গণতন্ত্রের দোহাই…
সারারাত, প্রায় জনমানবশূন্য, ঝকঝকে সাদা— সমস্তিপুর স্টেশনে কাটিয়ে, ভোরবেলা আমরা ট্রেনে রক্সৌল রওনা হলাম। ন্যারোগেজের ট্রেন, দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেনের মতো। কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে, বোটানির এক্সকারশনে আমরা আগেই দার্জিলিংয়ে গিয়েছি, টয়ট্রেনের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। উত্তর বিহারের এই টয়ট্রেনেও, মন উৎফুল্ল হল।
বিশেষত, আসন্ন হিমালয়ের প্রভাবে— উত্তর বিহারের ঢেউ খেলানো জমির ওপর, গাছগাছালির ফাঁকে-ফাঁকে ভোরের আলোয় যখন ফুটে উঠছিল, ছোট-ছোট এক-একটি শহর, গঞ্জের রেল স্টেশন, অদূরে রাস্তায় লোকজনের দিনশুরুর ব্যস্ততা, চায়ের দোকান থেকে উনুনের ধোঁয়া ছড়িয়ে যাচ্ছিল খেতিতে, দূরে-দূরে— গাছগাছালির ফাঁকে গ্রাম…ভারী ভাল লাগছিল তখন।
প্রসঙ্গত, সমস্তিপুর থেকে রক্সৌল যাওয়ার ন্যারোগেজটি, এখন ব্রডগেজ হয়ে গিয়েছে। উত্তর বিহারের ওই টয় ট্রেন আর নেই। এখন হাওড়া থেকে সরাসরি— ট্রেনে রক্সৌল যাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘ছেঁড়া তমসুক’ ছবিটিতে এমন একটি কবিসম্মেলনের দৃশ্য রয়েছে, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অসামান্য উপস্থিতি তাতে। লিখছেন মৃদুল দাশগুপ্ত…
তা তখন, সেই ১৯৭৫ সালে, অবিস্মরণীয়— উত্তর বিহারের টয়ট্রেনে, সমস্তিপুর থেকে রক্সৌল যাওয়ার সময়ে, ছোট- ছোট শহর, গ্রামগঞ্জের রেল স্টেশনগুলিতে ভোরের আলোয় দেখেছিলাম, নকশালপন্থীদের দেওয়াল লিখন। নকশালবাড়ির জয়ধ্বনির সঙ্গে দেখেছিলাম, কোনও এক মাস্টারজিকেও, লালসেলাম জানানো হয়েছে সেসব লিখনে।
কে তিনি, ওই মাস্টারজি— ঢিকি ঢিকি ছোটা, ছোট ট্রেনটিতে বসে ভেবেছিলাম খুব। ১৯৭৫ সালে, তখন, কারাগারগুলিতে বন্দি হাজারো তরুণ, গণহত্যা, জেলে-জেলে বন্দিহত্যা— পশ্চিমবঙ্গে নকশালপন্থী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বিহারে ছড়িয়ে গিয়েছিল সে-ঢেউ। তৎকালে, উত্তর বিহারের ঢেউখেলানো ভূমির ওপর দিয়েই দুলতে-দুলতে গিয়েছিল আমাদের ওই টয়ট্রেন।
ভোরের টয়ট্রেন ১০-টা/সাড়ে ১০-টার ভেতরে, আমাদের পৌঁছে দিল সীমান্তের রক্সৌল স্টেশনে। আমি, উদয়, শুভ্র, আশিস, জয়, সবাই তিনটি রিকশয় ভারত সীমান্ত পেরিয়ে, ঢুকলাম নেপালের বীরগঞ্জে। রিকশয় উদয় আমাকে বলল, তোর টিকিট শেষ পর্যন্ত কাটা যায়নি। তুই বিনা টিকিটে রক্সৌল এসেছিস। আমি বললাম, আমার টাকা ফেরৎ দে।
রিকশ, আমাদের নেপালের সীমান্ত শহর, বীরগঞ্জের বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেওয়ার পর— পুরি, আলু-মটর আর অমৃতি খেয়ে, বেলা ১২-টায় আমরা কাঠমান্ডুর বাসে চড়ে বসলাম। সে কী পথ! সে কী পথ! অপরূপ আর ভয়াল ৫০: ৫০ মেশানো ঝুঁকিপূর্ণ সেই সড়ক, একের পর এক পাহাড়ে পাক দিয়ে-দিয়ে— ওপরে উঠে গিয়েছে। সেই সড়কের একদিকে হিমালয়ের দেওয়াল, অন্যদিকে খাদ। প্রতিটি বাঁকে, বিপরীত দিক থেকে আসা, গাড়িকে জায়গা দিতে— খাদ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে পড়ছে আমাদের বাস, কয়েক সেকেন্ডের ওই মুহূর্তগুলি শ্বাসরোধী।
আমাদের দশা দেখে, জয়বাহাদুর হাসছিল, তার তো এই পথে, বাসে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা আছে। বাসে যেতে-যেতে, একটি বাঁকে নেপালের সরকারি ইয়েতি পরিবহনের একটি ছোট বাস দেখলাম, ভেঙে, তুবড়ে— খাদের ঝোপে আটকে রয়েছে, আগের দুর্ঘটনা! সন্ধেবেলায় আমাদের বাস পৌঁছে গেল কাঠমান্ডু, নেপালের রাজধানীতে।
বাসস্ট্যান্ড থেকেই , একটি হোটেলের প্রতিনিধি আমাদের নিয়ে গেল হোটেলটিতে। নতুন হোটেল। আলোয়-আলোয় নেপালের রাজধানী তখন ঝলমল করছিল। সে আলো উৎসবের। জানুয়ারি মাস, বাসে আসার পথে, কোথাও-কোথাও আমাদের কনকনে ঠাণ্ডা লেগেছে, তবে কাঠমান্ডু তত ঠাণ্ডা নয়, উপত্যকা বলে।
আমাদের দিন-সাতেকের ওই নেপাল সফরের সময়েই ছিল, রাজা বীরেন্দ্রর রাজ্যাভিষেক। রাজা মহেন্দ্রর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন তিনি। সাতদিনের ওই নেপাল সফরে, জয়বাহাদুর আমাদের খুব ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল— কাঠমান্ডু শহর ও তার আশপাশ। নারায়ণহিতি প্রাসাদ, রানীপোখরি, সব ঘুরে-ঘুরে দেখেছিলাম আমরা, গিয়েছিলাম পশুপতি মন্দিরেও। আর ওই হিমালয়…

একদিন সন্ধ্যাবেলা, আলো ঝলমল রানী পোখরির উদ্যানটিতে ঘুরছিলাম আমরা। শুভ্র খুব ভাল ছবি তোলে, সে ছবি তুলছিল আমাদের। উল্টোদিক থেকে, বর্ষীয়ান সুবেশ এক নেপালি ভদ্রলোক আসছিলেন, মাথায় নেপালি টুপি, হাতে নকশাখচিত ছড়ি। আমাদের মুখোমুখি হয়ে, হেসে শুভ্রকে বললেন, ‘ফ্ল্যাশ ছাড়া ছবি হবে?’ শুভ্র বলল, ‘এত আলো, ছবি প্রিন্ট হলে, আপনাকে পাঠাব। ঠিকানা বলুন।’
বর্ষীয়ান মানুষটি নাম বললেন, কী নাম বলেছিলেন, মনে নেই, পদবী বলেছিলেন, শ্রেষ্ঠ। বললেন, ঠিকানা, কাঠমান্ডু লিখলেই চিঠি চলে আসবে। আমরা তাও বললাম, ঠিকানা বলুন, পুরো ঠিকানা বলুন। ভদ্রলোক হেসে বললেন, আমার চিঠি হারাবে না, ডাক বিভাগের আমিই মন্ত্রী। আয় অ্যাম দা মিনিস্টার অফ পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ, রয়্যাল গভর্নমেন্ট অফ নেপাল।
আর একদিন বিকেল। কাঠমান্ডুর ঝকঝকে একটি এলাকায়, টুকটাক কেনাকাটায় বের হয়েছি আমরা। দু’দিন পর রাজ্যাভিষেক উৎসব। রাস্তাঘাট জমজমাট। পাহাড়ের ঢালে, বিপনীগুচ্ছ। সিঁড়ি বেয়ে সেদিকে যাচ্ছি। হুটার লাগানো তিন চারটি গাড়ি এসে থামল সিঁড়ির নীচে। গাড়ি থেকে নেমে এলেন তরুণ, ভাবী রাজা বীরেন্দ্র, পাশে রানী ঐশ্বর্য দু’তিনজন রক্ষী নিয়ে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন, তাঁরাও কেনাকাটায় এসেছেন। জনতা, আমরাও, সারিবদ্ধভাবে সিঁড়ির দুদিকে দাঁড়ালাম। হাত নাড়তে-নাড়তে, রাজা বীরেন্দ্র, রানী ঐশ্বর্য ওপরে উঠতে লাগলেন। আমাদের কাছে এসে থেমে গেলেন রাজা বীরেন্দ্র, সকৌতূহলে প্রশ্ন করলেন, ইন্ডিয়ান? আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম, রাজ্যাভিষেকের জন্য অভিনন্দন জানালাম। আমাদের সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন রাজা বীরেন্দ্র, হাসলেন রানী ঐশ্বর্য।
২০০১, ১ জুন রাতে, নারায়ণহিতি প্রাসাদে নৈশভোজসভায়, পারিবারিক ষড়যন্ত্রে খুন হলেন রাজা বীরেন্দ্র, রানী ঐশ্বর্য ও তাঁদের পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য। রাতে ‘আজকাল’ অফিসে এই খবরে, মন ব্যথিত হয়েছিল।

