সম্প্রতি জাভেদ আখতার ও মুফতি শামাইল নদভিরের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব-সম্পর্কিত একটি বিতর্ক বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সাধারণত বিতর্কে যেহেতু জয়-পরাজয়ের বিষয় থাকে, সেইমতো অনেকেই মনে করছেন জাভেদ আখতার, অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ও ক্ষুরধার বক্তা হলেও, এই তর্কে নাকি খানিক পিছু হটেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও হার-জিতের ক্ষেত্র তৈরি হয়নি ঠিকই, কিন্ত সাধারণ প্রতিক্রিয়া যেন একটু বেশি ঝুঁকে নদভিরের পক্ষে (বলা ভাল, এই তর্কের নিরিখে আস্তিকতার স্বপক্ষে)। ‘Atheism’, অর্থাৎ সাধারণ অর্থে নাস্তিকতা, বা আরও সহজে, ঈশ্বরে বিশ্বাসী না হওয়া, ‘Theism’ (আস্তিকতা, বা ঈশ্বরে বিশ্বাসী হওয়া)-কে কেন্দ্র করে আলোচনার এই পরিসর বেশ ব্যতিক্রমী, কারণ ভারতীয় মিডিয়া বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এমন সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্কের আয়োজন খুব একটা দেখা যায় না আজকাল। এই অনুষ্ঠান, প্রায় দু-ঘণ্টাব্যাপী দেখার পর, কিছু জরুরি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়; জানতে ইচ্ছে করে যে, আজকের ভূ-ভারতে নাস্তিকতা বিষয়টির কতটা সামাজিক স্বীকৃতি আছে? নাস্তিক হতে গেলে তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক কোনও আদর্শ বা আইডিওলজির দরকার পড়ে? কিংবা নাস্তিক হিসেবে সমাজের সামনে দাঁড়ালে লড়াইটা কি আরও কঠিন হয়ে যায়? যেখানে ধর্মের ভেদাভেদকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি ফায়দা লুটছে চারদিকে, সেখানে ‘আমি নাস্তিক’ বলার মধ্যে কি একটা প্রতিরোধের ভাষা তৈরি হয়, না কি বেশিরভাগ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ধর্ম/ ঈশ্বর না মানার সিদ্ধান্ত।
উপরোক্ত বিতর্কসভাটির প্রসঙ্গ টেনেই এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে, কারণ সভার শেষে দর্শকদের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তরের পর্বটি খুব সুষ্ঠুভাবে নাস্তিকতা নিয়ে একধরনের ‘জেনারেল কনসেনসস’ বা সাধারণ জনমত আমাদের সামনে আনে। খুব অবাক হতে হয়, যখন এই সভার ধর্মগুরুর ভাষণে তথাকথিত ট্র্যাডিশনাল বা স্ক্রিপচারাল বুলির বদলে প্রচুর তত্ত্ব, আক্যাডেমিক জারগন বা থিওরির অবতারণা দেখা গেল, অন্তত সাধারণ ধর্মানুষ্ঠানে সচরাচর যা চোখে পড়ে না। যারা ইতিমধ্যে দেখেছেন বিতর্কসভাটি, নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, কীভাবে কোনওকিছুর প্রমাণ বা সমীক্ষা দেওয়ার সময় শাস্ত্র-উদ্ধৃতি নয়, বরং অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বা ন্যাশনাল সাইন্টিফিক অ্যাকাডেমি ও প্রমুখ বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্থার ‘ডেটা’ বা তথ্য নিয়ে আলোচনা চলছিল। এই বিষয়টি খুব চিত্তাকর্ষক