চোরের শিক্ষা
কোটেশন আমাদের জিজ্ঞেস করেছে, তুমি অধম হলে আমি উত্তম হব না কেন। কিন্তু আসলে আমরা পইপই জপেছি, তুমি অধম হলে আমি অধম হব না কেন। বা, আরও সরল করে বললে, তুমি অধম আচরণ করলে আমি সমান অধম আচরণ হেনে তোমায় ‘শঠে শাঠ্যং’ মার্কা শিক্ষা দেব না কেন। একজন যুবক মেমারি-তে তার মা-বাবাকে কুপিয়ে খুন করার পর বনগাঁয় একটা অনাথ আশ্রমে গিয়ে চারজনকে কোপ মেরেছে, তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তখন প্রায় একশো-দেড়শো লোক বনগাঁ থানায় চড়াও হয়ে বলেছে, ওকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। নিশ্চয়ই তারা চেয়েছে, গণধোলাই দিয়ে লোকটাকে মেরে ফেলতে।
এই দাবি নতুন নয়, আরও বহুবার বহু জায়গায় বহু মানুষ এই দাবি তুলেছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শিশুপাঠ্য নভেলে (‘ছায়াময়’) অবধি আমরা দেখি, চোর ধরা পড়ার পর চণ্ডীমণ্ডপে আলোচনা হচ্ছে: ‘এইখানেই মেরে পুঁতে ফেলব। আজকাল গাঁয়ে-গঞ্জে চোর-ডাকাত ধরা পড়লে পুলিশে দেওয়ারও রেওয়াজ নেই। মেরে পুঁতে ফেলছে সবাই।…’ আরেকজন বলে ওঠে, ‘…পুলিশে দিয়ে লাভ নেই । ওসব বন্দোবস্ত আছে। হাজত থেকে বেরিয়ে ফের দুষ্কর্মে লেগে পড়বে।…’ এখানে যদিও চরিত্রগুলোর সন্দেহ: দেশের ন্যায়ব্যবস্থায় এমন দুর্নীতি ঢুকেছে যে, তার ওপর ভরসার প্রশ্ন নেই, নিজেরা বিচার-ময়দানে নেমে পড়াই ভাল, কিন্তু তাছাড়াও লোকের এই ধোলাই-দাবির গোড়ায় আছে চটজলদি সমাধানের ইচ্ছে। খেয়াল রাখতে হবে, এই চাহিদার মূলে কিন্তু অন্যায়ের প্রতিকারেরই বাসনা, এতে জনগণের কোনও স্বার্থ নেই, বরং আছে খুব সংগত ক্ষোভ, জঘন্য আচরণের প্রতি উচিত-ঘৃণা, সামাজিক ন্যায়ের প্রতি উৎসাহ। অনেকেরই মত: যদি তুমি অন্যের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না থাকো, মানুষের জিনিস কেড়ে নাও, মানুষকে আক্রমণ করো, মেরে ফেলো— তাহলে তোমার মৌলিক অধিকারও তুমি সেই ক্রিয়ার মাধ্যমেই হারালে। তুমি যখন অন্যের সম্পত্তির অধিকার বা বেঁচে থাকার অধিকার স্বীকার করোনি, আমি তোমার বেঁচে থাকার অধিকার স্বীকার করব কেন?
