সালটা যতদূর মনে পড়ছে, ১৯৮৭ কি ১৯৮৮ হবে। মানিক চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘নির্বেদ’ পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন বেরোয়, যার বয়ান ছিল এইরকম— ‘আগামী বইমেলায় প্রকাশিত হতে চলেছে ‘বিখ্যাত কবিদের বাজে কবিতার সংকলন’। সম্পাদনা: সমর তালুকদার।’ আরও দু-এক কথা সেখানে ছিল হয়তো, কিন্তু সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। বিজ্ঞাপনটি দেখামাত্র চমকে উঠেছিলাম দু-এক বছর আগে; এবং খুঁজতে শুরু করেছিলাম সেই বই। কখনও প্রকাশিত হয়েছিল কি? অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করলেও, কোনও হদিশ কেউ দিতে পারেনি আমায়। সুতরাং বইটা প্রকাশিত হয়ে থাকলেও, দেখার সৌভাগ্য হয়নি। না হোক, মন তবু সরেনি বিজ্ঞাপন থেকে; তার উদ্দেশ্য থেকে। ‘বিখ্যাত কবিদের বাজে কবিতার সংকলন’-এর মধ্যে একটা স্পর্ধা আছে, একটা মজা আছে ঠিকই, কিন্তু বাংলা কবিতার সামগ্রিক চর্চায় এই ধরনের সংকলন কি সত্যি-সত্যিই কিছু যোগ করতে পারে? ‘বাজে’ তকমা যদি দিয়েই দিই, সেগুলো অযথা ছেপে লোককে বেচার প্রয়োজন আছে কি আদৌ? খারাপ জিনিস মুখের ওপর বলে দেওয়া একরকম, আর ‘খারাপ’ বেছে নিয়ে তাকে বিক্রি করাটা আলাদা। এই খাটনির কোনও মানে আছে কি? ভাবছিলাম উল্টো কথা। যদি এরকম কখনও হয়, ‘অখ্যাত কবিদের ভাল কবিতার সংকলন’? তাহলে তো অন্তত কিছু ভাল লেখা এক জায়গায় করা যায়! যেসব কবিতা পত্রিকার পাতায় এখনও অভিমান নিয়ে পড়ে আছে, তাদেরকে যদি বাবা-বাছা করে ডেকে এনে একটু সম্মান জানানো যায়, যদি তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায় নতুন প্রজন্মের পাঠকদের, কেমন হয়? কাজ শুরু করেছিলাম সেই জায়গা থেকেই। ‘কাজ’ মানে বিরাট কিছু না অবশ্য, সময় পেলেই পুরনো পত্রিকা ঘাঁটা। অকারণ। কখনও-সখনও কিছু অন্যরকমের লেখা যদি চোখে পড়ে যায়? এই কবিতাগুলো যেমন—
এই গোলমেলে সময়ে…
~
সুধন্য সরকার
এই গোলমেলে সময়ে
তোমাকে কি
একটু একা পাওয়া যাবে?
রবীন্দ্রনাথ রোগ ছড়ায় মনে…
আজ সারা দিন
তোমাকে
একটু একা পাওয়া যাবে ভেবে
ফুল কুড়োই আর ফুল কুড়োই
কিসের অ্যাতো ফুল কুড়োনো?
চারপাশের উত্তাপ থেকে
তোমাকে সরিয়ে আনবো।
কথা দিলাম
কলকাতার অলিগলিতে
দেখা যাবে না আমাকে
দেখা যাবে না পার্কে
মেয়েদের স্কুলের সামনে
সিনেমা হলের অন্ধকারে
অথবা গোলকধাঁধায়।
কথা দিলাম।
ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো
অ্যাতোকাল শুধু
ঘুরেছি কলকাতায়।
তুমি আসবে বলে
চোখ বন্ধ করেছি
তুমি এলে কি এলে না
স্বপ্নের ভেতরে তলিয়ে দেখে নিই
খুলে দিয়েছ চুল
পৃথিবীতে অন্ধকার এসেছে নেমে।
জোনাকির পিদিম জ্বলছে চারপাশে
ঘরের কার্নিশে আটকে রয়েছে
একটা সাদা মুখ
কোথাও বেরিয়ে যাবো
এই পৃথিবী বড্ড মায়াময়
এখানেই হারিয়ে যাবো একদিন
তুমি জানতেও পারবে না।
আমি উন্মাদ আত্মজীবনীতে
~
চন্দন ভট্টাচার্য
এক.
