সামথিং সামথিং: পর্ব ৭৩

Jemimah Rodrigues

জেমাইমা ও ঈশ্বর


বিজ্ঞাপন

মেয়েদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ভারতের জেমাইমা রদ্রিগেজ (১৩৪ বলে ১২৭ নট আউট) ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিয়েই বললেন, প্রথম ধন্যবাদ প্রাপ্য যিশুর, ঈশ্বর না থাকলে তিনি একা এই কাণ্ড করতেই পারতেন না। নাস্তিক দর্শকের বুকে রামধাক্কা। এতক্ষণ উরিব্বাসরে, এ-মেয়ের মাথা কী ঠান্ডা, ম্যাচের গতিপ্রকৃতি পড়ে নেওয়ার ক্ষমতা কী অসামান্য, কী দুরন্ত স্ট্রোক হাতে, কী প্রবল ফিটনেস ও স্ট্যামিনা থাকলে এতক্ষণ খেলে যাওয়া যায়, অস্ট্রেলিয়াকে এ যে দেখছি ভয়ই পায় না— বলে-টলে উচ্ছ্বসিত হওয়ার পর, নায়িকা কিনা কৃতিত্বের সিংহভাগ দিয়ে দিলেন এমন একজনকে, যাঁর অস্তিত্ব আছে কি নেই তা-ই নিশ্চিত নয়? জেমাইমার অবশ্য বিশ্বাস নিশ্ছিদ্র, কারণ তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হল, আপনি নিজেকে কী বলছিলেন মাঝে মাঝেই, উনি বললেন, শেষদিকে এত ক্লান্ত লাগছিল যে শুধু বাইবেলের একটা অংশ আবৃত্তি করছিলেন, যা বলে, তুমি স্থির ও শান্ত থাকো, ঈশ্বর তোমার হয়ে লড়বেন। তার মানে, ময়দানের কঠোর সংগ্রামে ওই ধর্মবাণী তাঁকে লাগাতার অনুপ্রাণিত করছিল। প্রেস কনফারেন্সে এও বললেন, ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে। (ফাইনালে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিয়েও শেফালি বর্মা বললেন, আমি তো গোড়াতেই বলেছিলাম ঈশ্বর আমাকে ভাল কিছু করার জন্য পাঠিয়েছেন। শেফালি প্রথমে দলেই ছিলেন না, অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবেও নয়, প্রতীকা রাওয়ালের চোট লাগার পর সহসা তাঁকে দলে নেওয়া হয়। ফাইনালে ৮৭ রান করার ও দু’উইকেট নেওয়ার পর এখন অনেকেই এ-ঘটনায় ঈশ্বরের পরিকল্পনা দেখতে পাচ্ছেন)। বহু কৃতী মানুষই বলেন, তাঁরা বুঝতে পারেন কেউ একজন তাঁদের ক্ষমতা দিয়েছেন ও প্রার্থনা পূরণ করেছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে পাশাপাশি হেঁটেছেন বলেই তাঁরা ঈপ্সিত কোনও গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছেন।

আরও পড়ুন: এই মুহূর্তের ভারতে মেয়েদের এই জয় কেবলই ক্রিকেটীয় নয়, সামাজিক জয়ও বটে! লিখছেন কুমার অলকেন্দু দাস…

অসামান্য গায়ক বা গায়িকা রিয়েলিটি শো-র বিচারক হয়ে প্রতিযোগীকে বলেন, ঈশ্বর তোমাকে অসামান্য গলা দিয়েছেন, ঈশ্বরের কৃপায় আরও উন্নতি হোক। বহু কবি বলেন, অমুক কবিতাটা আমি লিখিনি, কোত্থেকে যেন লাইনগুলো এসে পর পর বসে গেল। আর একটা গোটা এরোপ্লেনের সবাই যদি মরে যায়, শুধু একটা লোক বেঁচে যায়, তাহলে সে (এবং খবরে সেই তাজ্জব ঘটনা দেখা-শোনা সাধারণ মানুষ) ঈশ্বরের কৃপায় বিশ্বাস না করে যাবে কোথায়! নোভাক জকোভিচ কখনও কোর্টে ঢোকার আগে, বা মেডেল নিতে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে ওঠার সময়ে, কখনও খেলা জেতার অব্যবহিত পরে সাক্ষাৎকারে বুকে ক্রসচিহ্ন আঁকেন বা গলা থেকে লকেটের ক্রস বের করে দেখান। ভারতীয় গণিতবিদ রামানুজন বলেছিলেন, তাঁর কাছে একটা সমীকরণের কোনও অর্থই নেই যদি-না তা ঈশ্বরের কোনও ভাবনাকে প্রকাশ করে।

তার মানে, আমরা যাঁদের কীর্তির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি, তাঁদের অনেকেরই ধারণা, শুধু দুর্দান্ত প্রতিভা, প্রখর অধ্যবসায় ও আত্যন্তিক স্বনিয়ন্ত্রণের ফলে তাঁরা চূড়ায় উঠতে পারেননি, এর পিছনে ঈশ্বরের সস্নেহ সাহায্য রয়েছে। এই প্রতিভা ব্যাপারটা যে ঈশ্বরদত্ত, এ-বিষয়ে তো প্রায় সকলেই একমত। নইলে একটা লোকের গলায় সুর আছে আর অন্য লোকের গলায় নেই, তা কী করে হল? নাস্তিক বলবে, এটা চান্স, জাস্ট হয়ে গেছে, যেমন কেউ বেঁটে কেউ লম্বা, তেমনই কেউ কাব্যক্ষম কেউ কবিতা-কানা। বিশ্বাসী মানুষ এই বিতরণটা, সৌভাগ্যটাকেই বলবে, ঈশ্বরের ইচ্ছা বা আশীর্বাদ। এই উপহারটা পড়ে পেয়ে গেলে, তারপর একে নিরন্তর পালিশ করে এবং মানসিক জোর সংগ্রহ করে নিজের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশের দিকে চলা হচ্ছে প্রতিভাবানের কর্তব্য। যদি সে এই উপহার নষ্ট করে, তবে সে তার ঠাকুরের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করল। নাস্তিক বলবে, এটা অলীক বিশ্বাস, তবে হ্যাঁ এর ফলে উপকার হতে পারে, যেমন ট্যাবলেট-টা স্রেফ ছলৌষধ হলেও রোগী বেশ সুস্থ বোধ করে, কারণ ‘আমি একটা ওষুধ খেয়েছি’ বোধটাই তাকে স্বল্প চাঙা করে দেয়। প্রবল প্রতিভাবান লোক যখন খেলছেন বা গাইছেন, তাঁর যদি বিশ্বাস জন্মায় কোনও ভয় নেই এক দিব্য শক্তি আমার সহায়তা করছেন, তখন খেলোয়াড় বা শিল্পী অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ও নিশ্চিন্দি নিয়ে তাঁর কাজটা করতে পারবেন, যা তাঁর সাফল্যের সম্ভাবনাকে দৃঢ়তর করবে। তাই ট্রফি বা পুরস্কার পেয়ে ঈশ্বরের বন্দনা গাইলে ক্ষতি নেই, তবে কিনা, আসল কাজটা করেছেন তিনি নিজেই, এবং ধন্যবাদটা আগে কোচকে দিলেই বরং ভাল হত। আর আস্তিক বলবে, অত বড় লোকটা কাজটা করতে-করতে উপলব্ধি করল কেউ যেন তার হাতটা ধরে আছে, তুমি বাইরে থেকে ফটরফটর ব্যাখ্যা বাগিয়ে ব্যাপার ভেস্তে দিচ্ছ? এ তো অনধিকারীর স্পর্ধা। জকোভিচ বা রবীন্দ্রনাথকে আমরা অতিমানুষ ধরি। তাঁরা যখন মনে করছেন মানুষের অতিরিক্ত কিছু তাঁদের নিরন্তর গড়ছেন, তখন সেই ভাবনাস্রোতকে আমরা দু’বার না-ভেবে টুসকি মারি কোন সাহসে?

