তপ্ত ঠোঙার নোনতা গল্প
আমাদের ছোটবেলাটায় ঋতুদের ওভার ভাগ করা ছিল। যার হাতে যখন খুশি বল তুলে দিয়ে ক্যাপ্টেন উদাসীন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতেন না, ফলে আশ্বিন মাসে ভরাডুবি বৃষ্টি বা পৌষ মাসে ফ্যান-চালানো গরম, এসবের বালাই ছিল না। বৃষ্টি মানে আষাঢ় শ্রাবণ, অন্য কারও তেমন ভাবে সে-অধিকার নেই। আর, খেয়াল করে দেখতাম তখনই, বর্ষাকালের বিকেল যখন গলে গলে চুঁইয়ে পড়ত সন্ধের নরম কড়াইয়ে, কেমন একখানা বেগনি, নিভে-আসা আঁচে আকাশ ছেয়ে যেত। যেন সবে উনুন জ্বেলেছে কেউ, আরেকটু পরে রাতের রান্না চাপাবে। একরকম ঠান্ডা ঠান্ডা অনিচ্ছুক হাওয়া বইত গোটা পাড়া জুড়ে, রাস্তার এদিক সেদিক থেকে জেগে উঠত জমা জলের টলটলে আয়না, বাড়ি বাড়ি হারমোনিয়ামের ডানা মেলে দেওয়া সন্ধেবেলায়, মোমের শিখা আর রিকশার ভেঁপু মিলেমিশে সে এক আজব কান্নাকাটি রং।
কান্না তখন অবশ্য ভেঙে যাওয়া প্রেমের জন্যে নয়, সেসব আসতে বহু দেরি। বরং জোরে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ভেঙে যাওয়া পুরনো ব্যাটের জন্যে ছিল কান্না। আর সেই কান্নার সমর্থন থাকত আষাঢ়ের আকশে আকাশে। আমাদের ছোটবেলা নামক সময়টার কথা যে বারবার লিখি, তা আসলে কেবল সময় তো নয়, অন্য একখানা গ্রহ, যার থেকে আজকের পৃথিবী অকল্পনীয় দূরে। অনেক আলোকবর্ষ দূরের কোনও তারায় যদি-বা কখনও পৌছনোও যায়, আমাদের ফেলে আসা দিনকালে আর ফেরা যাবে না কোনওদিন। তাই, আমাদের ছোটবেলা আসলে দূরতম গ্রহ, আমাদেরই পৃথিবী থেকে।
আজ যা যা ভারী সহজভাবেই আমাদের হাতের কাছে আছে, তার কী কী তখন ছিল না, এই তালিকা বানাতে বসলে দিনকতক লেগে যাবে নিঃসন্দেহে। যেমন ছিল না, বাড়িতে বসে খাবার-দাবার আনিয়ে নেওয়া। এ-ব্যাপারটা যে আদৌ ঘটনা হয়ে উঠবে, সেরকম সন্দেহও ছিল না। কিছু একখানা খেতে ইচ্ছে করছে মানে দোকানের দিকে হাঁটা লাগাতে হবে, বা নিদেনপক্ষে তেমন দূর হলে এক-রিক্সার পথ। আজকের এই লেখা তেমনই এক সান্ধ্য দোকান নিয়ে, যার জুড়ি আমার এই আজকের গ্রহে নেই।
সন্ধের পর, খেলা থেকে ফিরে এসে, হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসার আগে কী খাব, জলখাবারে কোনদিন কী জুটবে, এ নিয়ে বাক্যব্যয় করবার বিশেষ সুযোগ আমাদের ছিল না। এবং এও জানতাম যে, মাঝপকেটি এইসব বাড়িরগুলোয়, তিন-চার রকমের জলখাবারই ঘুরেফিরে পেশ করা হবে। তার মধ্যেই আমাদের আনন্দ লুকিয়ে থাকতে কসুর করেনি কখনও। তবে বর্ষায়, বিশেষত ঘন বর্ষার এইসব বেগনি রঙের সন্ধেগুলোয় সকলেরই মন একটু ছোঁকছোঁক করত, চনমনে বিলাসিতার জন্যে। রোজ রোজ যে হত, তা নয়, কিন্তু তেমন-তেমন হাওয়া বইলে, সেরকম বৃষ্টি-ধরে-আসা জমাটি সন্ধে হলে, জোরশোর আড্ডা নামার থাকলে, হয়ে যেত। সেসব সন্ধেয় আর জলখাবারের পাতে তাকে আটকানো যেত না।
