সিকিউরিটি কী বিষম ব্যাপার, তা নিয়ে গড়পড়তা মার্কিনির কোনওদিনই তেমন টেনশন ছিল না। পার্ল হারবার? সে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। তাও আবার মার্কিন মূলভূমি বলে ধরা যাবে না। আর জবাবে দুটো বোম ফেলে এক্কেবারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটাই খতম। ফলে, ‘এই আমরাই জগৎশ্রেষ্ঠ’র উড়ুক্কু মেজাজে বিমানবন্দরগুলোও যেন মাঠ। যে যেমন খুশি ঢুকে পড়ো চৈত্র সেলের মতো। আমার এক আত্মীয় তো সান ফ্রান্সিসকো-তে আমাকে সি-অফ করতে এসে এয়ারপোর্টেই চান-টান করে অফিসে চলে গেল।
কিন্তু ঠিক ২০ বছর আগের ১১ সেপ্টেম্বর, নিউ ইয়র্ক যথারীতি ট্র্যাফিক-জ্যাম আর হই-হট্টগোলে ভরপুর ব্যস্ত। কেউ কিছু বোঝার আগে, আমাদের ভারতীয় সময়ে সন্ধে ৬.১৬ নাগাদ বোয়িং ৭৬৭ আছড়ে পড়ল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর টাওয়ারে আর তার সাত মিনিট পরে দ্বিতীয় বিমানের সোজা ধাক্কা দক্ষিণ টাওয়ারে।
মার্কিনি আধিপত্য, খোলামেলা লাইফ ইজ বিউটফুল, সিনেমায়াবন হলিউডের মেজাজ, সর্বোপরি দেশের সাধারণ মানুষের গভীর নিরাপত্তাবোধ এক ধাক্কায় চুরমার। কয়েক ঘণ্টায় বিশ্ব রাজনীতির ভোলবদল। বাড়ি বাড়ি ঢুকে পড়েছে দুটো শব্দ— আল কায়দা আর বিন লাদেন।
একই সঙ্গে নতুন অধ্যায় টিভি সাংবাদিকতার আখ্যানে: এই প্রথম কোনও সন্ত্রাসের ঘটনার এই ভাবে জগৎজুড়ে সরাসরি সম্প্রসারণ হল। প্রথম বিমানটির ফুটেজ যদিও অনেক চ্যানেল পরে দেখিয়েছে তিনজন লোকের ব্যক্তিগত ভিডিও ধার করে (কেই-বা আর আগে থেকে ক্যামেরা বাগিয়ে বসে ছিল ট্রেড সেন্টারের দিকে!)। কিন্তু দ্বিতীয় বিমানের আছড়ে পড়ার মুহূর্তটি বিশ্ববাসী সরাসরি দেখেছে, তাও কিনা বৃহত্তম সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের। প্রযুক্তির ঘাড়ে চেপে টিভি জার্নালিজম যেন একদিনে সাবালক হয়ে গেল। ৯/১১-এর দশ বছর আগেও কি ভাবা যেত, রবিশঙ্করের সুর দিয়ে শুরু করে আমাদের দূরদর্শন সরাসরি বসনিয়া-সার্বিয়ার মারকাটারি গৃহযুদ্ধ ঢুকে গেছে?