কিন্তু এই হিংসাত্মক ন্যায়বাসনার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে সভ্যতা কী বলে? লোকটা যা-ই করে থাকুক, হুড়মুড়-সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, এর বিচার হবে, তার একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। এ-কথা শুনলে সাধারণের মুখ ভার হয়ে যায়। তার ওপর আবার চূড়ান্ত শাস্তি হিসেবে অনেক সময়েই প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় না, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড গোছের সাজা দেওয়া হয়। একে বিচার বিলম্বিত (ঘটনার দেড় বছর পর রায় বেরবে, তদ্দিনে ঘটনাটাই জনস্মৃতি থেকে লুপ্ত), তায় খুনির শাস্তি ফাঁসি না হলে মনে হয় যথেষ্ট হল না— সব মিলিয়ে এই বিচারব্যবস্থার প্রতি লোকের ততটা আস্থা নেই। তার চেয়ে অনেক জনমনোরঞ্জক উপসংহার: ও খুন করেছে, চলো আমরা সবাই মিলে ওকে খুন করে ফেলি। ল্যাঠা চুকে গেল, অঙ্ক মিলে গেল, ঘণ্টা চারেক-পাঁচেকের মধ্যে পৃথিবীতে ভারসাম্য ফিরে এল। মোটামুটি এই সমীকরণে যে রাষ্ট্ররা চলে— মেয়েদের দিকে তাকালেই পিছনে বেত মারব, চুরি করলেই হাত কেটে ফেলব, ধর্ষণ করলেই যৌনাঙ্গ ছেঁটে দেব— তাদের অনেকেই ভালবাসে। যদিও তোমার বাক্সে পোস্তর গুঁড়ো পড়ে থাকলেও তারা ড্রাগ চালানের অভিযোগে হপ্তাখানেকের মধ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে, তবু এই আলাউদ্দিন খিলজি গোছের ‘দেখো আর ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাও’ দাওয়াই অত্যন্ত জনপ্রিয়।
ভরসা এ-ই: জনপ্রিয় মত হলেই রাষ্ট্র তাকে মাথায় তুলে নাচে না, ‘হিংসার বদলে তক্ষুনি হিংসা’, বা ‘অপরাধের বদলে আরেকটা প্রতি-অপরাধ’ আজ বহু দেশই সমর্থন করে না। অনেকগুলো লোক মিলে একটা লোককে পেটাবে, এর মধ্যে যে ভয়ানক বর্বরতা আছে, তা তো তারা চিনতে পারেই, সঙ্গে মনে করে: একটা লোক কী অপরাধ করেছে, কেন তা করেছে এবং দোষী প্রমাণিত হলে কী তার শাস্তি হওয়া উচিত— এটা বহু যুক্তি, আলোচনা ও ভাবনার ব্যাপার, এবং তা করবে কয়েকজন চর্চাকারী, মানে, যারা আইন ও অনুশাসন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং অভিজ্ঞ। অর্থাৎ, তোমার খুব খানিক রাগ হলেই তুমি শাস্তি দেওয়ার অধিকারপ্রাপ্ত নও। তুমি আইন পড়লে ভাবলে ও তা নিয়ে নিজের মত সুচারুভাবে প্রকাশ করতে পারলে তবেই একজন অভিযুক্তের ভাগ্য নির্ধারণের এলাকায় ঢুকতে পারবে। আরও: তোমায় খতিয়ে দেখার অনুশীলন করতে হবে। শুধু আবেগ থাকলেই হয় না, অশ্রু থাকলেই হয় না, সঙ্গে শিক্ষা চাই। আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে, তা পেরিয়ে দেখতে চাওয়ার শিক্ষা, প্রতিবর্ত-ক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত না নেওয়ার শিক্ষা, প্রতিশোধস্পৃহা-তাড়িত না হয়ে যুক্তি দিয়ে নিজের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা, এবং অবশ্যই মানবিকতার শিক্ষা— যা বলে: অপরাধীরও মানবাধিকার আছে (নইলে তো জেলখানায় তাকে খাবার বা ওষুধ দেওয়ার প্রশ্নই উঠত না)।

