যাবতীয় দর্শন ‘জীবনের অর্থ কী?’ এই কানামাছিতে ছোটাছুটি করেছে। অ্যাবসার্ড নাটক সেই খেলাতেই নেই। ‘জীবন অর্থহীন, জীবনের কোনও অর্থ হয় না’— বলে দিয়ে সে সটান মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেছে একা একা। আমার মতো বাংলার একজন সাধারণ নাট্যকর্মীর কাছে ‘জীবন অর্থহীন, জীবনের কোনও অর্থ হয় না’— এই কথাটি এবং তাকে ভিত্তি করে আবার নাট্যচর্চা বামুনকুলে গোমাংসের মতো বর্জনীয়, কারণ আমাদের সমৃদ্ধ নাট্য-ঐতিহ্যে এ জাতীয় অলক্ষুণে কথার কোথাও কোনও স্থান নেই। শেষে কিনা জীবনের অর্থহীনতাকে তুলে ধরা হবে মঞ্চে? এটা কী করে আমাদের পথ হবে? কোনও মহাজন তো সে পথে যাননি!
কেন? যাননি কেন? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যে-পরিস্থিতিতে এই ধরনের নাটকের জন্ম, সেরকম মোক্ষম কোনও প্রেক্ষাপট আমাদের এখানে আদৌ নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই নাট্যদর্শন খুব একটা আমল পায়নি আমাদের কাছে। না কি এই নাটক আমাদের আরাম দিতে পারেনি? যে গ্ল্যামার, আবেগ, মায়া, মাদকতা, উচ্ছ্বাস নিয়ে আমাদের নাট্যচর্চা, এই নাটক করা তাতে একেবারেই রসভঙ্গের সামিল। তাই বৃহত্তর জনসংযোগের কথা মাথায় রাখলে, এই নাটকচর্চার কোনও তাগিদ আসার কথাও নয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা নয়, জনমত গড়ে তোলা নয়, বুদ্ধিদীপ্ত শিল্প-চাতুর্যে মোহাবিষ্ট করা নয়, চোখের জলে ভাসিয়ে দেওয়া নয়, তাহলে কী? কী বলতে বা দেখাতে চাইছে এই অদ্ভুতুড়ে নাট্যধারা?
এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য, অ্যাবসার্ড নাটক কোনও পরিকল্পিত বা সচেতন সাহিত্য আন্দোলন বা বিপ্লব একেবারেই নয়। কাছাকাছি সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানের কয়েকজন মানুষ, যাঁদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা তো দূর, পরিচয়ও নেই, তাঁরা এমন নাটক লিখছেন, যা নাট্য-রচনার যাবতীয় সনাতন শৈলীকে কচুকাটা করছে। তাই এই নাট্যধারা প্রচলনের কোনও সমবেত উদ্যোগ তো ছিলই না, বরং এই নাট্যকাররা অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক ও নিভৃতি-অভিলাষী।
সামাজিক বাস্তবতাকে সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরে কোনও মর্মকথা বা উপদেশ দেওয়া এঁদের অ্যাজেন্ডার মধ্যে নেই। আছে ব্যক্তির অন্তর্জগতের বাস্তবতাকে প্রকাশ্যে আনার নির্মম প্রয়াস। কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার বা তাকে খণ্ডন করার দায় তাঁদের নেই। তাঁরা ডুব দিয়েছেন ব্যক্তিমানুষের গভীরে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের যে মোহমুক্তি, যে ধর্মীয় অবিশ্বাস, যে অসহায়তা, যে সার্বিক শূন্যতাবোধ, সেগুলোই কোনও রকম সচেতন বাহ্যিক যুক্তিবোধ ব্যতিরেকেই নগ্ন রূপে ফুটে উঠেছে তাঁদের লেখায়।
