ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • স্বাধীনতার সাত-পাঁচ: ১


    ডাকবাংলা.কম (August 21, 2022)
     

    ২০২২ সালে আমরা ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে পা রাখলাম। কিন্তু যে আশার আলোয়, যে প্রতিশ্রুতির ঘনঘটায় ভারত ‘স্বাধীন’ হয়েছিল সে-বছর, তার কতটুকু অবশিষ্ট আছে আজ? এই দেশের মধ্যে যারা বসবাস করছি এই সময়ে, তারা আদৌ স্বাধীন তো? এই প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করেই পেন আমেরিকা জানতে চেয়েছিল, বিভিন্ন লেখকের বক্তব্য। ‘স্বাধীন’ বা ‘স্বাধীনতা’ শব্দগুলো নিয়ে তাঁরা কী ভাবছেন আজকের দিনে, তাঁরা তা জানিয়েছেন। সেই শতাধিক লেখকের শতাধিক ভাবনার কথাগুলোই এবার থেকে বাংলা অনুবাদে প্রকাশ পাবে ডাকবাংলা.কম-এ।

    ঝুম্পা লাহিড়ী (লেখক)

    আমি তো ভারতের বাইরেই জন্মেছি, আমার বেড়ে ওঠাও ভারতের বাইরে। ফলে, এই দেশ, শুরু থেকেই, তার অনুপস্থিতির মধ্য দিয়ে আমার মনের ভেতর আরও বেশি করে যেন জায়গা করে নিয়েছিল। দেখতাম, দেশের জন্য আমার বাবা-মায়ের মনকেমন। সেই মনকেমনের পাল্লা ভারী হলেই তারা আশপাশে আরও ভারতীয় মানুষজনকে খুঁজত। তাদের সঙ্গে দেখা, কথা, খাওয়া-দাওয়া, গল্পগাছা, এই-সেই। আর এই সূত্রে ভারতীয় সমাজকে আমার গোড়া থেকেই খুব বৈচিত্রময় মনে হত। স্মল রোড আইল্যান্ড টাউনে, আমাদের বাড়িতে, যেখানে আমার বড় হয়ে ওঠা— সেখানে যখনই ভারতীয় কোনও পরিবারকে বাবা-মা নেমন্তন্ন করত, দেখতাম, কী অদ্ভুত! ভিন্ন ভিন্ন কথার ধরন, ভিন্ন রুচির খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাক, তাদের প্রার্থনার ধরনও ভিন্ন। মনে হত, ভারত যেন অজস্র রকমের ব্যক্তিগত-কে ধরে রাখার একটা বিশাল অনন্ত কৌটো। এ-কথা বলছি না যে এই ভিন্নতাগুলো ‘একটা ঢালাও ছাঁদের ভারত’ সম্পর্কে আমার ধারণাকে সমৃদ্ধ করত, বলছি যে, এটাই ভারত। সেদিক থেকে মনে হত, ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর চেয়ে আলোকবর্ষ এগিয়ে। ইউনাইটেড স্টেট্‌স নামেই বহু সংস্কৃতির মিশেল-ক্ষেত্র, আদতে বিচ্ছেদপন্থী এবং সংকীর্ণ প্রাদেশিক বলেই আমার মনে হয়েছে বারবার। কলকাতায় যখনই আমরা আসতাম, মাকে বলতে শুনতাম— এই শহর ভারতের সমস্ত সম্প্রদায় ও ভাষাভাষীর মানুষকেই আপন করে নিতে পারে। এসব থেকেই আমার মনে হত, অন্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা একেবারে ভারতের স্বভাবের ভেতরে বোনা রয়েছে। ভারতের বহুভাষিক বৈশিষ্ট্যটি আমাকে একইসঙ্গে অনুপ্রাণিত করেছে ও প্রাণে আরাম দিয়েছে, কারণ, তা প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ, আলাপচারিতা ও অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছে। একাধিক ভাষার সহাবস্থান মানুষের কৌতূহল গড়ে তোলে, ভাব-বিনিময় ও তার ব্যাখ্যার রাস্তাটাকে আরও চওড়া করে, সর্বোপরি একটা কোনও ভাষা বা গোষ্ঠীর আধিপত্যের সম্ভাবনা খর্ব করে। এই বহুমাত্রিক জটিল সুতোর বন্ধনী থেকে একটা-দুটো গিঁট খুলে দিন, কিংবা কেটে বাদ দিয়ে দিন একটুখানি সুতো; দেখবেন, সেই কথোপকথন, আলাপচারিতার ক্ষেত্র কেমন চোখের নিমেষে উধাও হয়ে গেছে। পড়ে থাকবে একটা খাপছাড়া সমাজ, আরোপিত নীরবতার মধ্যে এক বিদ্বেষপরায়ণ ও ঠনঠনে জাতীয়তাবাদ।

