হিল কার্ট রোড
আমাদের জীবনে হিল কার্ট রোড ছিল সবটা জুড়ে, সবটা ঘিরে, সর্বত্র। ঠিক যেমন জুনিয়র স্কুলের ইতিহাস বইয়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড অবস্থিত, টানা বহু বছর। আসলে শিলিগুড়ি শহরে তো দুটো মাত্র রাস্তা ছিল, ফলে যে কোনও জায়গাতে যেতে হলে, দুটোর মধ্যে একটা নিতে হতই। অন্য রাস্তাটা সেবক রোড। নামেই রয়েছে এ রাস্তার পরিচয়— এই রাস্তা ছিল লোকজনকে সেবক থেকে শিলিগুড়ি ফেরি করার সড়ক। আর তাই, আমাদের জীবনে সেবক রোডের তেমন গুরুত্ব ছিল না।
সত্যি বলতে কী, শিলিগুড়ির অর্ধেকের বেশি বাসিন্দা হিল কার্ট রোডকে কোনও দিনই সঠিক নামে ডাকত না। রিকশাওয়ালারা— যাঁরা আশি এবং নব্বই-এর দশকে একটা গুরুত্বপূর্ণ পেশাদার সমষ্টি ছিলেন— সবসময়েই রাস্তাটাকে হিল ‘কাট’ রোড বলে উল্লেখ করতেন। এটা সেই সময়, যখন গোবিন্দা এবং জনি লিভার তাঁদের শব্দবিকৃতি এবং কল্পনামূলক উচ্চারণে পরিচিত বহু হিন্দি এবং ইংরেজি শব্দের ভোল পালটে দিচ্ছিলেন, ফলে নিতান্ত রাস্তার নাম নিয়ে কেই-বা আর মাথা ঘামাত?
হিল কার্ট রোড যে আমাদের দার্জিলিং-এর পাহাড়ে নিয়ে যায়, সেই বিষয়েও আমাদের বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। খানিকটা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্বকে আমরা যতটা গুরুত্ব দিই— যা হাঁটা বা দৌড়নোর সময় আমাদের পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচায়, কিন্তু আলাদা কোনও মর্যাদা পায় না, হিল কার্ট রোডও আমাদের কাছে সেই রকম মর্যাদাই পেত।
তবে, দার্জিলিং-এর এক বৃষ্টি-ভেজা দুপুরে দেশবন্ধু ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে হিল কার্ট রোড সম্পর্কে আমার এই মনোভাব সম্পূর্ণ বদলে যায়। ছাতা আনতে ভুলে যাওয়ায় আশ্রয় খুঁজতে লাইব্রেরিতে ঢুকি এবং টাকা-পয়সা আর মনোযোগের অভাবের চিহ্ন-ভরা তাকে আবিষ্কার করি একটা গাঢ় বাদামি রঙের বই, যার উপ-শিরোনাম ‘দার্জিলিং লেটারজ ১৮৩৯’ প্রথমেই আমার নজর কাড়ে। কিন্তু বইয়ের শিরোনামে ‘দ্য রোড অফ ডেস্টিনি’ কী বলতে চেয়েছিল?
‘দার্জিলিং-এর ইতিহাসে ১৮৩৯ সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ একটা সাল— যে বছর দার্জিলিং পাহাড়ি স্টেশনের সঙ্গে সমতলের সংযোগকারী রাস্তা; এর জীবনপ্রবাহ এই হিল কার্ট রোড তৈরি হয়। প্ল্যানাররা প্রথম থেকেই বলে এসেছিলেন: ‘নো রোড— নো দার্জিলিং’, এবং ১৮৩৯ ছিল সেই গুরুত্বপূর্ণ বছর, যে বছর রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, পাথুরে রাস্তার ধারে ধারে একটা ছোট্ট বসতি, কিছু কুঁড়েঘর, এবং পিঁপড়ের মতো শয়ে-শয়ে মানুষ, যাঁরা জঙ্গল সাফ করে বাড়ি বানাবার জন্য খণ্ড খণ্ড জমি তৈরি করছিলেন। এই মহান কর্মযজ্ঞের কাণ্ডারিদের আমরা আলাদা করে চিনে নিতে পারি। এখনও অবধি যাঁরা দার্জিলিং বানানোর ইতিহাসে শুধুমাত্র কয়েকটা নাম ছিলেন, তাঁরা রক্ত-মাংসের হয়ে উঠলেন— লয়েড, ক্যাম্পবেল, উইলসন্, নেপিয়ার…’
ফ্রেড পিন্-এর বইয়ের তৃতীয় পৃষ্ঠায় এই লেখা আমি খুঁজে পাই। এর আগে আসে উপমহাদেশে ব্রিটিশদের তৈরি স্যানিটোরিয়াম শহরগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বিশেষত দার্জিলিং-এর। তৎকালীন অসমে অবস্থিত চেরাপুঞ্জির সাফল্য ‘গভর্নমেন্ট’কে ‘কলকাতা এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির নাগরিকদের জন্য কিছু করার কথা’ ভাবিয়ে তোলে।
