যুদ্ধ কি উপভোগ করা যায়? অবিরল বোমাবর্ষণের শিকার, ইস্কুল-হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে যাওয়া, প্রবল খাদ্যাভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত আফগানিস্তান, সিরিয়া বা প্যালেস্টাইনের কোনও মানুষই তা বলবেন না। তাঁদের কাছে যুদ্ধ মানে মৃত্যু, ধ্বংস, পঙ্গুত্ব, ধর্ষণ, অনাহার— এক কথায় মানুষের তৈরি সবচেয়ে খারাপ সমস্ত কিছুর ভয়াল সম্মেলন। যুদ্ধক্ষেত্রে যেসব সৈন্য প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেন, তাঁদের কাছেও যুদ্ধ এক বিভীষিকা; উপভোগ করার প্রশ্ন তাঁদের ক্ষেত্রেও খুব একটা ওঠে না।
অথচ আমি একটু আগেই দিব্যি যুদ্ধ উপভোগ করছিলাম, শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত আমার শোওয়ার ঘরে বসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি ‘কোম্পানি অফ হিরোজ ২’ নামে একটা খেলা আমার ল্যাপটপে খেলতে-খেলতে। দুপুরে একটু গড়িয়ে, সন্ধেবেলা গরম-গরম পাটিসাপটা খেয়ে খেলতে বসলাম; দুর্দান্ত রুশ সৈনিক হয়ে বেশ কিছু নাৎসি জার্মান সৈন্যকে ধুমধাড়াক্কা গুলি চালিয়ে, বোমা মেরে, ট্যাঙ্ক লেলিয়ে যমের দুয়ারে পাঠিয়ে এলাম, জানি একটু পরেই ভাপা চিংড়ি খাব রাতের খাবারে।
যুদ্ধ-বিষয়ক কম্পিউটার গেম-এর বাজার প্রকাণ্ড, সারা পৃথিবী জুড়ে তার বোলবোলাও ব্যবসা; হলিউডের বিশালাকৃতি যুদ্ধ-বিষয়ক ছায়াছবির বাজারও মাত তার কাছে। এই খেলাগুলোর নির্মাতা ও বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মূল বিষয় হল: যুদ্ধের অবিমিশ্র অভিজ্ঞতাকে কোন খেলা কতটা নির্ভেজাল ভাবে পৌঁছে দিতে পারে খেলুড়ের বিনোদন-যন্ত্রে। খেলার অভিজ্ঞতা কতটা একেবারে আসল যুদ্ধক্ষেত্রের মতো হয়ে উঠছে, তার মাপকাঠি হল: কম্পিউটারে তৈরি দৃশ্য (গ্রাফিক্স)-এর মান, যে-যুদ্ধ দেখানো হচ্ছে তার ঐতিহাসিক ঘটনাবলির প্রতি আনুগত্য, এবং যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র, উর্দি, ইত্যাদির সঙ্গে আসল যুদ্ধে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সাযুজ্য। প্রায় প্রতিটি যুদ্ধের খেলার পিছনেই তাই থাকে বহু অর্থব্যয়, অনেক দিনের গবেষণা, নির্মাতাদের বহু ধৈর্য, অধ্যবসায় আর খুঁটিনাটির প্রতি নজর।
এইসবের ফলে যুদ্ধের ঐতিহাসিক অনুপুঙ্খের প্রতি যে-আনুগত্য তৈরি হয় এক-একটা খেলার, তাই আমার মতো খেলুড়েদেরকে সেই খেলাটা কিনতে ও খেলতে উৎসাহী করে। যুদ্ধের অভিজ্ঞতাটা কতটা বাস্তবানুগ হল, খেলার আগে তা বোঝার জন্য অনেক খেলুড়ে দস্তুরমতো খেলার রিভিউ পড়েন ইন্টারনেট ঘেঁটেঘুটে। এই যেমন আমার নাৎসি জার্মান সৈন্য মেরে এত পরিতৃপ্তি হত না, যদি তাদের হাতের মেশিনগানগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এম-জি-৪২ না হয়ে বর্তমান যুগের এম-জি-৩ হত, বা তাদের ট্যাঙ্কগুলো সে আমলের বিখ্যাত প্যানজার না হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমলের গোবদা যন্ত্র এ-৭-ভি হত।
তাই কেউ যদি বলে, কম্পিউটারের খেলাটা তো আর আসল যুদ্ধ নয়, তাই প্রকৃত যুদ্ধ আর একটা তৈরি-খেলার তুলনা অবধি করা উচিত নয়, তাহলে এই খেলাগুলোর আসল-যুদ্ধ-সদৃশ হয়ে ওঠার কথা বলতে হবে। তাছাড়া, শুধু খেলা কেন, ছায়াছবিতে যুদ্ধ দেখেও অনেক সময়ে আমরা যেন সেই জগতে ঢুকে যাই; কারণ একটাই— পর্দায় যা দেখছি, তা বহু যত্নে যতখানি সম্ভব বাস্তবের কাছাকাছি করে নির্মাতা বানিয়েছেন অভিনয়, সাজসজ্জা, সংলাপ, আর স্পেশাল এফেক্টের নিখুঁত মিশেলে। তবে সেসব সত্ত্বেও ছবির কল্পিত বাস্তব কিছুটা অধরাই থেকে যায়, কারণ হাজার হোক আমরা এই ঘটনাবলির দর্শকমাত্র, ছবি দেখতে-দেখতে পপকর্ন খাব না তেলেভাজা— বড়জোর তা ঠিক করতে পারি; কিন্তু ছবির ঘটনাপ্রবাহকে কোনও ভাবে পালটানো আমাদের পক্ষে অসম্ভব। অন্যদিকে কম্পিউটার গেম খেলার আগে দল বা চরিত্র বেছে নিই, ঠিক করে নিই যুদ্ধের কোন অংশ (মিশন) খেলব, আমাদের আস্তে-ধীরে খেলা বা চটজলদি এগোনোর মাধ্যমে ঠিক হয় খেলার গতি, শত্রুপক্ষের ক’টা লোককে মারছি না নিজেই পটল তুলছি তা দিয়ে নির্ধারিত হয় খেলার ভাগ্য। খেলার জগতে তাই আমি পর্দায় ঘটতে থাকা ঘটনার অসহায় দর্শক নই, নির্মাতাদের ঠিক করে দেওয়া গল্পের বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যে আমি নিজেই নানান ঘটনার স্রষ্টা।
শুধু ঐতিহাসিক ঘটনাবলির প্রতি আনুগত্য নয়, যে-কোনও রাষ্ট্রের সামরিক ক্ষমতা যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা দিকের উপর নির্ভরশীল, তা উঠে আসে বেশ কিছু খেলায়। ‘এজ অফ এম্পায়ার্স’-এ যেমন যুদ্ধ করতে গেলে আগে গ্রামবাসীদের দিয়ে ফল কুড়িয়ে, শিকার করিয়ে, ফসল ফলিয়ে খাবারের জোগানের ব্যবস্থা করতে হবে, কাঠ কাটিয়ে বাড়িঘর তৈরি করার উপাদানের সংকুলান করতে হবে, সোনার খনি থেকে সোনা বের করে আর বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকাপয়সা আমদানির ব্যবস্থা দেখতে হবে। ‘সিভিলাইজেশন’ সিরিজের খেলায় যুদ্ধ করার ক্ষমতা নির্ভর করে নিজের সাম্রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা, রাজস্ব আদায়, সামাজিক শান্তি, ও রাজনৈতিক স্থিতি বজায় রাখার উপর।
কল্পিত যুদ্ধক্ষেত্রে খেলুড়েদের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাকেও নানা ভাবে বাস্তবানুগ করে তোলেন নির্মাতারা। ‘টোটাল ওয়ার’ বা ‘কোম্পানি অফ হিরোজ’-এর যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা দেয় ঘন কুয়াশা, প্রবল তুষারপাত, বা বালির ঝড়; তার মধ্যেই যুদ্ধ করতে হবে, ঠিক বাস্তবে যেমন হয়। কোথাও পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে তবে শত্রুকে আক্রমণ করতে হবে; অথচ অতখানি চড়াই বেয়ে উঠে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ঘোড়া বেগ কমিয়ে দম নেয়, সেই সুযোগে শত্রুই আক্রমণ করে বসে আমাকে— বাস্তবের যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। আসল যুদ্ধের মতোই খেলাতেও গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া যায় শত্রুর দেহ, কম্পিউটারের পর্দায় দেখা মেলে তার রক্তমাখা দেহের, যদি না শত্রু আগেই নিশানা করে ঝাঁঝরা করে দেয় আমাকে। যুদ্ধ কতটা কঠিন হবে— সহজ, মাঝারি, শক্ত, না কি খুব শক্ত— তা আগে থেকে ঠিক করে নেওয়া যায় মাউসের ক্লিকে। কতটা রক্তপাত দেখা যাবে খেলার সময়ে পর্দায়— অল্প, মাঝারি, না বেশি— তাও নির্ধারণ করা যায় অনেক খেলায় পছন্দমতো।
অবশ্যই আসল যুদ্ধের প্রকাণ্ড কায়িক ও মানসিক চাপ এই খেলাগুলোয় নেই, আমি জানি খেলায় আমি মরে গেলেও তক্ষুনি আবার খেলা শুরু করতে পারব, সবচেয়ে বড় কথা, আসল যুদ্ধে শত্রুকে হত্যার অভিজ্ঞতা এক অতি জটিল বিষয়; শত্রু হলেও সে আরেকটা মানুষ। বহু প্রাক্তন সৈনিকই শত্রু বলে চিহ্নিত বহু মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার গ্লানি বয়ে বেড়ান বাকি জীবন। অথচ খেলায় যত খুশি মানুষ মারলেও কোনও অনুশোচনার ব্যাপার নেই; বরং শত্রুনিধনই খেলায় জয়লাভ করার মাপকাঠি। এমনকী আত্মসমর্পণ করেছে বা পালিয়ে যাচ্ছে, এমন শত্রুকেও মারতে কোনও বাধা নেই অনেক খেলায়, যা কিনা বাস্তব জগতে আন্তর্জাতিক আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কাজেই, কম্পিউটার গেমের ক্ষেত্রে যুদ্ধের অভিজ্ঞতার নানা দিক। চট করে সেই অভিজ্ঞতাকে আসল বা নকল বলে দাগিয়ে দেওয়া মুশকিল। কিন্তু প্রকৃত প্রশ্ন হল, যারা এই ধরনের খেলা খ্যালে, তারা কি আদতে হিংস্র? নাহলে কি কেউ মানুষ মারার খেলা খেলে এমন আনন্দ পেতে পারে? ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে এই প্রশ্নটা ভাবায়, কারণ বাস্তব জীবনে আমি নিজে ঘোর যুদ্ধবিরোধী ও শান্তিকামী মানুষ। তবে কম্পিউটারের পর্দায় যুদ্ধের খেলা খেলতে আমার এতটা ভাল লাগে কী করে?
আসলে নিজের সত্যিকারের জীবন থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে অন্যরকমের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে ভাল লাগে সব মানুষেরই, ভাল লাগে নিজের বাস্তব সত্তা ভুলে কিছুক্ষণের জন্য ‘অন্য কেউ’ হয়ে যেতে। তাই নিজের জীবনে ভূতের দেখা পাওয়ার এতটুকু ইচ্ছে না থাকলেও, সিনেমার পর্দায় ভূতের ছবি দেখে ক্ষণে-ক্ষণে চমকে উঠে খাবি খেতে বেশ লাগে। আবার ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দেখতে বসে বেকারত্বের জ্বালায় জর্জরিত লাগে, পর্দায় ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক করে ফেলি নিজেকে, ইন্টারভিউ প্যানেলের মুখের উপর চেয়ার ছুড়ে মারতে ইচ্ছে করে আমারও। অন্য আরেকজনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নিজের মনকে এই এক করে ফেলাকে, তার চোখ দিয়ে চারপাশকে এভাবে দেখা ও বোঝাকে বলে ‘এমপ্যাথি’। এর দৌলতেই, খেলতে বসে কিছুক্ষণের জন্য আমি আর ছাপোষা ইতিহাসের মাস্টার থাকি না; ‘টোটাল ওয়ার: অ্যাটিলা’-তে হয়ে উঠি মধ্য এশিয়া থেকে হাজার হাজার ঘোড়া নিয়ে প্রাচীনকালের ইউরোপ আক্রমণ করা দুর্দান্ত হুন সেনাপতি; ‘এজ অফ এম্পায়ার্স’-এ মধ্যযুগীয় জাপানের ডাকাবুকো সামুরাইদের একচ্ছত্র অধিপতি; আবার ‘কল অফ ডিউটি’-র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জগতে আমি কখনও অভিজ্ঞ মার্কিন সৈন্য মিলার, কখনও-বা পোড়খাওয়া সোভিয়েত রুশ সৈন্য দিমিত্রি পেত্রেংকো।
তবু প্রশ্ন জাগে, মারমুখো সৈন্যের সঙ্গে এমপ্যাথি দেখিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ভিড়ে যাওয়ার প্রবৃত্তির কারণ কী? মনে রাখা দরকার, মানুষের সত্তার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হল হিংস্রতা। প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে শুরু করে বহুকাল ধরে এই হিংস্রতাই তাকে কিছু বন্য জন্তুর হামলা থেকে রক্ষা করে, অন্য কিছু জন্তুকে শিকার করার মাধ্যমে তার খাবার জুগিয়ে, আর অন্য মানুষের আক্রমণের হাত থেকে তার পরিবারকে রক্ষা করে বহু শতাব্দী ধরে তাকে টিকিয়ে রেখেছিল। আদিমকালের সেই প্রবৃত্তি আজও সমস্ত মানুষের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে, ঠিক যেমন রয়েছে আরেক অবিচ্ছেদ্য প্রবৃত্তি— কাম, মানুষের প্রজননের চিরন্তন মাধ্যম।
সাধারণত বেশির ভাগ মানুষই সর্বক্ষণ বয়ে বেড়ানো হিংস্রতার এই বীজকে ভুলে থাকেন, আর থাকেন বলেই দিনেদুপুরে সচরাচর বন্দুক নিয়ে হাটেবাজারে গুলি চালাতে বেরিয়ে পড়েন না, ঠিক যেমন কামের দ্বারা তাড়িত হয়ে মাঝরাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়েন না আরেকজন মানুষের গায়ের উপরে। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে যুদ্ধের খেলার ঘটনাবলি সেই সুপ্ত প্রবৃত্তিকেই আকৃষ্ট করে, জাগিয়ে তোলে কিছুক্ষণের জন্য। আসল যুদ্ধের হাজারও জটিলতা সরিয়ে রেখে খেলার নির্মাতারা খেলুড়েদের সামনে পেশ করেন শুভ শক্তি বনাম অশুভ শক্তির সংঘর্ষের এক সরলীকৃত কাহিনি। আমাদের খানিক জেগে ওঠা আদিম হিংস্র প্রবৃত্তি সাড়া দেয় সেই কাহিনির সারল্যে, অন্য কেউ হয়ে অস্ত্র হাতে আমিও নেমে পড়ি পোড়ামুখো অশুভ শক্তিকে একহাত নিতে।
তবে এও ঠিক, যে-অভিজ্ঞতা এই খেলাগুলো খেলুড়েদের দেয়, তা অনন্য। মিউজিয়াম, সাহিত্য, পোস্টার, ছায়াছবির মতো অন্য যে নানা মাধ্যম যুদ্ধের সঙ্গে আমাদের— অর্থাৎ বরাতজোরে যারা কখনও যুদ্ধের কবলে পড়িনি— পরিচয় করায়, তাদের কারও এতটা ক্ষমতা নেই। অতীতে ঘটে যাওয়া নানা যুদ্ধের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞানের প্রসার ঘটাতে কম্পিউটার গেমের জুড়ি নেই। যে-সমস্ত হারিয়ে যাওয়া যুদ্ধের কথা আমরা পড়ি বইতে, যার ছবি দেখি ইন্টারনেটের পাতায়, যাকে নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার উপায় করে দেয় বিনোদনের অন্য নানা মাধ্যম, তার সম্যক একটা অভিজ্ঞতা আমাদের আয়ত্তের মধ্যে এনে দেয় কম্পিউটার গেম। হারিয়ে যাওয়া অতীত শুধু জ্যান্ত হয়ে ওঠে তাই নয়, আমরা সেই অতীতের অংশীদার হয়ে উঠি।
কম্পিউটারে যুদ্ধের খেলার সঙ্গে লিঙ্গ-রাজনীতির সম্পর্কও আছে। আমাদের সমাজ বরাবরই পুরুষতান্ত্রিক। যুদ্ধ করার কাজটাকে পুরুষরা চিরকালই তাই নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছে। এমনকী আজকের যুগেও খুব কম দেশেই সেনাবাহিনীর অংশ হয়ে লড়াই করতে দেওয়া হয় মহিলাদের। অতীতের নানা যুদ্ধকে ঘিরে তৈরি করা প্রায় সমস্ত কম্পিউটার গেমেই মূল নায়ক, অর্থাৎ খেলোয়াড়, তাই পুরুষ। কম্পিউটার গেম খেলতে বসেও তাই স্বাভাবিক ভাবেই এইসব চরিত্রের হয়ে খেলতে বেশি পছন্দ করে ছেলেরা; খেলায় মহিলা-চরিত্রের স্বল্পতার জন্য এইসব খেলার দিকে মেয়েরা আকৃষ্ট হয় কম। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ছেলেরা গড়ে মেয়েদের থেকে কম্পিউটার গেম খেলতে শুরু করে ছোট বয়সে, খেলার পিছনে সময় খরচা করে অনেক বেশি, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম্পিউটারের নানা রকম খেলার মধ্যে বেছে নেয় যুদ্ধ বা অন্যান্য মারপিটের খেলা। তুলনায় মেয়েরা গড়ে ছেলেদের তুলনায় বেশি সময় কাটায় টিভি দেখে বা অন্যান্য কাজ করে, কম্পিউটার গেম খেললেও এমন খেলা বেছে নেয় যেখানে মারামারি কম। অনেক ক্ষেত্রেই এইসব খেলা সমাজের সংজ্ঞামাফিক ‘মেয়েলি’, অর্থাৎ সেখানে রয়েছে গোলাপি রঙের আধিক্য, লড়াই করার চেয়ে জোর বেশি অন্যান্য কাজ করায়, বা খেলার একটা অঙ্গ কম্পিউটারের পর্দায় সাজগোজ বা রান্নাবান্না করা।
যুদ্ধ-বিষয়ক কম্পিউটার গেমের আরেক উদ্বেগজনক দিক হল তার মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠীর মতাদর্শ ও রাজনীতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া। কম্পিউটার গেম তৈরির সবচেয়ে বড় কেন্দ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত শতকের শেষের দিকে যুদ্ধ-বিষয়ক কম্পিউটারের খেলার উদ্ভব হয় মার্কিন সেনাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। সামরিক মহল তাই এইসব খেলার একটা বড় গ্রাহক হিসাবে খেলাগুলোর নির্মাতাদের মুনাফার একটা মুখ্য সূত্র হিসাবে কাজ করে। অন্যদিকে নির্মাতারা এইসব খেলা নিয়মিত জোগান দিয়ে সেনাবাহিনীর উপরমহলের হাত শক্ত করে।
২০০২ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ‘আমেরিকা’জ আর্মি’ খেলাটি সৈন্যদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মার্কিন সেনামহলে বহুলব্যবহৃত। এর সাম্প্রতিকতম অবতার ‘আমেরিকা’জ আর্মি: রিয়েল হিরোজ’, যেখানে কম্পিউটারের পর্দায় খেলুড়েরা একেকজন আসল মার্কিন সৈন্যের ভূমিকায় খেলতে পারে। তবে শুধু কম্পিউটার গেম নয়; হলিউড ও টেলিভিশনের একাংশও মার্কিন সামরিক ও শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে একইভাবে সম্পৃক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনোদন জগতের সঙ্গে সামরিক স্বার্থের এই নিবিড় সম্পর্ককে বলা হয় সামরিক-বিনোদন কমপ্লেক্স। এর ফলে বিনোদনের নানা জিনিস, বিশেষত যুদ্ধ-বিষয়ক কম্পিউটার গেম ও যুদ্ধ-বিষয়ক চলচ্চিত্র আর শুধু বিনোদনের মাধ্যম থাকে না, অনেক ক্ষেত্রেই তা তৈরি হয় মার্কিন সামরিক ও শাসক গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শ মার্কিন দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে।
২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামি সন্ত্রাস নির্মূল করার নামে সাদ্দাম হোসেন শাসিত ইরাক আক্রমণ করে। ২০১১ পর্যন্ত সেই যুদ্ধ টেনে নিয়ে যায় মার্কিন সরকার। এই গোটা সময় ধরে ও তার পরেও প্রকাশিত যুদ্ধ বিষয়ক কম্পিউটার গেমের একটা বড় অংশ প্রেক্ষাপট হিসাবে বেছে নেয় এই যুদ্ধকে, বা সাধারণ ভাবে যুদ্ধকালীন পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন জায়গাকে। এর মধ্যে উল্লেখ্য ‘কনফ্লিক্ট ডেজার্ট স্টর্ম ২’ (২০০৩), ‘ক্লোজ কমব্যাট: ফার্স্ট টু ফাইট’ (২০০৫), ও ‘ফুল স্পেকট্রাম ওয়ারিয়র: টেন হ্যামার্স’ (২০০৬)।
ইয়োহান হেয়োগলুন্ডের মতে, এই প্রত্যেকটা খেলাতেই পশ্চিম এশিয়াকে সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়া একটা ইসলামি সভ্যতা হিসাবে তুলে ধরা হয়, যেখানে মার্কিন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ও সামরিক হস্তক্ষেপ একান্ত জরুরি, এমনকী কাম্য। হেয়োগলুন্ড একে বলেছেন ‘নয়া-প্রাচ্যবাদ’। খেলাগুলোর নির্মাতারা, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসে থাকা খেলুড়েকে এই হস্তক্ষেপের অংশীদার করে তোলেন মার্কিন সৈন্যের ভূমিকায় কম্পিউটারের পর্দায় ঘটতে থাকা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার মাধ্যমে। এই সৈন্য-চরিত্ররা প্রায় সবাই শ্বেতাঙ্গ ও পুরুষ। মার্কিন সৈন্য হিসাবে খেলুড়ের একমাত্র লক্ষ্য পশ্চিম এশিয়ার বাসিন্দাদের নির্মূল করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা ও পাশ্চাত্য সভ্যতাকে রক্ষা করা। যেন এই বাসিন্দারা সবাই সন্ত্রাসবাদী, যেন পৃথিবীর একটা জায়গায় তাঁদের অস্তিত্বই তাঁদের অপরাধ। এর মাধ্যমে বাস্তবে ইরাকে মার্কিন সামরিক-রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও হত্যালীলা বৈধতা পায় সারা পৃথিবীর মানুষের একটা বড় অংশের মনে।
আর যেহেতু পশ্চিম এশিয়ার বাসিন্দাদের বেশিরভাগই মুসলমান, তাই এই ধরনের খেলার মধ্যে দিয়ে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে ইসলাম-বিদ্বেষ, মুসলমানদের সন্ত্রাসবাদী বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন খেলুড়েরা। এখানে অবশ্য কম্পিউটার গেমের পাশাপাশি মার্কিন সিনেমা, টেলিভিশন, এবং সংবাদমাধ্যম বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে বহুদিন ধরেই। বহু সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, এই বিরাট মার্কিন গণমাধ্যম ১৯৭০-এর দশক থেকে আস্তে আস্তে এবং ২০০১-এর পর থেকে প্রবলভাবে পাঁচরকম বাঁধাধরা ধারণা (স্টিরিওটাইপ)-এ মুসলমানদেরকে ছকে ফেলতে শেখায়। মার্কিন শাসকগোষ্ঠী ও খেলা-নির্মাতাদের এই ধারণা অনুযায়ী মুসলমান মানেই ‘আরব’, ‘বিদেশি’, ‘হিংস্র’, ‘সন্ত্রাসবাদী’, আর ‘মার্কিন-বিরোধী’— অর্থাৎ শত্রু। ট্যানার মিরলিস ও তাহা ইবাইদের মতে, মুসলমানদের বিষয়ে এই রকম মনগড়া ধারণা তৈরি করে শুধু যে ইরাক, আফগানিস্তান, বা অন্যত্র মার্কিন হানাদার বাহিনীর কার্যকলাপকে বৈধতা দেয় মার্কিন সামরিক-বিনোদন মহল তা-ই নয়, দৈনন্দিন সাধারণ জীবনেও ইসলামবিদ্বেষ বাড়িয়ে তোলে এই ধরনের খেলা। তা হয়তো সরাসরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংস্র ঘটনা ঘটায় না, তবে আসল সমাজে অন্য নানা ভাবে হিংস্র ঘটনা ঘটলে কম্পিউটারের পর্দায় মুসলমানদের মেরে মেরে হাত পাকানো খেলুড়েদের তা হয়তো ন্যক্কারজনক মনে হয় না আর; বরং মনে হয়, ‘ওদের’ সঙ্গে এরকমই হওয়া উচিত। খেলার মাধ্যমেই তাই পুষ্ট হয় সমাজের ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া এরকম আমরা/ওরা-র ধারণা।
তার মানে এই নয় যে, খেলা ছেড়ে দিতে হবে। বরং খেলার সময়ে বারবার নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কী বলতে চাইছে খেলাটা? শত্রুপক্ষে যাদের দেখানো হচ্ছে ও যেভাবে দেখানো হচ্ছে, তার পিছনে কোনও লুকোনো উদ্দেশ্য আছে কি? খেলব একশোবার, কিন্তু নিজের অজান্তে যদি অন্যদের রাজনীতির খেলার ঘুঁটি হয়ে উঠি, তাহলে হার-জিতের হিসেব গুলিয়ে যেতে পারে।