টেলিভিশন-সাংবাদিকতার মূল রেসিপি হল, একটি ঘটনা কত তাড়াতাড়ি, সরাসরি দর্শকের বসার ঘরের টিভির পর্দায় পৌঁছে দেওয়া যায়। ধারাবিবরণী গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তা ভিডিওর উপরে নয়। কেবলই বকবক চাইলে তো লোকে বলবে, ‘খোল দেকি বিবিধভারতী’।
হিসেব বলে, মার্কিন টিভিগুলি ৯/১১ টানা ৯৩ ঘণ্টা সরাসরি কভার করেছিল। স্যাটেলাইট টিভির অকল্পনীয় মহা-ম্যারাথন! টিভির ইতিহাসে এত বড় ঘটনা এবং তার নিরবচ্ছিন্ন প্রচার এর আগে হয়নি। এবং এখানেই টিভির জোর যে, কোনও ঘটনা, তা বিশ্বের বৃহত্তম সন্ত্রাস-কাণ্ড হলেও, তাকে কীভাবে এক লহমায় আরও আন্তর্জাতিক, আরও ভয়ঙ্কর আকার দেওয়া যায়। তাই, মিউনিখ অলিম্পিক্সে ১১ জন ইজরায়েলি অ্যাথলিটের খুনের ঘটনা মানবসভ্যতার ঘেঁটি ধরে নাড়িয়ে দিলেও গণমাধ্যমে এতটা প্রাধান্য পায়নি। দুটো কারণ। এক, ১৯৭২-এর টিভি এত বিশ্বব্যাপী, এত শক্তিশালী ছিল না। দুই, ম্যানহাটানের বুকে আইকনিক যমজ টাওয়ারকে গুঁড়িয়ে দেওয়া আধুনিক সন্ত্রাসের বৃহত্তম মাইলস্টোন। এমন ভয়াবহ ধ্বংসলীলার সরাসরি সম্প্রচারের ইমপ্যাক্ট একেবারেই অন্য মাত্রার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কি এর আগে আক্রমণ হয়নি? আব্রাহাম লিঙ্কন-সহ চার-চারজন প্রেসিডেন্টের প্রাণনাশ আততায়ীর গুলিতেই। দুনিয়া জুড়ে নানা মার্কিন দূতাবাসে মাঝেসাঝেই বোমা ফেটে মানুষ মারা গেছে। পরের বছরই, ২০১২-তে লিবিয়ার বেনগাজিতে সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণে প্রথম এক মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিহত হন। কিন্তু ৯/১১-এর ঘটনা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল যে, সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে রাজনীতির বা রাষ্ট্রনীতির কোনও লেনদেন না থাকলেও সে টার্গেট। যে কোনও দিন, যে কোনও জায়গায়। সন্ত্রাসের এই অনিশ্চিত উপস্থিতিতে মিডিয়া, বিশেষত টিভি মিডিয়ার (ইন্টারনেট বিপ্লবের সবে সলতে পাকছে) পক্ষে এরপরে আর টেরোরিজমকে নিছক এদিক-ওদিকের কিছু খাপছাড়া ঘটনা বলে দেখা আর সম্ভব হল না। টুইটারের বোধনের আগে সব ব্রেকিং নিউজের বিস্ময় আমাদের বসার ঘরেই। ছোট পর্দা হঠাৎই আরও সচেতন, আরও জাগ্রত। এ আমাদের ‘খবর পড়ছি দেবদুলাল’ নয়। ক্যামেরা কাঁধে চাপিয়ে সোজা মাঠে নেমে পড়েছে অ্যাঙ্কর।
একটা বড় সুবিধাও ছিল। খবরের কাগজ যেটা আগামীকাল আসবে, ম্যাগাজিনে যেটা সপ্তাহান্তের কভার স্টোরি, টিভি অনেক আগেই ব্রেকিং নিউজের বন্যায় দর্শকদের চুবিয়ে দেবে। বিশেষ করে সন্ত্রাসের মতো ঘটনার কভারেজে, যেখানে হাজার ছাপা শব্দের চেয়ে এক মিনিটের ভিডিও বেশি আকর্ষণীয়।