    বিশাখা দেশাই (লেখক)

    ১৯৪৭ সালে ভারত যখন ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করল, গোটা বিশ্ব তখন অবাক হয়েছিল এই ভূখণ্ডের সুপ্রাচীন সংস্কৃতি দেখে, এবং সদ্যোজাত একটি দেশ হিসেবে তাকে আত্মপ্রকাশ করতে দেখে। এই বিস্ময় কি ভারত খুব ধনী ছিল বলে? একদমই না। ঔপনিবেশিক শ্রেণি, মূলত ব্রিটিশরা একেবারে নিংড়ে নিয়েছিল এই দেশটাকে। তারা আসার সময় এই দেশটা যেমন ছিল, তার থেকে বহুগুণে দরিদ্র করে ছেড়েছিল। দেশটাকে খারাপভাবে ভাগ করে ফেলার ফলে বেশ কিছু হাঙ্গামাও বেধেছিল, কিন্তু গোটা বিশ্ব বিশেষ সমীহ নিয়ে দেশটার দিকে তাকিয়েছিল, কারণ এ দেশের ছিল সেই নৈতিক কর্তৃত্ব— গান্ধীজি প্রদর্শিত অহিংসার পথ। অহিংসার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের আশ্চর্য কৃতিত্ব।

    স্বাধীনতার প্রথম দিকে, গান্ধীবাদী এক স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এটা ভেবে আমার ভাল লাগত যে, এই তরুণ দেশ প্রাচীন সেই বৈদিক শ্লোককে মান্য করে পৃথিবীর সকলকে নিজের আত্মীয় বলে মনে করে। দেশের সংসদ ভবনের প্রবেশদ্বারে খোদিত রয়েছে সেই বিখ্যাত শ্লোক : বসুধৈব কুটুম্বকম। সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা এবং দেশের সংখ্যালঘু সমাজকে সুরক্ষা প্রদান ছিল এই রাষ্ট্রের মূলগত দায়িত্ব, ঠিক যেমনটি নতুন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

    ৭৫ বছর পরে কী দেখছি আমরা? দুঃখ হয়। এমন মহান চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্ত যে-দেশে জন্ম নিল, এখন সেই দেশে সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এগুলো সচেতন ভাবে মুছে ফেলার অভিসন্ধি। এটা দুর্ভাগ্যের।

    বন্দনা সিংহ (লেখক, অধ্যাপক)

    ওরা আমাকে মা বলে ডাকত। কী ছিলাম না আমি? বন ছিলাম, বিস্তীর্ণ তৃণভূমি ছিলাম। ছিলাম নদী, ছিলাম হ্রদ। ছিলাম মেঘ, কাঠফাটা মাটিকে পৌঁছে দিতাম উর্বরতার প্রতিশ্রুতি। পর্বতপ্রতিম হাতির দল, অরণ্যকে আকার দিত তাদের পথে পথে। পাখি আর সুশীর্ণ পায়ের হরিণ সেই অরণ্যে অরণ্যানীতে ঘুরে বেড়াত, প্রজাপতি নেচে বেড়াত সূর্যালোকের রেখায়-রেখায়। মানুষ বাস করত শহরে, গ্রামে, অরণ্যে, উপত্যকায়, মাঠেঘাটে। ছিল সাম্রাজ্য, শত্রুর অনুপ্রবেশ, যুদ্ধ আর মিলন-মহিমাও। ছিল প্রাচীন শোষণ আর বিভেদরেখাও। সর্বোপরি এই ভূখণ্ড ছিল উদার, প্রাচুর্যময়। কিন্তু তেমন ভেদাভেদ ছিল না। 

    তারপর সমুদ্র পেরিয়ে এল উপনিবেশ গড়তে চাওয়া লোকেরা। তাদের প্রাণহীন যান্ত্রিক চোখ দিয়ে আমাকে তারা মাপল, খোদাই করল, খুঁড়ল, সংখ্যা এবং লাইন দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করল আমার শরীর, টুকরো-টুকরো করল। আমার শস্যশ্যামল, জীবনের মহানন্দে সুরভিত শরীরকে কেবল ‘সম্পদ’ এবং ‘কাঁচামাল’-এর উৎস হিসেবেই দেখল তারা। আমার সন্তান মানুষদের তারা বন্দি করল। কেবলই কারাগারে নয়, মননের দিক থেকেও বন্দি করল, কব্জা করার জন্য বিভেদরেখাকে আরও গভীর করল। সেই আগল ছিঁড়ে বেরতে কত জীবন কেটে গেল! তারপর আমার সন্তানরা বলল— মা! এবার তুই মুক্ত! তারা মুক্তির আনন্দে রাস্তায়-রাস্তায় নেমে পড়েছে, আনন্দে ভাসছে, সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের মাদকতায় আচ্ছন্ন।