সেবার, ১৯৭৫ সালে আমরা নেপাল থেকে ফেরার পর, দেখতে-দেখতে ভারতে জারি হয়ছিল জরুরি অবস্থা। তার আগের বছর, ১৯৭৪ সালের মে মাসে, এক সপ্তাহ ধরে সারা দেশে রেল ধর্মঘটে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার চাপে পড়েছিল।
ওই রেল ধর্মঘটের সময়ে, কলকাতার সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল চার্চ থেকে, পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল রেল ধর্মঘটীদের নেতা জর্জ ফার্নান্দেজকে। সব মিলিয়ে, সারা দেশে তখন ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে, বিরোধীদের আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠছিল।
সম্প্রতি একটি পত্রিকায়, সাক্ষাৎকারে জ্যোতির্ময় দত্ত, জরুরি অবস্থাকালীন ঘটনাবলির কথা বলতে গিয়ে প্রয়াত কবি শম্ভু রক্ষিতের ভূমিকার উল্লেখমাত্র করেননি। অন্যায় করেছেন জ্যোতিদা।
ইন্দিরা গান্ধীর ‘তানাশাহি’-র বিরুদ্ধে, জয়প্রকাশ নারায়ণ আন্দোলন তুঙ্গে তুলে, একসময়ে— সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহে নামার ডাক দিতেই, ১৯৭৫ সালের ২৫ মে-র রাতে রেডিওয় আকাশবাণীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বিশেষ ভাষণে, সারা দেশে— জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা করেন।

তখন তো টিভি ছিল না। অনেক বাড়িতে রেডিওও ছিল না। মফস্সল শহরগুলিতে চৌরাস্তার মোড়ে, কোথাও-কোথাও বড়-বড় দোকানে, লাউড স্পিকারে, আকাশবাণীর খবর শোনানো হত। ওই রাত ১০-টায়, আমি আর সোমনাথদা শ্রীরামপুরে কালীতলায় একটি দোকানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ওই সংক্ষিপ্ত হিন্দি আর ইংরেজি মেশানো বিশেষ ঘোষণা শুনলাম। থমথমে মুখে সোমনাথদা আমাকে বললেন, ‘বাঙাল, এখন থেকে শুধু প্রেমের কবিতা লিখবি, শুধু প্রেমের কবিতা…’।
সময় গড়াতে লাগল, আমাদের জরুরি অবস্থার ভেতর ওই বছর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার দিন ঢাকায় সামরিক অভ্যুত্থানে, সপরিবারে নিহত হলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান।
সাড়া ফেলে দিয়ে, গোপনে— কলকাতায় বের হয়ে গেল জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত, ‘কলকাতা’ পত্রিকাটির জরুরি অবস্থা বিরোধী সংখ্যা। পত্রিকাটিতে, ইন্দিরা গান্ধীর গণতন্ত্রবিরোধী পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করে বেরোল, গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত (রামকৃষ্ণ দাশগুপ্ত ছদ্মনামে), নিরঞ্জন হালদার সহ কয়েকজনের লেখা।

ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশে, শম্ভু রক্ষিতের কবিতা, যার শিরোনাম ‘বুড়ি হুম্’। খবর ছড়াল, পত্রিকা প্রকাশের পর সকলেই গা ঢাকা দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টও জারি হয়েছে। পুলিশ খুঁজছে তাঁদের। আত্মগোপন করেছেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে, গৌরকিশোর ঘোষ গণতন্ত্রের মৃত্যুকে মাতৃবিয়োগ গণ্য করে— মস্তকমুণ্ডণ করে, নগ্নপদে ঘুরছেন অশৌচপালনে।
শম্ভু রক্ষিত অতি গোপনীয়তায়, এক রাতে শ্রীরামপুরে এসে— ‘কলকাতা’ পত্রিকাটির বেশ কিছু কপি আমাদের দিয়ে গেলেন, বিক্রি ও বন্টনের জন। পরে, ‘কলকাতা’ পত্রিকাটির একটি ইংরেজি সংস্করণও বের হয়েছিল।
সম্প্রতি একটি পত্রিকায়, সাক্ষাৎকারে জ্যোতির্ময় দত্ত, জরুরি অবস্থাকালীন ঘটনাবলির কথা বলতে গিয়ে প্রয়াত কবি শম্ভু রক্ষিতের ভূমিকার উল্লেখমাত্র করেননি। অন্যায় করেছেন জ্যোতিদা। জরুরি অবস্থায় জ্যোতির্ময় দত্তের সহবন্দী ছিলেন শম্ভুদা। শিথিল জরুরি অবস্থায়, জেলে বসেই জ্যোতির্ময় দত্ত কিছু কবিতা লিখেছিলেন, যা একটি পুস্তিকা হয়েছিল, ‘শম্ভু রক্ষিতের গান’ নামে।

কিন্তু তার আগে, ওঁদের ওই আত্মগোপনের সময়ে?
১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসের দুপুর। পুজোর আগে, না পরে মনে নেই। রোদ ঝলমল দুপুর বেলায় আমাদের বাড়িতে শম্ভু রক্ষিত হাজির। তখনও হাফ সোয়েটার পরার সময় হয়নি। কিন্ত শম্ভুদার গায়ে, পা পর্যন্ত ঝোলা একটি লং কোট! হাতে একটি ডিকশনারি! দেখে তাজ্জব হলাম বাড়ির সবাই। এক গাল হেসে, শম্ভুদা বললেন, ছদ্মবেশ! ছাত্র-ছাত্র দেখাচ্ছে না আমাকে?