মানবিক ক্রাইম থ্রিলার

সমালোচনা— ওয়েব সিরিজ: ‘আনবিলিভেবল’
মুখ্য চরিত্রে— টোনি কোলেট, মেরিট ওয়েভার
পরিচালক— লিসা চলোডেঙ্কো (পর্ব ১, ২, ৩), মিখাইল ডিনার (পর্ব ৪, ৫, ৬),

সুসানা গ্র্যান্ড (পর্ব ৭, ৮)

মহিলা দু’জন, দু’রকম। একজন কঠিন ও রুক্ষ, একজন পেলব ও শান্ত। মিল একটাই জায়গায়। দু’জনেই গোয়েন্দা। থাকে আমেরিকার দুটি শহরে। এদের কাছাকাছি নিয়ে আসে ভিন্ন ভিন্ন শহরের বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ধর্ষণের ঘটনা। যেহেতু শহরের মধ্যে দূরত্ব অনেক, তাই এক শহরের ধর্ষণের ঘটনার খবর, অন্য শহরে পৌঁছয় না। কিন্তু যে-গোয়েন্দাটি শান্ত, নাছোড়, এবং দুই সন্তানের মা— সে তার তদন্তাধীন ঘটনার সঙ্গে হঠাৎ করেই অদ্ভুত মিল পেয়ে যায় অন্য এক শহরে অন্য এক ধর্ষণের ঘটনার। তখন সে, অর্থাৎ কারেন ডুভাল (এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন মেরিট ওয়েভার) দেখা করতে যায় দুঁদে, পোড় খাওয়া আপাত-রুক্ষ স্বভাবের গ্রেস রাসমুসান (টোনি কোলেট)-এর সঙ্গে। দু’জনেই অত্যন্ত অস্থির হয়ে আছে একটাই কারণে: সিরিয়াল রেপিস্টটি ধরা পড়ছে না। দুটি ধর্ষণের মধ্যে মিল কোথায়? ধর্ষণের কোনও প্রমাণ নির্যাতিতা দিতে পারছে না। কোনও রকম চিহ্ন নেই, কোনও হাতের ছাপ নেই, কোনও রকম মেডিক্যাল পরীক্ষার সুযোগ নেই। যতক্ষণ না ধর্ষণের সব প্রমাণ মুছে যাচ্ছে, ধর্ষকটি অপেক্ষা করছে, এবং তার পর উধাও। আবার অন্য কোনও ধর্ষণ, অন্য কোনও শহরে। দুই ভিন্ন স্বভাবের মহিলা তখন রাজি হয়, এই অপরাধীকে ধরার জন্য, একসঙ্গে কাজ করতে। 

দুই গোয়েন্দা

সিরিজের শুরুতে আমরা দেখি একটি নাবালিকার ধর্ষণ হয় এবং সে প্রমাণ দিতে অক্ষম হয়, তাকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করা হয় এবং তার কেসটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং প্রায় বাধ্য হয়েই সে স্বীকার করে, সে মিথ্যে কথা বলেছিল। এর পর অন্য শহরে কারেন একই রকম ধর্ষণের ঘটনা তদন্ত করতে যায়। এবং প্রমাণ না পেয়ে হতাশ হয় বটে, কিন্তু হাল ছাড়ে না। আর ধর্ষিতাকে দেখে, তার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে, সে তার কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে এবং দোষীকে ধরতে উদ্যত হয়। 

এবং এইখান থেকে শুরু হয় আশ্চর্য এক মানবিক ক্রাইম থ্রিলার। যে থ্রিলারে আমরা দেখি, একটা অপরাধের ঘটনায় কেবল তথ্যপ্রমাণ নয়, খুনির মানসিকতাও বুঝতে হয় এবং সমব্যথী হতে হয় নির্যাতিতা বা নির্যাতিতর সঙ্গে। আরও দেখি, প্রমাণ কেবলমাত্র দগদগে হয়ে কোণের টেবিলে, বাগানের ঝোপে কিংবা আলমারির পেছনে ঘাপটি মেরে বসে থাকে না, উদ্ঘাটিত হওয়ার অপেক্ষায়। প্রমাণ খুঁজতে হয় খুনির ফুলপ্রুফ প্ল্যানের মধ্যে। খুনি কী কী উপায়ে বাঁচতে পারে সেই ফাঁক-ফোকরগুলি উপেক্ষা করলে চলে না। আরও আছে।

তদন্ত চলছে

কী আছে? আছে এক ভাবে লক্ষ্যে স্থির থাকার জেদ, সঙ্কটে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রাখার অভ্যেস। তুচ্ছ কোনও জিনিসেও গুরুত্ব আরোপ করার মনোযোগ। এবং শুনতে ক্লিশে লাগলেও, এই সিরিজ আমাদের দেখিয়ে দেয়, কেবল পুরুষ দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট নয়, অপরাধী ধরার ক্ষেত্রে বা অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে। এও দেখায়, শুধু  ভাবভঙ্গি আর পোশাকে স্মার্ট হলে চলে না, বুদ্ধিতে ক্ষুরধার হতে হয়। হতাশ হওয়ার পরও জোর করে মনোবল সংগ্রহ করে এগিয়ে যেতে হয় এবং অন্যদের মোটিভেট করতে হয়। যেখানে কিছুটি পাওয়ার আশা নেই, সেখানেও ওৎ পেতে থাকতে হয়, যদি বা মেলে পরশপাথর। আরও দেখাল, স্বভাবের বৈপরীত্য থাকলেও এক উদ্দেশ্য হলে এক সঙ্গে থাকা যায়, কাজ করা যায়। আর ভাঙল: এক জনের বাইরেটা দেখে চটজলদি রায় দেওয়ার প্রবণতাও।

অভিযোগ দায়ের। সুরাহা?

আসলে এই সিরিজটা কিছু প্রমাণ করতে চায়নি। চেয়েছে অন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটা সমাজকে বিশ্লেষণ করতে। আপাত উদারমনস্ক সমাজ যে আসলে ভেতর থেকে এখনও উদার হয়নি, এখনও পিতৃতন্ত্রের ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসেনি, সেটা দেখাতে। এবং এও বোঝাতে, একই রকম চোখে দেখে চলার মানসিকতা কেবল যে মেয়েদের পক্ষে ক্ষতিকর তা-ই নয়, একটা সমাজের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও বিরাট প্রতিবন্ধক। 

বিশেষ ভাবে মনে থাকে সিরিজের শেষ দৃশ্যটি। যখন অপরাধী বয়ান দিতে তৈরি হয় এবং বলে, সে তার পদ্ধতিগুলি বলে দেবে, যাতে পুলিশ পরবর্তী কালে অন্যান্য ধর্ষকদের তাড়াতাড়ি ধরতে পারে। কিন্তু সে এই দুই মহিলা গোয়েন্দার কাছে বয়ান দিতে অস্বীকার করে। বলে, তার মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে, আলোচনা করতে অসুবিধে আছে। সে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে। আর ঠিক এখানেই এই সিরিজের জিত, কিচ্ছু না বলে, অনেকটা মন্তব্য করে যায়, আয়না তুলে ধরে দর্শকের মুখের সামনে।