কলকাতার রাস্তার খাবার নিয়ে লেখা ঝামেলার ব্যাপার। প্রথমেই একটা টেকনিকাল প্রশ্ন সামলাতে হয়— ‘রাস্তার’ খাবার মানে কি? যদি পাপড়ি চাটের কথা বলি, ‘রাস্তা’ ট্যাগটা বজায় রাখতে হলে কি আমরা রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর উপর জুনিয়র ব্রাদার্স-এর অবিস্মরণীয় চাট-টা বাদ দিয়ে— যেহেতু সেটা (নব্য বাতানুকূল) ‘দোকান’-এর আওতায় পড়ে— বিবেকানন্দ পার্ক থেকে বাগবাজার, লিন্ডসে স্ট্রিট থেকে বরদান মার্কেট অবধি ঢেলে পসরা বসানো বাকি লাখ-খানেক চাটওয়ালার উদাহরণ নিয়ে আলোচনাটা চালাবো? না বোধহয়। কিন্তু ঝাঁ-চকচকে পাঁচতারা হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলনে কাঁটা-চামচ সহ পরিবেশিত মশলা মুড়ি, বা ঝিংচ্যাক ফ্যাশন শো-এর ভদকা ফুচকা বা চকোলেট-স্নাত মোমো— এগুলো অবশ্যই কাটিয়ে যাবো। তর্ক বেশি বাড়িয়ে লাভ নেই, এ-হেন ঘোর পাপ যে অহরহ ঘটছে, তা জেনেও আমরা স্রেফ ইগনোর করে যাব, ভদ্দরলোকে যা করে আর কি। তার চেয়ে বরং সোজা রাস্তার, বা অলি-গলির, খাবারের কথায় আসি।
রাস্তার খাবারের কথা বলতে গেলেই মুড়ির কথা উঠে আসে। ভেবে দেখুন, খাদ্যগুণ বিচারে মুড়ি আদতে এমন একটা সিরিয়াল (টিভি’র নয়) যা নিয়ে আমরা মোটেও মাথা ঘামাই না। কলকাতা-জীবনে চলতে-ফিরতে মুড়ি এতটাই দৈনন্দিন, এতটাই ছাপোষা, এতটাই সর্বব্যাপী যে আমরা ভুলেই যাই যে সেটা একটা কার্ব, এবং যথার্থে এক অসাধারণ সমাজবৈষম্য-নির্বাপক কার্ব।
কুরকুরে (প্লাস্টিক প্যাকেটের নয়), ক্রাঞ্চি, জিরে-বিটনুন-লাল লঙ্কা গুঁড়ো ছেটানো, কুচি-কুচি কাটা শসা-পেঁয়াজ-টমেটো-আদা-ধানিলঙ্কা আর পাতলা ফালির আলুসেদ্ধ দেওয়া, একমুঠো বাদাম-মটর-ছোলা-চানাচুর ঠাসা, হালকা পাতিলেবুর রস, অবশ্যই সর্ষের/আম আচারের তেল আর তেঁতুলের চাটনিতে বাঁধা, একটুখানি তাজা ধনেপাতা আর ঝুরিভাজা ছড়ানো, এক টুকরো নারকোল দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া ভালো করে মাখা এক ঠোঙা ঝালমুড়ি— অনন্ত কাস্টোমাইজেশনের অপশনে ভরা এবং যে কোনও স্বাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারার কারণে জলখাবার হিসেবে কলকাতা শহরে এর জুড়ি মেলা ভার। কিছুটা পপ্ মিউজিক-এর মতো।
