‘শ্রমলব্ধ নীরবতা’র মিত্র

An article on most famous Bengali singer and composer Shyamal Mitra on his birth anniversary, written by Somnath Sharma.

শ্যামল মিত্র কেমন শিল্পী— এই কথার পিঠে হাজার কথা বলতে পারেন অনেকে। গিরীশ পার্ক হয়েই যাক বা আমহার্স্ট স্ট্রিট— যে-বাসের গন্তব্য ধর্মতলা, তা ধর্মতলায় যাবেই। অর্থাৎ, বড় শিল্পী। এ নতুন করে বলতে হয় না আর। কেন যে বড় শিল্পী, তা চিন্তার রকমফেরে নানা লোকের কাছে নানা রকম। কেন যে শ্যামল মিত্রকে মনে রাখি, কেন যে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে কখনও শ্যামল মিত্রকে আনি বা কেউ এনে ফেললে এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করে আরেকবার একসঙ্গে, সেইটা বরং বলা যাক। শ্যামল মিত্রের চলে যাবার ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছর বাদেও যে কোথাও শ্যামল মিত্র কথাপ্রসঙ্গে বিদ্যুতের তার ছেঁড়ার আগের স্পার্কের মতো উঠে আসছেন, তা শুনে যাঁদের বয়স ষাট পেরিয়েছে, মুচকি হেসে হয়তো বলে ফেলতে পারেন, শ্যামলের কী সৌভাগ্য! সেই বক্রোক্তি শ্রোতার গলায় অলংকার আর কি!

বাঙালির ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, শচীন-সৌরভ, ঋত্বিক-সত্যজিৎ, উত্তম-সৌমিত্র, হেমন্ত-মান্না সবই আছে। কিন্তু শ্যামল আসলে ওঁদের সবার মিত্র, শ্যামল ওই ডুয়েলে ফুয়েল জোগান না! কেননা শ্যামল যখন গান, ‘ওই আকাশ নত/যুগে যুগে সংযত/নীরবতায় অবিরত/কথা বলে গেছে কত…’, তখন লড়াই নিয়ে বড়াই করার সময় থাকে না। শ্যামল মিত্র ঠিক ওই অংশটুকু গেয়ে আমাদের চুপ করিয়ে দেন, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত কবিতায় যাকে বলবেন ‘শ্রমলব্ধ নীরবতা’। খুঁজে-টুজে দেখা গেল, এ-গানটা ১৯৬৩ সালের। রাওলাট আইন-অসহযোগ আন্দোলনের সাল মনে রাখার মতো ১৯৬৩ সাল মনে থেকে গেছে ‘দেয়া নেয়া’-র জন্য। স্কুলে যেরকম দেওয়া হত, মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি লেখো— ওইরকম পয়েন্ট করে ‘দেয়া নেয়া’ পছন্দ হবার কারণ লেখা যায়। তার অনেকটাই অবশ্যই শ্যামলকেন্দ্রিক। অত ভাল-ভাল গানের মধ্যে একটা অংশের উল্লেখ না করা অপরাধের সামিল। ‘দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা’ হয়ে-টয়ে গেছে, পরদিন সকালে একেবারে ভোর হব-হব, চাঁদ দেখা যাচ্ছে, চাঁদের আলো নদীর জলে পড়েছে, উত্তমকুমার তানপুরা নিয়ে রেয়াজ করছেন, শ্যামল মিত্রর গলায় রাগ ভাটিয়ার। তরুণকুমার পাশের ঘর থেকে বিছানায় শুয়ে শুনছেন।

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং উত্তমকুমারের সঙ্গে শ্যামল মিত্র

একজন শ্যামল মিত্র, একটা ভাটিয়ার রাগ, এগুলো বীজগণিতের সূত্রের মতো; একটা মনে রাখলে অনেক অঙ্ক করা যায়। ‘দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা’ গানটা সম্পর্কে, একটা জানা কথা আরেকবার আউড়ে যেতে হয়, অত ভাল ডুয়েট খুব কম হয়েছে। যেমন দুই ভাই, এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ, তেমনই শ্যামল মিত্র-মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়— যথেষ্ট শক্ত গান হওয়া সত্ত্বেও গানটার মধ্যে একটা অদ্ভুত সারল্য আছে, যার জেরে গানটা আজকেও পুরনো বলে মনে হয় না।

আরও পড়ুন : মৌলিকত্বের সন্ধানে সেতারে মোটা তার ব্যবহার করেছিলেন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়…