আর একটা গোটা এরোপ্লেনের সবাই যদি মরে যায়, শুধু একটা লোক বেঁচে যায়, তাহলে সে (এবং খবরে সেই তাজ্জব ঘটনা দেখা-শোনা সাধারণ মানুষ) ঈশ্বরের কৃপায় বিশ্বাস না করে যাবে কোথায়! নোভাক জকোভিচ কখনও কোর্টে ঢোকার আগে, বা মেডেল নিতে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে ওঠার সময়ে, কখনও খেলা জেতার অব্যবহিত পরে সাক্ষাৎকারে বুকে ক্রসচিহ্ন আঁকেন বা গলা থেকে লকেটের ক্রস বের করে দেখান। ভারতীয় গণিতবিদ রামানুজন বলেছিলেন, তাঁর কাছে একটা সমীকরণের কোনও অর্থই নেই যদি-না তা ঈশ্বরের কোনও ভাবনাকে প্রকাশ করে।

এ-তর্ক তো মীমাংসার নয়, আর তার দরকারটাই-বা কী, যে যার নিজ ধরনে ও প্রক্রিয়ায় আত্মপ্রয়োগ করলেই মিটে গেল, কেউ ড্রাগ না খেলে লিখতে পারে না, কেউ গায়ত্রী মন্ত্র না আউড়ে সার্জারির ছুরিকাঁচি ধরে না, কেউ সঙ্গম না করে ক্যানভাসে আঁচড় কাটে না। কিন্তু দুরন্ত খেলোয়াড়দের অটল ঈশ্বরবিশ্বাস দেখে কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে, এঁরা যখন হেরে যান, বা সহজ শট ফসকান, তখন ঈশ্বরকে দায়ী করেন কি? কিংবা জেমাইমাই যে-দুটো লোপ্পা ক্যাচ তুলেছিলেন ওই ম্যাচে, যদি সেগুলো ফিল্ডাররা ধরে নিতেন, তাহলে কি ঈশ্বরের দোষ দেওয়া হত? কেউ কখনও খেলাশেষের ইন্টারভিউয়ে বলেছেন, ঈশ্বরের অসহযোগিতার জন্যে আজ আমরা জেতা ম্যাচটা হারতে বাধ্য হলাম? কিংবা, বারংবার শ্লোক-আবৃত্তির পরেও যখন রান আউট হয়ে গেলাম, তখন ঠিক করলাম ওই শ্লোকটা আগামী ১৭ দিন আর বলব না? তা কিন্তু হয় না। তখন পরাজিতরা নিজের অক্ষমতার কথাই বলেন। হয়তো হোটেলে ফিরে গিয়ে অভিমানে ফোঁপান, ঈশ্বর, এতবার বললাম, তবু সাফল্য দিলে না? কিন্তু প্রকাশ্যে ব্যর্থতার দায় ঈশ্বরের উপর কখনও চাপানো হয় না। সেঞ্চুরি করে আকাশের দিকে তাকানোর প্রথা আছে, শূন্য রানে আউট হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নালিশ-মুষ্টি ঝাঁকানোর বা গালাগাল-নিক্ষেপের চল নেই। সেদিক থেকে ঈশ্বরের অবস্থানটা প্রকাণ্ড সুবিধেজনক। ভাল হলে কৃতিত্বে আমার অংশ আছে, খারাপ হলে আমি ও-তল্লাটেই নেই। হাততালি নেব, দায় নেব না।

