প্রথমে সুখবরটা: আমাদের জীবনের একটা ব্যাপার যা গরম দ্বারা একেবারেই নিয়ন্ত্রিত হয় না, তা হল রাগ। গরমকালের মতোই আমরা শীতকালেও ঠিক একই ভাবে ও একই মাত্রায় মাথাগরম করি। এবার দুঃসংবাদটা: মোদ্দা কথা হল আমরা আমাদের রাগের জন্য, চিল্লামিল্লির জন্য, সাধারণ ও ধারাবাহিক খারাপলাগাগুলোর জন্য আবহাওয়াকে দোষী ঠাওরাতে পারি না।
আমাদের রাগের পারা এখন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে তুঙ্গে পৌঁছেছে আর অল্পেই তীব্র রেগে ওঠার জন্য কোনওভাবেই বিশ্ব উষ্ণায়ন দায়ী নয়। তাহলে কী এমন প্ররোচনা আমাদের উসকে দেয়, যে এক মুহূর্তে আমরা দুম করে রাগের স্কেলে একেবারে শূন্য থেকে ১০০’য় পৌঁছে যাই? এর নানা কারণ আছে, আর সবাই অন্তত একটা বিষয়ে একমত হবেন যে বয়স জিনিসটা এই রাগের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়ার ব্যাপারে এক নম্বর। মধ্য-চল্লিশে পৌঁছে শুধু তাপমাত্রাই যে আমাদের অসহ্য লাগে তা নয়, যা আসলে অসহ্য হয়ে ওঠে, তা হল আমাদের মেজাজ। মধ্যবয়সিদের রাগ একেবারে গনগনে লাল। তা বয়স্কদের রাগের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়ি মাথায় চড়ে, আর কমবয়সিদের তর্জনগর্জনের চেয়ে অনেক বেশিবার আছড়ে পড়ে। মুশকিল হল, আমরা মনে মনে তরুণ, এদিকে ব্যথায় আর ক্লান্তিতে বুড়োদের মতো, আর রাগের উসকানিতে— তরুণ এবং বুড়ো: দুই বয়সের মিশ্রণ। আর তা ছাড়া তো নিজ নিজ রাগের বিভিন্ন কারণ সব সময়ই থাকে। মাঝে মাঝে কেউ যদি বলে আমার মাথাগরম, তা হলে মাথা গরম করার পক্ষে সেটা যথেষ্ট কারণ হয়ে ওঠে। টলস্টয়ের লেখা আনা কারেনিনার প্রথম লাইনটি একটু ঘুরিয়ে বলা যায়: আনন্দিত লোকজন সব এক রকমের, কিন্তু প্রতিটি রাগী লোক নিজের নিজের মতো করে রেগে যায়। তবে কিনা, ৪৫-৫০ বছরের মানুষজন, তিনি পুরুষ বা মহিলা যেই হোন কিংবা পৃথিবীর যে মুলুকেই থাকুন, কয়েকটা কমন রাগের কারণের ব্যাপারে একমত হবেন।
নিজ নিজ শহর নিয়ে সব্বাই রেগে থাকি আমরা। অনন্ত ট্রাফিক, অসংখ্য লোকজন, জায়গায় অভাব, জীবনের গতিবেগ অথবা গতিহীনতা, এসব নিয়ে। আর এটা সত্যি যে এই শহরগুলো নিয়ে নব্বই দশকে আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, তার কাছাকাছিও এরা পৌঁছতে পারেনি। কলকাতায় কোনও ফুটপাথ নেই হাঁটার মতো, বেঙ্গালুরুতে লোকজন যত না বাড়িতে থাকে তার চেয়ে বেশি সময় কাটায় ট্র্যাফিকে আটকে রাস্তায়, দিল্লি-বৃহত্তর দিল্লিতে সারা বছর ঠিক করে শ্বাস নেওয়াই দুষ্কর, আর মুম্বইয়ের গতি এতই দ্রুত যে তাকে ভাল করে দেখতে না দেখতেই সে যেন বোঁ করে উধাও। তাছাড়া সারা ভারতে এমন কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই যাকে আমরা সত্যিকারের নেতা হিসেবে ভাবতে পারি। তাঁরা কেবল এক নির্বাচন থেকে অন্য নির্বাচন অবধি বিরক্তিকর ভাবে ঝুলে থাকেন। রাগের কারণের ফিরিস্তি অনন্ত। ঠিক সেই কারণেই মেজাজ সবসময় খিঁচড়ে থাকে আর সামান্যতম উসকানিতেই রাগের বোতামটা অন হয়ে যায়।
যারা ১৯৬৫-১৯৭৫ সালের মধ্যে জন্মেছে, তাদের দিকে একটি বড় মাপের বাউন্সার ধেয়ে এসেছে, যার নাম সোশ্যাল মিডিয়া। সম্প্রতি, নন্দন নিলেকানি তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই ‘আর্ট অফ বিটফুলনেস’-এ বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্ফোরণ ঘটেছে যখন তিনি পঞ্চাশের কোঠায়, অর্থাৎ জীবনের দ্বিতীয়ার্ধে, এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর গোটা সম্পর্কটাই এই ব্যাপারটার দ্বারা নির্ধারিত। যদি ধরে নিই ২০০৭ সাল থেকে আমরা অর্কুট বা ফেসবুক করতে শুরু করলাম আর ক্রমে পৌঁছলাম টুইট থেকে ইনস্টা-য়, মানতেই হবে আমাদের প্রজন্মটি এইসব নতুন যোগাযোগের গুঁতোয় একেবারে নাজেহাল হয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নতুন ব্যাপারগুলোই আমাদের গ্রাস করেছে, এবং আমাদেরকেই তাদের হাতের পুতুল করে, প্রলুব্ধ করে, আমাদেরকেই প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য করছে।
যখন দেখি, বহু পুরনো বন্ধু, যাদের আমরা যুগ যুগ ধরে চিনি, যারা কিনা বেশ সরল, মিষ্টি স্বভাবের মানুষ ছিল, তারা হঠাৎ দুর্দান্ত সব বেড়াতে যাওয়ার ছবি, চমকদার সেলফি, রোগা রোগা অপূর্ব চেহারার প্রদর্শনী করছে (যখন আমার মতো কেউ বিরিয়ানি আর ‘হট ইয়োগা’র মধ্যে অন্তহীন দোদুল্যমান), দক্ষিণপন্থী চিন্তাভাবনার পোস্ট দিচ্ছে, কোহলী-বিরোধী মন্তব্য করছে, স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশগুলির রাজনীতি নিয়ে বিরাট বিশেষজ্ঞের মত দিচ্ছে, ইথিয়োপিয়ান খাবার সম্পর্কে দেখনদারি জ্ঞান ফলাচ্ছে, এমনকী পড়শির পোষা শীতের দেশের কুকুর হাস্কিকে নিয়ে বাড়াবাড়ি আদিখ্যেতা করছে (গুরগাঁও-এর মতো গরম জায়গায় এসে কী করে ঠান্ডা দেশের কুকুর থাকবে!!!)— তখন এইসব চটে ওঠার কারণগুলো সিধে মাথায় গিয়ে টাং করে আঘাত করে।
শুনেছি অনেকে ডিজিটাল-ডিটক্স করছে, অর্থাৎ কিনা ইন্টারনেটের নেশা ছাড়তে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু সত্যিই কি তারা এসব করে? এদের বেশিরভাগ হয়তো কিছুদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা বন্ধ রাখে, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় যাতায়াত সমানে চলতে থাকে, সারাদিন অন্যের পোস্টে চোখ বোলায়। ব্যাস, ওইসব পোস্ট পড়েই ক্রমাগত রেগে যেতে থাকে, যা এড়াতে ডিজিটাল ডিটক্স-এর বিরাট প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা হয়েছিল!
আর তার পরে তো মধ্যবয়সের নিজস্ব ভেলকি আছেই। যখন আমাদের ছেলেমেয়েরা বিদ্রোহী টিনএজার থেকে ধীরে ধীরে স্বাধীন চাকুরে হয়ে ওঠে, আমাদের নিঃসঙ্গ আর পরিত্যক্ত লাগে। অন্যদিকে, আমাদের মা-বাবারা। যে বাবা আমাদের এক সময় অনায়াসে কোলে নিয়ে দোল খাওয়াতেন কিংবা যে মা’র কাছে যখন খুশি গিয়ে বায়না করতে পারতাম, তাঁরা এখন বয়সের ভারে খোঁড়াচ্ছেন, ভুলে যাচ্ছেন, অসুস্থ থাকছেন। সর্বোপরি তাঁরা আমাদের ওপরই নির্ভরশীল। চোখের সামনে মা-বাবাকে বুড়ো হতে দেখাটা খুব কষ্টের। যদিও চিরকালই জানতাম এমন একটা দিন আসবে, কিন্তু একেবারে বুঝতে পারিনি, তখন কেমন লাগবে। আমার মধ্য-পঞ্চাশের কিছু বন্ধুবান্ধব আছে, যারা নাতি-নাতনিদের দেখভাল করছে, আবার অসুস্থ বাবার বিছানার পাশেও রাত জাগছে। এমনটা তারা কক্ষনও ভাবেনি। যখন তারা দেখছে নিজেদের মনোমত কাজ করার জন্য এতটুকু সময় নেই, বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও একদম উপায় নেই, তখন চারপাশের সবকিছু দেখেই খেপে উঠছে— সে পুতিনের অস্ত্রসজ্জাই হোক বা সেলেব্রিটিদের বিয়ে নিয়ে আদেখলাপনা।
একজন দুর্দান্ত মাথাগরমের মানুষ আমি, এই রাগের ব্যাপারাটা খুব ভাল বুঝতে পারি। আমি তো সব বয়সেই রাগ করে এসেছি! যখন কম বয়স ছিল তখন লিঙ্গ-বৈষম্য আর জেন্ডার স্টিরিওটাইপিং আমার মাথা জ্বালিয়ে দিত, আর এখন কলকাতায় কাজ করা আর এই শহরকে স্টিরিওটাইপ করাটা আমায় বেজায় রাগিয়ে দেয়। যাঁদের কাছে গদি বা ক্ষমতা আছে, তাঁদের উদ্ধত ভাবভঙ্গি আর নির্দ্বিধায় অন্যায় সুযোগ নেওয়া দেখলে চিরকালই প্রচণ্ড রাগ ধরে। জীবনের অনিত্যতা, আমার পাকাচুল, আমার মুখের ভাঁজ, সবকিছুই আমায় খোঁচায় সবসময়। এসবই জটিয়ে-পাকিয়ে আমার মাথায় রাগের মণ্ড হয়ে জমে থাকে। যত বয়স বাড়ছে, ততই যেন আমি আরও রাগী হয়ে উঠছি।
সমাধানটা কী? আমি কৌতুকের মোড়কে আমার রাগকে মুড়ে রাখার চেষ্টা করি। ঠিক করেছি আমার কাজের চাপ অন্যান্য অনেকের সঙ্গে ভাগ করে নেব— যেমন, খুব ঠান্ডা মাথার আমার জ়েন-স্বামী এবং আমার কমবয়সী সহকর্মীদের সঙ্গে। নিজেকে ক্ষমা করতে শিখেছি। যখন রাগটা পড়ে যায়, আমি ঠিক করি পরেরবার এই কারণটাকে পাশ কাটিয়ে যেতেই হবে। ভালবাসা, হাসি-ঠাট্টা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, যারা আমার হঠাৎ রেগে যাওয়াকে পাত্তাই দেয় না— এসবই হল সমাধান। আর হ্যাঁ, আমি আমার ফোনটাকে নিজের থেকে যতটা দূরে রাখা যায়, সেই চেষ্টা করছি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এটা বুঝেছি, মাথাগরমের যাই কারণ থাকুক না কেন, সেগুলো তুচ্ছ এবং সেই সময়টা ঠিক পেরিয়ে যাবে। আবার যদি গনগনে রাগটা ফিরে আসে, আবারও চলে যাবে। আমি মাথা গরম করি ঠিকই, কিন্তু নিশ্চিত জানি যে ঠিক শান্ত হতে পারব।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র