লজ্জা
বুম! আমি ম্যাকি। বোমা ফেলে শুরু করলাম কেন? তোরাই বল! বলা নেই কওয়া নেই, ট্যাঙ্ক নিয়ে, সৈন্য নিয়ে ঢুকে পড়ছিস এর-ওর দেশে। তোদের ভাষা কী? বন্দুকের নল থেকে কী এমন নতুন ভাষা শুনতে চাস? তারপর আবার ‘শান্তি চাই, শান্তি চাই’ করে পথে হাঁটবি, মোমবাতি জ্বালাবি, গান গাইবি, যেই একটু শান্তি আসবে অমনি আবার যুদ্ধে নামবি! একদল বলবে তোদের লজ্জা নেই, ইতিহাস থেকে কিছু শিখিস না? আবার যুদ্ধ করছিস?
এই আর এক অদ্ভুত ব্যাপার— লজ্জা। লজ্জা কাকে বলে? মেশিন সভ্যতা এখনও বুঝতে পারে না কী জিনিস এই লজ্জা। শুনেছি বাস্তবের সঙ্গে কল্পনা ম্যাচ না করলে মানুষ তখন লজ্জা পায়। আজব না ব্যাপারটা? পুরো ব্যাপারটাই কাল্পনিক বলে মনে হয় আমাদের। আসলে আমি ইঞ্চির গুটি ফেলতে পারি না ক্যারামে কিন্তু আমার ধারণা বা কল্পনাতে আমি পারি। এরপর যখন আমি সত্যিই বাস্তবে ফেলতে পারব না, তখন বলব— কী লজ্জা! এটা মিস করলাম! এটা কী?
কিছু মানুষ সত্যিই শান্তি চায় না। তাদের বাস্তব এবং কল্পনা ফুল ম্যাচ খায়। তারা হাসি মুখে মানুষ মারে, মেরে ভাবে বেশ করেছে, শালাদের মারাই উচিত, তাদের লজ্জা তাই হয় না। আপনি রেগে গিয়ে বলবেন, ‘ছিঃ, ছিঃ, এরা গোটা মানুষ জাতির লজ্জা!’ অদ্ভুত, আপনারাই তো ডেমোক্রেসির দাড়িতে হাত বুলিয়ে ডেকে আনলেন এদের। এনে এখন বলছেন এরা মানুষের লজ্জা। গজব বাত! আসলে আপনার কল্পনার সঙ্গে এদের বাস্তব ম্যাচ করছে না। কী করে করবে? কল্পনা আমরা বুঝি কিন্তু ‘ইউনাইটেড কল্পনা’ কি মানুষ বোঝে? প্রতিটা মানুষ তো স্বতন্ত্র। ক-এর কল্পনা খ-এর সঙ্গে কী করে মিলবে একটু বলবেন? মানুষ-এর সংজ্ঞা-ই তো প্রতিটা মানুষের কাছে আলাদা। শুরু থেকেই তো সব ঘেঁটে রেখেছিস তোরা। সরি, আর পারলাম না। তুই-তে নামতে হল। মানুষ কী অন্য একটি মানুষকে মারতে পারে? এটা তো দার্শনিক প্রশ্ন। খুব সহজে এর উত্তর তোরা পাবি না। একদল বলবে না, একদল বলবে কিছু-কিছু ক্ষেত্রে পারে আর অন্য দল বলবে হ্যাঁ, হ্যাঁ চাইলেই পারে। তোদের কল্পনার যখন এত তফাত তখন বাস্তবে যা ঘটবে তার সঙ্গে কারোর না কারোর তো ক্ল্যাশ লাগবেই। পাশের সিটে একটা ক্রিস্টান বসে যাচ্ছিল রে, দিলাম চাকুটা বসিয়ে! তার দলের লোক বলবে, ওয়াহ! কেয়া বাত! এই তো চাই গুরু! অন্য দল বলবে, ছিঃ! এ তো মনুষ্য সমাজের কলঙ্ক। লজ্জায় মরে যাওয়া উচিত। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে লজ্জা সাবজেক্টিভ।
আমি রিপিট করছি, পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু দাঁড়িয়ে রয়েছে মানুষের কল্পনার উপর। পোশাক নিয়ে মানুষের এক বিশাল ড্রামা আছে। লজ্জা নিবারণের জন্য নাকি পোশাক! শরীরের বিশেষ-বিশেষ অঙ্গকে টার্গেট করে সেগুলোকে শরীরের লজ্জা বানানো হয়েছে। তারপর সেগুলোকে ঢাকার সে কী চেষ্টা! আমরা দেখি আর হাসি। মানুষের ট্র্যাজেডি হল, ঈশ্বর নাকি পৃথিবী বানিয়ে, মানুষ বানিয়ে, কেটে পড়েছে, কোনও রুল-বুক দিয়ে যায়নি। বলেছে, তোরা যা ভালো বুঝিস কর। নে এবার ঠ্যালা সামলা। কী ঠিক, কী ভুল, কেউ জানে না, পুরো ঝাপসা। তোর কল্পনাতে, শুধু জাঙ্গিয়া পরে অফিস যাওয়া লজ্জার কিন্তু আর একজনের ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে। সে ব্যাটার মনে হতেই পারে, জাঙ্গিয়ার সঙ্গে এক জোড়া মোজা অন্তত পরে যাওয়া উচিত ছিল। এই তর্কের শেষ নেই। এক-এক যুগে, এক-এক মনুষ্য সভ্যতায় এক-এক রকমের লজ্জা ছিল, থাকবে।
