নীলা-নীলাব্জ: পর্ব ১৫

Neela Neelabjo 15

স্কুল ইউনিফর্ম

নীলা ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল। সবে একটা স্কুল ছুটি হয়েছে। রাস্তাময় স্কুলের জামা পরা কচি ছেলেমেয়েদের মেলা। ভিড় কাটিয়ে এগোতে যাবে, হঠাৎ, ‘আরে নীলা? কোথায় চললে?’

নীলা: তুমি কী করছ এই ভিড়ে? ফুচকা বেচছ?

নীলাব্জ: না, না খাচ্ছি। তুমি খাবে?

নীলা: না, আমার টাইম নেই।

নীলাব্জ: টাইম কার কবে থাকে? আরে… আরে চললে নাকি?

নীলাব্জ কোনও রকমে শেষ ফুচকাটা মুখে দিয়ে, টাকা মিটিয়ে নীলার পিছু নেয়।

নীলা: ভাল করে খেলেই পারতে। আমার পিছু নেওয়ার কী দরকার?

নীলাব্জ: ও হয়ে গেছে। আবার অন্যদিন খাব নাহয়। কিন্তু তোমার কি আজ ছুটি? না কি অফিস কামাই?

আরও পড়ুন: কেন মহাকাশ গবেষণাই সহ্য হয় না নীলাব্জর? যে-তুমুল তর্ক দানা বাঁধল! লিখছেন অনুপম রায়…

নীলা: সামনের সপ্তাহে বেঙ্গালুরু যেতে হবে অফিসের কাজে। অফিসে পরার ভাল জামা…

নীলাব্জ: ইউনিফর্ম করাতে যাচ্ছ?

নীলা: ইউনিফর্ম কেন হতে যাবে? স্কুলে পড়ি নাকি?

নীলাব্জ: না, তবে ওই কর্পোরেটদের জামা কাপড় ইউনিফর্ম টাইপেরই লাগে আমার। সব এক রকম। জঘন্য!

নীলা: মোটেও সব এক রকম না। এক রকম হল এই বাচ্চাগুলোর স্কুল ইউনিফর্ম।

নীলাব্জ: এগুলো তো আরও জঘন্য!

নীলা: স্কুল ইউনিফর্ম জঘন্য? তুমি একটা আজব প্রাণী নীলাব্জ! এই প্রথম আমি কাউকে স্কুল ইউনিফর্মকে খারাপ বলতে শুনলাম।

নীলাব্জ: বিদেশে উঠে গেছে।

নীলা: কী উঠে গেছে?

নীলাব্জ: স্কুল ইউনিফর্ম। ওখানে বাচ্চারা এরকম মিলিটারির মতো স্কুলে যায় না।

নীলা: সব জায়গায় নিশ্চয় নয়। আর বিদেশ করছে মানেই যে ঠিক করছে, লজিকটা কোথায়? কিছু তোমার মতো অতিপাকা লোকজন এইসব…

নীলাব্জ: অতিপাকা মানে?

নীলা: এই তোমাদের মতো, যাদের খাওয়া-পরার ভাবনা নেই, তাদের খেয়ালি পোলাও এইসব বাজে আইডিয়া।

নীলাব্জ: এই যে স্কুলের সবার এক রকম পোশাক করে দেওয়া, একটা বাচ্চার কতটা ক্ষতি করে জানো? মেরে দেয় সৃজনশীলতা, ওই বয়স থেকেই। নিজেকে যে অন্যভাবে প্রকাশ করবে, তার সুযোগটাই বন্ধ হয়ে যায়।

নীলা: পোশাক দিয়ে প্রকাশ করবে? ক্লাস ফাইভের বাচ্চা? থাক। প্রকাশ করার অনেক বয়স পড়ে আছে। স্কুলে এসবে মন গেলে ওরই ভবিষ্যৎ অন্ধকার। স্কুলে এক ঝাঁক শিশু আসছে বিভিন্ন পরিবার থেকে। সবার এক রকম জামাকাপড় দরকার। নাহলে তো বড়লোকের বাচ্চা এমন জামা পরে আসবে, গরিবের বাচ্চা হুব্বা হয়ে যাবে। একটা সমতা আনে, এক রকমের পোশাক।

নীলাব্জ: শুধু পোশাক এক করলেই সমতা আসে? কে স্কুলবাসে আসে, কে দামি গাড়িতে আসে, কে টিফিনে কী নিয়ে আসে, কে কত দামি পেনসিলবক্স নিয়ে আসছে, এখানে তফাত তৈরি হয় না? বাচ্চারা সবই বুঝতে পারে। ফালতু এক রকমের জামা পরিয়ে দিলেই সাম্য আসবে না। আর ইউনিফর্ম করে দিলে কিন্তু গরিবদেরই বেশি সমস্যা। তাদের আবার একটা আলাদা করে জামা বানাতে হবে স্কুলের জন্য। খরচা নেই সেখানে?