সঠিক পরিমাণে টক-ঝাল-নোনতা আর এক চিলতে মিষ্টি মিলিয়ে যে ভালো ঝালমুড়ি তৈরি হয়, তার গোড়ার উপকরণ কিন্তু একটাই— সংযম। মুড়ি মাখা বোঝাতে যে পরিমাপের শব্দগুলোর ওনোম্যাটপিয়া প্রয়োজন ছিল, তা থেকেই এটা বোঝা যায়। মিতাচার বলুন, সংযম বলুন, নিছক বাঙালি ভদ্রতার পরিচয় বলুন, ঝালমুড়িতে যেন কলকাতা শহরটা, কলকাতা বলতে যা আমরা বুঝি, সেই পরিশীলিত এস্থেটিকটা পরিষ্কার ফুটে ওঠে। এ খাবার যে আদতে বাংলার, তা বেশ বোঝা যায়।
বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। ঝালমুড়ি, ইদানীং শুনছি, ‘কলকাতা স্ন্যাক’-এর তকমা লাগিয়ে ভালোই ঘুরে বেড়াচ্ছে— শুধু বাংলার বাইরে, দেশের অন্য প্রান্তে দিল্লি বা বিশাখাপত্তনম নয়, এক্কেবারে সাগরপার। কখনও ওভাল, কখনও গ্ল্যাস্টনবেরি ফেস্টিভ্যাল, কখনও ডোভার সমুদ্রসৈকতে— অ্যাঙ্গাস ডেনুন-কে ঘুরে-ঘুরে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে দেখা যায় (মুড়ির ঝাঁকাটা কলকাত্তাইয়া ভার্সনের একজ্যাক্ট রেপ্লিকা) ইংল্যান্ডের নানা লোকেশনে, লন্ডন শহরে তো বটেই। তাঁর ঝালমুড়ির ‘ব্র্যান্ড’-এর নাম ‘এভরিবডি লাভ্ লাভ্ ঝালমুড়ি এক্সপ্রেস’; এক ঠোঙার দাম প্রায় চার পাউন্ড! বিখ্যাত পপ সিঙ্গার লিলি অ্যালেনের বিয়েতে হইহই করে সার্ভ করা সেই ঝালমুড়ি নাকি অভ্যাগতরা চেটেপুটে সাবড়েছেন। হায় রে আমাদের পন্ডিতিয়া রোডের লক্ষ্মীদা! ওদিকে কুইন্সে রমরম করে বিক্রি হয় ‘ঝাল এন ওয়াই সি’-এর ঝালমুড়ি আর ফুচকা; নিউ ইয়র্ক মাতিয়ে রাখেন তিন বাংলাদেশী-বংশোদ্ভুত ভাই।
আজ থেকে কয়েক দশক আগে অবিশ্বাস্য শোনালেও, আজকাল আর এ-সব ব্যাপারে কেউই আশ্চর্য হন না। ঝালমুড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে ওই বহুরূপী কাস্টোমাইজেশন— এতটাই ভার্সাটাইল যে যেকোনো রুচিতে সে বেশ মানিয়ে যেতে পারে। ভোটের কথা বলতে পারব না, তবে আপনার সবিস্তার নির্দেশ মতো তৈরি ঝালমুড়ি— আলু ছাড়া বা দিয়ে, বিনা কাঁচা পেঁয়াজে বা তেঁতুল জল ছাড়া, তেল সম্পূর্ণ বাদ বা বেশি— অবশ্যই আপনার গণতান্ত্রিক, নাগরিক অধিকার। এটা সম্পূর্ণ আপকা স্বাদ কা মামলা হ্যায়— যা হওয়াই উচিত। ঝালমুড়ির বিদেশযাত্রার পিছনেও এই যে-কোনো-স্বাদে-মিশে-যেতে-পারি ফ্যাসেটটা বোধহয় একটা বড় কারণ।
বাংলার জনজীবনে ঝালমুড়ির পেরেন্ট সিরিয়াল, বা প্রধান শস্য, মুড়ি, দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান। মুড়ি যদিও বাংলার একচেটিয়া খাদ্যশস্য নয়— গ্রেট ইন্ডিয়ান ইস্ট-এ বাংলা-বিহার-ঝাড়খন্ড-ওডিশার অধিবাসীবৃন্দ প্রতিদিন মুড়ি খেয়ে থাকেন। কিন্তু ঝালমুড়ি বলতে আমরা যা বুঝি, সেই জিনিস মূলতঃ কলকাত্তাইয়া, ‘বাঙালি’ জলখাবার হিসেবেই পরিচিত। সাংস্কৃতিক ভূগোলবিদেরা এখুনি বলে দেবেন যে কলকাতা শহরে ‘বাঙালি’ জলখাবার তৈরি করে যারা প্রতিদিন কয়েক কোটি নগরবাসীকে ক্ষান্ত করেন, তাঁদের অধিকাংশই জন্মসূত্রে বাঙালি নন, আদতে বাংলার ওই প্রতিবেশী রাজ্যবাসী এবং একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন পেশাদারদের বিরাট নেটওয়ার্কের অঙ্গ। তবে হ্যাঁ, ‘অবাঙালি’ ছোলা-বাদামওয়ালার মাখা মুড়ির সঙ্গে আপনার স্থানীয় ঝালমুড়ি-মায়েস্ত্রোর মাখা বস্তুতে যে ফারাক আছে, তা ঠিক, তা সে মায়েস্ত্রো যে জেলারই বাসিন্দা হোন না কেন। ‘বাঙালি’ ঝালমুড়িতে সর্ষে আর জিরেগুরোর ঝাঁজটা দুর্বল হৃদয়ের পক্ষে বিপজ্জনক, আর মশলাটাও একটু আলাদা।
তিনবেলা চপ-মুড়ি না খেলে মেদিনীপুরে থাকা যায় না, এ-রকম একটা প্রবাদ আছে। বহু কৃষক পরিবারে যেখানে মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে মাঠে-ঘাটে সারাদিন খেটে বেড়ান, ভাতের বদলে মুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ, বিশেষত নৈশভোজে, দেখা যায়। সারাদিন কাঠফাটা রোদে হাড়ভাঙা খাটুনির পর আবার সন্ধ্যাবেলায় হেঁসেল ঠেলার ঝক্কি থেকে রেহাই দেওয়ার জন্যই মুড়ি যেন মেয়েদের জন্য আশীর্বাদ-সম উপহার। বলা বাহুল্য, মুড়ি আর জল খেয়ে ক্ষুধানিবৃত্তি সমাজের এই স্তরের মানুষের জন্য শুধু একটা অপশন নয়— অপশনের অভাব।
‘কলকাতা স্ন্যাক’ কথাটা হাল আমলের কয়েনেজ হতে পারে, কিন্তু শহর কলকাতার কুইন্টেসেনশিয়াল আড্ডায় মুড়ির আবির্ভাব কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের দশকগুলো থেকেই দেখা গেছে। চপ/সিঙ্গারা/তেলেভাজা সহযোগে মুড়ি এবং চা ছাড়া কোনো আড্ডা সম্পূর্ণ হয় না, হতে পারে না। ১৯৩০-এর দশকে, বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগে, কলেজ স্ট্রিট-এর বইপাড়ায় প্রতিদিন বিকেলবেলা কোনও না কোনও প্রকাশকের দপ্তর যেন এক লহমায় হয়ে উঠত সাহিত্যসভা, তর্ক-বিতর্ক বা নিছক খোশগল্পে মেতে উঠতেন বিখ্যাত-সুবিখ্যাত লেখক-কবি-সাহিত্যিকেরা। যাকে বলে সাহিত্যের ‘জ্যাম সেশন’। সাগরময় ঘোষের ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ বইতে এই রকম কিছু সুপ্রসিদ্ধ বিতর্কের কথা পাওয়া যায়। যেখানে বসে এই আড্ডা/যুক্তি/তর্ক/গপ্পো চলত, সেই আনন্দবাজার অফিসে ঢালাও মুড়ি আর চা-সহযোগে এই জমায়েতে প্লেট হিসাবে ব্যবহার করা হত খবরের কাগজ (বলাই বাহুল্য!)। মুড়ি ছাড়া আড্ডা হয়?
কলকাতার ফুডস্কেপে ঝালমুড়ি আরো একটু সাম্প্রতিক যোগ। চল্লিশের দশকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শহরে অবশিষ্ট মার্কিন সৈন্য এবং চাকুরিজীবী বাবুদের খাওয়াতে মাখা মুড়ির প্রচলন শুরু করেন বিহার-উত্তর প্রদেশ থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকেরা, এই রকম একটা ঐতিহাসিক থিওরি শোনা যায়। পেরেন্ট সিরিয়ালের মতো সাহিত্যসভার মধ্যমণি হয়ে ওঠা হয়নি ঝালমুড়ির; প্রথম থেকেই একটু কেজো খাবারের তকমা লেগে গিয়েছিল। শোনা যায়, আজীবন আস্তানা মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট-এর মেসের তলায় দাঁড়িয়ে শিব্রাম চক্রবর্তী তাঁর মনপসন্দ ঝালমুড়ি যথেচ্ছ খেতেন, যদিও তাঁর কোনও লেখাতেই ঝালমুড়ি নায়কের হয়ে উঠতে পারেনি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মহা-ওস্তাদ টেনিদা তাঁর পটলডাঙ্গা স্ট্রিট পাড়ার ঝালমুড়ি– এবং এর ভায়রা, আলুকাবলি— সাঁটিয়ে থাকতেন, তা অবশ্য লেখাতেই আছে। তাঁর ‘চারমূর্তি’-র বাকি তিন জন, যাদের উপর দিয়ে টেনিদা রেগুলার এই পরস্মৈপদী অত্যাচার করে আসতেন, একটু হেসে সহ্য করে নিতেন স্রেফ গল্পের লোভে।
‘আসল’ ঝালমুড়ি কিন্তু সত্যিই ‘কেজো’ খাবার— দৃঢ়চরিত্র, রং-ময়লা, ঝাঁজালো, দৈনন্দিন; পুরুষ-মহিলা-ছেলে-মেয়ে-হিন্দু-মুসলমান-শিল্পী-কেরানী-সম্পাদক-সন্ন্যাসী-রাজা-বেঁটে ড্রামার এবং একটু বড় বয়েসের বাচ্চা নির্বিশেষে ওয়ান-ডিশ ওয়ান্ডার। ইস্কুলের পরে, কাজের শেষে বাড়ি ফেরার পথে বিকেলের জলখাবারে, কাজের ফাঁকে দুপুরের খাবার হিসেবে, মায় বাড়ি ফেরার ঠিকঠিকানা নেই যে-সব অফিসে সেখানে ডিনারের আগে খুচরো ফিলার হিসেবে ঝালমুড়ি যেখানে-সেখানে, যখন-তখন খাওয়া যায়।
উৎপত্তি যা-ই হয়ে থাকুক, জলখাবার হিসেবে ঝালমুড়ির উত্থান রকেটের মতো। এর কারণও পরিষ্কার— ঝালমুড়ি খুব সহজে এবং খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে যায়, ঝালমুড়ি মোটেও গ্রাম্ভারি খাবার নয়, এবং ভীষণ সস্তা। এখনও কিছু কিছু জেলায় বা শহরতলিতে পাঁচ টাকায় এক ঠোঙা ঝালমুড়ি পাওয়া যায়। পাঁচ টাকায় বোধহয় আজকাল আর দেশলাই আর গুটখা ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না।
যেহেতু উচ্চাশা নেই, তাই পথচারী খাবার হতে পারে, তবে এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে এতে কোয়ালিটি কন্ট্রোল থাকে না। স্থান-বৈশিষ্ট্যের অন্য দিকটা, দেখা যায়, প্রচন্ড প্রতিযোগিতামূলক। পাড়ার ফুচকাওয়ালার মতই সবাই তাঁদের পাড়ার ঝালমুড়িওয়ালাকেই জগতের শ্রেষ্ঠ মনে করে থাকেন। একটু আগে যে কাস্টোমাইজেশনের কথা বলছিলাম, তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেতে এবং ‘খুঁতখুঁতে’ কথাটার সংজ্ঞা বুঝতে হলে যে-কোনোদিন নিজের পাড়ার মুড়িওয়ালার পাশে দাঁড়িয়ে একটু কান পাতলেই ব্যাপারটা প্রাঞ্জল হয়ে উঠবে। ‘আলু দেবেন না’, ‘টমেটো দেবেন না’, ‘শসা দেবেন না’, ‘বেশি করে চানাচুর দিন’— এ-সব তো জলভাত। ‘টমেটো দেবেন কিন্তু বিচি ফেলে দিয়ে, ধনেপাতার ডাঁটা যেন দিয়ে ফেলবেন না; তেল আধ-চামচে দেবেন, আর ঠিক এক ফোঁটা লেবু’— এই না হলে কথা! এছাড়াও আছে ডায়াবেটিক বা ‘মেডিক্যাল’ মুড়ি, যাতে আলু-মশলা-তেল বাদ, থাকে শুধু চানাচুর! শোনা যায় ২০১৪ সাল থেকে, ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর যুগে একটা পেঁয়াজ-বাদ ‘সাত্ত্বিক’ ভ্যারিয়ান্ট-ও নাকি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
আমার কাছে ট্রেনের মশলা মুড়ি ছাড়া— যে-কোনো ট্রেন, যে-কোনো গন্তব্যে, যে-কোনো মুড়িওয়ালার কাছ থেকে— আমাদের পাড়ার, অর্থাৎ রাসবিহারী এভিনিউ-পন্ডিতিয়া রোডের চার-মাথার এক কোণায়, ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের বাইরে বসা লক্ষ্মীদার ঝালমুড়িটাই ঘরের জিনিস। তিরিশ বছর ধরে ঝালমুড়ি বেচে যাচ্ছে লক্ষ্মীদা; ছোটবেলার আমি থেকে চাকরিরত, সংসারী আমি, এবং আমার মতো পাড়ার অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের ননস্টপ খাইয়ে গেছে। এই কয়েক দশকে কিছু বার লক্ষ্মীদার জায়গা বদল হয়, যদিও ওই চতুর্ভুজ এলাকাতেই। আমাকে একেবারে ছোট দেখেছে লক্ষ্মীদা, বাবা-মা বা কোনো পিসি বা কাকার হাত ধরে হাঁটতে বেড়িয়েছি দেখেছে, বড়দের ঠোঙা থেকে এক চিলতে চানাচুর খাচ্ছি দেখেছে। পার্কে ফুটবল খেলে গলদ্ঘর্ম হয়ে বেরিয়ে বা টিউশন থেকে ফেরার পথে আমার নিজের ঠোঙা তুলে নিয়েছি লক্ষ্মীদার হাত থেকে। আমাকে বেকার দেখেছে, চাকরি করতে দেখেছে, চাকরি ছাড়তে দেখেছে লক্ষ্মীদা। মুড়ি মাখতে-মাখতে একটু গল্প করে নিত লক্ষ্মীদা, কিছুটা ম্যাজিশিয়ানদের ‘প্যাটারের’ মতো। তিরিশ বছর আগে, এই কথোপকথন শুরু করার প্রশ্নটা ছিল ‘কোন ইস্কুলে পড়ো?’। সেখান থেকে ধীরে-ধীরে ‘কোন সাবজেক্ট পড়ছ?’, ‘কোথায় অফিস’। তারপর, গত বছর, একদিন মুড়ি মাখতে-মাখতে লক্ষ্মীদা প্রশ্ন করে বসল: ‘দাদা, আর কতদিন এই লকডাউন চলবে, বলতে পারো? তোমরা তো খবরের কাগজে আছো…?’
এই শেষ প্রশ্নটার জবাব নেই। এই প্রশ্নটার এখনও কোনও সদুত্তর নেই; পোস্ট-প্যান্ডেমিক একটা দুনিয়ায় লক্ষ্মীদার মতো বার্ধক্যে অবতীর্ণ, বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন কিন্তু অসংগঠিত পেশাদারদের জন্য কোনও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কোনও সম্ভাবনাই নেই। আমি এই প্রশ্নটা এড়িয়ে যাই। উল্টোপাল্টা, হালকা কথা বলি, আর মনে করে লক্ষ্মীদাকে তিরিশ টাকার একটু বেশিই দিই মুড়ির ঠোঙাটার জন্য (এটা মাথায় রাখতেই হয় যে ডেনুনের বিলেতি ঠোঙার দাম এর দশ গুণ)। আমার ঠোঙার উপরে প্রতিবারই একটুকরো নারকোল ‘এক্সট্রা’ দেওয়া থাকে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র