খুব ছোট থাকাকালীন বাবার হাত ধরে যেতাম, পরে, পাড়ার মধ্যে চলাফেরার দূরত্বছাড় বাড়লে নিজেই যেতে পারতাম। তার জন্যে অবশ্য সাধ্যসাধনা করতে হত খানিক। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে, বেশ খানিকটা হেঁটে, কিশোর কল্যাণ সংসদের খেলার পাঠ পেরিয়ে, খালের ওপর সরু ব্রিজ টপকে আরও খানিকটা হেঁটে তবে সেই মহার্ঘ দোকান। বাটুদার তেলেভাজার ঠেক। তখনও বাটুদা নামের মানুষজন সব পাড়ায় থাকতেন। যখন মানুষ না-বলেকয়ে একে অপরের বাড়িতে এসে গল্প পেড়ে বসে চায়ের পর চা উড়িয়ে দিত। তখন। সেই অন্য গ্রহে। সন্ধে নাগাদ বাড়িতে ঢুকে সকলের মনমেজাজ বুঝে কথাটা পাড়তে হত। যে, আজ মুড়ি-তেলেভাজা হবে নাকি? সে-সময়ে ডায়েট নামক কথাটা অভিধানে ঢোকেনি, কোলেস্টেরল আছে, এরকম কাউকে চিনলে তাকে খুব বড়লোক ভাবতাম। ফলে ব্যাপারটা সহজ ছিল। মেজাজ হল, তো হল, নইলে নয়। বলতে নেই, এসব সন্ধেয় মেজাজে শান দেওয়াই থাকত। তাই কতদিন যে মা বা বাবার কাছ থেকে স্যাঁতসেঁতে দশ টাকার নোট চেয়ে নিয়ে সগর্বে পাড়ার রাস্তায় নেমে পড়েছি, তার লেখাজোকা নেই।
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে তখনও, কোথাও হয়তো একটু বেশিই জল জমে আছে। প্যান্ট হাঁটুর কাছে গুটিয়ে নিয়ে, হাড়ভাঙা ছাতাকে লজ্জাসহ মেলে ধরে চলেছি বাটুদার দোকান জয় করতে। পাশাপাশি চেনা লোকজনকে হাঁটতে দেখছি আবছা অন্ধকারে, তাদের বেশিরভাগও যে ওই পানেই যাচ্ছেন, তাতে সন্দেহ নেই। ব্রিজ পেরিয়ে কিছুদূর হেঁটেই আজাদ হিন্দ পাঠাগার, সেখানেও সন্ধের দিকে ভিড় ভালই। বিশেষত বর্ষাকালে গোয়েন্দা আর ভূতের বই হুশ করে শেষ হয়ে যায়, তাই সকলেই বিকেল থাকতে বই বাগিয়ে বাড়ি ফেরার তালে থাকত। সেই পাঠাগারের পাঁচিলের পাশেই বাটুদার দোকান। অবশ্য দোকান বলতে ইদানীং যা বুঝি, তা একেবারেই নয়। এবড়োখেবড়ো আর প্রায়-চৌকোনা একখানা এলাকাকেই ঢেকেঢুকে বাটুদা নিজের জীবিকাস্থল বানিয়ে নিয়েছিলেন। আর সে-সময়ে গড়িয়ার তাবড় রেস্তোরাঁর চাইতে তাঁর ওই একচিলতে বিপণিতে ভিড় হত অনেক বেশি। কেননা, স্বাদ হাতে থাকে। লগ্নিতে নয়।
দোকানের সামনের দিকে মাটির উনুন, আঁচ নিভে এলে বাটুদার ছোকরা সহকারী সেখানে ঝড়তি একখানা হাতপাখা নিয়ে হাওয়া দিতে বসে যায়। সেই উনুনের উপর চাপানো বিরাট এক কড়াই, যার বয়স তখন নির্ঘাত আমার চেয়ে বেশিই ছিল। তাতে টলটলে দিঘির মতো তেল ভাসছে। বাটুদা দুহাতে খেলতেন। এক হাতে সাঞ্চা, আরেক হাতে কাঠের একখানা কাঠি, যেমনটা দিয়ে ঢাক বাজান ঢাকিরা। এই দুয়ের তালে তালে তাঁর কড়াইয়ে ফুলেফেঁপে উঠত বর্ষার সুস্বাদু মেঘপুঞ্জ।
