মনডে ব্লুজ : পর্ব ৫

Weekly Coloumn Monday Blues Episode 5 by Rwitobroto Mukhopadhyay, young actor in tollywood.

থার্ড বেল

আলাদা করে নির্দিষ্ট কাজের দিনের শুরু বা সোমবারের মতো একটা দিন অন্তত আমার ক্ষেত্রে নেই, যেহেতু আমি ধারাবাহিকে অভিনয় করি না, আপাতত। যাঁরা ধারাবাহিকে কাজ করেন, তাঁদের অনেক ক্ষেত্রে রোববার দিনটা ছুটি থাকে। আর শহরে যে কোনও শুটিং হলে দ্বিতীয় রোববারটা ছুটি থাকে সাধারণত। দুশো কিলোমিটার পেরিয়ে গেলে সেটাও আবার প্রযোজ্য নয়। ফলে, ধারাবাহিকের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একটা রবি-সোম হয়তো আছে, আমার ক্ষেত্রে তেমনটা নেই, যেমন অনেক পেশাতেই নেই।

আমার যেটাই কাজের দিন, তা সোমবার হোক বা সপ্তাহের অন্য কোনও দিন, সেটার দিকে আমি উৎসাহভরে তাকিয়ে থাকি। কারণ এমনিতেই আমাদের কাজের দিন কম। খুব কম অভিনেতার কথাই শোনা যায়, যাঁরা সারা বছর কাজ করে চলেছেন। আবারও, ধারাবাহিকের বাইরের কথা বলছি। জনপ্রিয় অভিনেতাদের ক্ষেত্রে, অথবা অনেকরকম চরিত্রে যাঁরা খাপ খেয়ে যান, তাঁদের ক্ষেত্রে হয়তো কখনও কখনও সারাবছরই অভিনয়ের একটা রুটিন থাকে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সারাবছর একজন অভিনেতার অভিনয় করা উচিতও নয়, তাতে নিজের চর্চাটাই হয়তো ব্যাহত হয়। শুনতে খুব শৌখিন মনে হতে পারে কথাটা, কিন্তু শৌখিনতার জন্য বলা নয়। নিজস্ব অনুশীলনের জন্যই বলা।

আমার জীবনটা আপাতত পুরোটাই কাজ সংক্রান্ত। আমি কাজকে কেন্দ্রে রেখেই তারপর আশপাশে যা করার করি। অবশ্যই, আমার কাছে বন্ধুবান্ধব, পরিবার, নিজের জন্য সময় কাটানো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা কাজ নষ্ট করে নয়, বা কাজ ভুলে গিয়ে নয়। কাজের পরিসরটা ঠিক থাকলে তবেই আমার আশপাশের সবকিছু ঠিক থাকে।

আরও পড়ুন : উনিশ শতকের শিশুপাঠ্য বইগুলি ছিল সোমবারের, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এলেন রবিবারের বই! পড়ুন জয়দীপ ঘোষের কলমে মনডে ব্লুজ পর্ব ৪…

কাজে যাওয়ার আগেরদিন থেকেই আমার একটা প্রস্তুতি থাকে, উৎসাহ থাকে, আগ্রহ থাকে। সেটা ছবির শুটিং হোক, সিরিজের শুটিং হোক, ডাবিং বা রেকর্ডিং হোক, কোনও একটি নাটকের রিহার্সাল শুরু হবে নতুন করে, বা নাটকের শো-এর আগের দিন— সবক্ষেত্রেই আমার একটা আনন্দ থাকে, উৎসাহ থাকে। এমনিতেই আমাদের এখানে কাজ কম, তাই আলসেমিকে উপভোগ করার কোনও অবকাশ থাকে না।

উৎসাহ যেমন হয়, উৎকণ্ঠাও হয়। আমি যেন ঠিক সময়ে পৌঁছই, যেন সবকিছু প্রস্তুত করে রাখি, এইটা নিয়ে সবসময় একটু ভাবনায় থাকি। আমার যেন দেরি না হয় পৌঁছতে, আমার জন্য যেন কেউ অসুবিধেয় না পড়ে, এই ভাবনাগুলো মাথার মধ্যে সর্বক্ষণ কাজ করে চলে। খুব সকালে কলটাইম থাকলে রাতে ঠিক করে ঘুম হয় না। ছোটবেলা থেকেই আমি নানারকম উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখতাম, দুঃস্বপ্নই বলা যায়। ধরা যাক, কোনও নাটকের শো-এ ঢুকছি, থার্ড বেল পড়ে গেছে, কোনও একটি সিনে আমি হয়তো ঢুকতে পারিনি, দেরি হয়ে গেছে বলে গোটা ইউনিট হয়তো বসে আছে আমার জন্য— এমন নানাবিধ স্বপ্ন। এসব ভেবেই আমি একটু বাড়তি তৎপর হয়ে থাকি। তাই খুব সকালের কলটাইম হলে আমার ঘুম হয় ছেঁড়া-ছেঁড়া। যথাস্থানে পৌঁছে কাজ শুরু না করা অবধি ভেতরে এই উদ্বেগটা থেকেই যায়। আমি নিজের প্রস্তুতি নিয়েও সচেতন থাকার চেষ্টা করি সেজন্য। এই দুটো বোধই আমার সমান্তরালে কাজ করে চলে, ছুটি কাটিয়ে কাজ শুরুর আগে।

উৎসাহ যেমন হয়, উৎকণ্ঠাও হয়। আমি যেন ঠিক সময়ে পৌঁছই, যেন সবকিছু প্রস্তুত করে রাখি, এইটা নিয়ে সবসময় একটু ভাবনায় থাকি। আমার যেন দেরি না হয় পৌঁছতে, আমার জন্য যেন কেউ অসুবিধেয় না পড়ে, এই ভাবনাগুলো মাথার মধ্যে সর্বক্ষণ কাজ করে চলে।

আমাদের কাজে ছুটির ধারণাটা খুবই পরিবর্তনশীল। হয়তো বারো দিন শুটিং হল, তারপর একটা বিরতি, বা শুটিং শেষের পরের ছুটি, বা কোনও একটি নাটকের রিহার্সাল টানা দু’মাস হল, তারপর একটা ছুটি বা শো হয়ে যাওয়ার পরের ছুটি— এমন নানারকম। তাই কাজ করার সময় সময়ের হিসেবটা গুলিয়ে যায়। টানা অনেকদিন শুটিং করার পর যেমন আগামিকাল কী দিন, খেয়াল থাকে না বহু সময়। আবার যখন রুটিনমাফিক শুটিং হয়, আউটডোরে হলে হোটেলে, এখানে হলে বাড়িতে ফিরে কিছুটা নিজের মতো সময় কাটানোর সুযোগ থাকে, তখন ওই কাজের রুটিনটাতেই মনোযোগটা দিয়ে রাখি, বাকি আর কোনওদিকে তখন তাকাই না।

আমার কখনওই মনে হয় না, ছোটবেলা বা ছাত্রজীবনটা ফিরে এলে বেশ হত! আমি খুবই উপভোগ করেছি আমার শৈশব, কৈশোর বা কলেজবেলা। কিন্তু সেখানে আর ফিরে যেতে চাই না। এমন নয় যে, ছাত্রজীবনেও প্রভূত ছুটি ছিল। ক্লাস, পরীক্ষা, ছুটি, তারপর আবার ক্লাস, পরীক্ষা… এই আবর্তেই তো জীবনের এক চতুর্থাংশটা কেটেছে! আর আমি অনেকটা ছোটবেলা থেকেই কাজ করে যাচ্ছি। তাই ওই টানটা যেন ভেতর থেকে আসতে চায় না। আমার ক্যাম্পাসে গিয়ে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করতে, আড্ডা মারতে ভালই লাগে, কিন্তু কিছুতেই আর ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না।

আমার কাজ আর ছুটি, রবি-সোম মিলেমিশেই থাকে। কোনও অভিযোগ নেই তাই!