মানে, এখানে অধিকারীভেদের প্রশ্ন আছে। সব লোকের মত থাকতেই পারে, কিন্তু তাদের মতানুযায়ী একটা লোককে মারা বা ধরা যাবে না। কয়েকটা লোক সেই চূড়ান্ত মত দেবে, যারা ন্যায়শাসন নিয়ে ভাবে ও সে-ব্যাপার নিয়মিত অনুশীলন করে। অধিকারীভেদ সবেতেই স্বীকার করা হয়, টিভিতে মতামত দেন বিশেষজ্ঞরা, সাহিত্য পুরস্কার দেয়, কয়েকজন লেখক বা সমালোচকের কমিটি (যদিও বহু গান-নাচের রিয়েলিটি শো-র মতো অনলাইন ভোটে সাধারণের মতকে মাথায় তুলে নাচা শুরু হল বলে)। তবে এই তুলনাটা দুর্বল, কারণ শিল্পে অযোগ্য লোককে পুরস্কার দেওয়া হলে বা টেলিভিশনে আবোল-তাবোল বকলে, সেগুলো তেমন নিদারুণ ব্যাপার নয়, কিন্তু কোনও মানুষকে তার প্রাপ্যের অধিক শাস্তি দিলে তার জীবনটাই বিপর্যস্ত হযে যায়। কিন্তু পৃথিবী যে-প্যাঁচে ইদানীং ঘুরপাক খাচ্ছে, তাতে টিভি চ্যানেলের খবর পর্যন্ত (সামাজিক মাধ্যমের মতোই) ঔচিত্যের বদলে জনপ্রিয়তার দিকে ঢলছে। নেতানেত্রীরাও যদি সেই ফাঁদে পা দেন, তাহলে কোনওদিন গণধোলাই না মান্যতা পেয়ে যায়।
কিন্তু অন্তত একজন চোর তার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। ক’দিন আগে পাটুলিতে তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে গণধোলাই দেওয়া হয়েছে। তারপর পুলিশের জিম্মায় অর্পণ করা হয়েছে। সেই চোর ফিরতি এইআইআর করেছে। যারা তাকে মেরেছে, তাদের বিরুদ্ধে। তার বক্তব্য, সে চুরি করতে ঢুকেছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে মারার অধিকার তো মানুষকে কেউ দেয়নি। একজন চোর মরমে মরে না-থেকে, নিজের অধিকার-লঙ্ঘন বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সচেতন করেছে ও নালিশ দায়ের করেছে, সঙ্গে বাঘাযতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালের মেডিক্যাল রিপোর্ট দাখিল করেছে (যেখানে বলা আছে তার মুখে ও দাঁতে আঘাতের কথা), এ এক বিরাট ব্যাপার। আরও বড় ব্যাপার হল, সে এফআইআর গ্রহণ করা হয়েছে, ‘ধুর, তুই তো চোর, তোর আবার নালিশ করার অধিকার কী’ বলে বাতিল করে দেওয়া হয়নি। কলকাতা পুলিশের এক সিনিয়র অফিসার বলেছেন, তদন্ত হবে— নালিশ যে করছে সে চোর কি না, তা আমরা দেখব না।
