বড়দিনের আলো
আমরা তো অল্পে খুশি, কী হবে দুঃখ ক’রে’— সেই কবে লিখেছিলেন জয় গোস্বামী। আজ মনে হয়, বোধহয় সব প্রজন্মেই কথাটা সত্যি, একটা সময় পর্যন্ত। জীবন হয়তো সকলকেই একটা বয়স অবধি অল্পে খুশি হয়ে উঠতে পারার অলীক ক্ষমতা দিয়ে রাখে, সময়ের বাতাস-ঝাপটায় যা আস্তে-আস্তে ক্ষয়ে যায় একদিন।
আমার ছোটবেলার শীতকাল, আমাদের ছোটবেলার শীতকাল, কলকাতার সেই শীতকাল ছিল আরও একটু কনকনে, আরও কিছুটা জবুথবু। তখন মানুষের পায়ে তাড়ার ঘুঙুর এত বেশি বাঁধা ছিল না বলেই বোধহয় ঠান্ডাও বেশিই লাগত আমাদের। কুয়াশা পড়ত একটু বেশি-বেশি, তার সঙ্গে নিম্নমধ্যবিত্ত উনুনের ধোঁয়া মিলেমিশে এমন এক পাড়া তৈরি হত, যার চারপাশে বিষণ্ণতার মশারি টাঙানো যেন। যেন কারও কিছু খোয়া গেছে হঠাৎ।
কিন্তু এরই মধ্যে মন ভাল হয়ে উঠত বড়দিন কাছে এলে। পুজো চলে যাবার পরের যে-মনখারাপ, দীপাবলি শেষ হবার পরের যে-নিষ্প্রভতা, তার অনেকটা আমরা ঢাকা দিয়ে দিতে চাইতাম বড়দিনের দিকে তাকিয়ে। কেননা সেও এক আলোর উৎসব, উপহারের উৎসব, খুশির উৎসব। সে বিদেশি বটে, কিন্তু দূরের নয়। সে বড় বটে, কিন্তু ছোটদের জন্য। সে ঝলমলে বটে, কিন্তু অধরা নয়। তাই এমনকী আমরাও তাকে আমাদের বিষণ্ণ পাড়ায় বরণ করে নিতে পারতাম, ছোট-ছোট অপেক্ষার নুড়িপাথর সাজিয়ে। আর অপেক্ষার সেই ছোট তালিকায় সকলের আগে নাম লেখা থাকত কেকের। আমরা তো জানতাম, বরফের উপর দিয়ে বলগা হরিণে টানা স্লেজ চালিয়ে সান্তা আসেন সকলের দরজায়। লাল টুকটুকে মোজার ভেতরে উপহার পুরে ছোটদের ঘুমন্ত বালিশের তলায় রেখে দিয়ে যান তিনি, যাতে ঘুম ভেঙে সারা পৃথিবীর ছোটরা বড়দিনের আলোয় নিজেদের মুখ রাঙিয়ে তোলার সুযোগ পায়। কিন্তু কেক তো তিনি বিলি করেন না মোটেই। সে-ব্যবস্থা গেরস্থকেই করে নিতে হয়।
তার জন্য অবশ্য পাড়ার দোকানগুলো তৈরি হয়েই থাকত। বড়দিনের এক হপ্তা আগে থাকতে তারা সাজিয়ে বসত নিজেদের কেক-পসরা। কিন্তু সে-আয়োজনকে আজকের সাজসজ্জার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে ভারি ভুল হবে। এখন যেমন কেক-পেস্ট্রি-প্যাটিসের জন্য আলাদা-আলাদা সব দোকান, নামীদামি সব ব্র্যান্ড, তখন তো সেসবের বালাই ছিল না। হ্যাঁ, এক-দু’খানা দোকান ছিল, যাদের কাচের ওপারে সারা বছর কেকেরা সেজে থাকত, কিন্তু কেক-পেস্ট্রি ঘিরে এমন এলাহি ব্যবসার দিনকাল ছিল না সেসব। কিন্তু যেটা মজার ব্যাপার ছিল সেটা হল এই যে, সব রকম দোকানেই বড়দিনের আগে আগে কেক পাওয়া যেত।
ধরা যাক, বড় রাস্তা থেকে একটু ঢুকে এসে মণিহারি দোকান। তার বাইরে অস্থায়ী চৌপায়া পেতে তার ওপরে থরে-থরে সাজানো কেক। কেউ এসে কিনতে চাইলে ভেতরের ছোকরা সহকারীটি বেরিয়ে এসে দরদামে হাত লাগাচ্ছে। বা ধরা যাক, পাড়ার কোণে বইয়ের দোকান। তারও বাইরের চাতালে কেকের পাহাড়। লোকজন বই কিনতে এসে একটা দুটো কেক কিনে যে ফিরছেন না, তা নয়। এইরকম সব ধরনের দোকানের বাইরেই কেক কিনতে পাওয়া যেত তখন। খেলনার দোকান হোক বা জয়নগরের মোয়ার স্টল, সামনে কেকের একখানা ছোটখাটো পসরা থাকবেই থাকবে। আর একটা ভারি মজার ব্যাপার ছিল এই যে, দোকান হাজার রকম হোক না কেন, তাদের বাইরে সাজানো কেকেরা মোটামুটি একই রকমের।
ইটের সাইজের একখানা ফ্রুট কেক পাওয়া যেত, মনে আছে। তার বাদামি পিঠে উঁচু হয়ে জেগে থাকত কিছু কাজু আর কিসমিস। তার দাম ছিল একটু বেশিই। আমরা ওসব দিকে নজর দিতাম না বিশেষ। আমাদের লোভ ছিল বাক্সবন্দি কেকের প্রতি। খুব ছিমছাম, সাদা কাগজের চৌকোনা বাক্স হত, মনে আছে। তাতে সান্তার হাসিমুখের একখানা ছবি ছাপা থাকত, আর রোমান হরফে লেখা থাকত মেরি ক্রিসমাস। কিন্তু সেইখানেই তার আকর্ষণ শেষ নয়। তাকে বাঁধা হত সোনালি সরু রাংতার ফিতে দিয়ে। ওই চারচৌকো বাঁধনে তার জৌলুস শীতের রোদ্দুরের চেয়ে কিছু কম দাঁড়াত না। যা কিছু চকচক করে, তা-ই যে সোনা নয়, সে-কথা ওই ছোট বয়সে বুঝলেও, এই কেক-জড়ানো সোনালি রাংতার প্রতি কেন যে এত টান ছিল, তা আজ আর বলতে পারব না।
তার ভেতরকার কেকও ছিল ভারি সাধারণ, আটপৌরে। ঠিক আমাদের ছোটবেলার মতোই। কোনও রঙের বাহার ছিল না তার, আহামরি সজ্জাও ছিল না। কিন্তু হলপ করে বলতে পারি, স্বাদে আর গন্ধে তার চাইতে ভাল কেক আজও মুখে পড়েনি আমার। বুকের ভেতরটা হত নরম, একটু তাতিয়ে নিলে তার সুগন্ধী ওম গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে লেগে থাকত হাতে। সেই কেক কি একখানা কেনা হবে এবার, আমাদের বাড়িতে? বড়দিনের আগে আগে এই প্রশ্ন জামার পকেটে লুকিয়ে আমরা সকলেই পাড়া বেড়াতাম হাসিমুখে। সকলের বাড়িতে সেই সোনালি স্বপ্নের প্রবেশ সম্ভব ছিল না ঠিকই, কিন্তু তিন বাড়িতে এলে সে দিব্যি দশ বাড়ির পাতে পাতে ভাগ হয়ে যেতে পারত। নইলে আর বড়দিন কীসের?
আজ নানা রকম রোশনাইয়ে বয়স জড়িয়ে ফেলার পর সেই সোনালি ফিতের ঔজ্জ্বল্যকে খুব হিংসে হয়। ওই সরু, প্যাচ খাওয়া ফিনফিনে শরীরে সে বেঁধে ফেলতে পেরেছিল শীতকালের গোপন আনন্দকে, ধরে রাখতে পেরেছিল ছোটবেলার সুগন্ধকে। এ কি বড় কম ক্ষমতা? এখনকার বড়দিনের কলকাতায় কখনও হাঁটতে বেরোলে আমি সেই হাসিমুখ সান্তা আঁকা সাদা কাগজের ঠুনকো বাক্সগুলো খুঁজি। পাব না জেনেও খুঁজি। আর মনে-মনে সান্তাকে বলি, সে কি আমার বালিশের নীচে রেখে যেতে পারে না, ওই একখানা বাক্স? অন্তত একবারের জন্যেও?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র