দার্জিলিং-এর ‘আবিষ্কার’-এর জন্য যে দুই ব্যক্তিকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় তাঁরা হলেন জি.ডব্লিউ.এ. লয়েড এবং জে.ডব্লিউ. গ্রান্ট, যাঁরা ১৮৩৯ সালে ‘এক প্রাচীন এবং পরিত্যক্ত গুরখা সামরিক ঘাঁটি’ খুঁজে পান— ‘দোর্জে-লিং বা দার্জিলিং’। সিকিমের মহারাজার সঙ্গে ‘গভর্নমেন্ট’-এর বহু আলোচনার পর ন’মাসের জন্য কর্নেল লয়েড এবং গভর্নর-জেনারেল-এর দেহরক্ষী ড. চ্যাপম্যান ‘গিনি পিগ’ হিসাবে দার্জিলিং-এ বাস করেন। এবং কলকাতায় তৈরি হওয়া ‘দোর্জেলিং অ্যাসোসিয়েশন অফ কলকাতা সিটিজেন্স’-এর সদস্যরা দার্জিলিং-এ বসবাস করা বা নির্বাসনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সেই তাড়নায় ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে লে. গিল্মোর-এর দার্জিলিং-এ ১৮৩৮-এ পোস্টিং হয়, তিনি কিছু ‘স্যাপার (মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার) এবং খনি শ্রমিকদের একটি দল মোতায়েন করেন, কিছুটা ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ এবং কিছুটা নিরাপত্তার খাতিরে’। গিলমোর অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাজ এগোয় না, এবং ১৮৩৯-এ, জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়ে ‘গভর্নমেন্ট’ এই বিষয়ে মধ্যস্থতা করতে বাধ্য হয়।
‘সুপ্রিম কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া’র কলকাতা দপ্তর থেকে এবং গভর্নমেন্ট হাউসের কাউন্সিল চেম্বার থেকে ফ্রেড পিন্ দার্জিলিং-এর উদ্দেশ্যে, দার্জিলিং থেকে এবং দার্জিলিং-এর বিষয়ে ১৮৩৯-এ লেখা বহু চিঠি সংগ্রহ করেন; এর মধ্যে রয়েছে ‘তৎকালীন বিশিষ্ট সংবাদপত্রে পাঠানো বহু চিঠি’।
আমি চিঠিগুলো পড়া বন্ধ করতে পারিনি। হিল কার্ট রোড— ‘যে রাস্তা পাহাড়ে জিনিসপত্র পাঠায়’, সেই রাস্তা যাঁরা তৈরি করেছিলেন, তাঁদের অবহেলিত ইতিহাস সম্বন্ধে পড়াটা এতটাই জরুরি ছিল আমার কাছে যে, আমার লাইব্রেরি কার্ড না থাকা সত্ত্বেও আমি পরের দিন আবার লাইব্রেরিতে যাই। এই ইতিহাস শুধুমাত্র কিছু ইতিহাসে উপেক্ষিত কিছু ইঞ্জিনিয়ার বা শ্রমিকদের নয়, যাদের নাম হয়তো একমাত্র উঠে এসেছে কোনও গির্জার রেজিস্টারে বা অল্প-প্রচারিত বুলেটিনে। এই ইতিহাস তাঁদের পরিবারবর্গের, যাঁদের তাঁরা পেছনে ফেলে এসেছিলেন ভারতের দুঃসহ দাবদাহের সমভূমিতে, বা ইংল্যান্ডে, বা ইউরোপের অন্য কোনও প্রান্তে। সেই পরিবারগুলো পথ চেয়েছিল শুধু তাঁদের ফেরার অপেক্ষায়।
এই চিঠিগুলোর কথা আমি পরের কলামে লিখব। এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে যা ঘটে চলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৩৯ সালের ৩রা জানুয়ারি প্রকাশিত ‘দ্য ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’র প্রথম সম্পাদকীয় থেকে একটা উদ্ধৃতি আপনাদের কাছে তুলে দিতে চাই। লেখার বিষয় আফগানিস্তানে লর্ড অকল্যান্ডের ‘সর্বনাশা বিদেশনীতি’:
‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ইতিহাসে আরও এক বছর শেষ হয়েছে… সাম্রাজ্যের বিদেশনীতিতে বিরাট বদলের আবহাওয়া পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে… কাবুল, ভারতবর্ষের চাবি, এখন তাদের হাতে, যারা আমাদের পারস্য শত্রুদের সঙ্গে খোলাখুলি ভাবে সংঘবদ্ধ; এর পরিণামে কাস্পিয়ান সাগর থেকে ইন্ডাস পর্যন্ত যে তুমুল গোলমাল বেধেছে তা হিন্দুস্তানে আমাদের রাজত্বে আমরা অনুভব করতে পারছি… প্রাচ্যে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিরাপত্তাহীন, এই ধারণা ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করেছে… সামরিক উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ সৈন্যদলের সাহায্যে তাই কাবুলে শাহ সুজাহ’র প্রত্যাবর্তন আবশ্যিক।’
কিছুই প্রায় বদলায়নি, তাই না?
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র