বাজবল না কাজবল?
অস্ট্রেলিয়ায় ইংল্যান্ড অ্যাশেজ খেলতে গিয়ে, পাঁচ টেস্টের সিরিজে প্রথম তিনটেই হেরেছে, এবং তা ঘটেছে মোট ১১ দিনে। নিন্দের ঝড় বইছে। জিওফ্রে বয়কট কোচের ইস্তফা চাইছেন। এদিকে ইংল্যান্ড ‘হুঁ হুঁ আমরা বাজবল খেলি’ বলে গত ক’বছর এমন রেলা-মথিত হল্লাগুল্লা মচিয়েছে, তাদের এই দুরমুশ-দশা দেখে অনেকেই উল্লসিত। বাজবল-দর্শন কী, কেউ-ই নিশ্চিত জানে না, তবে আন্দাজ করে: টেস্টেও ওয়ান-ডে’র মতো খ্যালো, বল দেখলেই পেটাও, এতটুকু ভয় পেও না। যেমন ভারতের ঋষভ পন্থ খ্যালেন, বা বীরেন্দ্র শেহওয়াগ খেলতেন। মুশকিল হল, একদিনের খেলা ও পাঁচদিনের খেলার ধাঁচ যদি একই হয়, তখন পাঁচদিনের খেলা প্রায়ই তিনদিনেই ফুরিয়ে যায় এবং ফল নিজেদের অনুকূল হয় না। ব্যর্থতার ভয় না-থাকা দুরন্ত ব্যাপার বটেই, কিন্তু পরোয়াহীন হয়ে, খেলার পরিস্থিতি অনুযায়ী মানানসই ব্যাটিং না-করে, ধৈর্য ব্যাপারটাই অভিধানে না-রেখে, সর্বক্ষণ একই খড়্গহস্ত হুড়ুমতাল গৎ-এ বাজতে থাকলে, সেই ব্যর্থ হওয়ার দিকেই ঢাল বেয়ে গড়াতে হয়, অন্তত শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে।
ইংল্যান্ডের খেলাকে তুলনা করা হচ্ছে ‘চার্জ অফ দ্য লাইট ব্রিগেড’-এর সঙ্গে। বহুদিন আগের এক যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কম-সংখ্যক সৈন্য কমজোরি অস্ত্র নিয়ে অনেক রুশ সৈন্যের ভয়াবহ কামানের মুখে দৌড় দিয়েছিল, যা প্রকাণ্ড বীরত্বের দ্যোতক (বিশেষত, টেনিসনের ওই-বিষয়ক কবিতার জন্য) এবং একইসঙ্গে হঠকারী সিদ্ধান্তেরও প্রতীক। এক ফরাসি সামরিক কর্তা বলেছিলেন, ‘এটা দুর্দান্ত ও মহৎ, কিন্তু এটা যুদ্ধ নয়। পাগলামি।’ সমালোচকরা বলছেন, ইংল্যান্ড গত কয়েক বছর (বাজবল শুরু হয়েছে ২০২২ থেকে, বেন স্টোকস অধিনায়ক এবং ব্রেন্ডন ম্যাকালাম কোচ হওয়ার পর— ম্যাকালামেরই ডাকনাম ‘বাজ’) খুব দ্রুত রান তুলে ও ম্যাচকে দ্বিগুণ উত্তেজনাময় করে এবং কয়েকটা খেলা জিতে এতই আত্মসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছে, বুঝতেই পারছে না, এই রগরগে ও হুট-মুগ্ধকারী ধরনটা আসলে আত্মঘাতী। আরেকজন উদ্ধৃত করেছেন ম্যানেজমেন্ট-মার্কা বাণী: the purpose of a system is what it does. মানে, একটা পদ্ধতি বা প্রণালী যে-উদ্দেশ্যে গঠিত, সেটাই সাধিত না-হলে, তার উপযোগিতাটা কোথায়? ‘বাজবল’ অসামান্য একটা তত্ত্ব হতেই পারে, কিন্তু তা যদি সুবিন্যস্ত ও প্রতিভাময় দলের বিরুদ্ধে বারবার আমায় হারিয়েই দেয়, তার চেয়ে বাবা আমি কাজ-বল খেলব, মানে যাতে আমার কাজ হয়।
আরও পড়ুন : বিবিসি-কেও মাথা নোয়াতে হল ক্ষমতার সামনে? চন্দ্রিল ভট্টাচাৰ্যর কলমে ‘সামথিং সামথিং’ পর্ব ৭৪…
এখানে যে-তর্ক ওঁৎ পেতে আছে: শুধু কাজের ফলাফলটা দেখব, নাকি কাজের ধরনটাও সমান জরুরি? ধরা যাক, রাম বলল, মার্কসবাদ কোথাও সফল হয়নি, মানে, তুষ্ট সমাজের জন্ম দিতে পারেনি। শ্যাম বলল, কিন্তু তত্ত্ব হিসেবে এটাই সেরা, শ্রেষ্ঠ সমাজ গড়া যাবে এই দর্শন মেনেই। তাহলে যদ্দুর কাজ কি মার্কসবাদকে প্রত্যাখ্যান, নাকি নতুনভাবে তার পুনর্প্রয়োগ? কিংবা, একটা লোক অতুলনীয় সাহিত্যিক, গদ্যে অনন্য, কিন্তু তার লেখা কেউ পড়ে না। তাহলে তাকে আমি গদ্য বদলে ফেলতে উপদেশ দেব, নাকি বলব, চালিয়ে যাও, এতে সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে?

এই সিরিজ ইংল্যান্ড মর্মান্তিকভাবে হারল বটে (এখনও দুটো টেস্ট বাকি আছে, সেগুলো জিতলে অনেকটা সম্মান নিশ্চয় পুনরুদ্ধার হবে), কিন্তু তাতেই কি প্রমাণ হয়ে গেল এই দৃষ্টিভঙ্গিটা পুরো ভুল? বয়কট বলেছেন, বাজবল ইংল্যান্ডের ক্রিকেটকে অনেক দিয়েছে, কিন্তু এখন আর কাজ করছে না, সুতরাং টেক্সট বই-ক্রিকেটে ফিরতে হবে। শুনে ম্যাকালাম বলতে পারেন, মশাই, টেক্সট বই-ক্রিকেটই তো খেলা হয়ে এসেছে চিরকাল, আমরা যদি সেই দেড়শো-বছুরে ধারণায় বিপ্লব ঘটাতে চাই, যদি বলি টেস্ট মানেই ঘাড় গুঁজে পানসে খেলা নয়, তাকে জেতা যায় দাপুটে ও ঝিনচ্যাক কেতায়— তা আমরা এই মুহূর্তে প্রয়োগ করতে ফেল মেরেছি বটে, কিন্তু সেজন্য আমাদের চিন্তাকে গোটাগুটি বাতিল করে দেওয়া যায় কি? যদি ম্যাকালাম ও স্টোকস মনে করেন, রূপায়ণ ভুল হয়েছে মানেই প্রস্তাবটা ভুল নয়? যদি তাঁদের মনে হয়, সাময়িক এই সর্বনাশের ফলে গতিপথটাই বদলে ফেললে দীর্ঘমেয়াদে ইংল্যান্ডের ক্ষতি হবে, তারা যে আশ্চর্য ও সাহসী ঘনঘটা শুরু করেছিল তা চির-লুপ্ত হয়ে পড়বে?
গৌতম গম্ভীর গালাগাল খাচ্ছেন অলরাউন্ডার দিয়ে গোটা দল গড়ার স্ট্র্যাটেজির জন্য। ম্যাকালাম গালাগাল খাচ্ছেন মারকাটারি আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের জন্য। কারণ খেলার ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, ম্যাচের ফলাফলেই সব কৌশলের সার্থকতা। (শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা ছাড় দিই, হাতে-গরম সাফল্য না পেলেও ভ্যান গখ কিংবা জীবনানন্দ পূজিত হন)। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক মার্টিন ক্রো ওয়ান-ডে ম্যাচের প্রথম ১০ ওভারকে স্লগ ওভার হিসেবে দেখতে শিখিয়েছিলেন বলেই একদিন জয়সূর্য ও কালুভিথরনে এসে শ্রীলঙ্কাকে অলৌকিক আরম্ভ উপহার দিতেন। বিশ শতকের তিনের দশকে জিমি হোগান অস্ট্রিয়ার জাতীয় দলে ‘টোটাল ফুটবল’ এনেছিলেন বলেই সাতের দশকে জোহান ক্রায়াফের দলের মধ্য দিয়ে হল্যান্ডের রিনাস মিখেলস তার দুরন্ত প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। সব নতুন ভাবনা তার সমসময়ে হাততালি-বাচক উপসংহার খুঁজে পায় না। তাকে অনেকটা সহিষ্ণুতা ও প্রশ্রয় উপহার দিতে হয়। অবশ্য অভিনব বা ছক-ভাঙা মানেই উৎকৃষ্ট, ভাবলে ভুল হবে। পৃথিবীতে জঘন্য-নতুন কিছু কম দেখা যায়নি। কিন্তু বাজবল যে নিতান্ত ফেলনা নয়, তার আবেদন ও অভিঘাত প্রবল, বহু টেস্ট ম্যাচেই প্রমাণিত। বাজবল-ঘরানা শুরু হওয়ার আগে ইংল্যান্ড শেষ ১৭টা টেস্ট ম্যাচের একটা জিতেছিল, আর শুরু হওয়ার পরের সাতটা টেস্ট ম্যাচের ছ’টা জিতেছিল। বাজবল ঝুঁকি-কে এড়ায় না, দৌড়ে আলিঙ্গন করে। ২০২২-এ ইংল্যান্ড পরপর চারটে টেস্ট ম্যাচ জিতেছিল চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করে, রান তাড়া করে। পাকিস্তানের সঙ্গে একটা টেস্ট ম্যাচে প্রথম দিনেই তুলেছিল চার উইকেটে ৫০৬ (রান-রেট ৬.৭৫)। ২০২৩-এ নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে টেস্টে স্টোকস প্রথম দিনেই ইনিংস ডিক্লেয়ার দিয়েছিলেন। ২০২৩-এর অ্যাশেজেও প্রথম টেস্টে তা-ই করেছেন। অনেকবারই ঝুঁকি নিয়ে হেরেছেন, অনেকবার জিতেছেন। তাঁদের প্রবণতাটা হল: জেতার সম্ভাবনা যাতে বাড়ে, তার জন্য হারের সম্ভাবনাকে আমরা স্বাগত জানাব। এই দুঃসাহসী, প্রথাকে কাঁচকলা-দেখানো, এবং ‘নিকুচি করেছে তোদের সতর্কবাণীর’ মনোভঙ্গি এখন ফসল ফলানোর মানদণ্ডে মুখ থুবড়ে পড়েছে বটে, কিন্তু সেজন্য তাকে টান মেরে ছুড়ে ফেললে, হয়তো ভবিষ্যতের অনবদ্য ও বহুপ্রসবী ঝলমল অকালে মুড়িয়ে যাবে।


