো তামাক পাতা চূর্ণ থেকে যে দোক্তা-খৈনি, তারও রাজপাট বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে নেপাল, ভুটান পর্যন্ত সুবিস্তৃত। আর জর্দার চল তো সর্বত্রই এবং তার সংযোগ-শক্তিও যথেষ্ট। প্রধানত পানে জর্দা মেশানোর রীতি বেশ পুরনো।অন্যদিকে পানে সুপুরি ও সুগন্ধী দেওয়ার রেওয়াজও অতি সুপ্রাচীন। সুগন্ধী জর্দা-যোগে বেনারসি পানের সঙ্গে ধ্রুপদী গান-বাজনার এক রস-মধুর সম্পর্ক। আর পান থেকে চুন খসলে তো অনর্থক। তবে ইদানীং বেশ কিছু কাল পান থেকে চুন সরে গিয়ে, চুন-সুপারি ও জর্দা-যোগে এক নেশাদ্রব্য পশ্চিমবঙ্গের জেলায়-জেলায় ভয়ানক সাড়া ফেলেছে। ডাকনাম তার গুটকা, উচ্চারণভেদে গুটখা। মনে রাখা দরকার, গুটকা বাংলা ও বাঙালির নেশা নয়। মূলত বিহার, রাজস্থান, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশে বহু আগে থেকে গুটকার স্বচ্ছন্দ বিহার। আমাদের বাংলায় গুটকার প্রবেশ তথা আমদানি উদার অর্থনীতির পথ বেয়ে গত শতকের শেষ দশকে। সেই হিসেবে পঃ বঙ্গে তিন দশকের বেশিসময় পার করে ফেলল গুটকা। হইহই করে রজত-জয়ন্তী পেরিয়ে চলা গুটকার উদ্ভব, ইতিহাস, চলতি-চিত্র খুবই চিত্র-বিচিত্র!


মানিকচাঁদের বিমল

গুটকার ইতিহাস অনুসন্ধানে পাওয়া যাচ্ছে একটি সংক্ষিপ্ত নাম—R.M.D. এই নামে একটি গুটকাও প্রচলিত। আর.এম.ডি-র পুরো নাম রসিকলাল মানিকচাঁদ ধরীয়াল। যিনি হলেন ‘মানিকচাঁদ’গ্ৰুপের প্রতিষ্ঠাতা। এই মানিকচাঁদ গ্ৰুপের মূল ব্যবসা গুটকা, জর্দা, সুগন্ধী-সুপারি, পান-মশলা, মাউথ-ফ্রেশনার(মুখশুদ্ধি)। এছাড়াও এর পাশাপাশি অক্সিরিজ নামে জল, অফসেট-প্রিন্টিং, বিয়ের কার্ডের ব্যবসাও আছে। মোট তিরিশটি দেশে তাদের এইসব পণ্য বিক্রি হয়। রসিকলাল মানিকচাঁদের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্কুল,কলেজ, চিকিৎসালয়। মানিকচাঁদ গ্ৰুপের অন্যতম সফল গুটকা হল ‘বিমল’বা ‘ভিমল’। মিস্টার গুগুলের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-’২০ টানা তিন বছর গুটকায় শীর্ষ স্থানে বিমল। এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হলেন মোয়িজ মিয়া। অন্যদিকে ভারতে চর্বিত তামাক তথা গুটকার ব্যবসায় সর্বাধিক সফল এই ‘মানিকচাঁদ’গ্ৰুপ, যার মূল অফিস মহারাষ্ট্রের পুনেতে, আর মালিক রসিকলাল মানিকচাঁদ ধরীয়াল।

আরও পড়ুন : ‘হানি ট্র্যাপ’ শব্দটি যেন এক রহস্যময় অস্ত্রের নাম। তবে বাস্তবে এটি শুধু যৌন প্রলোভনের কোনও রূপকথা নয়। লিখছেন আদিত্য ঘোষ