আবার এই শ্যামল মিত্র যখন গান, ‘এলোমেলো হাওয়া হারিয়ে যেতে চায়’— তখন মনে হয় ‘পলাতক’ ছবির অনুপ কুমারের চরিত্রটা যেভাবে তরুণ মজুমদার সৃষ্টি করেছিলেন, তার স্পিরিট যেন গানটায় ধরা আছে। এই গানটার সঙ্গে অবধারিতভাবে যে-গান আমার মনে আসে, ‘এই রাত, এ-আকাশ, এ-বাতাস আর তুমি কাছে থেকো’। কেন জানি না, এই দুটো গান আমি পর পর শুনি।

শ্যামল মিত্র বলতেই মনে পড়ে ইলা বসুর গলায়, ‘তোমারেই বেসেছি ভাল’। কী যে ভাল সুর, কী ভাল গাওয়া— এই সুর, এই সব গাওয়া শুনতে-শুনতে আসলে এই গানগুলোর ‘কথা’-তে যে গুচ্ছের দুর্বলতা, গুরুচণ্ডালি দোষ, বা শ্যামল মিত্র যে ‘চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন’-এ ‘চেইয়ে চেইয়ে’ গেয়েছেন, সেগুলো কিছুই মনে থাকে না। লিখতে বসে নাম্বার কাটার ভয়ে একবার স্বীকার করে উল্লেখ করে যেতে হয়, শুনতে গিয়ে কানে লাগে ঠিকই, কিন্তু গানগুলোর সুর আর গায়কি অনবদ্য বলে সেগুলোই বেশি মনে থাকে। ইলা বসু, বাসবী নন্দী, প্রতিমা ব্যানার্জি, সন্ধ্যা মুখার্জি, সতীনাথ মুখার্জি, হেমন্ত মুখার্জি— এঁরা সবাই শ্যামল মিত্রের সুরে গেয়েছেন। শ্যামল মিত্র নিজে সুরকার হিসেবে পেয়েছেন সুধীরলাল চক্রবর্তী থেকে নচিকেতা ঘোষ থেকে সুধীন দাশগুপ্ত, রতু মুখোপাধ্যায়-সহ দিকপালদের।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শ্যামল মিত্র

গানগুলো যখন বেরোয় আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে, গানের গুণে বা সময়ের গুণে সেগুলো সেই সময়ের ফসল হিসেবে হিট বলে মনে হয়েছিল। অত কাছ থেকে যেহেতু ইতিহাস বিচার করা যায় না, তাই আমাদের এই আজকের এই সময়টাই উৎকৃষ্ট, যখন গানগুলোর আয়ু নিয়ে কথা বলবার একটা অবসর তৈরি হয়েছে। এখনও প্রতিদিন কোনও-না-কোনও রেডিও চ্যানেলে দিনে একটা হলেও শ্যামল মিত্রের, হেমন্ত মুখার্জির, প্রতিমা ব্যানার্জির গান বাজে। নিশ্চয়ই তার একটা শ্রোতা আছে, যত অল্পই হোক। ফলে বোঝা যায়, যে-বাজার নির্ধারণ করে আজকে সব কিছু, সেই বাজারের একাংশ শ্যামল মিত্র বা মান্না দে-র বাংলা গানের জন্যও বরাদ্দ রেখেছে।

যখন শ্যামল মিত্রকে মনে পড়ে, আসলে শ্যামল মিত্রকে একা মনে পড়ে না; মনে পড়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, অলোকনাথ দেকে, ভি বালসারা, ওয়াই এস মুলকি-দের। যে-সময়ে শ্যামল মিত্র একের পর এক আধুনিক গান আর সিনেমার গান গাইছেন, ওই একই সময়ে শ্যামল মিত্র গাইছেন রম্যগীতির গান। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্ররা বেশ কিছু রবীন্দ্রনাথের গান গাইলেন। একদিন শুনলাম শ্যামল মিত্রর গলায়, ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে’— গানটা ঢুকে গেল ভেতরে; আরেকটা চিত্রকল্প ভেতরে ঢুকে গেল, ‘রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের পরে, নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে’।

শব্দকে ব্রহ্ম বলে। শিবরাম চক্রবর্তী বলেছিলেন, একটা word আসলে world; কিন্তু শব্দের সমস্যা হচ্ছে, এই লেখার শব্দসংখ্যার পাঁচ গুণ লিখলেও শ্যামল মিত্র যে কত বড় গায়ক এটা লিখে বোঝানো অসম্ভব। তার জন্য গানগুলোর দ্বারস্থ হতে হয় আমাদের। তেতো দিন উতরে যায়। আজকেও যায়…