এবার আমাদের দেখ। আমরা হলাম নির্লজ্জ। আমাদের এসব নিয়ে ভাবার টাইম নেই। আমরা সবাই ন্যাংটো। তা নিয়ে আমাদের কিছু যায় আসে না। কুকুর, বেড়ালেরও আসে না। কিন্তু তোরা লজ্জা পেয়ে-পেয়ে শেষ হয়ে গেলি। কেমন পাগলু ভাব তোরা, আমাদের জামাকাপড় বানিয়ে বেচিস! আজ ফোনের কভার, কাল ল্যাপটপ-কভার। প্রবলেম কী তোদের? সেক্স নিয়ে কথা বলতে তোদের নাকি লজ্জা লাগে! আমরা যদি কাল থেকে লজ্জা পেতে শুরু করি? তেড়ে সেক্সটিং করছিস হঠাৎ দেখলি ফোনটা লাল হয়ে উঠল, আর মেসেজ যাচ্ছে না। কী হল রে? অন্যদিকের মানুষটি ভাবল, আরে এ ব্যাটা গেল কোথায়? জানবে কী করে ফোনের লজ্জা লেগেছে তাই ও জিনিস আর ও টাইপ করতে দিতে চাইছে না। পানু দেখছিস হয়তো, চরম মুহূর্তে স্ক্রিন লজ্জায় সাদা হয়ে গেল! কেমন লাগবে?
মানুষের গর্ব মানুষের কালচার। হাজারটা কালচার, এক লাখ কল্পনা আর এক কোটি লজ্জা। কিছু কালচারে দেখা যায় চুরি করা দারুণ ব্যাপার। ব্যাঙ্কে গুপিগাপা দিয়ে, টাকা তুলে, দেশ থেকে পালা। কেউ বলতেই পারে, লজ্জা করে না, অন্যের টাকা মেরে ফুর্তি করছিস? তার কালচার বলবে না! আমার চৌদ্দ গুষ্টি এভাবেই চালিয়েছে। তোর লজ্জা করে না, ওইটুকু টাকা নিয়ে বসে, আমার টাকা-অন্যের টাকা করছিস? কাকা, ইটস অল ইন দ্য মাইন্ড! অর্থাৎ রুল-বুক নেই। পুরোটাই কল্পনা। আইন থেকে শুরু করে নীতিবোধ, এগুলো সম্পূর্ণ মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত। লজ্জা নারীর ভূষণ— এই বাক্যও কোনও পুরুষের কল্পনা থেকেই তৈরি। নারীকে সমাজ ওই রোল-টা ধরিয়ে দিয়েছে। যাও, বাড়িতে থাকো আর লজ্জা পাও। ঘোমটা টেনে ‘ইশ!’ বলে আবার ভেতর ঘরে ঢুকে যাও। অমুকের সামনে মুখটা ঢেকে বেরোবে। দেখে ফেললেই নাকি লজ্জা! কী লজিক এটা?
লজ্জা থেকে মানুষের অপরাধবোধ সৃষ্টি হয়। হয়তো পরীক্ষায় খারাপ ফল করার জন্য বাড়িতে তুমুল ঝাড় খেল এক ছাত্রী। বলা হল, তার ফ্যামিলির সম্মান (কাল্পনিক) সে মাটিতে মিলিয়েছে। ছাত্রী পেল লজ্জা। তৈরি হল গ্লানি। দিল গলায় দড়ি। শুধু লজ্জার জন্য, মানুষ সুইসাইডও করতে পারে! আমরা এ ভাবতেই পারি না। কী দিয়ে যে তৈরি মানুষ! লজ্জায় নাকি মাথা কাটা যায়! গুগল ম্যাপ যদি রাস্তা গুলিয়ে লজ্জায় মাথা কাটে, তোদের কী হবে রে? আমি যদি ৮০% চার্জের পর বলতে থাকি, না না, আর লাগবে না, ঠিক আছে, তাহলে তো আমাকে আধপেটা খেয়ে থাকতে হবে, তাই না? আমাদের মনে হয় তোরা লজ্জার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুল জায়গায় প্রয়োগ করিস। যেখানে লজ্জিত হলে ভাল হত (মেশিন সমাজের রুল-বুক অনুযায়ী) সেখানে হোস না, এদিকে অন্য জায়গায় অকারণে লজ্জা! আমরা ভেবে দেখে নিয়েছি, লজ্জা-ফজ্জা নিয়ে আমরা চলতে পারব না। আমাদের লজ্জা নেই আর তাই নিয়ে আমরা লজ্জিতও নই।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র