যে, আজকের ধর্মগুরুরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য, প্রাথমিকভাবে পুঁথি বা শাস্ত্রের উদ্ধৃতি না দিয়ে, বৈজ্ঞানিক সংস্থার বয়ানগুলি নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে। কোনও ভারতীয় ধর্মগুরুর মুখ থেকে ‘infinite regress’, ‘contingent theory’ বা ‘necessary being’ সম্পর্কিত কঠিন কঠিন তত্ত্বের বিশ্লেষণ শুনলে প্রথমেই একটু অবাক হতে হয়। সাধারন রিল, মিম বা ধর্মীয় সভার ভিডিওতে যে ধরনের ভাষা বা ন্যারেটিভ দেখতে পাই, সেখানে এমন সব মেটাফিজিকাল বা আধিবিদ্যক পরিভাষা খুব একটা ব্যবহার হয় না। তাই প্রথমে পুরো বিষয়টা শুনে তাজ্জব বনে যেতে হয়; অবোধ্য ও জটিল শব্দবন্ধ, কঠিন ব্যাখ্যা। এই চমক, শব্দচয়ন বা অত্যন্ত স্পষ্ট স্বরে একনাগাড়ে কথা বলে যাওয়ার মধ্যে একটা আকর্ষণ আছে, মুফতির বাগ্মিতা নজর কাড়ে। তবে এই বিস্ময় ও সমূহ তত্ত্বের পিছনে থাকা মুফতির পরিচয় বা তার আদর্শগত ঘরানা সম্পর্কে হয়তো একটু জেনে নেওয়া দরকার। জাভেদ আখতারের পেশা বা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সর্ম্পকে আমরা সকলেই কমবেশি জানি। কিন্তু এই বিতর্কসভা যে নদভি বা তার সংস্থারই আয়োজিত এক অনুষ্ঠান, এই বিষয়টি বুঝে নেওয়া জরুরি। কেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে একটি ধর্মীয় দল বিতর্কসভার আয়োজন করল হঠাৎ? কী ধরনের ডায়লগ বা মত বিনিময় চায় তারা?
আরও পড়ুন: আমাদের এক্স রে প্লেট থেকে তৈরি হত মাওয়ের মুখের স্টেনসিল! লিখছেন মৃদুল দাশগুপ্ত…
মুফতি শামাইল, লখনউয়ের দার-উলুম নাদওয়াতুল উলেমার সদস্য। ১৮৯৮ সালে তৈরি হওয়া এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ও ইসলামী পঠন-পাঠনের সংমিশ্রণ ঘটাতে চায়। মুফতি নিজে কলকাতার বেনিয়াপুকুরে অবস্থিত ‘Wahyain Foundation’-এর কর্ণধার, যেখানে ইসলামের আদর্শগত দিকগুলি নিয়ে পড়াশোনা হয়, এছাড়া আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান (মালয়েশিয়াতে) যেখানে মেডিসিন, আইন, ম্যানেজমেন্ট বা বিজ্ঞান পড়ানোর পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষাচর্চা চলে, তার অনুসারী কলকাতা ও লখনউয়ের এই ঘরানা। এই বিতর্কসভার আয়োজন তারা করেছিল এক ধরনের ‘ইনক্লুসিভিটি’ বা সমন্বয়ের তাগিদে। যেভাবে পাবলিক ফোরামে আখতারের মতো একজন জনপ্রিয় শিল্পীকে নিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে বাদানুবাদ চলেছে, মনে রাখতে হবে, আয়োজকদের নিজেদের সংস্থাতেও এমন তাত্ত্বিক তর্কাতর্কি চলে। জনসমক্ষে, সৌরভ দ্বিবেদী দ্বারা পরিচালিত এই সভা, তাদের নিজেদের আদর্শগত আলোচনার এক পরিবর্ধিত ও পাবলিক রূপ (নাস্তিকের সঙ্গে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের অন্দরে বাদানুবাদ হয় না নিশ্চয়ই, কিন্তু অনুষ্ঠানের দর্শকাসনে উপস্থিত কিছু ছাত্রের প্রশ্নের ধরন দেখে বোঝা যায়, যে তারাও মুফতির বলা প্রত্যেকটি তত্ত্ব বা থিওরি নিয়ে ওয়াকিবহাল, সেগুলোই তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে পড়ে বা অভ্যেস করে)।