আফগানিস্তানের তোরা বোরায় বসে বিন লাদেন সাক্ষাৎকার দিচ্ছে, সে যতই ফালতু কথা বলুক, সেই ভিসুয়ালটার একটা গুরুত্ব আছে। লোকটা কীভাবে ভাষণ দেয়, ওসামা লাঠিতে ভর করে হাঁটে, হাফিজ সৈয়দের চোখের ব্যামো, টিভির দৌলতে সবাই জেনে গেছে। ৯/১১ গোটা পৃথিবীর ফোকাস পাকাপাকি ভাবে ঘুরিয়ে দিল সন্ত্রাসে। এবং টিভি মিডিয়া খুঁড়তে শুরু করছে সন্ত্রাসের গভীর ও গোপন জগৎ। কারণ, ৯/১১ পরবর্তী পৃথিবীতে সন্ত্রাসের নতুন সংজ্ঞার মধ্যে একটা ব্যাপকতর ইঙ্গিত ছিল।
এই যে সাধারণ মানুষ বিমানে চড়তে তিনবার ভাববে, সুটকেস পড়ে থাকলেই চিন্তা হবে আই.ই.ডি. নয় তো? অফিসে, রেলস্টেশনে বসে গেছে মেটাল ডিটেক্টর। লন্ডনে দোতলা বাসে, বোস্টনের ম্যারাথনে বিস্ফোরণ। আফগানিস্তান-ইরাকে মার্কিন সেনা, রোজ খবর আসছে লিবিয়া থেকে লেবানন— টেররিজম কেমন একসূত্রে বাঁধা। ফলে গতকাল অবধি যে সন্ত্রাস সীমিত ছিল কাশ্মীর, প্যালেস্টাইন, পাকিস্তান বা দাউদ ইব্রাহিমে, এবার তার নতুন নাম ‘গ্লোবাল টেররিজম’। ইনসর্জন্ট, মিলিটান্ট— শব্দগুলো নেহাতই ফিকে। জর্জ বুশের ‘হয় তুমি আমার বন্ধু, না হলে শত্রু’র মতো, মেরুকরণের মতো— কেবলই টেররিস্ট।
এই অবস্থায় টিভি সাংবাদিকতাই বহু বছর অবধি সেই মাধ্যম ছিল, যা ভিসুয়ালের হাতিয়ার সঙ্গে করে ঘরে ঘরে নিয়ে গেছে চরম আতঙ্কের নানা দিক। সন্ত্রাসের ঘটনার গুরুত্বও আরও বেড়েছে মিডিয়ায়। কারণ এই ভুবনায়নের জমানায় লন্ডনে টেররিস্ট গাড়িবোমা ফাটালে, লাদাখও দুশ্চিন্তায় পুড়ে যাবে। পরের আর.ডি.এক্স কোথায় ফাটবে, কেউ জানে না।
তবে টিভি সাংবাদিকতায় সন্ত্রাস কভারের জোয়ার এলেও মিডিয়া-কর্তারা সুচিন্তিত ভাবেই কভারেজে একটা বাঁধ, কোথাও বা লক্ষ্মণরেখা টেনে দিয়েছেন এই ভেবে যে, অযথা প্যানিক না তৈরি হয় আর ওই বুদ্ধিভ্রষ্ট অমানুষের দলও যেন বেমক্কা পাবলিসিটি না পায়।
কিন্তু টিভির গুরুত্ব গত কয়েক বছরে ফিকে হয়ে গেছে ইন্টারনেটের দুর্নিবার অভ্যুত্থানে। সেখানে নেই কোনও বাধা, নেই কোনও ভয়। প্যারিসের ফুটপাথে লুটিয়ে পড়া পুলিশকে বন্দুকবাজ ঘাতক পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মেরে ফেলল, সে-দৃশ্য বারবার ফিরে আসে।
এর উত্তর এই নয় যে, টিভি সাংবাদিকতাও হোক লাগামহীন।
পুনশ্চ: ৯/১১ সন্ধেবেলা গুয়াহাটি থেকে বার্তা সম্পাদক রজত রায়কে ফোন করে বলেছিলাম, ‘রজতদা, একটা বড় খবর আছে।’ শীতল গলায় উত্তর এসেছিল, ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে টেরর অ্যাটাকে দুটো প্লেন ভেঙে পড়েছে। এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ?’