মেডিসিনারি : পর্ব ১১

Representative Image

চেম্বার ছাড়িয়ে…

পিজিআইএমইআর চণ্ডীগড়ে এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগ থেকে ডিএম পাশ করে কলকাতায় ফিরে আসা ২০০১ সালে। সেই থেকে আমার নিজস্ব প্র্যাকটিস শুরু। বিগত চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা খুব স্বাভাবিকভাবেই নানাবিধ। তবে আজ স্মৃতিরোমন্থন করতে গিয়ে দেখলাম, সুখস্মৃতিগুলোই বেশি জ্বলজ্বল করছে। যেখানে আবালবৃদ্ধবনিতার অফুরন্ত স্নেহ, আশীর্বাদ, ভালবাসা, শ্রদ্ধা পেয়ে আমি ধন্য। অথচ আমি যে তাদের জন্য বিরাট কিছু করেছি— এমন নয়। আমার বিশ্বাস, আজকের সমাজেও, ‘মন্দ যদি তিনচল্লিশ, ভালর সংখ্যা সাতান্ন’।

আমার ডাক্তারি-জীবনের বেশ কিছুটা সময় কেটেছে বহরমপুরে; শনিবার সন্ধেবেলা ভাগীরথী এক্সপ্রেসওয়ে-তে চেপে বহরমপুরে পৌঁছনো, রাত্রিবেলা গিয়ে উঠতাম একটি নার্সিং হোমে। রাত্রিবাস করে রবিবার রোগী দেখে আবার কলকাতা ফেরা। নার্সিং হোম যাদের, আমার ডাক্তারি-জীবনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। যদিও আমি সরকারি চাকরি কখনও করিনি, তবুও আর্থসামাজিক নানা স্তরের মানুষের সংস্পর্শে এসেছি।

বেশ মনে আছে, একটি বছর কুড়ির বিবাহিত মেয়েকে তার বাবা নিয়ে আসেন হাইপার-থাইরয়েডের চিকিৎসা করাতে, দূরের কোনও গ্রাম থেকে। আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তাঁরা দিন কাটাতেন, বলাই বাহুল্য। প্রথমবার দেখার পর, দ্বিতীয়বার এলেন বহু মাস পরে। দেখলাম, শারীরিক অবস্থার উন্নতি তো বিন্দুমাত্র হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে। জানলাম, অর্থাভাবে ওষুধ বন্ধ হয়েছে, মেয়েটির স্বামীও তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। বাবা ওষুধের জোগান দিতে পারছেন না। বোঝালাম, এই দেরি করার ভুলটা যেন আর না করেন।

আপনি থাকতেও কিছু করা গেল না ডাক্তারবাবু!
পড়ুন অভিজিৎ মুূখোপাধ্যায়ের কলমে ‘মেডিসিনারি’ পর্ব ১১…

পরেরবার তাঁরা যথাসময়েই এলেন। চিকিৎসার শেষে যখন প্রেসক্রিপশন লিখছি, তখন দেখি, মেয়েটির বাবা তাঁর শতচ্ছিন্ন গামছা থেকে কিছু একটা বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন। তাকিয়ে দেখি, টেবিলে রাখা হয়েছে চারটে ডিম।

মেয়েটির বাবা যারপরনাই কুণ্ঠিত। যদি আমি গ্রহণ না করি সেই পারিশ্রমিক!

এই ভালবাসা বোধহয় কোনও মূল্য দিয়েই চোকানো যায় না। তারপর কয়েকবার এসেছিলেন। তারপর আর দেখা হয়নি ওঁদের সঙ্গে, কখনও। বাবা ছাড়া মেয়েটি ছিল নিঃসহায়। মনে মনে খুব প্রার্থনা করেছিলাম, ওঁরা যেন ভাল থাকেন।

এই বহরমপুরেই, একদিন একটি অতি-রুচিশীল শিক্ষিত পরিবার আমাকে অনুরোধ করল, রাতে তাদের বাড়িতে আমাকে থাকতেই হবে। ভোরবেলা তাঁরাই আমাকে চেম্বারে পৌঁছে দেবেন। আমি প্রথমে একটু ইতস্তত বোধ করলেও, অনুরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছল, যে, আমার তরফে না বলাটা প্রায় অভদ্রতা হয়ে যাচ্ছিল। গিয়ে দেখি, এলাহি ব্যবস্থা। খাইয়েদাইয়ে, যত্ন করে, শোবার ব্যবস্থা করে, সবাই শশব্যস্ত— আমার কোনও অসুবিধে যাতে না হয়। অস্বস্তি আর ভাললাগার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ তখন আমার মধ্যে।