ভেতরে টিমটিমে কুপি জ্বলত সন্ধের পর, রোজকার খদ্দেরদের ঠেক দেবার জন্যে কয়েকখানা বেঞ্চি আর টেবিল পাতা থাকত, সেখানে বসে খবরকাগজ পড়তে পড়তে আর দেদার আড্ডা দিতে দিতে অনেকেই কাপের পর কাপ চা আর নানখাটাই শেষ করে দিতেন। বাইরে অবশ্য অনেক ভিড়। ছাতার গুচ্ছ দেখা যেত রাস্তার একধারে। বোঝা যেত, বাটুদা এবার তেলেভাজা ছাড়ছেন কড়াইয়ে। যতক্ষণ দাঁড়াতে হয় হোক, না নিয়ে কেউ ফিরবে না।
উনুনের একপাশে আঁকাবাঁকা এনামেলের থালায় স্তূপ করে সাজানো আছে আলুর চপের চাকতি। তারপরেই সারিবদ্ধ সৈন্যের মতো পাতলা করে কাটা বেগুন। আর অন্য একখানা মহাগামলায় বেসনে ভাসন্ত পেঁয়াজকুচি। এই দৃশ্যের পর যে-অপেক্ষা, তার চেয়ে লোভনীয় সময়-সরণি আর দেখিনি জীবনে। পেঁয়াজি তার মতো ছাড়া হয়ে যাচ্ছে কড়ায়, ফুটে উঠছে তারা। সেই অবকাশে বাটুদার শিল্পীহাত অন্য গামলায় ফেটিয়ে নিচ্ছে ব্যাসন-ময়দার যুগলবন্দি। আর সেই দোলায়মান সান্দ্র মিশ্রণে ভেসে ভেসে উঠছে কালোজিরের ফুটকি, যেন মেঘ কেটে গিয়ে তারা উঠেছে রাতের আকাশে।
এরপর সেই ব্রাহ্মমুহূর্ত। হাতের নরম ঠেলায় ময়ানে চোবানো আলুর চপ আর বেগুনি জায়গা করে নিচ্ছে পেঁয়াজিদের পাশে। যেন কালো তেলের মহাকাশে পাশাপাশি ছুটে বেড়াচ্ছে জ্বলন্ত নক্ষত্ররাজি, উল্কা আর ধূমকেতু। চিড়বিড় আওয়াজের সংকেতে আমরা বুঝে নিচ্ছি কখন কার সঙ্গে কার সংঘর্ষ হয়ে যাবে, আর বাটুদা নিপুণ শৈলীতে বাঁ-হাতের কাঠি দিয়ে সেসব মহাজাগতিক দুর্ঘটনা ঠেকিয়ে দিচ্ছেন। স্বাদ তো অনেক পরের কথা, এই দক্ষ নিষ্ঠাই শিল্পের আখ্যা পেতে পারে।
একেক রকমের তেলেভাজার জন্যে আলাদা আলাদা চুবড়ি রাখা, সাঞ্চায় ছাঁকা হয়ে তারা যার যার খোপে ঢুকে পড়লেই চাহিদা শুরু। কার কখানা কী ভাজা লাগবে, সেই হট্টগোলে দোকান সরগরম। সহকারী ছোকরা দুর্দান্ত পটু ছিল এ-ব্যাপারে। একে একে দ্রুত খদ্দের ছাড়ায় তার কোনও জুড়ি ছিল না। কাগজের ঠোঙা সরু ফুঁয়ের আঘাতে চিরে নিয়ে তাতে নিশপিশ করতে থাকা গরমাগরম চপ পেঁয়াজি বেগুনি চাহিদামতো ঢুকিয়ে উপর থেকে বিটনুন ছড়িয়ে যখন এক দুবার ঝাঁকাত, তখন ওইখানেই অর্ধেক খাওয়া উসুল হয়ে যেত আমার।
দশ টাকায় পৃথিবীর সেরা আনন্দ পাওয়া যেত তখন, সেই দূরতম গ্রহে, যার নাম, আমার ছোটবেলা। ওই ধুকপুক করতে থাকা তপ্ত ঠোঙা বুকের কাছে জড়িয়ে যখন জলদি পায়ে হাঁটা লাগাতাম সন্ধের বাড়ির দিকে, তখন কখনও নেমে আসত আর এক পশলা টিপটিপ। বিটনুনের ভাসাভাসা নোনতা গন্ধে মিশে যেত বৃষ্টির সোঁদা। ওই হাঁটাপথটুকুর রোমাঞ্চ আজ কোন দামে আমাকে ফিরিয়ে দেবে, জীবন? যখন তেলে আর জলে সহজেই মিশ খেতে পারত, ছোট্ট একখানা ঠোঙার মধ্যে? সেখানে ফিরে যাবার কোনও যান আজও বিজ্ঞান বানাতে পারেনি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র