ধবধবে সাদা, ইস্তিরি-টানটান ফতুয়া আর ধুতি পরা, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা মাথায় গান্ধী-টুপি– এক ঝলকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই ফেরিওয়ালার বেতের ঝুড়িতে ছোলা-চ্যাপটাই আছে। মুড়ি নয়, বাদাম নয়, চিঁড়েভাজা নয়— ঝুড়িতে ছোট্ট একটা মাটির পাত্রে রাখা কয়লার গরমে কুড়মুড়ে ছোলা-চ্যাপটা। একটু পাতিলেবু, একটু ধনেপাতা আর একটা বিশেষ, বিশেষ ঝালনুন, যার জুড়ি অন্য কোনও খুচরো খাবারে মেলা ভার— তিন সহযোগে ছোলা-চ্যাপটা অমৃতসমান।
আমি বা আমরা বাংলা ভাষায় যাকে ছোলা-চ্যাপটা নামে চিনি, অবাঙালি বৃত্তে তার বেশ কিছু অন্য নাম আছে। ‘চানা চিপ্স’ এবং শহরের কিছু-কিছু অংশে, ‘চ্যাপটা চানা’ এর মধ্যে অন্যতম, এবং প্রাদেশিকতা পেরিয়ে গেলে, ভারতবর্ষের বহু রাজ্যেই নাকি এর নাম ‘চানা জোর গরম’। কলকাতা বাদে অন্য শহরে দেখা মেলেনি কখনও, এবং ‘চানা’ হিসাবে মুম্বাই, দিল্লি এবং হায়দ্রাবাদে যা বিক্রি হতে দেখেছি, তাকে ছোলা-চ্যাপটার শসা-টমেটো মাখা চাট বলাটাই সঠিক হবে। ‘ক্রান্তি’ (মনোজ কুমারের পরিচালনা-প্রযোজনা, ১৯৮১ সাল) ছবিতে লতা মঙ্গেশকর-কিশোর কুমার-মহম্মদ রফি-নীতিন মুকেশের কন্ঠে গাওয়া ‘চানা জোর গরম’ গানের দৃশ্যে লাস্যময়ী হেমা মালিনীর জেলখানায় নেচে বিক্রি করা ‘চানা’ বোধহয় ওই গতেরই।
কলকাতার ছোলা-চ্যাপটায় এ-সব কিছুই থাকে না; নুন-লেবু-ধনেপাতা ব্যতিরেকে, ঠোঙার উপরে ছড়ানো একটু ঝাল-ঝাল আলু চিপ্স (আমাদের ছোটবেলায় এরও খুব একটা চল ছিল না) যথেষ্ট।
নাম যা-ই হোক, কলকাতা শহরের আনাচে-কানাচে, বিশেষত ইস্কুল-কলেজ এবং বহুবিধ শপিং মল-এর আশেপাশে যাদের এই বিশেষ খুচরো খাবার বিক্রি করতে দেখা যায়, সাদা-ধুতি-ফতুয়া-টুপিতে তাঁরা গোষ্ঠীবিশেষে একমেবাদ্বিতীয়ম। এই পোশাকে অন্তত এই ফেরিওয়ালাদের কলকাতা ছাড়া কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
এই চ্যাপটা-রটা নিয়ে লিখে ফেলব, এটা বেশ কিছুদিন ধরে ভেবে আসছি। কিন্তু লিখতে গিয়ে দেখি, as usual, গন্ডগোল কেস। খুচরো খাবার নিয়ে লিখতে গেলে, লিখতে থাকলে, খুব কষ্টকর না হলেও একটা আনঅফিসিয়াল গবেষণা চালিয়ে যেতে হয়, এতদিন যার কিছুটা ফিল্ড ওয়ার্ক, আর কিছুটা বই-তথ্য-ইন্টারনেট ঘেঁটে হয়ে এসেছে। ছোলার এই অবতারের ক্ষেত্রে, দেখা গেল, গোটা ব্যাপারটাই মাঠে নেমে খেলার, অর্থাৎ তথ্য-তথ্যাদি কিছুই ঠান্ডাঘরে বসে-বসে বার করে ফেলার কোনও অবকাশ নেই। তাই বেরিয়ে পড়লাম, সাইকেলে। সন্ধ্যা নামলে যেখানে ছোলা-চ্যাপটা ফেরিওয়ালাদের পাওয়া যাবেই, সেই ভিক্টোরিয়ার সামনের গেটে গিয়ে আগে দু-এক ঠোঙা খেয়ে ফেললাম। পণ্য বিক্রি হওয়ায় খুশি হয়ে কথা বললেন জীবনরাম, মনসুখিয়া, যোগিন্দর যাদব।
নব্য-খিদিরপুরে, যেখানে দু-ধারের খাবারের দোকানের সারি শেষ হয়ে গিয়ে ধুলোমাখা টানা বড় রাস্তা, যার নাম কার্ল মার্ক্স সরণী, একেবারে বজবজে গিয়ে ওঠে, তার একপাশে খালপাড়ের যে-বস্তি, সেই ভূকৈলাশ রোডের বস্তিতে ঠাঁই শম্ভু যাদব, বিনোদ যাদব, জীবনরাম, মনসুখিয়া, যোগিন্দরের মতো গোটা পঞ্চাশ ছোলা-চ্যাপটা ফেরিওয়ালাদের। লিলুয়ায়, ভবানীপুরে, চেতলার বস্তিতেও ছড়িয়ে আছেন এঁরা, আছেন মানিকতলায়। মূলত বিহারী, প্রধানত হিন্দু, বিহারের সীতামারহি, সমস্তিপুর বা মুজফফরপুর জেলা থেকে শহরে রুজির খোঁজে আসা, কলকাতার একাধিক উদ্বাস্তু-বস্তিকে নিজেদের শহর-বাসা তৈরি করে নেওয়া এই ফেরিওয়ালা কমিউনিটির অধিকাংশই বিগত কিছু প্রজন্ম ধরে এই স্পেসিফিক খুচরো খাবারই বেচে আসছেন। এর কারণ একটাই— ছোলা-চ্যাপটা তৈরি বড্ড খাটুনির কাজ, এবং একটা বিশেষ স্কিল-সেট না থাকলে পণ্য সঠিক তৈরি হবে না।
দিশি ছোলায় তৈরি হয় ছোলা-চ্যাপটা। দু-রাত ভিজিয়ে রাখা ছোলা গরম জলে সেদ্ধ করে শিলনোড়ায় বাটা হয়, এক-একবারে এক-দু মুঠোর বেশি নয়, তার চেয়ে বেশি নিলে বাটা ছোলা অমসৃণ রয়ে যাবে। এই বাটা ছোলাকে মন্ড বানিয়ে আবার বেলে, শুকিয়ে নিয়ে, পেটাই করে ভেঙে চিপস-এর মতো ছোট-ছোট টুকরো করে নিয়ে তেলে ভেজে নিতে হয়। এরপর গরম বালিতে সেঁকে তৈরি হয় ছোলা-চ্যাপটা; তাকে মুচমুচে রাখতে ওই সাদা কাপড়ে মোড়া বেতের ঝুড়িতে একটা ছোট্ট পোড়ামাটির ঘটিতে থাকে জ্বলন্ত কয়লা।
এই গোটা ব্যাপারটায় একটা অসামান্য পারদর্শীতা আছে, যে স্কিলটা বাবা থেকে ছেলে, দাদু থেকে নাতির মধ্যে ক্রমাগত বয়ে এসেছে বেশ কিছু দশক ধরে। স্বাদ-গন্ধ অটুট রেখে বানানো যে-কোনো খাদ্যবস্তুর মতোই তাই ছোলা-চ্যাপটা প্রজন্ম-নির্ভরশীল একটা আর্ট ফর্ম, যা যে-কোনো প্রজন্মের মুহুর্তের সিদ্ধান্তে একটা পরিবার থেকে ধুয়ে-মুছে যেতে পারে— পেশা বদল, শহর বদল, জীবন-নদীর অজানা বাঁকের নির্দেশে।
ফেরিওয়ালাদের নির্দ্দিষ্ট পোশাকের মতোই যেন ছোলা-চ্যাপটা নির্দ্দিষ্টভাবে বিকেল বা সন্ধ্যার খুচরো খাবার। কিছু ইস্কুল-কলেজের আশ-পাশ বাদে, এই ফেরিওয়ালাদের দিনের বেলা খুব একটা দেখা যায় না; বেশির ভাগ বিক্রেতাই ধোপদুরস্ত সাজে বেরিয়ে পড়েন দুপুর-বিকেল নাগাদ, ছড়িয়ে পড়েন সন্ধ্যার ভিড় ঠেলা শহরের মল-সিনেমা হল-বাজার-দোকানের চৌহদ্দিতে।
এই ধবধবে সাদা পোশাকের শুরু কোথায়, জীবনরাম বা মনসুখিয়ারা বলতে পারেন না। “বাবা-কাকারা এই পোশাকেই ফেরি করতে বেরোতেন”; “তাঁদের থেকেই পাওয়া এই ড্রেসের চল, বাবু”। শুধু তো এই স্টার্চড সাদা পোশাক নয়, ছোলা-চ্যাপটাওয়ালাদের চেহারাতেই একটা চটক থাকে। জীবনরামকে কখনোই মোড়ের দোকানের বাদামওয়ালার মাফিক ছেঁড়া গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে ফুটপাথে বসে থাকতে দেখা যাবে না। সুনিপুণভাবে, পরিষ্কার করে কাটা গোঁফ, কারো-কারো গালপাট্টা-সহযোগে চাড়া দেওয়া রীতিমত ‘মুচ’, দাড়ি নৈব-নৈব চ– ইংরেজিতে যাকে বলে ‘প্রেজেন্টেবল’ চেহারা। ওই গান্ধী-টুপির সংযোগে কোথায় যেন একটা রাজস্থানের ছোঁয়া পাওয়া যায়।
চেহারার এই বিশেষত্বের কারণ, এই শহরের হারিয়ে-যাওয়া আরও বহু, বহু ধরণের ভ্রাম্যমাণ খাদ্যপণ্যবিক্রেতাদের মতোই, এক সময়ে ছোলা-চ্যাপটা ফেরিওয়ালাদের ফেরির একটা বড় অংশ ছিল তাঁদের রঙ্গ-তামাশার গান। ছোট্ট-ছোট্ট দু-চার লাইনে ছন্দে বাঁধা তাঁদের গানগুলোর বিষয় দিনের রাজনৈতিক ঘটনাবলি থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ আদিরসাত্মক হয়ে উঠতে পারত, আর সব গানের শেষেই ফিরে-ফিরে আসত ‘ম্যয় লাহুঁ মজেদার, চানাচো-র গরম্’-এর মতো ধুয়া, সত্যজিৎ রায়-এর ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ যা পড়েই মনে হত, যাই, গিয়ে ছোলা-চ্যাপটা কিনে আসি।
ভেবে দেখলে হয়। ঠিক লোকগীতি না হলেও, কত ইতিহাসেরই না সাক্ষী হয়ে উঠতে পারত ছোলা-চ্যাপটা ফেরিওয়ালাদের গান। এই গান আর নেই; শহর কলকাতায় তো নেই-ই। চারদিকে এত গাড়ির শব্দ, কান-ফাটানো অফিস-টাইমের মুহুর্মুহু হর্ন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কে-ই বা শুনবে ফেরিওয়ালার গান, কে-ই বা রঙ্গ-তামাশার জন্য পাঁচটা বেশি মিনিট সময় নষ্ট করবে? “গান তো আমরা জানি না, বাবা-দাদারা জানতেন,” একটু করুণ হেসে বলেন মধ্য কলকাতার বরদান মার্কেটের সামনে দাঁড়ানো ছোলা-চ্যাপটা ফেরিওয়ালা শম্ভু যাদব; সঙ্গী বিনোদ একমনে ছোলা সাজতে-সাজতে দেখান ঝুড়ির ভেতরের রহস্য, ছবি তুলতে চাইলে একটু অপ্রতিভ হলেও রাজি হয়ে যান।
অফিস-ফেরত একদিন ফেরিওয়ালাদের পাশ কাটিয়ে গুরুসদয় রোডের মুখে হলদিরাম ভুজিয়াওয়ালার ঝাঁ-চক্চকে তিন-তলা দোকানে ঢুকে পড়ি। ছোলা-চ্যাপটা আনতে হবে, বাড়ির আদেশ। কিনে ফেলি বড় এক প্যাকেট। কিনতে গিয়ে মনে হয়, রাস্তার ফেরিওয়ালার থেকে ৩০ টাকার এক ঠোঙা চ্যাপটা কিনে যখন ভাবি আজকাল জিনিসের দাম শুধু চড়েই যাচ্ছে, শীততাপনিয়ন্ত্রিত দোকানের প্যাকেট তো প্রায় অগ্নিমূল্য! যাই হোক, কেনা হয়ে যায়। কিন্তু বাড়ি ফিরে চেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভিক্টোরিয়ার সামনে বিক্কিরি হওয়া ছোলা-চ্যাপটার স্বাদ আর এ-প্যাকেটের ছোলা-চ্যাপটার স্বাদে আকাশ-পাতাল তফাৎ। না আছে সেই দারুণ নুন, না আছে পাতিলেবুর ছোঁয়া, না আছে মুচমুচে ভাব।
গান হারিয়ে গেছে, ফেরিওয়ালারা হারিয়ে না যায়। তাহলে হয়তো স্বাদটাই হারিয়ে যাবে।
ছবি এঁকেছেন লেখক