    সন্তানেরা, এখন তোমরাও আমায় মা বলেই ডাকো। স্বাধীনতা উদযাপন করতে দেখি তোমাদের। কিন্তু দ্যাখো, তোমাদের নেতারা যে আমার শরীরকে ক্রমশ টুকরো-টুকরো করে দিচ্ছে। যে যত বেশি দর হাঁকছে, তাকে বিক্রি করে দিচ্ছে কেটে আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। বরফ ঢাকা আমার মুকুট, আমার হৃদয় হাসদেও অরণ্য, আমার প্রসারিত বাহু কচ্ছ এবং দেহিং পাটকাই, আমার বালুকাময় পা, যাকে ধুয়ে দিচ্ছে তিন সমুদ্রের ঢেউ— এরা সব বিক্রি হয়ে যাবে? তোমাদের কোটিপতি লোকগুলো গরিবদের অস্থিমজ্জাহাড়ের স্তূপে বিলাসিতা ও অহংয়ের অট্টালিকা তুলছে। খাবারের লোভে, চাষজমির হয়রানিতে মুছে যাচ্ছে একের পর এক অরণ্যশোভা, নিসর্গ প্রান্তর। আর তার পরিণতি : ধ্বংস, দখল, দুর্দশা। হারানো অরণ্যের জন্য বন্যপ্রাণী কাঁদে, খরচল পাখিরা তাদের বিলুপ্তিকে চোখের সামনে দেখতে পায়, দুঃখে চকচকে তাদের চোখ। আর আমার রক্ষককুল, বন এবং মরুভূমি, তৃণভূমি ও পর্বত, গ্রাম এবং শহরের বাসিন্দা মানুষরা, আমার সত্যবাদী সন্তানরা ন্যায়ের সংগ্রামে মাইলের পর মাইলের পায়ে হেঁটে মিছিল করে। আর তাদেরই তোমরা কণ্ঠরোধের চেষ্টা করো, তাদেরকে কারাগারের দেয়ালে আবদ্ধ করে রাখতে চাও।

    এটাই কি স্বাধীনতা?

    বলো গিয়ে তোমার নেতাদের : আমি কেবলই মা নই, আরও বেশি কিছু। আমি বজ্র, আমি বরফ-ধ্বস, আমি সেই রহস্য যা কেবল গভীর বন জানে। আমি আছড়ে পড়া জলের ক্ষোভ। আমি সেই অদম্য বাতাস, যার তীব্রতায় তোমার ভ্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। আমি সেই বন্যা যে তোমার শিকারদের কবর উন্মোচিত করে দেয়। আমি সেই সত্য যার সামনে তোমার মিথ্যার প্রাসাদ বালির মতো ঝরে পড়ে। কোনও নাম, কোনও সীমানা আমাকে ধরে রাখতে পারে না। কোনও ঘৃণার রেখা, কোনও প্রমত্ত ধ্বজা আমাকে নির্ধারণ করতে পারে না। সন্তানেরা, যদি সত্যিই আমাকে জানতে চাও, তাহলে শিশুর মতো খালি হাতে আমার কাছে এসো, শেখো। স্বাধীনতাকে বুঝতে হলে, কারাগারের লৌহকপাট ভেঙে ফেলতে হবে, যেতে হবে তৃণভূমির কাছে, উদ্ভিদ আর বন্যপ্রাণীর মহিমা স্বীকার করতে হবে। মানুষের বর্ণ, ধর্ম, জাতির বৈচিত্রকে সানন্দে গ্রহণ করতে হবে। ত্যাগ করতে হবে লোভ, ঘৃণা এবং ভীতিপ্রদর্শনের স্পৃহা।

    তবেই তোমার মুক্তি।

    যশিকা দত্ত (লেখক, সাংবাদিক)

    স্বাধীনতার মুখচ্ছবিটি কেমন? কী তার রূপ? ধার করা সময়ে যাদের সার্বভৌমত্ব বেঁচে থাকে তেমন জনগণের কাছে? আমাদের কাছে? যাদের পাশ দিয়ে যে-কেউ হেঁটে যাওয়ার সময় ‘জাত’ নামে পরিচিত ধাতুর খাঁচাগুলিতে ঠোকর দিয়ে আওয়াজ তুলতে পারে, যাতে আমাদের অস্তিত্ব ঝনঝনিয়ে ওঠে? অথচ এই দেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা তো অনেক আগেই করা হয়েছে। 

    আমরা শুনে আসছি, ১৯৪৭ সালে, স্বাধীনতা এল অনেক লড়াই, অনেক কষ্ট, অনেক রক্তক্ষয়ের পর। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে তখনও দর-কষাকষি চলছিল। সাধারণতন্ত্রের নামে, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম, উজ্জ্বল, নতুন’ হওয়ার সে কী উদ্যম। কিন্তু সেই উদ্যমের প্রয়াসে জাতপাত নামক শৃঙ্খলের নিরসন তারা ঘটাল আর কই, এমনকী তা ভাঙার কথা ভাবেওনি কখনও।

    আমাদেরকে মুক্ত করা মানে তো সকলের মুক্তি। নীচের দিকে তাকানোর জন্য কেউ অবশিষ্টই তো থাকবে না। কাদের ঘাড়ে মাথায় ভর করে তখন জাতপাতের পিচ্ছিল সিঁড়িটা রাখবে, কীসের ওপর বসে তারা তাদের এবং আমাদের বিশ্বকে সংজ্ঞায়িত করবে? তাদের অস্তিত্বকে নতুন করে ঠিকানা দেওয়া, তাদের জীবনকে ‘ঊর্ধ্বতন’-এর মায়া থেকে মুক্তি দেওয়া, উচ্চ-নীচ ধারণার পুনর্বিন্যাস ঘটানো কি চাট্টিখানি কথা? বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? আমাদেরও স্বাধীন হওয়ার পালা আসবে, তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এত তাড়াতাড়ি চাইলে সবাই আমাদের লোভী বলবে না কি? খালি জিজ্ঞাসা করা, খালি দাবি, কেবলই আদেশ ভাঙার হুংকার! আরে, একটা জাতপাত প্রথা, যা কিনা ওদের ঠিকঠাক যুক্তি বলে মনে হয়েছে, সেসবকে নস্যাৎ করার বারংবার চেষ্টা চালানোটা কেমন বেয়াদপি!

    শোনা যাচ্ছে, পরিস্থিতি নাকি এখন বেজায় খারাপ। ঠিকই। অলীক, অশরীরী বা স্পষ্ট— সমস্তরকম স্বাধীনতা এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। যুদ্ধ করে, জিতে এবং দর-কষাকষি করে যে-স্বাধীনতা এত কষ্ট করে এল, কেমন হু হু করে বাষ্পীভূত হয়ে গেল সে। ঠিক যেন পেতলের কলের মতো। টপটপ করে জল পড়তে থাকল সারা রাত। তারপর হঠাৎই থেমে গেল পুরোপুরি। তেমনই, এমনতর পরিস্থিতিতে আমরা আগেও ছিলাম। আদপে আমরা সবসময়ই এই পরিস্থিতির মধ্যেই রয়ে ছিলাম। কেবল কেউ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সকলের অবস্থা তো আর খারাপ হয়নি। হয়ও না।

    ‘Will She lose it again?’ গণতন্ত্র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, দেশ ও তার দলিত সন্তানদের সত্যিকারের স্বাধীন ঘোষিত করার কয়েক মাস আগে, বাবাসাহেব ডক্টর বি আর আম্বেদকর ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভেবেছিলেন এই প্রশ্ন, ভেবেছিলেন ফের এই স্বাধীনতা হারিয়ে যাওয়ার কথা। আর সেটি সত্যি, ভারত সত্যিই হারাচ্ছে ক্রমশ তার স্বাধীনতাকে। কিন্তু স্বাধীনতা, তা সে তুমুল দর-কষাকষির বিনিময়েও যদি আসে, তাহলেও সে অমূল্য। এবং সেই অমূল্যরত্ন বজায় রাখার জন্য খাটতে হয়, লেগে থাকতে হয়। আমরা নিশ্চয়ই সম্মত হব তাহলে, যে, কিছু মানুষ রয়েছে এই দেশে, যারা ৭৫ বছর ধরে অপেক্ষা করে আসছে। মুক্তি পাওয়ার জন্য!

    জিয়া জাফরি (লেখক)

    স্মৃতি, দিল্লি, ২০১৪:

    আমরা তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে। শীতকাল, কিন্তু হালকা রোদের আঁচে গরমের আভা ছিল বেশ। হালকা নীল শাড়ি পরেছিলে সেদিন। হঠাৎই আমার দিকে ঘুরে বললে, ‘এখনকার পৃথিবীর সমস্ত ঝামেলা এই মুসলিমদের হাতেই শুরু হয়েছে! ব্যাপারটা খেয়াল করোনি?’ এবং তারপর, বলেই চললে, ‘আমরা শুধু চাই তারা একটি কাগজে সই করে দিক, যেখানে লেখা থাকবে তারা আমাদের আইন মেনে চলবে। এটা হিন্দুদের দেশ— আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমাদের কথাই শেষ কথা। যদি তারা মানতে না পারে, তাহলে এই দেশ ছেড়ে তারা চলে যেতে পারে!’

    কীভাবে এই কথাগুলো বলতে পারলে তুমি? তোমারই নাতি-নাতনিদের সামনে, যারা কিনা অর্ধেক মুসলিম! স্পষ্ট দিবালোকে কীভাবে পারলে তুমি এই কথাগুলো বলতে! তুমি কি জানো না আমার পদবি? তুমি কি দেখোনি, আমি এরপর কাঁপছি? আমি এতটাই আতঙ্কিত হয়ে গেছি যে, কথা বলার জোরটুকু আমার মধ্যে নেই। তুমি কি সত্যিই এই কথাগুলো বিশ্বাস করো? না কি কথাগুলো মিসেস জোন্সের কথা, জোন্সদের কথা, যা প্রায় বন্ধুত্বপূর্ণ স্বরে, অতশত না-ভেবে উচ্চারিত হয়েছিল? আমরা কি রোয়ান্ডায় আছি? এভাবে কথা বলার ধরন কবে থেকে জায়েজ হয়ে গেল? কিছু তো আমাকে বলতে হবেই এর উত্তরে। কিন্তু আমার মুখে রা কই? আমি তাদের খুঁজে পাচ্ছি না। ছোট থেকেই এই এক পুরনো অভ্যেস। অনেক কষ্টে, শক্তি সঞ্চয় করে, আমি ধীরে আস্তে বললাম— তুমি যা বলছ, তা সত্যি নয়। 

    আমি তখনও কাঁপছি। এরপর সে যে আরও কী কী বলে গেল, আমি আর শুনতে পেলাম না। আমি আমার মায়ের পরিবারের পরিচয়ের ছাতায় রয়েছি, সাংস্কৃতিকভাবে তো বটেই। আমি হিন্দু পরিচয় বহন করছি মায়ের দিক থেকে। কিন্তু এই কথা শোনার পর, এই মুহূর্ত থেকে, আমি মুসলিম। আমি মুসলমান।

    সেই উঠোন, আলো, মানুষজন— সকলকে আমার ক্ষতিকর মনে হতে লাগল। একটা পরিচিত মুখ খুঁজে পেলাম শেষমেশ। হতে পারে, তার চোখই আমাকে খুঁজে নিল। তার শ্বশুরমশাই। সব কিছু কেমন চক্রান্তমূলক লাগছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল?’ বললাম সব। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কি মেনে নেওয়া যায়, বলুন?’ তিনি মৃদু মাথা নাড়েন। বললেন, ‘গায়ে মেখো না, পারিবারিক সমাবেশে এসব কথা না তোলাই ভাল।’ 

    গাড়িতে ওঠার পর, আমি তো আরওই ছটফট করতে থাকলাম। কিছুতেই চুপ করতে পারছি না। কেউ একজন বলল, ‘হতে পারে, ও, অন্যান্য মুসলিমদের কথা বলতে চেয়েছে, যারা খুব ধার্মিক কট্টর গোছের হয় আর কি!’ 

    ‘আমাদের’ কারা? ‘ওরা’-ই বা কারা? ‘আমরা’-ই বা কে?

    মনে পড়ল, রোয়ান্ডায়, মানুষকে হত্যা করার জন্য রীতিমতো প্রস্তুত করা হত। কয়েক বছর ধরে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে হত্যা করার জন্য তৈরি হয়ে উঠত মানুষ— এমনই প্রক্রিয়া ছিল। রেডিও, মিডিয়া— সকলে সাহায্য করত তাতে। ‘আজ কি আমার মরার দিন হতে চলেছে?’ বেজে উঠত। তাই শেষমেশ যখন কারও মরার দিন আসত, সে এই নিয়ে ভাবত না কেন তাকে মরতে হবে, মূল প্রশ্নটা হত, কীভাবে মরণ হবে। কতটা নিপুণভাবে মারবে আমাকে? মারবে কি ভালভাবে?

    সৌজন্যে : https://pen.org/india-at-75/

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook