বিনিদ্র: পর্ব ৫৬

‘মনে হয় বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেল গুরু। বড় অসময়ে। একটু ধৈর্য রাখতে পারল না। মাত্র উনচল্লিশ বছরে চলে যাওয়া— বেঁচে থাকলে আরও কত মহান কীর্তি করে যেতে পারত সে। খুব আফশোশ হয়। তারাভরা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবন-দেবতার উদ্দেশে বলি— ‘হে ঈশ্বর, গুরুকে একটু শান্তি দিও তুমি, ওর চোখে একটু ঘুম দিও, ও বহুদিন ‘বিনিদ্র’, বড় জ্বালায় জ্বলছে সে।’ গুরুর অকাল প্রয়াণ।

বিনিদ্র: পর্ব ৫৫

গুরুর মনের খবর বোধহয় ভগবান ছাড়া কারুর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। এর দুদিন পরেই আমি কলকাতায় ফিরে আসি। কথা হয়েছিল পুজোর পরে গুরু আবার আমায় বোম্বেতে ডাকবে। কিন্তু হায়, তখন বুঝিনি এই আমাদের শেষ দেখা, এরপরে আমাদের আর জীবনে কোনোদিন দেখা হবে না।

বিনিদ্র: পর্ব ৫৪

‘লোকে বলে গুরু দত্তর জীবনে সব চেয়ে বড় অভিশাপ তার গীতার সঙ্গে বিয়েটা! কিন্তু সেটা যে কত বড় ভুল, তা আমি কেমন করে বোঝাব। আসলে ওয়াহিদা রেহমান কেবল একটা উপলক্ষ্য। গীতা যদি আর একটু হিসেবী হত, আর একটু কড়া হাতে গুরুর জীবনের রাশ টেনে ধরত, তাহলে হয়তো আর আমাকে এই রাত জেগে ‘বিনিদ্র’ লিখতে হত না।’ ছন্নছাড়া জীবন।

বিনিদ্র: পর্ব ৫৩

‘অসুখের মধ্যে কেমন একটা অসহায়তা আছে। সেই অসহায়তা অন্যের সামনে লজ্জা পায়। বিশেষ করে সুস্থ লোকের সামনে। অথচ সেই সুস্থ লোকের সাহায্যও দরকার। কিন্তু তখন মনে হয় আমার দুর্বলতা যেন কারো নজরে না পড়ে। আমি যে অসমর্থ, এটা যেন কেউ জানতে না পারে।’ অসুস্থ গুরু।

বিনিদ্র: পর্ব ৫২

‘বড় অবাক হয়ে গেলাম, গুরু এতে এত বিচলিত হল কেন? গুরু তো এমন ছিল না।
মনে আছে, পরদিনই সকালে মহাবলীপুরম্-এর টুরিস্ট-হাউসে চলে গেলাম। মদ্রাজ-স্টুডিওর কথা আবার ভুলে গেল গুরু। অত যে মন খারাপ তা এক নিমেষেই গুরু ভুলে গেল। তার মনে আর কোনও দাগ লেগে রইল না দেখে আমার খুব ভালো লাগল। পরের দিন থেকে গুরু আবার সহজ-স্বাভাবিক হয়ে উঠল।’ মাদ্রাজে শুটিং-বিভ্রাট।

বিনিদ্র: পর্ব ৫১

‘একদিন কে যেন বলেছিলেন— বলছ কি হে? বখে যাওয়া কি অত সহজ? সংসারে বুদ্ধদেবের মতো রাজ্য ছেড়ে অরণ্যে যাওয়াও যেমন শক্ত, লজ্জা-সঙ্কোচ ট্যাগ করে বখে যাওয়াও ঠিক তেমনি শক্ত। কিন্তু সংসারে বাস করে পুরোপুরি নিরাসক্ত হওয়াও সহজ নয়, তাই মাঝে মাঝে ইনকামট্যাক্স নিয়ে, উকিল-অ্যাটর্নি নিয়ে বিব্রতও হত খুব।’ সংসার সীমান্তে গুরু দত্ত।

