সংগীতের সেতু

Article on legendary singer and music composer Pankaj Mullick on his death anniversary by Kabir Suman.

পঙ্কজকুমার মল্লিক কেবল বাংলার নয়, আমি বলব, আসমুদ্রহিমাচল যে ভূমি, আরও বিশেষ করে বললে, অফিশিয়াল ভারত নয়, অবিভক্ত ভারত, হিন্দুস্তান— তার এক বিপুল প্রতিভা। পঙ্কজকুমার মল্লিককে নিয়ে একটি সংস্থা চালিয়েছেন বেঙ্গালুরুর এক মানুষ। কোনও বাঙালি কিন্তু ওঁকে নিয়ে কোনও সংস্থা তৈরি করেননি।

লতা মঙ্গেশকর মহোদয়া একটি ঋণস্বীকার অনুষ্ঠানে পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া একটি গান পুনরায় রেকর্ড করার আগে বলেছিলেন যে, আমাদের দেশে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব যিনি প্রথম এনেছেন এবং বরণ করে নিয়েছেন, তিনি পঙ্কজকুমার মল্লিক, আর কেউ নন কিন্তু। কাজেই পঙ্কজ মল্লিক একইসঙ্গে হিন্দুস্থানী সংগীত, বাংলার পল্লিগীতি এবং পাশ্চাত্য লঘুসংগীত, যাকে পপ সং বলে— তার আশ্চর্য মিলন ঘটিয়েছেন। পপ সং বলতে লোকে অন্যরকম কিছু ভাবে। কিন্তু পপ সং বলতে আমরা মূলত বুঝব আধুনিক গান, জনপ্রিয় গান।

আরও পড়ুন : যে-কারণে শ্যামল মিত্রর কণ্ঠ ছিল অনন্য! লিখছেন সোমনাথ শর্মা…

বিভিন্ন ছবিতে এই মেলবন্ধন তিনি বারবার ঘটিয়েছেন। আমাকে যেমন ভি বালসারা বলেছিলেন, ‘পিয়া মিলন কো জানা’ গানটির কথা। এই গানটি ‘কপালকুণ্ডলা’ ছবির গান। এই গান শুরু হওয়ার ঠিক আগে যে ছন্দের আভাস আমরা পাই, তাকে বলে ‘ক্যান্টর’। এই ছন্দ অনেকটা যেন ঘোড়ায় চড়ার ছন্দ। এই গানেই ক্যান্টরের যথাযথ প্রয়োগ করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, প্রথম। তারপর এই ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন নৌশাদ আলি, ‘আন’ ছবিতে। ‘দিল মে ছুপাকে পেয়ার কা’— এই গানে। পঙ্কজ মল্লিক থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে। একথা আমাকে ভি বালসারাই বলেছিলেন।

পঙ্কজ মল্লিক আধুনিক গানের মানুষ। তাঁর একটি গানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘চৈত্রদিনের ঝরা পাতার পথে’। কী অপূর্ব সেই গান!

শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে…

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল পঙ্কজ মল্লিকের সান্নিধ্য পাওয়ার। সাতের দশকের কথা। আকাশবাণী কলকাতার সরস্বতী বন্দনার অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং। সেখানে গীতিকার ছিলেন বাণীকুমার, সুরকার ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। সেই রেকর্ডিংয়ে, এমনকী, এই অধমও সুযোগ পেয়েছিল পঙ্কজকুমার মল্লিকের নির্দেশনায় গান গাওয়ার। একটি চার লাইনের গান তিনি আমার জন্য রেখেছিলেন। আমার গলা একটু ভারীর দিকে। সেজন্যই আমাকে এই সুযোগ তিনি দিয়েছিলেন। বলতে দ্বিধা নেই, আমার মনে হয়, একেবারেই ভাল গাইনি সেই গান। খুব বকুনিও খেয়েছিলাম, মনে পড়ে যায়। এটা বলা দরকার।

আমাকে যেমন ভি বালসারা বলেছিলেন, ‘পিয়া মিলন কো জানা’ গানটির কথা। এই গানটি ‘কপালকুণ্ডলা’ ছবির গান। এই গান শুরু হওয়ার ঠিক আগে যে ছন্দের আভাস আমরা পাই, তাকে বলে ‘ক্যান্টর’। এই ছন্দ অনেকটা যেন ঘোড়ায় চড়ার ছন্দ। এই গানেই ক্যান্টরের যথাযথ প্রয়োগ করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, প্রথম। তারপর এই ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন নৌশাদ আলি, ‘আন’ ছবিতে।

সামনে সেদিন বাঘের মতো বসে আছেন পঙ্কজ মল্লিক। যাঁর পরিচালনায় কিনা গান গেয়েছেন কে এল সায়গল-সহ বাঘা বাঘা গায়ক, আমার পিতৃদেব সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও রয়েছেন সেই তালিকায়। তিরিশ-পঁয়ত্রিশটা বাদ্যযন্ত্রে অর্কেস্ট্রা বাজছে। আমি সামনে যেন ছাগলের ছানার মতো কাঁপছি ভয়ে, থরথর করে, পঙ্কজদার দিকে তাকিয়ে। একটা করে টেক হচ্ছে। পঙ্কজদা বলছেন, এনজি, মানে নো গুড! আবার গাইছি, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আঠারোটা টেক হল এভাবে। উনিশ নম্বর টেক হবে। আমাকে পঙ্কজ মল্লিক বলে উঠলেন, ‘শোন, তোর বাবাকে কনডাক্ট করেছি আমি। তোকেও করছি। এরপর তোর ছেলেমেয়েদেরও কনডাক্ট করব। এখান থেকে মাত্র কিছু দূরে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি ছেলেমেয়েরা তাদের দেশকে স্বাধীন করার জন্য লড়ছে। আর তুই একটা বাঙালির ছেলে হয়ে চার লাইন বাংলা গান গাইতে পারছিস না!’

এমনই ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক!