সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আপনার পরিচয়ের শুরুটা একটু বলবেন?
মানিকদার সঙ্গে আমার আলাপ হয় ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। আমি তখন শ্যামল ঘোষের ‘নক্ষত্র’তে থিয়েটার করি। এদিকে মনে-মনে সিনেমায় অভিনয় করার ইচ্ছে প্রবল। আমার বয়সি একটা ছেলে সেই সময়ে মৃণাল সেনের ‘পদাতিক’-এ অভিনয় করেছিল। তার কাছ থেকেই সত্যজিৎ রায়ের ঠিকানা জোগাড় করে একদিন ওঁর কাছে গিয়ে হাজির হই। যেদিন যাই, সেদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আমার পরিচয় দিতেই উনি আমাকে বলেন, ‘তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আমি তো তোমার খোঁজে অনেককে বলেছি। এমনকী তোমার দলেও একজনকে পাঠিয়েছিলাম। তোমার নাম তো আমি জানি না, কেবল চেহারার বর্ণনা দিয়ে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু দলের কেউ বিবরণ অনুযায়ী কাউকে নির্দিষ্ট করে বলতে পারল না। কেউ-কেউ অবশ্য এসেছিল, কিন্তু তাদের আমি ফিরিয়ে দিই।’ সেই ওঁর কাছে যাতায়াত শুরু। এর আগে ‘লম্বকর্ণ পালা’ নাটকে একটা ছোট চরিত্র করতাম যখন, রবীন্দ্রসদনে উনি সেই নাটকটা দেখেন এবং তারপর থেকেই আমার খোঁজ করতে শুরু করেন। আমার যদিও বরাবরই মনে হত, উনি আমাকে সুযোগ দিলেও দিতে পারেন। কেন মনে হত, সে অবশ্য ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না!
‘জন অরণ্য’ ছবিতে আপনার চরিত্রটা উনি আলাদা করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, নাকি চিত্রনাট্য পড়ে শোনাতেই সব বোঝা হয়ে গেছিল?
মানিকদা আমাকে চিত্রনাট্য পড়ে শুনিয়েছিলেন অনেক পরে। আগে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত হওয়ার পর্বটা চলেছিল। উনি আমাকে মাঝে মাঝেই ডাকতেন ওঁর কাছে। আমিও সময় পেলেই অফিস থেকে চলে যেতাম আড্ডা দিতে। এইভাবে দীর্ঘদিন আমাকে পর্যবেক্ষণ করার পর, অবশেষে যখন চিত্রনাট্য পড়ে শোনালেন, দেখলাম আমার অনেক আচার-ব্যবহার উনি চরিত্রের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। আমি যে কিছুটা গুটিয়ে থাকতে ভালবাসি, সচরাচর নিজেকে জাহির করি না, ভাগ্যের দুর্দশার কারণে ক্ষুব্ধ হলেও চুপ করে থাকি— এই বিষয়গুলো চরিত্রের মধ্যেও ছিল। ফলে আলাদা করে চরিত্রটা ওঁকে বুঝিয়ে দিতে হয়নি। কখনও-সখনও হয়তো দু-একটা জায়গা বুঝিয়ে দিতেন, তবে সেটা সামান্যই। আমি ভীষণ রোগা ছিলাম বলে কখনও প্যান্টের মধ্যে জামা গুঁজে পরতাম না। মানিকদা আমার পোশাক পরিকল্পনাও একইভাবে করেছিলেন, এমনকী আমার সিগারেট খাওয়াটাও চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। বদল করেছিলেন কেবল চুল আঁচড়ানোটা। আমি চুল সম্পূর্ণ পেছনে ফেলে প্রায় মধ্যিখানে সিঁথি কাটতাম, উনি সেটাকে বাঁ-দিকে করে দেন।
শুটিং-এর সময় কোনও-কোনও দৃশ্যে, অভিনয়ের খুঁটিনাটি কি উনি বলে দিতেন?
অভিনয় খুব যে একটা উনি দেখিয়ে দিতেন, এমন মনে পড়ে না। উনি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের স্বাধীনতা দিতেন। তবে প্রয়োজনে যে দেখাতেন না, এমনটাও নয়। একটা সিন আছে, সোমনাথের বান্ধবীর ফোন আসে এবং সেটা বৌদি ধরে সোমনাথকে দিচ্ছেন। সোমনাথ ‘হ্যালো’ বলে কী উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। দাদা-বৌদি পাশে থাকায় একটা ইতস্তত ভাব, অথচ ভাল লাগছে। হুঁ-হাঁ করছে উত্তর না পেয়ে। আমি সেই অনুযায়ী করে টেলিফোনটা নামিয়ে রেখেছিলাম। মানিকদার পছন্দ হয়নি। ক্যামেরা থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘আরে, প্রেমিকা ফোন করেছে। দুম করে নামিয়ে রাখলে চলবে? সময় নাও, দ্যাখো ও আগে রাখছে কি না। দোনামোনা ভাব, মুখে হালকা ভালোলাগার ভাব থাকুক, রেজাল্ট ভাল হয়নি তো কী হয়েছে?’ পরামর্শ দিলে এইরকম ভাবে দিতেন।
‘জন অরণ্য’ যেহেতু আপনার প্রথম ছবি, খ্যাতনামাদের (উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ প্রমুখ) সঙ্গে অভিনয় করার সময় ভয় করেনি? নিজেকে কীভাবে মানিয়ে নিয়েছিলেন?
একেবারেই ভয় করেনি। এবং এর জন্য দায়ী মানিকদাই। উনি ওঁর ইউনিটে এমনভাবে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের বন্ধুত্ব করিয়ে দিতেন মনেই হত না কে নামকরা অভিনেতা আর কে নবাগত। ফলে মনে কোনও অস্বস্তি কাজ করত না। রবি ঘোষের সঙ্গে যেমন মানিকদার বাড়িতে আগেই আলাপ হয়ে যায়। ওঁর সঙ্গে আমি স্ক্রিন-টেস্টও দিয়েছি। উৎপল দত্তের সঙ্গে দেখা হয় প্রথম মেক-আপ রুমে। আমাকে দেখেই একটু হেলে বসা অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বলেছিলেন, ‘এসো সোমনাথবাবু। আজ থেকে ক’দিন তুমি ও আমি মুখোমুখি ওই মহান মানুষটির ক্যামেরার সামনে।’ এছাড়া দীপঙ্করদা, লিলিদি, সন্তোষ দত্ত-রা এতই ভালমানুষ ছিলেন, আমাকে কখনও বুঝতেই দেননি যে আমি প্রথম সিনেমা করছি।
থিয়েটার থেকে যেহেতু প্রথম সিনেমায় অভিনয়, সংলাপ বলার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধায় পড়তে হয়নি?
সমস্যা একটু যে হয়নি, তা নয়। সংলাপ বলার ক্ষেত্রে অভিব্যক্তি একটু বেশি মনে হলেই মানিকদা কানের কাছে মুখ এনে বলতেন, ‘বড্ড থিয়েটার-থিয়েটার লাগছে।’ এছাড়া সবসময়ই বলতেন, ‘মুখস্থ করবে না।’ ওঁর বিশ্বাস ছিল, সংলাপ মুখস্থ থাকলে চরিত্র পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে পারে না। তাই ও-কথা বলতেন। এখন অবশ্য সিনেমায় এত সংলাপ থাকে, মুখস্থ না করে গেলে উপায় নেই!
‘জন অরণ্য’ মুক্তি পাওয়ার পরবর্তী সময়ের কথা একটু বলবেন? ঠিক কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল এই ছবিকে ঘিরে?
এই ছবি নিয়ে বিরাট কোনও প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মানুষের মনে, এমনটা মনে হয় না। তবে আমার জীবনটা খানিক পালটে গেছিল। যেখানেই যেতাম, আমায় দেখে ভিড় জমে যেত। রাস্তাঘাটে লোকে আমাকে ধাওয়া করলে, ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণি ছিল আমার আশ্রয়স্থল। কোনও কলেজ জমায়েতে গেলে সবচেয়ে বেশি সম্বর্ধনা পেতাম। এইসব আর কি!
অনেকে মনে করেন, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে এই ছবির প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আপনি কোনও প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পান কি?
সময় বদলেছে ঠিকই, কিন্তু সত্যিই কি বদলেছে? রাজনৈতিক টানা-পড়েন, বেকারত্ব আর কি আমাদের মধ্যে নেই? আমার বাড়ির সামনে এক সময়ে ফাঁকা ছিল, কিন্তু এখন বাজার বসে গেছে। সত্যিই যদি এত চাকরি থাকত, এই বাজারটা বসত না। যাঁরা সরকারি চাকরি করেন, তাঁরা খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা বুঝবেন না। আগেও বোঝেননি, পরেও বুঝবেন না। ফলে, আমি মনে করি এই ছবি আজও প্রাসঙ্গিক। হয়তো বাহ্যিক অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু সমাজের মূল সমস্যাগুলো একই থেকে গেছে এখনও।
সোমনাথ ছাড়া সত্যজিতের অন্য কোনও চরিত্রের কথা মনে হয়, যাঁর ভূমিকায় আপনি অভিনয় করলে আপনার ভাল লাগত?
সে-সুযোগ আর পেলাম কই! তবে, ‘শাখা-প্রশাখা’ ছবিতে রঞ্জিতবাবু (মল্লিক) যে-চরিত্রটা করেছেন, সেটা করতে পারলে ভাল লাগত মনে হয়।