বিনিদ্র: পর্ব ৫০

‘কে একজন সেই ফাঁকে বারান্দার একমাত্র আলোটা নিভিয়ে দিলে। আর সঙ্গে সঙ্গে নিবিড় নীলিমায় অলংকৃত হয়ে উঠল বাইরের আর মনের আকাশ। মনে হল আমরা যে আর মহাবলীপুরম্-এ নেই। আমরা সুদূর কোন্ দ্বীপের ভেতরে চলে গিয়েছি। সেখানে শুধু হাসি, শুধু গল্প আর শুধু আনন্দ। তখন সামনে পেছনে পাশে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। শুধু কথা শুনছি। শুধু সিগারেটের আগুনে বিন্দুগুলো দেখতে পাচ্ছি। আর পুরুষ-নারী সব একাকার হয়ে গেছে।’ মহাবলীপুরম্‌-এ গুরুর পার্টি।

বিনিদ্র: পর্ব ৪৯

‘আসলে ওই রান্নাটা ছিল উপলক্ষ। গুরু সব সময়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখে সমস্ত কিছু ভুলে থাকতে চাইত। ভুলতে চাইত সংসারকে, ভুলতে চাইত গীতাকে, ভুলতে চাইত ছেলে-মেয়ে সকলকে। সকলকে ভুলেই সে ভোলানাথ হবার আশায় কখনও রান্না করত, কখনও বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে আড্ডা দিত, কখনও বা হুইস্কির বোতলে আকন্ঠ ডুব দিত!’ একাকী শিল্পী।

বিনিদ্র: পর্ব ৪৮

‘মাদ্রাজে গুরুর সামনে বসে গল্প করতে করতে এই সব কথাগুলোই কেবল মনে পড়ত। ভাবতাম এ-মানুষটা যে হাসে, অভিনয় করে, গল্প করে এটাই তো একটা বিস্ময়! আর এ মানুষটা যে ঘুমোতে পারে না, এটাই তো স্বাভাবিক! যদি ঘুমোতে পারত তাহলেই আমি হয়তো বেশি অবাক হতাম।’ কেন গুরু বিনিদ্র।

বিনিদ্র: পর্ব ৪৭

‘বুঝলাম, গুরু ঠিক এভাবে এই নিরিবিলিতে আর থাকতে পারছে না। সে অসহ্য হয়ে উঠেছে এই কদিনেরই মধ্যে। আমার এখানে যত ভালো লাগছে, তার তত খারাপ লাগছে। গল্প লেখা এগোচ্ছে, ওদিকে তার শুটিংও চলছে। তাস খেলতে পাচ্ছে না। আমি তাকে সমস্ত আপদ থেকে দূরে রেখেছি।’ মহাবলীপুরম্‌-এর একাকীত্ব।

বিনিদ্র: পর্ব ৪৬

‘গুরু আমার কথায় অবাক হয়ে গেল। সে যেন আমার কথায় নিজেকে খুঁজে পেল। আমি বললাম— আপনি কি বেশিদিন কাউকে ভালোবাসতে পারেন? আপনার যে সবাইকেই কিছুদিন পরে একঘেয়ে লাগে।’ মহাবলীপুরম্‌-এ গুরুর সান্নিধ্য।

বিনিদ্র: পর্ব ৪৫

‘মহাবলীপুরম্‌’ নাম শোনা ছিল জায়গাটার। এককালে ছিল পহ্লবীদের একটা বিখ্যাত বন্দর। তারপর আছে লাইট-হাউস তারপর পক্ষীতীর্থ। আমরা দেশ-ভ্রমণ করতে আসিনি। একটা নিরিবিলি জায়গা শুধু খুঁজছিলাম, যেখানে দুজন মুখোমুখি বসে গল্প করা যায়। গল্প মানে সিনেমার গল্প।’ শহর ছেড়ে শান্তির খোঁজে।