সব লোকের মত থাকতেই পারে, কিন্তু তাদের মতানুযায়ী একটা লোককে মারা বা ধরা যাবে না। কয়েকটা লোক সেই চূড়ান্ত মত দেবে, যারা ন্যায়শাসন নিয়ে ভাবে ও সে-ব্যাপার নিয়মিত অনুশীলন করে। অধিকারীভেদ সবেতেই স্বীকার করা হয়, টিভিতে মতামত দেন বিশেষজ্ঞরা, সাহিত্য পুরস্কার দেয়, কয়েকজন লেখক বা সমালোচকের কমিটি (যদিও বহু গান-নাচের রিয়েলিটি শো-র মতো অনলাইন ভোটে সাধারণের মতকে মাথায় তুলে নাচা শুরু হল বলে)। তবে এই তুলনাটা দুর্বল, কারণ শিল্পে অযোগ্য লোককে পুরস্কার দেওয়া হলে বা টেলিভিশনে আবোল-তাবোল বকলে, সেগুলো তেমন নিদারুণ ব্যাপার নয়, কিন্তু কোনও মানুষকে তার প্রাপ্যের অধিক শাস্তি দিলে তার জীবনটাই বিপর্যস্ত হযে যায়।
এইক্ষেত্রে চোরের যেটা লক্ষণীয় গুণ: সে দুটো ব্যাপারকে গুলিয়ে ফেলেনি। সে স্বীকার করছে, সে যা করেছে তা অপরাধ, কিন্তু একই সঙ্গে বলছে, তার প্রতি যা করা হয়েছে, তাও অপরাধ— চোরের অন্যায়ের বিরুদ্ধ-বন্দোবস্ত হিসেবে করা হয়েছে বলে সেই অন্যায়টা সংগত হয়ে যায় না। চোর যদি ভাবত, সে নিজে লজ্জাকর কাজ করেছে বলে অন্য লোকের অন্য কাজের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না, তা হত আমাদের সমাজের স্বাভাবিক আচরণ। কারণ আমরা যখন নিজে লজ্জায় থাকি, তখন সব অপমানকেই প্রাপ্য বলে মেনে নিই। একবার যদি প্রমাণ হয়ে যায়, আমি পরকীয়া করেছি, তখন ভাতে চুল পড়লেও খ্যাচখ্যাচ করে উঠতে পিছপা হই, কে বলতে পারে উল্টোদিক থেকে বলবে কি না, তুমি তো আমাদের সম্পর্কেই আবর্জনা ফেলে দিয়েছ। যে লোকটা ঘুষ খেয়ে ধরা পড়েছে, সে রাস্তায় জল জমা নিয়ে কথা বলতে ডরায়।
ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা হয় না, সব জিনিস মেপেজুখে একটা বিরাট মণ্ড পাকিয়ে ফেলা আমাদের স্বভাব, কারণ আমরা একটা মানুষকে গোটাগুটি দেখি, একবার তার গায়ে ভিলেনের তকমা লেগে গেলে, তার প্রতিবাদের অধিকারের ওপর ময়লা ঠোঙা মুড়ে রাখি। আমাদের স্বীকৃত যুক্তি: ও তো অমুক ক্ষেত্রে ভুল কাজ করেছে, ফলে তমুক ক্ষেত্রে ওর কথা শুনব কেন? উত্তরটা সহজ, ক্ষেত্র দুটো আলাদা বলেই শুনব। কিন্তু তা আমরা চলতি ঝগড়ায় মানি না। বিতর্কেও একটা রাজনৈতিক দলের লোক অন্য দলের লোক সম্পর্কে বলেন, যে-দল নিজের জমানায় ওইভাবে খুনখারাপি করেছে, তার কাছ থেকে আমরা ন্যায়ের উপদেশ শুনব না। পথচারী পড়ে-থাকা মাতালকে দেখে বলে, অ্যাই ছোট বাচ্চা কে আছিস, এর মুখে পেচ্ছাপ করে দে। সবাই হেসে কুটিপাটি হয়। কারণ যে-লোকটা মদ খেয়ে প্রকাশ্যে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে, তার তো কদর্য ব্যবহারই প্রাপ্য।
কিন্তু আমাদের এই হাতে-গরম সমাধানেচ্ছার ওপরে উঠতে হবে। প্রকৃত ঔচিত্যবাদীকে সহজতা ও ধৈর্যহীনতার ফাঁদ এড়িয়ে চলতে হয়। সে সাধনা কঠিন। তার জন্য মুহুর্মুহু নিজেকে সামলাতে হবে, বিরক্তি, বিতৃষ্ণা, অসহিষ্ণুতা গিলতে হবে, এমনকী, অনুব্রত মণ্ডলও কোনও যুক্তি দিলে তার যাথার্থ্য বিচার করতে হবে, ‘ছ্যা ছ্যা, ওই বদরুচিসম্পন্ন লোকটার একটা অক্ষরও শুনব না’ বলে মুখ ফেরালে চলবে না।