রকমারি পর্দার আড়ালে সারি-সারি জর্দা

জর্দা ও সুপারি মিলেমিশে গুটকা। কখনও জর্দা রূপে, কখনও মিষ্টি সুপারির বেশে তার বিকিকিনি। রকমারি নাম-বাহারে তার কত না পসার! হীরা, শিখর, তি-রঙ্গা, পান পরাগ, মানিকচাঁদ, সিমলা, রাজা, গিটার, পাস-পাস, চুটকি, আদব, স্টার, কেতন, পান বাহার, কমলা পসন্দ, দিলরুবা, রাজশ্রী, মারুতি, আর.এম.ডি, গোয়া, তুলসী, পরাগ, রজনীগন্ধা, তেজ, পরশ, নবীন, মধু, বাহার, রাগ, রত্না, সিগনেচার…। এর বাইরেও হয়তো থেকে গেল হরেক গুটকা বা জর্দা-সুপারির নাম। যে-কোনও পান-গুমটির সামনে দাঁড়ালেই আপনার চোখের সামনে ফুটে উঠবে সারি-সারি সুগন্ধি সুপুরি ও গুটকা-মালা। এমনকী হয়তো ট্রেনে-বাসেও আপনি পেয়ে যাবেন গুটকা। শহর-কলকাতার অনেক জায়গাতেই আপনি পান না-পান, গুটকা পাবেনই। নানা রঙের প্যাকেট, হর কিসিমের নাম,দাম-সহ প্যাকেটে ‘বিধিসম্মত সতর্কীকরণ’—যা আবালবৃদ্ধবনিতার মুখস্থ— ‘তামাক ক্যান্সারের কারণ’। শুধু তাই নয়, ফলস্বরূপ ভয়াল বীভৎস ছবি ছাপা থাকে তামাকের প্যাকেটে। তাতে কী!ভয়াবহ ছবি-সহ দেদার বিকোচ্ছে গুটকা, অহরহ। মরণের আশঙ্কা আর ভয়ংকর ছবি-সহ সে-প্যাকেট ঢুকে পড়ছে পকেটে। তারপর ইচ্ছেমতো প্যাকেট ছিঁড়ে মুখে ঢালা। ধোঁয়াহীন তামাক, আশেপাশে ধোঁয়া ছড়ায় না, তবে যত্রতত্র সর্বত্র দলা-দলা থুথু ছিটিয়ে চলেছে গুটকা-বাহিনী।

গুটকার চিত্র-চরিত্র

গুটকা তৈরিতে মূল উপাদান সুপারি, তামাক, খয়ের, আরকা-বাদাম, প্যারাফিন, মোম, চুন, সুগন্ধী এবং আরও কিছু রাসায়নিক। এরপর মশলাতে অনেক সময়ে স্থানীয় টেস্ট অনুযায়ী মেশানো হয় সর্ষের দানা, হলুদ, লবঙ্গ, এলাচ, জায়ফল ইত্যাদি। গুটকার ব্যবহার এশিয়া মহাদেশে মূলত ভারত, পাকিস্থান, বাংলাদেশ, নেপালে। এছাড়াও উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশেও জর্দা এবং গুটকার ব্যবহার যথেষ্ট। সমীক্ষা বলছে, ভারতের মোট জনসংখ্যার ২৫%-এর বেশি মানুষ ধূমপান-সহ তামাকজাত পণ্যকে স্বীকার করেছেন বা শিকার হয়েছেন। নিয়মিত ও পর্যাপ্ত নিকোটিন ও রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারে ওরাল ক্যান্সার-সহ আরও তিরিশটি ক্যান্সারজাত অসুখকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। এহেন প্রাণঘাতী ‘অতিথি’র কথা জেনেও, গুটকার জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। মুম্বই রিপোর্ট দিচ্ছে ওখানকার ৪০% স্কুলছাত্র, ৭০% কলেজছাত্র নিয়মিত গুটকা খায়। প্রথমত ধূমপানহীন এবং অল্প খরচে সে-আসক্তি মেটানোর রাস্তা বেয়েই গুটকার এই প্রবল জনপ্রিয়তা। এই মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি রোধে নানা সময়ে ভারী ট্যাক্সের বোঝা দিয়ে বা নিষেধাজ্ঞার লাগাম পরিয়ে এই দুরন্ত প্রাণঘাতী নেশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে বিভিন্ন রাজ্য। কিন্তু প্রবল চাহিদার স্রোতে ২০১২, ’১৩, ’১৫, ’১৯ সালে দিল্লি সরকারের নিষেধাজ্ঞা;২০১৩, ’১৮, ’১৯ সালে রাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে বালির বাঁধ হয়ে পুনরায় স্রোতে মিশেছে।