নীলা: প্রথম-প্রথম খরচা মনে হতে পারে কিন্তু তারপর বন্ধুরা যখন নিয়মিতভাবে পালটে-পালটে জামা পরে আসবে, তখন ওই গরিব বাচ্চাটিরও মনে হবে, আমিও পালটাব। তখন ডবল খরচা। আর নিজের পকেট অনুযায়ী বা ফ্যাশন সেন্স অনুযায়ী জামা কিনলে বাচ্চাটির আরও সমস্যা হবে। একদল বুলি করবে যদি দেখে সে একটু আলাদা। ইউনিফর্ম শব্দটার মানেটাই তো তাই, সামাজিক বা অর্থনৈতিক, যে-কোনও রকম ব্যবধানকে একদম মুছে দেবে। আর ইউনিফর্মটা গায়ে দিলে বাচ্চাটার একটা ভাল লাগাও জন্মাবে। আমি একটা বড় কিছুর অংশ। আমি ওই স্কুলের ছাত্র। ইউনিফর্ম ওকে ওই প্রাইডটা দেয়।

নীলাব্জ: মানতে পারলাম না। আমার তো কোনও গর্ব হত না এই ফালতু ইউনিফর্ম পরে। আমার শুধু মনে হত কখন বাড়ি ফিরে জুতো-জামা খুলব। স্কুলবাসে উঠেই প্রথমে টাইটা খুলতাম। গুঁজে রাখা জামাটা বের করে দিতাম। দম বন্ধ লাগত আমার। ওটা যে আমার আইডেনটিটি, আমার পরিচয়, আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না। স্কুলের বিশেষ অনুষ্ঠানের দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করতাম, যেদিন অন্য রকম জামা পরে যাওয়া যেত স্কুল। তুমি যে-সাম্যের কথা বলছ, সেটা একটা মিথ্যা সাম্য। সবাইকে এক জামা পরিয়ে দিলাম কিন্তু ভেতরে-ভেতরে সবার মারাত্মক রকমের তফাত। আসলে তো কেউই সমান নয়, তাহলে কেন?  

নীলা: আরে বাবা, শুধু কি তাই? স্কুলে যদি যে যা খুশি পরে আসতে শুরু করে, তাহলে কে স্কুলের বাচ্চা আর কে বাইরের বাচ্চা বুঝতে পারবে না কর্তৃপক্ষ। যে-কেউ ঢুকে যাবে স্কুলের ভেতর। নিরাপত্তার তো একটা ব্যাপার আছে নাকি? আর ওই বয়সে একটু পড়াশোনায় মন দিলেই ভাল, বেশি ফ্যাশন করতে হবে না। অন্যদিকে মন গেলে…

নীলাব্জ: অন্যদিকে মন যায় না বাচ্চাদের? ফ্যাশন নিয়ে আলোচনা করে না স্কুলের বাচ্চারা? শুধু পড়াশোনা করতে যায় ওরা স্কুলে? তুমি তাই করতে? ম্যাডোনার মিউজিক ভিডিয়ো স্কুলে দেখোনি তুমি? গ্ল্যামার ম্যাগাজিন দেখোনি পাতা উলটে? স্কুলের জামা পরে সিগারেট খেতে দেখোনি কাউকে? কী ভাবো বলো তো? সবাইকে এক রকম জামা পরিয়ে দিলেই সবাই একাগ্র চিত্তে পড়াশোনা করবে? বাস্তবে তা হয়?

শুধু পোশাক এক করলেই সমতা আসে? কে স্কুলবাসে আসে, কে দামি গাড়িতে আসে, কে টিফিনে কী নিয়ে আসে, কে কত দামি পেনসিলবক্স নিয়ে আসছে, এখানে তফাত তৈরি হয় না? বাচ্চারা সবই বুঝতে পারে। ফালতু এক রকমের জামা পরিয়ে দিলেই সাম্য আসবে না। আর ইউনিফর্ম করে দিলে কিন্তু গরিবদেরই বেশি সমস্যা। তাদের আবার একটা আলাদা করে জামা বানাতে হবে স্কুলের জন্য। খরচা নেই সেখানে?