কাল বিকেলবেলা পাড়ার গলিতে নেমে তোকে পকেট থেকে
ছুঁড়ে ফেলেছি রাস্তায়, কোঁচকানো বডি আস্তে সোজা
হচ্ছে— একটা পিঁপড়ে ভয় পেল। আমি হাঁটলাম বাড়ির দিকে,
তোকে চাপা দিচ্ছে খড়ম জুতো শ্রীখাদিম। পাড়ার দোকান থেকে
টুথব্রাশ কিনছি, বোতলের বাঁচা জল আহ তোর গায়ে উপুড়
করল টিউশানি-ফেরত ছাত্র। আমি স্নান গেঞ্জিপাজামা—
টিভি নিয়ে বসলেই তোর গায়ের ওপর উঠে দাঁড়াবে শেয়ার ট্যাক্সি
হরিদেবপুর একজন, হরিদেবপুর; একজন যে আপনার চাকার নিচে
আলুপোস্ত তা তো দেখছে না! দেখছিলাম ডিসকভারিতে আটলান্টিকের
ভেতর সমুদ্রমাছ আমি খেতে বসে, এক মাতাল খক করে কফ
ফেলছে একটুর জন্যে তোর গায়ে লাগল; হাওয়া দিল এখানে,
ওখানেও, দেশি মুরগির বাচ্চা হয়ে উড়লি নর্দমার কোলে কোলে।
তারপর আমিও আলো নিভিয়ে বিছানায় বসেছি, চোখবন্ধ,
ওমনি শিরদাঁড়ার ওপর-পিঠে ফটাশ করে খুলছে সবুজ চোখ,
সবুজ জ্যোতিষ্ক-আলো ঘরদরজা শিউলিগাছ পার হয়ে টেলিফোনবুথ
রিকশামোড় স্ট্যাচু করে এক দৌড়ে পেছন থেকে গিয়ে জাপটে
ধরছে তোকে … … আস্তে তোর ধুলোমাখা মুখ ভেসে উঠল
সোনি-র পর্দায়, কাগজের খসখসে গলায় বলছিস রক্তাক্ত
সন্ধেবেলাটার অপমান, আগামীকাল তোর কপালে কী আছে,
আগামী পরশু মরে আবার কাঠ হয়ে যাওয়ার আগে—
বলতে বলতে হা হা করে কেঁদে উঠছিসরে সোনা, আমার
চল্লিশের বি বাসের টিকিট
সলতে পাকানোর সময়
~
রাজশ্রী চক্রবর্তী
সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলেই জেনেছি।
এখন শুধু ফিকে হলুদ আর ফিরোজা নিয়ে কথা বলার
সময়। যতোটুকু রং দিনের বেলায় দেখা যায় সেগুলো
আসলে সব সাদা। নিরুচ্চার সে নিয়ম করে রান্না করে
আর বিউলির ডাল দিয়ে ভাত মাখতে বসে চিন্তায় পড়ে
যায়— রাতে তো বর ভাত খাবে না। আর, খাবেই বা
কেন?… যে বুড়ি বারান্দায় বসে সলতে পাকাচ্ছে,
সে-ও জানে— বংশবৃদ্ধির সময় মানুষ ভালোবাসে ঘামের
নুন… বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া পশুর আর্তচিৎকার আর
স্নায়ুশিথিল মিশে যাওয়া ধানের বিছানায়। এরপর কেউ
কিচ্ছু বলবে না— একা একা ঠেলে ওঠো ছাদে… বিরাট আকাশে
হয়তো চাঁদ গুটিসুটি মেরে ডেকে উঠবে— ম্যাও! পুরোনো
জীবনের ফেলে আসা মমতা পেটের মধ্যে গুলিয়ে উঠবে। তখন
রাতের পর রাত জেগে সলতে পাকানোর সময়। মাটির প্রদীপে
খোকার আয়ু জ্বলতে থাকবে নীল-ষষ্ঠীর থানে…
মায়ার খেলা
~
কৌষিক বন্দ্যোপাধ্যায়
সামান্য তামাক আমি হাত টান দোষে তুলে রাখি
অসময়ে হয়ত কাজে দেবে
কেননা সমস্ত রাত্রি যেন কোন ষড়যন্ত্র,
রুক্ষলাল জবুথবু একদল বৃদ্ধ মেঘ ওপরে আকাশে
কি এক খবর নিয়ে ছুটে গেল, ফিরে আসছে
হাত নেড়ে ডাকছে পড়শীকে
এখন সমস্ত রাত্রি পূর্বস্মৃতি নামে এক চতুর ভিখিরী
সুদ ও আসল চাইবে, মায়াবী চোখের জল
এই রুদ্র পৃথিবীর অনুপযুক্ত করতে চাইবে আমাকে
একটু তামাক আমি রেখেছি সম্বল করে হাতে
একটা সাইকেল খুঁজছি কমদামে
আছে?
চারটে লেখাই প্রকাশিত হয়েছিল ‘নীল অপেরা’ নামের এক ছোট-পত্রিকায়। এই চারজনের মধ্যে একজনের সঙ্গে আমার আলাপ রয়েছে। বাকি তিনজনই অচেনা। তাঁরা এখন কবিতা লেখেন কি না তা-ও জানা নেই। কিন্তু সেই সময় যে তাঁদের মধ্যে কবিতার ভূত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তাঁদের লেখা পড়লেই বোঝা যায়। কবিতা বন্ধুর মতো সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে উঠেছিল তাঁদের প্রত্যেকের কাছে। এতদিন পরে হয়তো তেমন করে এঁদের কেউই আর মনে রাখেননি। দু-একজন মনে রাখলেও, কবির হাসি তাঁদের স্মৃতিকে বেশি আবেগপ্রবণ হতে দেয়নি। কেমন হয়, এইরকম আরও নানান লেখা নিয়ে যদি একটা সংকলন করা যায়? এইরকম কবিতা যখন গোয়েন্দার মতো খুঁজে বের করেছিলেন ওই পত্রিকার সম্পাদকেরা, আমরা চেষ্টা করলে কি পারি না এইরকম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লেখাদের হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে?
পাতলা একটা পত্রিকা যে কত যত্ন নিয়ে প্রকাশ করা যায়, এতদিন পর আবার ‘নীল অপেরা’র প্রতিটা পাতা দেখে টের পেলাম। প্রথম প্রকাশ : জুলাই, ২০০০। শেষ প্রকাশ : জানুয়ারি, ২০০৯। ন-বছরে মোট চারটে সংখ্যাই প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকার। প্রথম সংখ্যা সম্পাদনা করেছিলেন অভীক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুমন্ত মুখোপাধ্যায়। শেষ সংখ্যায় সম্পাদনার দায়িত্বে সুমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন সুপ্রতীপ দত্ত ও রাণা রায়চৌধুরী। কেউ-কেউ যেমনটা বিশ্বাস করে থাকেন যে, ‘নিজেদের একটা পত্রিকা থাকা খুব দরকার’— এই পত্রিকার সংখ্যাগুলো দেখলে, সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। লেখক প্রতি সংখ্যাতেই প্রায় এক। খুব সামান্যই এদিক-ওদিক হয়েছে। অগ্রজদের লেখাও নেওয়া হয়েছে বেছে-বেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশিরভাগ পত্রিকা-করিয়েই যেভাবে আদেখলের মতো অগ্রজদের একটা ঠুনকো লেখা পাওয়ার আশায় হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে, এখানে তার ন্যূনতম আয়োজনও চোখে পড়বে না। কেননা এই পত্রিকা বিশ্বাস করত—
‘কবিতা নিয়ে আজকাল সমস্ত কিছুই হচ্ছে, কবিতা লেখা ছাড়া। একের পর এক পত্রিকাগুলো, বেশ কয়েকবছর, যখন আগ্রহে আমরা ঘরে নিয়ে আসছি আর হাজার আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মনের মতো কবিতা খুঁজছি, সত্যি কথা কি, হতাশ হয়ে পড়ছি আমরা, বিষণ্ণ হয়ে পড়ছি। দু-তিনটে পত্রিকায় তিন-চারটে কবিতা ছাড়া, মায়াকবিতা জাদুকবিতার ছায়াও এখন আর দেখতে পাই না। বাংলা কবিতায় এখন মামা-ভাগ্নের যুগ চলছে। জুতোয় কাঁকর ঢুকে পড়ার মতো এক অস্বস্তিতে পড়ে গেছি আমরা। এই বিরক্তিকর বিষণ্ণতা থেকেই নীল অপেরা-র জন্ম। এ পত্রিকা আপনার পত্রিকা, যে-আপনি কবিতার জন্যে সাড়া পৃথিবীটাই তোলপাড় করতে পারেন।’ (চতুর্থ প্রচ্ছদ/ সংখ্যা ১, জুলাই ২০০০)
‘বিরক্তিকর বিষণ্ণতা’র দিন কি আবারও ফিরে আসছে না বাংলা কবিতায়? পত্রিকার সংখ্যা বেড়েছে বই কমেনি! কবির সংখ্যা তো ছেড়েই দিলাম! কিন্তু ভাল কবিতা? দিনে-দিনে সুন্দরবনের বাঘের মতো কমছে। একশোটা কাগজে কবিতা লিখে ফেলছে, এদিকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বইয়ের নাম জিজ্ঞাসা করলে বলছে, ‘অবনী’। অস্বস্তি আমাদেরও ফিরে এসেছে। বাংলা কবিতা নিয়ে কথা উঠলেই বেশির ভাগ সময়ে চুপ করে থাকতে হয়। সম্পাদকেরা কবিতা চান, যেন দয়া করছেন। অপেক্ষায় থাকি, হয়তো এসব কেটে গিয়ে একদিন আবার সুন্দর একটা চর্চার ক্ষেত্র ফিরে আসবে। ‘নীল অপেরা’র মতো একাধিক পত্রিকা আবার জন্ম নেবে গুমটি চায়ের দোকানের আড্ডা থেকে; যারা কবিতার জন্য সারা পৃথিবীটা তোলপাড় করার ক্ষমতা রাখে।
নীল অপেরা ততদিন নীল অপেক্ষা হয়ে রইল নাহয়!