ঈশ্বরের আশীর্বাদই বলব, জীবনে কঠিন প্রতিকূলতার মধ্যে যেমন কাজ করেছি, তেমনই চরম স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেও কাজ করেছি। পর্দাঝোলানো শৌচাগার-বিহীন চেম্বারেও যেমন ছুটে গিয়েছি, তেমনই কলকাতার ঝাঁ-চকচকে হাসপাতালেও বসতে পেরেছি। এমনই একদিন, এক নামজাদা হাসপাতালে রোগী দেখছি, দেখি, বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে ঘরে ঢুকলেন। এঁরা আমার পূর্বপরিচিত। মুর্শিদাবাদের কোনও এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভোররাতে ট্রেনে রওনা দিয়ে পৌঁছেছেন হাসপাতালে, মা-মেয়েকে আমাকে দেখাবেন বলে। গলদঘর্ম অবস্থা। শরীরের ক্লান্তি ছাপিয়ে চোখে-মুখে শিশুসুলভ সারল্যের উজ্জ্বলতা। চমকটা অপেক্ষা করছিল, ওঁদের দেখে প্রেসক্রিপশন করার পর। ব্যাগ থেকে একের পর এক বেরতে থাকল নারকেল, চাল, নিজের জমিতে চাষ করা সবজি, শাক। কাজ শেষ করে যখন ফিরছি, দু’হাতে রীতিমতো বাজার। সঙ্গে আর-একটা জিনিসছিল, যেটা অদৃশ্য। আজ পর্যন্ত যা পরিমাপ করার কোনও একক হয়নি— নিখাদ ভালবাসা। এদের সঙ্গে আমার আজও যোগাযোগ রয়েছে, সেই ছোট ছেলেটি আজ গ্র্যাজুয়েট। একদিন আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে লিখল, ‘আঙ্কল, আমি কাল স্বপ্ন দেখেছি, একটা দামি বিদেশি গাড়ি চড়ে আপনি আমাদের গ্রামে এসেছেন।’ ওকে কীভাবে বোঝাব, আমার জীবনযাত্রা অত্যন্ত সাধারণ! হয়তো কখনও ওর গ্রামে গিয়ে উঠতে পারব না, তাই ওর স্বপ্নের মাধুর্য নষ্ট করিনি আর।

কেউ যদি ধৈর্য ধরে এতটা পড়ে থাকেন, তার মনে হতেই পারে, চিকিৎসক-রোগীর সুসম্পর্ক বুঝি জেলাতেই হয়, কলকাতায় হয় না? অবশ্যই হয়। ক্লাস সিক্সে পড়া ছোট্ট মেয়েটিকে যখন টাইপ-১ ডায়াবেটিস নিয়ে তার বাবা-মা আমার কাছে নিয়ে আসেন, তখন একরাশ আশঙ্কা আর চিন্তা তাঁদের মাথায়। ধীরে-ধীরে বাবা-মায়ের নিরলস পরিশ্রম, ছোট্ট মেয়েটির ভাল থাকার তাগিদ এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদে সে আজ সুস্থ জীবনযাপন করছে। আজ সে ইঞ্জিনিয়ার; আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে চাকরিরতা, সর্বোপরি একজন মা। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বুঝতে পারিনি, কখন ও আমার কন্যাসমা হয়ে উঠেছে।

হরমোন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বহু রূপান্তরকামী মানুষকেই আমি চিকিৎসক হিসেবে দেখি। সেখানে আমার কাজ, তিনি যে লিঙ্গ-পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করতে চাইছেন, ওষুধের মারফত সেই প্রক্রিয়াতে সাহায্য করা। আর সেটা করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি, সামগ্রিকভাবে এঁদের পাশে সমাজ একেবারেই নেই। এমনকী সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, এঁরা পরিবারের সাহায্য থেকেও বঞ্চিত। যার ফলে, যে-কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা বয়ঃসন্ধিক্ষণের আগেই শুরু করা উচিত, তা হয় না।

এতটা সময় তো শুধু নিজের প্রাপ্তির কথাই বললাম! আর যেখানে আমি ব্যর্থ? না, চিকিৎসার সফলতা বা ব্যর্থতা, কোনওটাই আমি আজ লিখতে বসিনি। আজ শুধু মানুষ হিসেবে আমার অভিজ্ঞতার ভাগ করার দিন।

হরমোন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বহু রূপান্তরকামী মানুষকেই আমি চিকিৎসক হিসেবে দেখি। সেখানে আমার কাজ, তিনি যে লিঙ্গ-পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করতে চাইছেন, ওষুধের মারফত সেই প্রক্রিয়াতে সাহায্য করা। আর সেটা করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি, সামগ্রিকভাবে এঁদের পাশে সমাজ একেবারেই নেই। এমনকী সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, এঁরা পরিবারের সাহায্য থেকেও বঞ্চিত। যার ফলে, যে-কাউন্সেলিং বা চিকিৎসা বয়ঃসন্ধিক্ষণের আগেই শুরু করা উচিত, তা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এঁরা নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে এই চিকিৎসা-প্রক্রিয়ার মধ্যে যুক্ত হতে পারেন। কিছু সংগঠন নিশ্চয়ই আছে, যারা রূপান্তরকামী মানুষদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে; তবে প্রয়োজনের তুলনায় সেই সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। আজও রূপান্তরকামীরা শিক্ষিত সমাজের কাছে কৌতুকের পাত্র। অথচ তাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে-অসম লড়াই চালিয়ে যান, চিকিৎসক হিসেবে আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার দায়িত্বটুকু পালন করেছি মাত্র, কিন্তু সামগ্রিক পরিকাঠামো বা মানুষের সচেতনতায় কোনও বদল আনতে পারিনি, এখানেই আমার ব্যর্থতা।

ভাল-মন্দ যা-ই হোক না কেন, সব কিছু তো প্রকাশ করা যায় না, পিছনে ফিরে দেখার ফুরসৎও ও বড় একটা হয় না। আজ লিখতে বসে মনে হচ্ছে, মন্দ থাকে বলেই ভাল এত উজ্জ্বল। স্মৃতি সততই মধুর।