নীলা: আরে! এমনিতেই বাচ্চাদের আজকাল এত রকম ডিস্ট্র্যাকশন, তার মধ্যে আর একটা যোগ করার কী দরকার? দেখো না, চড়া মেক-আপ করে মেয়েগুলো বিদেশের স্কুলগুলোতে যায়। দেখতে ভাল লাগে? এটা বয়স ওদের এসব করার?

নীলাব্জ: তুমি তো বুড়ি পিসিমা টাইপ হয়ে যাচ্ছ। বাঁধতে চাইছ কেন মানুষকে? যার যা ইচ্ছে করুক না!

নীলা: ফেল করবে যখন বুঝতে পারবে!

নীলাব্জ: ফেল যেন স্কুলের জামা পরে কেউ কোনওদিন করেনি! যার যেদিকে মতি, সে সেদিকেই যাবে। সে তুমি বোরখা পরাও, স্কুলের জামা পরাও, পাগড়ি পরাও, যা ইচ্ছে করো। ইউনিফর্ম পরা অনেক নিপাট ভদ্র ছেলেমেয়ে আমি দেখেছি। স্কুল ছুটির পর, বাড়ি ফেরার আগে সেই দলের বেশ কিছু মেয়েদের দেখেছি স্কার্টগুলো দু’ইঞ্চি করে গুটিয়ে নিতে। নিয়ম করে স্লেভ বানিয়ে রাখতে পারবে না মানুষকে। 

নীলা: বাঁদরামি দিয়ে তো সব জাস্টিফাই করা যায় না নীলাব্জ। অনুশাসন কে ভাঙছে, তা দিয়ে কিছু প্রমাণিত হয় না। কিন্তু স্কুলে একটা কঠোর ডিসিপ্লিন দরকার। নাহলে সিস্টেমটা ভেঙে পড়বে। সেই ডিসিপ্লিনের প্রথম ধাপ সবার এক রকম পোশাক, সবার এক পরিচয়: আমরা ছাত্র। এটাই আমাদের একমাত্র পরিচয়।

নীলাব্জ: কিন্তু আরও পরিচয় তো থাকে আমাদের। সেগুলোর প্রকাশ? কেউ হয়তো তার জেন্ডার, তার রাজনৈতিক আদর্শ…

নীলা: স্কুলের ভেতর সব প্রকাশ করে ফেলতে হবে? আঠারো বছর বয়স হোক, তারপর নাহয় মাথায় পতাকা, কাঁধে ট্যাটু, এইসব হাবিজাবি… তখন তো কেউ বাধা দিচ্ছে না। স্কুলের ভেতর বাঁদরামোটা কীসের?

নীলাব্জ: তুমি বুঝতে পারছ না। একজন বাচ্চার এই অনুশাসন ভাল নাই লাগতে পারে। ওর ডেভেলপমেন্ট…

নীলা: ভাল লাগার জন্য তো সব কিছু হয় না। শিখতে শুরু করুক সে। পৃথিবীতে সব কিছু তার ভাল লাগবে না।

নীলাব্জ: সবাইকে এক ছাঁচে ফেলে দেওয়া ঠিক নয় নীলা। আমরা প্রত্যেকে আলাদা। ওটাই বিউটি। সেটাকে বিকশিত হতে দিতে হবে…

নীলা: ইউনিফর্ম পরলে আমাদের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ সম্ভব হবে না, এই তো তোমার বক্তব্য? একদম বাজে কথা। আমাকে এসব বলতে এসো না, আমার জীবনে আরও হাজারটা কাজ আছে। ইউনিফর্ম পরে বড় হওয়া লক্ষ-লক্ষ ছেলেমেয়ের খুব ভালভাবেই ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছে এবং ভবিষ্যতেও পাবে। তুমি তোমার ওই গো অ্যাজ ইউ লাইকের আইডিয়া নিয়ে বিশ্ব বখাটে জেনারেশন তৈরি করো, যাও।

নীলাব্জ: বাপ রে! কী রেগে যাও তুমি!

নীলা: রাগব না? গায়ে পড়ে যত বাজে কথা …

নীলাব্জ: আর কিছু বছরে কলকাতার স্কুলগুলোই তুলে দেবে ইউনিফর্ম! মিলিয়ে নিয়ো, আমার কথা।

নীলা: তখন দেখা যাবে। এখন টাটা।

নীলাব্জ: বেশ, টাটা।

ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী