লক্ষ্মীপুজোয় পুরুত চুরি
পৃথিবীটা এমন লোকে-লোকারণ্য হয়ে ওঠার আগে, যখন ভিড় কম ছিল আর ঠাকুরদেবতার সংখ্যাটাও এমন ফুলেফেঁপে ওঠেনি— প্যান্ডেলের সংখ্যা তো কম ছিলই— শিলিগুড়ির মানুষ বছরের দুটো দিনের জন্য মুখিয়ে থাকত: লক্ষ্মীপুজো আর সরস্বতীপুজো।
নামকরা দুর্গাপুজো আর কালীপুজোর প্যান্ডেল বলতে তখন ছিল স্বস্তিকা, জাতীয় যুব সংঘ, জে টি এস আর জি টি এস, দেশবন্ধু স্পোর্টিং, হায়দারপাড়া ক্লাব। এই প্যান্ডেলগুলোয় যথেষ্ট ভিড় হত; আমরা ছোটরা বড়দের মাঝে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে যেতাম, হাতগুলো যেন শাড়ি-ব্যাগ-লম্বা বিনুনির জটে জড়িয়ে যেত, নাক ভরে যেত সস্তা পারফিউমে, বেশির ভাগই হংকং মার্কেট থেকে কেনা জাল চার্লি আর ওল্ড স্পাইস। এগুলোর ওপর আমাদের ছোট শরীর আর ছোট্ট চাওয়াগুলোর কোনও নিয়ন্ত্রণই থাকত না। কবে, কোন বেলা কী খাওয়া হবে, কোন রাস্তা ধরে (গোটা পরিবার) হেঁটে শহরের কোন প্রান্তে কোন-কোন প্যান্ডেল দেখতে যাবে— পুজো পরিক্রমার রাস্তা থেকে খাবারের মেনু, এ-সবই ছিল বড়দের এক্তিয়ারে। দুর্গাপুজো আর কালীপুজোই যে বছরের ক্যালেন্ডারে প্রধান দুটো ঘটনা— এই মতামতও ছিল সম্পূর্ণ বড়দের।
আমরা ছোটরা অপেক্ষা করতাম দুই বোন এবং তাঁদের জন্মদিনের— পুজোকে আমরা তাই ভাবতাম তখন, দেবদেবীদের ‘স্পেশাল ডে’। এই পুজোগুলোতে আমরা সত্যিকারের অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠতে পারতাম; শুধু আচারপদ্ধতিতে নয়, বড়দের দুনিয়ার অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে ওঠার ভীষণ ইচ্ছায়।
দুর্গাপুজো আর কালীপুজো করত পাড়ার ক্লাবগুলো, এবং তার জন্য পাড়ার বাসিন্দাদের থেকে চাঁদা তোলাটা ছিল জরুরি। এক্ষেত্রে আমরা ছিলাম দর্শকমাত্র। ‘প্রবেশ’ এবং ‘প্রস্থান’ লেখা সাইনবোর্ডগুলোর মাঝে আমাদের অবাধ গতিবিধি থাকলেও, পুষ্পাঞ্জলিতে পুরোহিতের থেকে তিন সারি পিছনে দাঁড়িয়ে যে ফুলগুলো আমরা দেবীর পায়ে ছুঁড়তাম, প্রায়শই তা গিয়ে পড়ত মা-কাকিমা-দিদিমাদের মাথায়। এত কিছু এই বোঝাতেই বলা যে, প্যান্ডেলের পুজো আমাদের জন্য চিরকালই একটু নাগালের বাইরে থেকে যায়।
লক্ষ্মীপুজো আর সরস্বতীপুজোতে কিন্তু আমরাই একাধারে লিডার আর চিয়ার-লিডার হয়ে উঠতাম। ভোর-ভোর ঘুম থেকে উঠে হই হই করতে-করতে পড়শিদের বাগান থেকে ফুল কুড়ানো আর দুব্বো ঘাস তোলা, কখনও বেপাড়ার অচেনা বাসিন্দাদের বাগান থেকে ফুল চুরি— এ-সবই ছিল প্রায় নিজেদের প্রতি মনোযোগ টানার অছিলা। যেন আমাদের গুরুত্ব নিজেদের কাছেই প্রমাণ করতে হবে।