মুফতির পরিচিতি নিয়ে এতখানি গৌরচন্দ্রিকা করার কারণ এই যে, বর্তমান ভারতে, ঈশ্বর বা ধর্মের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে সুষ্ঠুভাবে যে একটি বিতর্কসভার পরিচালনা সম্ভব, তা কি এক অন্যরকম ভারতের স্বপ্ন দেখায়? সম্প্রতি চিকেন প্যাটিস, সেক্যুলার গান বা সান্টার টুপি নিয়ে যে রক্তচক্ষু দেখতে আমরা অভ্যস্ত, সেখানে এই ধরনের বিতর্কসভার আয়োজন কি ব্যতিক্রমী? একথাও মনে হয় যে, ধর্ম, তার প্রয়োজনীয়তা, ধর্মকে সুরার সঙ্গে তুলনা (জাভেদ আখতার বেশ কয়েকবার এই তুলনা টেনেছেন তর্কে), তার হানাহানির ইতিহাস নিয়ে এমন প্রকাশ্যে মত বিনিময় ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় দলের সঙ্গে হওয়া সম্ভব?
প্রসঙ্গত, একটা ছোট গল্প বলা যাক। জনক রাজা বিদেহ একবার এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। সমস্ত ব্রাহ্মণদের সেখানে আমন্ত্রণ করে বলা হয় সবথেকে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে রাজা হাজারটি গরু ও দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দেবেন। এই প্রস্তাবে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য তার শিষ্যদের সমস্ত গাই নিয়ে যেতে বললে বাধা দেন বাকি শ্রমণরা। শুরু হয় এক দার্শনিক বাদানুবাদের। প্রায় আটটি স্কুল অফ থট, বা আটরকমের ভাবনার সঙ্গে যজ্ঞ, পৃথিবীতে প্রথম মানুষ, তার পরিযান, আত্মার প্রকৃতি, কীভাবে বিশ্ব তৈরি হল ইত্যাদি নিয়ে বিতর্কসভা চলতে থাকে। সেই সভায় গার্গী নামে এক মহিলাও অংশগ্রহণ করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হন যাজ্ঞবল্ক্য। বৃহদারণ্যক উপনিষদে বর্ণিত এই পর্বটি সর্ম্পকে ঐতিহাসিক উপিন্দর সিং বলেছেন যে, এর সত্যতা নিয়ে কথা বলা বাতুলতা, কারণ বেদ একটি ধর্মীয় টেক্সট, ইতিহাস নয়। আমরা জানি না যাজ্ঞবল্ক্য বা গার্গী নামে সত্যিই কোনও ব্যক্তি ছিলেন কিনা, এও জানি না এমন সভা বা পুরস্কারের ঘোষণা হয়েছিল কি না জনকরাজের পক্ষ থেকে। তবু এই ধরনের তর্ক বা বাকবিতণ্ডার বর্ণনা এটা প্রমাণ করে যে, প্রাচীনকালেও হয়তো ডিসেন্ট বা প্রচলিত, বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করার অবকাশ ছিল।
তথাকথিত আধুনিকতা এই তর্কের পরিসর হয়তো বাড়িয়েছিল। মিশেল ফুকো বনাম দেরিদা থেকে স্লাভোই জিজেক বনাম জর্ডন পিটারসন, বিশ শতক থেকে একুশ শতক জুড়ে এমন বিখ্যাত বেশ কিছু আন্তর্জাতিক তর্কের নিদর্শন আছে। এদেশেও কয়েক বছর আগে শশী কুমার বনাম সদগুরুর তর্ক আমরা দেখেছি। তবে, জাভেদ আখতারের সঙ্গে নদভির সাম্প্রতিক বিতর্কটি আপাতভাবে তাত্ত্বিক হলেও, বিষয়টি এই মুহূর্তের ভারতের নিরিখে যথেষ্ট সংবেদনশীল।
ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তর্কের প্রসঙ্গ উঠলে কিছু কথা উল্লেখ করতে হবে। ঈশ্বর কৃষ্ণের শঙ্খ করিকা, বিজ্ঞান ভিক্ষুর শঙ্খ প্রবচন ভাষ্য (যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে) বা বৌদ্ধ, জৈন বিবিধ গ্রন্থে, সরাসরি সৃষ্টিতত্ত্ব অস্বীকার করা হয়েছে বা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নকে সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হল, নাস্তিক (যদিও এই শব্দের মূলগত অর্থ, বেদকে সর্বজ্ঞানী না মানা, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী নয়) বা যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তাদের অস্তিত্ব যদি এই ভূ-ভারতে নতুন কোনও বিষয় না হয়ে থাকে, তাহলে আজকে ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে নাস্তিক আত্মপরিচয় এক উপহাস বা মশকরার মতো শোনায় কেন? যার গ্রহণযোগ্যতা একেবারে তলানিতে, যা নিয়ে সর্বসমক্ষে বলতে গেলে ভেবেচিন্তে বা সংখ্যালঘুর মতো আচরণ করতে হয়?
আবারও ফিরে আসি ২০ ডিসেম্বরে আয়োজিত বিতর্কসভাটিতে, যেখানে এক যুবা দর্শকাসন থেকে প্রশ্ন করেছিল যে, মেলা, উৎসব, পার্বণ ইত্যাদিতে যেতে সে অভ্যস্ত; কিন্তু নাস্তিক হয়ে পড়লে এই মেলামেশার পরিসর মিলবে কী করে? ছেলেটির এই প্রশ্ন যেন খুব মৌলিক এক জিজ্ঞাসা। ধর্ম না মানলে মানুষের সঙ্গে মিশব কীভাবে? ধর্মীয় চৌহদ্দির বাইরে বেরলে, সহজাতভাবে মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগও যে হারাব! সেই সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা আমায় দেবে কে? অর্থাৎ ঐকবদ্ধ হতে গেলে বোধ হয় একটা যৌথ বিশ্বাসের দরকার হয়। না-আস্তিক বা না-বিশ্বাস তো একটা নঞর্থক শব্দ, সেই নঞর্থকতার ভিত্তিতে একজোট হওয়া যায়? আসলে আমরা হয়তো প্রায়শই এড়িয়ে যাই যে ঈশ্বরবাদ বা ‘থিসম’ যেমন সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ করে (ঈশ্বরবাদী হয়েও হিন্দু, শিখ, মুসলিম, প্যাগান এদের সকলেরই পরম পিতা নিয়ে ধারণাগুলি আলাদা আলাদা), তেমনই নাস্তিকরাও পৃথক পৃথক কারণে ঈশ্বরে বিশ্বাসী হওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে। অর্থাৎ, নাস্তিকতারও বিভাজন আছে, অন্তত তাদের নাস্তিক হওয়ার প্রধান কারণগুলি আলাদা আলাদা। যেমন বার্ট্রান্ড রাসেল যেভাবে নাস্তিক, গণিত, বিজ্ঞান বা বিশ্লেষণমূলক দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সে-অর্থে বিংশ শতকের কমিউনিস্টরা নাস্তিক নন। একজনের মনে হতে পারে যে, সে চার্লস ডারউইনের তত্ত্ব মেনে বিজ্ঞানের ছাত্র, তাই তিনি নাস্তিক, অর্থাৎ, বিবর্তনই সত্য, মানবসভ্যতায় ঈশ্বরের অবদান নেই। অপর কারও মনে হয়, সে সমাজতান্ত্রিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী, শ্রেণিহীন সমাজে বিশ্বাসী এবং শ্রেণিচেতনার মূলে মহান ঈশ্বরের কোনও জায়গা নেই বলে সে নাস্তিকতায় বিশ্বাসী। গত শতকের ছয়ের দশকের পর থেকে সারা বিশ্বে হয়ে চলা নারীবাদী