উল্টোদিকে হাঁটা লোকটা

Article on Don Quixote on it's first publishing date by Suman Mukhopadhyay, who played Don in a Bengali play.

আমার মনে আছে, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে পড়ার সময় ডন কিহোতে আমাদের সিলেবাসে ছিল। তখন ডন কিহোতে সম্পর্কে খুবই আগ্রহ জন্মেছিল, নানারকম পড়াশোনাও করেছি ডন কিহোতে-সংক্রান্ত। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে যখন মিগুয়েল দে সেরভান্তেস ডন কিহোতে লিখছেন, তখন কিন্তু ডন কিহোতে-কে একজন ‘ইমপ্র্যাকটিক্যাল ম্যান’ বা ‘ইমপ্র্যাকটিক্যাল জোকার’ হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছিল। একধরনের ‘শিভালরি’ বা  ‘নাইটহুড’ বা মধ্যযুগীয় প্রথা তার আদর্শ। যে ধরনের সামাজিক অবস্থান বা প্রথাগুলো তখনও ছিল, নানা ভাঙাগড়ার মধ্যে সে তাই আঁকড়ে ধরছে।

এটাকে যদি তুলনামূলক আলোচনার মধ্যে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে দেখব, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের যেভাবে চলে যাওয়া সামন্ততন্ত্রর প্রতি একধরনের আনুগত্য, একধরনের করুণা ছিল। ‘জলসাঘর’ অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেও তা স্পষ্ট ছিল। সেই সময়টা চলে যাওয়া নিয়ে তারাশঙ্করের বিভিন্ন লেখায় একটা বিষাদ কাজ করেছে। নব্য সামন্ততন্ত্রকে তখনও তিনি আত্মস্থ করে উঠতে পারছেন না। ডন কিহোতের যে-ধরনের কীর্তিকলাপ, তার নারী সম্পর্কে যেমন দৃষ্টিভঙ্গি, যেভাবে সে হাওয়াকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে— এই সবকিছুই আসলে এক সামাজিক স্তরে বদলের প্রেক্ষিতে পুরনো সবকিছুকে আঁকড়ে ধরা। এক কল্পনার জগতে উড়ান দিচ্ছে সে। পৃথিবী যেভাবে সময়কে দেখছে, ডন কিহোতে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। কাজেই, ডন কিহোতে-কে নিয়ে একধরনের ‘গ্রোটেস্ক’ মজা করতে চেয়েছিলেন সেরভান্তেস।

আরও পড়ুন : রিলকের অলৌকিকতাকে আমরা কতটুকু চিনেছি? লিখছেন অভীক মজুমদার…

কিন্তু পরবর্তীকালে, অষ্টাদশ শতকে, যুক্তিবাদ বা যৌক্তিকতাবাদের উত্থান এবং বিজ্ঞানের রমরমার পর দেখা গেল, যা কিছু যুক্তিগ্রাহ্য নয়, যুক্তিপটের বয়ানের সঙ্গে যা খাপ খাচ্ছে না, সেই পরিসরে যা পড়ছে না— তাই বাতিল হয়ে গেল। সেখানে কল্পনাকেও একইভাবে খারিজ করা হল। ব্যাপারটা এমন, অনেক মধ্যযুগীয় কল্পনা হয়েছে, এবার আমরা সত্যের ভূমিতে আসি। কোপারনিকাস আসছেন, গ্যালিলিও আসছেন। তখন কিন্তু ডন কিহোতের ভূমিকাকে পাগলামি বলেই মনে করা হচ্ছে। সেরভান্তেস সেসময় সমাজকে ব্যঙ্গ করছেন। এবং ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই দিয়ে তাঁকে কয়েদখানায় পুড়ে দেওয়া হচ্ছে।

আমাদের নাটক, ‘চেতনা’-র প্রযোজনা ও সুজন মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘ডন তাকে ভাল লাগে’ শুরু হয়েছিল সেরভান্তেসের এই জেলে যাওয়ার ঘটনা থেকেই। আমি সেই নাটকে ডন বা সেরভান্তেসের চরিত্রে অভিনয় করি। সেরভান্তেসই সেখানে ডন হয়ে ওঠে।