চটজলদি একটা স্নান, ফুল-বেলপাতা সাজানোয় সাহায্য করা, ফল ছাড়ানো, কাটা, নান ধরনের পাত্রে জল ভরে রাখা, উঠোনের তুলসী গাছ থেকে কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসা, বিধান মার্কেটের দশকর্মা ভাণ্ডার থেকে বাবা বা মা যা ভুলে গেছেন, সেই একটুখানি ঘি বা মধুর জন্য বাপ্পা বা বুড়ি দিদিকে চেঁচিয়ে ডাকা (কেননা শহরে তখন এই রকম দুটো বা তিনটেই দোকানই ছিল), হাতভর্তি খুব দামি কড়াইশুঁটি ছাড়ানো, চন্দনবাটা তৈরি করা— কাজ, কিন্তু সত্যিকারের কাজ এর কোনওটাই যেন ছিল না।
আসল কাজ ছিল এর পর। বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে নুনিয়া আতপ চালের পায়েস আর খিচুড়ির গন্ধ যত বেড়ে উঠত, আর তার সঙ্গে বাড়ত আমাদের খিদে আর অধীরতা, বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে আসতাম আমরা, যেন একটা বড়সড় ক্ষুদে সৈন্যদল, ছোট হওয়াটাই যাদের প্রধান অস্ত্র। বছরে মাত্র দু’দিন— লক্ষ্মীপুজো আর সরস্বতীপুজোর দিন হলেও, ততদিনে আমাদের ট্রেনিং হয়ে গেছে। বেলা গড়িয়ে যায়, ঠাকুরমশাই সকাল ন’টায় আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন, এখন প্রায় বারোটা বাজে। কখন আসবেন ঠাকুরমশাই, পুজো হবে কখন, আর কখনই বা পুজোর ভোগ— লুচি, পায়েস, পাঁপড়ভাজা আর টমেটোর চাটনি খাব আমরা?
বাবা-কাকারাই আমাদের এই পথ দেখিয়েছিলেন। কোনও এক সময়ে— বেশ বেলাতেই— ঠাকুরমশাই আমাদের বাড়ি ঘুরে যেতেন। সেকেন্ড-হ্যান্ড হিরো বাইসাইকেলে চেপে আসা, একহারা চেহারার এক ভদ্রলোক। উপোস করা চেহারায়, শরীরে যা সয় তার চেয়ে বেশি স্পিডে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি-বাড়ি পুজো সারতে থাকতেন। আমাদের মধ্যে কোনও একজনের দায়িত্ব থাকত ওঁকে দেখে ফেলার। ব্যাস! আমাদের গলির মুখে ঢোকামাত্র বাপ্পা বা সঞ্জয়, রোহিত বা বুড়ি দিদি, পাপাই আর ইতি, দেবু আর অলোক, আর আমি আর আমার ভাই মনুষ্যশৃঙ্খল তৈরি করে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়তাম। ঠাকুরমশাই যতই কষে সাইকেলের বেল বাজান, রেগে চিৎকার করেন বা শেষমেশ কাকুতি-মিনতি করেন (‘ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে যে…’), আমাদের নট নড়ন-চড়ন। এর পরেই আমাদের বাড়ির কম্পাউন্ডে ওঁর সাইকেল, এবং মন্ত্রপাঠ; প্রথমে আমাদের বাড়ি, তারপর বাপ্পাদের, তারপর আর একটা, আরও একটা…
বড় হয়ে শুনেছিলাম, লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে কিছু চুরি করলে তা চিরকালের জন্য তোমার রয়ে যাবে। আশির আর নব্বই-এর দশকের শিলিগুড়ির কথা ভাবি যখন, মনে পড়ে, প্রতি বছর লক্ষ্মী আর সরস্বতীপুজোর দিনে পুরুতঠাকুরকে আমরা ‘চুরি’ করতাম।
সেই শহরটা হারিয়ে গেছে।
আজকাল ঠাকুরমশাইরা ঘড়ি ধরে, কাঁটায়-কাঁটায় আসেন, অপেক্ষারত যজমানদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন, আশ্বস্ত করেন। বাইক চালান।
মোটরবাইক আমরা থামাতে পারতাম না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র