কুড়ি-কুড়িটা বছর পেরিয়ে গেলেও সব সময় সব ঘটনা, সব অনুভূতি, সব মানুষ, সব মনন বদলে যায় না। সময় সব কিছুর ওপর স্থায়ী প্রলেপ দিতে পারে না। কিছু কিছু ঘটনা বা অনুভূতির ওপর একটা হালকা ধুলোর আস্তরণ পড়লেও, সেই ধুলো সরালে ক্ষত দগদগে হয়ে ফের জানান দেয়। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন-টাওয়ার আক্রমণের ঘটনাটাও ঠিক তেমন। ৯/১১— এই ঘটনাটা আমাদের যন্ত্রণা তো ভুলতেই দেবে না, ভুলতে দেবে না মানবতার প্রতি অপরাধ, এমনকী পৃথিবীর অন্য খাতে বয়ে যাওয়ার মুহূর্তগুলোও চিরদিন জীবন্তই থাকবে।
ডাকবাংলা-র তরফে বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তিত্বকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এই বিষয়ে দুটি প্রশ্ন—
১. আপনি তখন কোথায় ছিলেন, কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?
২. রাজনৈতিক মতবাদ ব্যতিরেকে এই ঘটনাটা কি পৃথিবী সম্পর্কে মানুষের আদত ভাবনা বদলে দিয়েছিল?
সবাই তাঁদের অনুভূতি আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কী, কুড়ি বছর পরেও মানবতার প্রতি এমন হিংস্র ঘটনা যে ঘটতে পারে, সেই অবিশ্বাসের ব্যাপারে সবাই একমত।
নাসিরুদ্দিন শাহ, অভিনেতা-পরিচালক
আমি তখন টরোন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, ‘মনসুন ওয়েডিং’ ছবির স্ক্রিনিং-এর দৌলতে। আমাদের সঙ্গে আমেরিকার অনেক সাংবাদিকও ছিলেন। ছবি দেখে তাঁরা খুব উচ্ছ্বসিত। কিন্তু হল থেকে যে মুহূর্তে বেরিয়ে এই সাংঘাতিক খবরটা আমরা পেলাম, সেই মুহূর্তে সবার মধ্যে থেকে সমস্ত রকম উচ্ছ্বাস অন্তর্হিত হল। খবরটা এতটাই হতচকিত করে দিয়েছিল উপস্থিত সবাইকে যে, সেটা আত্মস্থ করতে সবারই বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল।
আমার মনে হয় এই ঘটনা এবং তার পর মুসলমানদের নিয়ে আমেরিকার যে প্রচার চলেছিল, তা মুসলমানদের প্রতি সারা বিশ্বের মনোভাব বদলে দিয়েছিল। আমার ছবিটা, ‘ইঁউ হোতা তো কেয়া হোতা’ তৈরি করার পেছনে একটাই কারণ ছিল যে, সেদিন ওই প্লেনগুলোয় পৃথিবীর যে কেউ থাকতে পারত।
রাজদীপ সরদেশাই, সাংবাদিক
আমি তখন আমার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘দ্য বিগ ফাইট’ অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থা করছিলাম। আমার মনে আছে আমার অনুষ্ঠানে সেই দিনের একজন অতিথি ছিলেন শিল্পপতি রাহুল বাজাজ। এবং খবরটা শোনা মাত্রই আমাদের বিতর্কের বিষয়— ‘অর্থনীতি’ বদলে আমি করে ফেললাম ‘৯/১১’। এবং আমার অন্য আরেকজন অতিথি ছিলেন নরেন্দ্র মোদী।
আমার তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া ছিল, এসব কী হচ্ছে! এটা অবিশ্বাস্য! তখন আমেরিকায় ঠিক কী কী হচ্ছিল, সে বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা ছিল না আমাদের কিন্তু এটা যে সাংঘাতিক রকমের একটা ডামাডোল, একটা পাগলামি চলছে সেটা বারবার মনে হচ্ছিল। আমার মনে আছে, যখন টুইন টাওয়ারের দ্বিতীয় বাড়ির ভেঙে পড়াটা টিভিতে দেখলাম, সেটা সবাইকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মানে, মনে হয়েছিল, কেবল আমেরিকা নয়, গোটা পৃথিবীই এখন সন্ত্রাসের কবলে।
তাবিশ খায়ের, লেখক
আমি তখন কোপেনহেগেন-এ ছিলাম। টেলিভিশনে দেখলাম মর্মান্তিক ঘটনাটা, কারণ তখনও অবধি আমি আমেরিকাই যাইনি সুতরাং নিউ ইয়র্ক যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই পুরো ঘটনাটা একটা সিনেমার মতো মনে হয়েছিল। একটা দেহ যখন ট্রেড সেন্টার থেকে বাইরে পড়তে দেখলাম, ভয়টা তখন মনের ভেতর গেঁথে গেল। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এই পুরো ব্যাপারটা একটা অবাস্তব টেলিভিশন-দৃশ্য থেকে এক ভয়াবহ অপরাধ এবং মর্মান্তিক ঘটনায় পরিণত হল।
এই ঘটনাটা গোঁড়া মুসলমানদের প্রতি একটি বৈরী মনোভাব তৈরি করল। কিন্তু এটা কি সত্যই নৈতিক বদল ছিল? আমি ঠিক জানি না। আমার বেশ ভাল করে মনে আছে, এক সময় কমিউনিস্ট ‘ষড়যন্ত্র’ এবং ‘শয়তান’ সোভিয়েত রাষ্ট্রকে ঠিক এইভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।
কুণাল বসু, সাহিত্যিক
অক্সফোর্ড-এ আমার পড়াশোনার ঘরে বসে আমি তখন লিখছিলাম। আমার এক বন্ধু উত্তেজিত হয়ে ফোন করে আমায় বলল টেলিভিশন খুলে দেখতে। টিভিতে তখন দেখাচ্ছে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে প্লেন ঢুকে যাচ্ছে। সারা বিশ্বের মতো আমরাও হতবুদ্ধি হয়ে সেই দৃশ্য দেখলাম। সমস্ত ট্রাভেল-প্ল্যান তো ভেস্তে গেলই, নানা রকম বাধানিষেধও জারি হল। কিন্তু সবচেয়ে বড় আঘাত হানল আমাদের সহনাগরিকদের প্রতি ব্যবহার আর মনোবৃত্তিতে। তাদের প্রতি মনোভাব কঠোর হল, সহনশীলতা কমে গেল। এই ঘটনা নানা রকম ভাবে আমাদের মানবিকবৃত্তিকে ক্ষয় করে মানুষ হিসেবে যেন অনেকটা সংকীর্ণ করে দিল, সভ্যতার খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিল।
প্যারিসে উগ্রপন্থীদের আক্রমণের অভিঘাতটা আমার কাছে অনেক বেশি তীব্র হয়েছিল। সেই সময় আমি প্যারিস শহরে ছিলাম আর ঘটনাটা ঘটার কয়েক মিনিট আগে বাটাক্লান, যেখানে বোমা ফেলা হয়েছিল, সেখান দিয়ে আমি গেছিলাম। আমার মনে হয় প্যারিস উগ্রপন্থী আক্রমণের পর অনেক তাড়াতাড়ি সামলে উঠেছে। প্যারিসের মানুষজন ঘৃণার মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে একটা সুস্থ-স্বাভাবিক মানসিকতার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, এই ঘটনা তাদের অনেক বেশি মানসিক ভাবে শক্ত করে তুলেছে।