আরও বড় কথা, জেমাইমা যে-ঈশ্বরকে ভজেছিলেন ও যাঁর কাছে শক্তি যাচনা করেছিলেন, অস্ট্রেলীয়রাও হুবহু সেই ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থনা করেন ও বলেন ট্রফি চাই। যদি জেমাইমা দুর্গা কিংবা মহম্মদের কাছে প্রার্থনা করতেন তাহলেও যুক্তিটা বদলে যেত না, কিন্তু এক্ষেত্রে একই যিশুর কাছে অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়দের অধিকাংশই (হয়তো সক্কলেই) সাফল্যের দরবার করেন। তাহলে ঈশ্বর সেদিন জেমাইমার সঙ্গে টানা থাকলেন এবং অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়দের পরিত্যাগ করলেন, তার ভিত্তিটা কী? তাঁর স্পষ্ট পক্ষপাত দৃষ্ট হল কেন? তিনি কি শুধু ‘এতগুলো লজেন্স তুমি পেয়েছ, এবার ছোটবোনকে দাও’ বলে সাতবারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে বঞ্চিত করলেন? বা মনে করলেন জেমাইমার ওইদিনের প্রার্থনার তীব্রতা ও সমর্পণ অনেক বেশি ছিল? না কি অত কিছু উনি ভাবেন না? আনমনা ইকিরমিকির খেলার মতো যেদিন যাকে ইচ্ছে হয় জিতিয়ে দেন? জকোভিচের উল্টোদিকের লোকও তো পুজো দিয়ে খেলতে নামেন, রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বীও তো আশ্চর্য পংক্তি ও উদ্দাম প্রেরণা কামনা করেন, আলেকজান্ডার এবং পুরু দুজনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন, প্লিজ আজ জিতিয়ে দাও। তাহলে সন্তানদের মধ্যে একজনকে গাঁট্টা মেরে অন্যজনের কাঁধে হাত দিয়ে হাসতে-হাসতে হাঁটা কি পরম পিতার (বা মাতার বা সখার বা প্রভুর) শোভা পায়?

তাই নাস্তিক (বা বিশ্বাসী কিন্তু ভুরু-কোঁচকা পাবলিক) জিজ্ঞেস করতে পারে, দুই আস্তিকের মধ্যে একজনকে (বা একটা দলকে) আদৌ বাছা হচ্ছে কেন, তার চেয়ে খেলা বা কাব্যের মতো ছুটকো বিষয়ে কোনও আগ্রহ না দেখালেই তো মিটে যায়। বরং সুনামি বা রেল-দুর্ঘটনা আটকাতে, বা শিশু-ধর্ষণ কিংবা দাঙ্গা-হত্যা প্রতিহত করতে সুপার-শক্তিটা ব্যয় করলে হত না? আস্তিক বলবে, ওই দুর্ঘটনা বা অন্যায়গুলোর ক্ষেত্রে অকুস্থলে উনি থাকছেন না, বা তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগুলো আপনিই ঘটে যাচ্ছে, তা অনুমান করা একটু পাতি ও সরলবোকা। ওঁর ক্রিয়া (বা নিষ্ক্রিয়া), উদ্দেশ্য বা যুক্তিক্রম আমাদের বোধ্য না-ই হতে পারে। আর, উনি প্রার্থনার ফলে তাঁর ভক্তকে একটা করে নারকোল-নাড়ু জোগাতে ব্যস্ত, তা-ই বা কে বলল? তিনি কোনও মহাজাগতিক বেয়ারা নন যে, একটা কিছু চাইলে দৌড়ে এনে দেওয়া তাঁর দৈনিক চাকরি হিসেবে নির্ধারিত। তিনি জেমাইমাকে সাফল্য দেবেন না অস্ট্রেলীয় কোনও খেলোয়াড়কে, তা সেই খেলোয়াড়-নিরপেক্ষ (মানে, তার আকাঙ্ক্ষা-নিরপেক্ষ) ভাবেই হয়তো নির্ণীত হচ্ছে, এবং সেই কার্যকারণ আমাদের বুদ্ধিসাধ্য না-ই হতে পারে। নাস্তিক অবশ্য তখন নাক বেঁকিয়ে বলবে, কিস্যুই আমরা বুঝব না, সবই অন্য টাইম-স্পেসে খড়ির দাগের লীলা, এ-সুরে বাজলে তো তর্ক করা যায় না, বরং শ্রয়ডিংগার এবং চেশায়ার-বেড়ালের বিবাহ দিয়ে দে, একটা না-বেড়ালের না-হাসি শুধু খচিত থাক গগন-শেলেটে। আস্তিক বলবে, ধুর থিওরি-খেকো, নিজে খেলিস না কেবল ধারাভাষ্য খাবলাস, ওইজন্যেই এত তড়পানি, মাঠে নেমে পড়লে বুঝতিস, তাঁর অনুমোদন ছাড়া তৃণ টলে না।