‘ডন তাকে ভাল লাগে’-র একটি দৃ্শ্যে সুমন মুখোপাধ্যায় ও অরুণ মুখোপাধ্যায়

কিন্তু এখন, ডন কিহোতে-র এই পাঠটাই বদলে গিয়েছে। এই উপন্যাস যখন ব্রডওয়ে মিউজিক্যাল হয়েছে, ‘ম্যান অফ লা মাঞ্চা’ নামে, বা পরেও, ডনকে কিন্তু আর ব্যঙ্গ করা হয়নি। বরং তাঁর এই স্বপ্ন দেখাকেই উদযাপন করা হয়েছে। ‘স্বপ্ন অসম্ভবকে স্বপ্নে ধরা’— এটাই হয়ে উঠল মূল স্বর। এই লোকটাকে নিয়ে মজা করা হয়েছিল, ব্যঙ্গ করা হয়েছিল, ক্রিটিকাল ভঙ্গিতে দেখা হয়েছিল এই মর্মে যে, লোকটা উল্টোদিকে হাঁটে, আমাদের মতো সোজা সে হাঁটে না। এই নিজেকে উল্টো করে দেখা, উল্টো হাঁটাটাকে এবার সোজা করে দেখা হচ্ছে, অর্থাৎ সমালোচনার, তামাশার দৃষ্টিভঙ্গিকে সরিয়ে রেখে, খানিক যেন রোমান্টিসাইজই করা হচ্ছে।

এখন, ডন কিহোতে-র এই পাঠটাই বদলে গিয়েছে। এই উপন্যাস যখন ব্রডওয়ে মিউজিক্যাল হয়েছে, ‘ম্যান অফ লা মাঞ্চা’ নামে, বা পরেও, ডনকে কিন্তু আর ব্যঙ্গ করা হয়নি। বরং তাঁর এই স্বপ্ন দেখাকেই উদযাপন করা হয়েছে। ‘স্বপ্ন অসম্ভবকে স্বপ্নে ধরা’— এটাই হয়ে উঠল মূল স্বর।

‘আমার কিন্তু স্বপ্ন দেখতে আজও ভাল লাগে’— কবীর সু্মনের ভাষায় বললে। যে পৃথিবীতে মানুষ আর স্বপ্ন দেখতে পারছে না, স্বপ্ন দেখার পরিসরটাই পাচ্ছে না, যে স্বপ্ন একসময় সমাজবাদ দেখিয়েছিল, বা হয়তো কোনও আদর্শ দেখিয়েছিল— সেইসব স্বপ্ন, সেইসব বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ভেঙে পড়তে পড়তে ধ্বস্ত এক সমাজের সামনে এসে আমরা দাঁড়ালাম। সেইখানে দাঁড়িয়ে সেইসব স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলার জন্য ডন কিহোতেকে আবার ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন পড়ল যেন। কারণ, পাগলামি, উন্মাদনারই অভাব পৃথিবীতে। তাই উন্মাদকে আবার জাগিয়ে তোলো।

‘ডন তাকে ভাল লাগে’-র দৃশ্যে

ধরা যাক নবারুণ ভট্টাচার্যর গল্পে এবং আমার ছবিতে হারবার্টের চরিত্র যেভাবে এসেছে, সেই হারবার্টকে কিন্তু চেনা যায় না সহজে। এই যে চেনা যায় না, এই চেনা না যাওয়াটাকে একসময় হয়তো রসিকতাই করা হয়েছে, এখন কিন্তু এই চিনতে না পারাটাকেও একটা স্থান দেওয়া হচ্ছে, একটা এজেন্সি দেওয়া হচ্ছে। এই না-চেনাটাকেও পাঠ করতে শেখার কথা বলা হচ্ছে। এই না-চেনাটাকে ফেলে দেওয়ার বিরোধিতা হচ্ছে। যেজন্য হারবার্টের সঙ্গে শেষত দ্বন্দ্বটা হয় যৌক্তিকতাবাদীদের, কারণ সে কীভাবে মৃতের সহিত কথোপকথন করছে, তা নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলে। কিন্তু পরে এমন চিন্তকরাও এসেছেন, যাঁরা কিন্তু আবার এই যুক্তিপাঠের বাইরে থাকা পরিসরকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এখন পাঠের নতুন বন্দোবস্তও করা হচ্ছে। ঔপনিবেশিক একবগ্গা দৃষ্টি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা চলছে।

‘ডন তাকে ভাল লাগে’-র আগেও, যখন ‘দুখীমুখী যোদ্ধা’ হয়েছে ডন কিহোতে অবলম্বনে, তখন সোভিয়েত ভেঙে পড়া, বার্লিন দেওয়াল ভেঙে পড়ার প্রেক্ষিতেই তা করা হয়েছে। স্বপ্নগুলো ভেঙে পড়েছে, সেই স্বপ্নগুলো আবার কুড়িয়ে নাও, তুলে ধরো। ডন কিহোতে-কে উপন্যাসে যেভাবে দেখা হয়েছিল, সেখান থেকে তার অবস্থানটা বদলে গেল। উল্টোদিকে যে হাঁটত, তাকে এককালে ব্যঙ্গই করেছি। এখন সেই উল্টোদিকে হাঁটা লোকটাকেই যেন আমরা খুঁজে চলেছি।