তবে হ্যাঁ, ২০১৩ সাল থেকে আমাদের দেশে সরাসরি গুটকা বিক্রি খাতায়-কলমে বন্ধ। এখন আর গুটকা বিক্রি হয় না, এখন টুইন প্যাকেট। খোলসা করে বললে দাঁড়ায় একটি বড় প্যাকেটে সুগন্ধী-সুপারি, আর একটি ছোট প্যাকেটে জর্দা। বড় ভাই আর ছোট ভাই মিলেমিশে গেলেই গুটকা। লাঠি অক্ষত রেখে সাপ মেরে ফেলার এই অনন্য কৌশলটি যারা বাজারজাত করেছেন এবং এই অসামান্য কায়দায় যারা কানুনকে সফেদ দেখছেন, তাদের উভয়কেই গুটকাপ্রেমীর তরফ থেকে এক পিক-পিচিক রঞ্জিত অভিবাদন ছাড়া, আর কিস্যু বলা যায় না।


অজ্ঞজন, বিজ্ঞজন ও তামাকের বিজ্ঞাপন


গুটকার বিজ্ঞাপনেও নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডসের বিধি মেনে বিজ্ঞাপন দিতে বাধ্য পণ্য-বিক্রেতারা। তাই সেগুলিকে ‘পান মশালা’রূপে দেখানোর বিশেষ ছাড় আছে। আর জর্দার প্যাকেটে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ, তাহলেই সাত খুন মাপ। বজ্রের মতো আঁটোসাঁটো আইন, আর তার ফসকা গেরোর পথ বেয়ে বিমলের বিজ্ঞাপনে অজয় দেবগন‘পান মশলা’মুখে ভরে আওয়াজ তোলেন,‘বোলো যুবান কেশরী’বা ‘দানে দানে সে কেশর কা দম’। ২০২২-এ, তার বিমল-বন্ধু হয়েছেন শাহরুখ খান, যুক্ত হয়েছেন অক্ষয়কুমার, সৌন্দর্য শর্মা আরও পরে টাইগার শ্রফ।মনে রাখা দরকার, এরমধ্যে অজয় দেবগন, শাহরুখ, অক্ষয়কুমার তিনজনেই ‘পদ্মশ্রী’পুরস্কার প্রাপ্ত। যদিও তামাকের বিজ্ঞাপনী মুখ হওয়ায়, স্বাস্থ্যকর রুটিনে বাঁধা অক্ষয়কুমার প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে সরে আসেন এই বিজ্ঞাপন থেকে। অন্যদিকে আবার তিনি ‘বাবা ইলাচি’র বিজ্ঞাপন-মুখ হিসেবে বরাবর হিট। একসময়ে পানগুমটির দোকানদার সেজে ‘গোয়া 1000’বেচতেন অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত। ‘সিলভার পার্লস’আর ‘রজনীগন্ধা’র সৌরভ ছড়িয়েছেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। ২০১৫ সালে ‘পান-ই-শাহি’র হয়ে ফানি পারফর্মার গোবিন্দা, সাথে অঞ্জলি পান্ডেকে নিয়ে বিজ্ঞাপন জমিয়েছেন। সানি দেওল আর প্রীতি জিন্টা একদল শিশুশিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে করেছিলেন ‘পান পরাগ’-এর বিজ্ঞাপন। শিশুদের নিয়ে এহেন বিজ্ঞাপনে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তারপর তারা তাদের জুটিতে ‘সন্তুর পান মশালা’র বিজ্ঞাপন-চিত্র বানান, যেখানে অনেক বন্ধুবান্ধবের হই-হুল্লোড়ের মাঝেও এক বড় রিফ্রেশমেন্ট এনে দেয় ‘সন্তুর পানমশালা’।বিজ্ঞাপন-ভিডিওর শেষে সানি দেওল এবং প্রীতিকে বলতে শোনা যায়, সন্তুর পান মশলা কোনওরকম টোবাকো ছাড়া, সুপুরি ছাড়া, এ হল বিশুদ্ধ মুখশুদ্ধি। আমরা জানি ‘পান বাহার’-এর বিজ্ঞাপনে একসময়ে দেখা যেত সইফ আলি খানকে। ইদানীং আবার টলিউড অভিনেতা জিৎ সর্বত্রই ‘বাহার’দেখছেন। একসময়ে‘রজনীগন্ধা’র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন বিরাট-পত্নী অনুষ্কা শর্মা। যে-বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন ছিল,‘Let goddess shine’, শেষমেশ জর্দা মেশানো সুগন্ধী সুপারির ‘রজনীগন্ধা’তে ঈশ্বরের বর্ণচ্ছটা।