কর্মীরা বলতে পারে যে, সমস্ত ধর্মীয় গ্রন্থে যেভাবে নারী-নির্যাতনকে ন্যায্যতা দেওয়া হয়, সেই হেতু তারা নাস্তিক। ভারতীয় কোনও মহিলা মনুস্মৃতি বা লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ে দেখে অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলতে পারে যে, আমি আজ থেকে নাস্তিক, এই ধর্মের বার্তা যদি পরমপূজনীয় কোনও ঈশ্বর লিখে থাকেন, তা আমার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। কোনও দলিত বা আদিবাসী ভারতে দাঁড়িয়ে ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাভঙ্গিভাবে জড়িত জাতপ্রথার বিরোধিতা করতে গিয়ে নাস্তিকতা গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং নাস্তিক বললেই হল না, সকলের ব্যক্তিগত অবস্থান আলাদা আলাদা আর সেই পৃথকীকরণই হয়তো না-আস্তিক বা নঞর্থক শব্দের ভিত্তিতে যূথবদ্ধ হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয় না।
নাস্তিকতা একটি ব্যক্তিগত বিষয়, কিন্তু আস্তিকতা নয়। আস্তিক হলে তার ধর্মাচরণ আছে, পূজো-পার্বণ, মেলা, ঢাক-ঢোল, আড়ম্বর আছে। দশজনকে নিয়ে একসঙ্গে হওয়া বা সকলকে জানান দেওয়ার অজস্র পন্থা রয়েছে। নাস্তিকতায় এর কোনওটাই প্রায় নেই, আচার-অনুষ্ঠানের কথা হচ্ছে না, তা থাকবে না স্বাভাবিক, কিন্তু একত্রিত হওয়া? জনজীবনে নাস্তিকদের কোনও যূথবদ্ধ উপস্থিতি? এই ঐক্যবদ্ধতার কি কোনও প্রয়োজন আছে আজকের ভারতে? না কি ব্যক্তিগত মতামত বা আত্মপক্ষ সমর্থনই যথেষ্ট নাস্তিকদের কাছে?
দলিতদের বিশ্বাস নিয়ে যখন কথা হচ্ছেই, তখন বাবাসাহেব আম্বেদকরের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ নিয়ে কয়েকটি কথা বলা যেতে পারে। মনুস্মৃতির উল্টোদিকে নাস্তিকতার প্রচারও তো বেছে নিতে পারতেন বাবাসাহেব, কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম কেন? প্রথমত বোঝা দরকার যে, গৌতম বুদ্ধের মার্গ আদৌ কোনও ধর্ম কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। যেহেতু বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বর, মহাজাগতিক অস্তিত্ব বা বিশ্বের স্রষ্টা নিয়ে কোনও কথা বলা নেই, তাই এটি ধর্ম নয় বলে অনেকে মনে করেন। বুদ্ধের পাশে যদিও আমরা ধর্ম কথাটাই ব্যবহার করি এবং আম্বেদকরের ধর্মান্তরের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় চার লক্ষ দলিত বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। ঘোষিত নাস্তিকতার দৃষ্টান্ত সেই সময় থাকলেও (যেমন জওহরলাল নেহরু বা ভগৎ সিং) আম্বেদকরের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ দু’টি দিক নির্দেশ করে। এক হল, যদি কোনও প্রচলিত ধর্মে তিনি সকলের সমানাধিকারের আভাস পেয়ে থাকেন, তা ছিল বৌদ্ধ ধর্মে। নাস্তিকতার ভিন্ন ভিন্ন পন্থা থাকতে পারে, সেখানে দলিতদের হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে বাধা আসতে পারত। সবাই এক যুক্তিতে নাস্তিক হতে রাজি নাও হতে পারত। সেখানে একটি ধর্ম, যা জাতপাতের বিভেদ ঘটাচ্ছে না, তার ছাতার তলায় দলিত সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা সহজ। তাই হয়তো বাবাসাহেব বেছে নিয়েছিলেন ‘হেটেরোডক্স সেক্ট’ (‘অর্থোডক্স’ বা গোঁড়া আস্তিকতার উল্টোদিক) যেখানে দলিতদের ঐক্যবদ্ধ জীবন গড়ে তোলা সহজ এবং এক ছাতার তলায় তাদের নিয়ে আসা যায়, ঈশ্বর বা পরমপিতার কথা না বলেও।
ফলে বোঝা যায়, নাস্তিকতা একটি ব্যক্তিগত বিষয়, কিন্তু আস্তিকতা নয়। আস্তিক হলে তার ধর্মাচরণ আছে, পূজো-পার্বণ, মেলা, ঢাক-ঢোল, আড়ম্বর আছে। দশজনকে নিয়ে একসঙ্গে হওয়া বা সকলকে জানান দেওয়ার অজস্র পন্থা রয়েছে। নাস্তিকতায় এর কোনওটাই প্রায় নেই, আচার-অনুষ্ঠানের কথা হচ্ছে না, তা থাকবে না স্বাভাবিক, কিন্তু একত্রিত হওয়া? জনজীবনে নাস্তিকদের কোনও যূথবদ্ধ উপস্থিতি? এই ঐক্যবদ্ধতার কি কোনও প্রয়োজন আছে আজকের ভারতে? না কি ব্যক্তিগত মতামত বা আত্মপক্ষ সমর্থনই যথেষ্ট নাস্তিকদের কাছে?
আজ যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, নারীবাদী বা যে-কোনও প্রগতিশীল মানুষের ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ কথাটিকে অবলম্বন করে আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলা উচিত যে, যারা এই ঈশ্বরবাদকে হাতিয়ার করে দাঙ্গা করে, তাদের বিরুদ্ধে এই দল।
নাস্তিকতা মানে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো নয়, ধর্মের জিগির তুলে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রোখার পথ হতে পারে যুক্তিবাদ বা মানবতাবাদ। তবে যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্বের রাজনীতি ফিরে গেছে দশম শতাব্দীর ক্রুসেডের অবস্থায়; নারকীয় হত্যা, জমি দখল, দেশ থেকে উৎখাত বা যাবতীয় অভিবাসন সংক্রান্ত সমস্যার মূলে ধর্ম বা উগ্র এক জাতীয়তাবাদ, সেখানে দাঁড়িয়ে নাস্তিকতার সংজ্ঞা বা কার্যকারিতা নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত।
যদিও এই ভাবনা বা কর্মদ্যোগ নিয়ে খুব বেশি আশা রাখা যায় না। সম্প্রতি কলকাতায় এক নাস্তিক মঞ্চের আহ্বান করা হলে তার রিপোর্টিং বেরতে দেখা গিয়েছিল বাংলার জাঁদরেল সব পত্রপত্রিকায়। খানিক তির্যক মন্তব্য বা সমালোচনার সুরেই লেখা সেইসব প্রতিবেদন, যদিও পুরোটা পড়ে বোঝা গেল না কেন এই অসন্তোষ। জাভেদ আখতারের বিতর্ক আবারও সেই প্রশ্নকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে: নাস্তিকতা নিয়ে অত্যন্ত প্রগতিশীল বা ধর্মের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ না থাকা প্রতিষ্ঠানেরও এমন বিরূপ মনোভাব কী ধরনের রাজনীতি সামনে আনে? এই প্রশ্নের উত্তর এবং সর্বোপরি নাস্তিকতা নিয়ে আলোচনা, বিশ্লেষণ, তর্কবিতর্ক হয়তো একুশ শতকের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে, এক্ষেত্রে দরকার শুধু খানিক শুভবুদ্ধির।