অনেকের মনে আছে নিশ্চয়ই, জেমস বন্ড-খ্যাত হলিউড অভিনেতা পিয়ার্স ব্রসননের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল ‘পান বাহার’যোগে। এই বিজ্ঞাপনের জন্য২০১৮ সালে দিল্লি রাজ্য তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল এই হলিউডি অভিনেতাকে তামাকদ্রব্য প্রচারের কারণে নোটিশ পাঠায়। সেই নোটিশের উত্তরে জেমস পিয়ার্স ব্রসনন জানান, ২০১৬ সালে ‘পান মশলা’তাদের বিজ্ঞাপন-চুক্তিতে কোথাও তামাকের উল্লেখ করেনি, তিনি জানতেন এটা ব্রেথ-ফ্রেশনার এবং দাঁত সাদা রাখার মশলা। তাই বন্দুক হাতে নয়, স্রেফ ‘পান-বাহার’-এর কৌটো ছুড়েই তিনি শয়তানদের ঘায়েল করছিলেন আর স্বল্পবসনা সুন্দরীর তনু-মন জিতে নিচ্ছিলেন। একইরকম ঘটনা ঘটে, ২০২১ সালে ‘কমলা পসন্দ’-এর বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে। বিজ্ঞাপনে দেখা যায় বিগ বি অমিতাভ বচ্চনকে। যিনি দেশে পোলিও নির্মূলের ডাক দেন বজ্রকণ্ঠে, তিনি কিনা ‘কমলা-পসন্দ’-এর হয়ে নাচ করছেন, তার গুণমুগ্ধদের বিষয়টা এক্কেবারে না-পসন্দ।

অ্যাড-ফিল্মে দেখা যায় অমিতাভ ক্ল্যাসিক্যাল গানের ভক্ত, অন্যদিকে নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি রণবীর সিং ধুন্ধুমার রক গানের ফ্যান, কিন্তু এই দু’জনকেই মিলিয়ে দেয় ‘কমলা পসন্দ’ -এর ‘আনোখা স্বাদ’। যেমনভাবে ২০২৩ সালে ‘কমলা পসন্দ’এক ফ্রেমে হাজির করে ক্রিকেট দুনিয়ার তাবড় চার তারকাকে— সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেব, বীরেন্দ্র শেহবাগ এবং ক্রিস গেইলকে। সে-নিয়েও সমালোচনা হয়েছে বিস্তর। এ-বিষয়ে গৌতম গম্ভীর প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলেন, যাঁরা ক্রিকেট-ক্ষেত্রে দেশবাসীর আইকন, তারা কীভাবে ক্যান্সারবাহী গুটকার বিজ্ঞাপন করেন? বরাবরের জেন্টলম্যান শচীন টেন্ডুলকার ‘তামাক-বিরোধী দিবস-এ, লেখেন,‘At the start of my international career, my father gave me a simple yet important piece of advice, Never promote tobacco. I have lived by it, and so can you. Let us choose health over tobacco for a better future.’

শচীনের এই উজ্জ্বল অবস্থানের পাশাপাশি আরও কিছু আলোক বার্তা-হলিউড অভিনেতা পিয়ার্স ব্রসনন, বলিউড অভিনেতা অক্ষয়কুমার, অমিতাভ বচ্চন তাদের ভুল বুঝতে পেরে তামাকজাত দ্রব্যের প্রচার থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। এমনকী সানি লিওন পর্যন্ত তামাকের বিজ্ঞাপনে নিজেকে আর জড়াবেন না, সেরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।আবার অনিল কাপুর, কার্তিক আরিয়ান, দক্ষিণের জনপ্রিয় অভিনেতা আল্লু অর্জুনের মতো আরও অনেকেই তামাকদ্রব্যের কোটি-কোটি টাকার বিজ্ঞাপনী অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন।দুর্নিবার লোভ আর চরম ভোগের দুনিয়ায় এগুলিই আশার আলো।

পিক-আপে ভক্ত আর পিক-পয়েন্টে ভগবান

সরাসরি গুটকা বিক্রি বন্ধ, সরাসরি বিজ্ঞাপনও বন্ধ। কিন্তু বন্ধ নয় যত্রতত্র গুটকার পিক ফেলা। আইনের ফাঁক দিয়ে যেমন বিক্রি চলছে, বিজ্ঞাপন চলছে, তেমনই ঠোঁটের ফাঁক পিচকারির মতো পিক রাঙিয়ে দিচ্ছে সর্বত্র। পানের পিক বা গুটকার পিচিক আটকানোর জন্য কত-না দেওয়াল লিখন, কত-না সচেতনবার্তা। ট্রেনে-বাসে-অফিসের সিঁড়িতে, এমনকী লিফটে পর্যন্ত পিক না ফেলার অনুরোধ, আদেশ, নিষেধাজ্ঞা। এমনকী হুমকি পর্যন্ত, কিন্তু পিকের পিক-আপই আলাদা। সব ‘স্বচ্ছ’‘নির্মল’আয়োজনকে ফিকে করে দিয়ে পিক এখনও পিক-ফর্মে। যে-কোনও সরকারি অফিসের সিঁড়ি বেয়ে উঠুন, দেখবেন বাঁকে-বাঁকে গুটকা ও পানপিকের পিচকারিতে লালের উজ্বল উপস্থিতি। যে-কোনও টোল প্লাজায় ঢোকার মুখেও এই পিকের খেলা আপনার নজর কাড়তে বাধ্য। হাওড়া ব্রিজের ইস্পাত পিলারকে খেয়ে নিচ্ছিল গুটকার থুতু। তাকে বাঁচাতে ফাইবার গ্লাসের মোড়কেও লাভ হয়নি। পরিশেষে পুরসভা বাধ্য হয়েছে দেবদেবীর ছবি সাঁটাতে। এইরকম কত সহস্র দেবদেবী পানের পিকের মুখে ভাবলেশহীন মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তার ইয়ত্তা নেই। পিক প্রতিরোধের প্রহরায় নিযুক্ত দেবদেবীরা যে সর্বত্র নিজেদের উজ্জ্বল ভাব বজায় রাখতে পেরেছেন তা নয়। অনেক অবাধ্য পান-প্রিয় বেগতিক ভক্তরা বেসামাল ভাবে দেবদেবীর গায়েও এঁকে দিয়েছেন লাল রঙের উলকি-ঝুলকি। ভক্তের ঝালায় ভগবান বড় অসহায়!

২০২৩ সালে ‘কমলা পসন্দ’এক ফ্রেমে হাজির করে ক্রিকেট দুনিয়ার তাবড় চার তারকাকে— সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেব, বীরেন্দ্র শেহবাগ এবং ক্রিস গেইলকে। সে-নিয়েও সমালোচনা হয়েছে বিস্তর। এ-বিষয়ে গৌতম গম্ভীর প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলেন, যাঁরা ক্রিকেট-ক্ষেত্রে দেশবাসীর আইকন, তারা কীভাবে ক্যান্সারবাহী গুটকার বিজ্ঞাপন করেন?

‘বিমল’আনন্দে জাগো

একদিকে নির্মলের আহ্বান, অন্যদিকে বিমলের দানায়-দানায় ঘনায় গভীর লাল রং। না গুটকা নয়, আমাদের দেশে ও রাজ্যে গুটকা নিষিদ্ধ, এ হল সুগন্ধী-সুপারি ও জর্দা যোগে এক দমদার মিশেল। মিলেমিশে মুখে নিলেই এক ঝটকায় তামাকের আবেশ ও আসক্তি ঘিরে ধরবে শরীরের যাবতীয় শিরা ও স্নায়ুকে, রক্ত প্রবাহ হয়ে উঠবে চঞ্চল। আর সে-চাঞ্চল্য ছুটে বেড়াবে সারা শরীরে। মাথা জুড়ে ঝিমঝিম, সিমসিম। ক্ষণিকের জন্য চনমনে হয়ে উঠবে শরীর, ফুরফুরে হবে মন। ততক্ষণে গুঁড়ো, দানাদার সুগন্ধী সুপারি ও জর্দা লালারসের সাথে মিশে মুখভর্তি হয়ে উঠবে গভীর লাল রঙে। পিক ফেলা দরকার, সে যেখানেই হোক! রাস্তার মাঝে, দোকানের সামনে, অফিসের করিডোরে, ট্রেনের কামরায়, বাসের জানলায়, ক্লাসরুমের কোনায়, সিঁড়ির বাঁকে।

নেশার রাজ্যে তামাকু ভ্রাতৃত্ববোধে বাঁধা।প্রবল নেশাড়ুরা বলছেন, এই বারংবার সুপারি চর্বন নাকি হজম সহায়ক। জানা নেই। তবে নিশ্চিত এ যম সহায়ক। মুখ, খাদ্যনালি ও অগ্নাশয়ের ক্যান্সার, এছাড়াও হাঁপানি, হৃদ্‌রোগকে আহ্বান জানায় এই জর্দা মেশানো সুপারি। ৩১ মে, গুটকাপ্রেমীরা ভাবুন, গুটকা সুগন্ধী-সুপারি না সুপারি-কিলার?