১৯৫৩-তে একইসঙ্গে প্যারিসে মঞ্চস্থ হয় দুটি নাটক। স্যামুয়েল বেকেট-এর ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ এবং ইউজিন ইউনেস্কোর ‘দ্য চেয়ারস’। প্রথমটিতে দুই ভবঘুরে অপেক্ষা করছে গোডো আসবে বলে, গোডো-র আসার কথা। দ্বিতীয়টিতে এক বৃদ্ধ দম্পতি অপেক্ষা করছে এক বক্তার জন্য, যে তাদের হয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে। আমরা দেখতে পাই, একটি নাটকের শেষে গোডো আসে না, অন্যটিতে বক্তা আসে, কিন্তু সে বোবা। গোডো কে? বা ওই দম্পতির কী কথা বলার ছিল? আমরা জানি না। জানাবার চেষ্টাও করেননি নাট্যকার। কারণ পরিণতিহীন এই ‘অপেক্ষা’টুকুই এখানে উপজীব্য। এটাই চরিত্রের ‘inner reality’, ‘ভেতরের বাস্তব’। অ্যাবসার্ড নাটকে, গল্পের যুক্তিযুক্ত পর্যায়ক্রম বা সুনির্দিষ্ট পরিণতি নেই। চরিত্রগুলির কোনও সামগ্রিক রূপরেখা নেই। একটি চরিত্র যেন তার অস্তিত্বের, তার অন্তর্জগতের খামচে তোলা অংশমাত্র।
সমালোচনাও কম হয়নি। লন্ডনের ‘অবজার্ভার’ পত্রিকায় নাট্যকার ইউনেস্কো ও সমালোচক কেনেথ টাইনান-এর মধ্যে প্রশ্ন-উত্তর-প্রত্যুত্তরের দীর্ঘ বাকবিতণ্ডা চলে। অনেক বুদ্ধিজীবীই তাতে অংশগ্রহণ করেন, কোনও না কোনও পক্ষের হয়ে। তাঁর নাটকে কোন মেসেজ নেই এই সমালোচনার বিরুদ্ধে ইউনেস্কো লেখেন, ‘I am a writer, I am not a postman.’ তাঁর মতে, ‘reailsm… falls short of reality… it does not take into account our basic truths. Truth is in our dreams, in the imagination.’ পরে হ্যারল্ড পিন্টার-ও জানান, তথাকথিত সামাজিক বাস্তববাদীদের চেয়ে তিনি নিজেকে বেশি বাস্তববাদী মনে করেন, কারণ তাঁরা অস্তিত্বের প্রাথমিক সমস্যাগুলিকে তুলে ধরতে পারেন না।
এইখানে একটা মজার বৈপরীত্য লক্ষ করি। এই নাট্যকারদের জীবনচর্চা সম্পর্কে একটু বিশদে পড়তে গিয়ে দেখতে পাই, এঁদের অধিকাংশই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ও আদর্শগত ভাবে মূলত বামপন্থী। অর্থাৎ এমন নয় যে, তাঁদের আদতে কোনও রাজনৈতিক আদর্শ নেই। তবু তাঁদের নাটক ‘Anti-Ideological’ বলে সমালোচিত হচ্ছে। কারণ তাঁরা যে শিল্প সৃষ্টি করছেন, সেখানে কোনও নির্দিষ্ট মতবাদের সোচ্চার সমর্থন বা বিরুদ্ধাচরণ নেই। এটা কি তবে দ্বিচারিতা? রাজনৈতিক উদাসীনতা? সাহসিকতার অভাব? না কি এর থেকে এটা শিক্ষণীয় যে, দৃঢ় রাজনৈতিক আদর্শ থাকলেও একজন শিল্পী বাধ্য নন তাঁর শিল্পে সেই আদর্শের ওকালতি করতে?
প্রসঙ্গত, সেই ‘অবজার্ভার’ পত্রিকা থেকে ইউনেস্কোকে উদ্ধৃত করা যেতে : ‘art and ideology often interact on each other… they are brothers, not child and parent.’
এই ‘art’ ও ‘ideology’, শিল্প ও মতাদর্শ-র বোঝাপড়া নিয়ে কথা উঠলে, বিশেষত সেটা যদি থিয়েটার সম্পর্কিত হয়, অবধারিত ভাবে যাঁর নাম উঠে আসে, তিনি বের্টল্ট ব্রেশট। অ্যাবসার্ড নাটকের সঙ্গে যুক্ত না হলেও, এই আলোচনায় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অ্যাবসার্ড নাটকের খুব খুব শক্তিশালী একটি ‘counter point’ হিসেবে দেখা যেতে পারে ব্রেশটীয় নাটককে, যেটি বাংলার নাট্যমণ্ডলে অনেক বেশি সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত। এই দুই ধারার তফাত বা বিরোধগুলি খুব সহজেই বোধগম্য। ব্রেশট একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শে আস্থা রেখে সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন দর্শকের সামনে এবং তাদের শিক্ষিত করে তোলার বা রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেছেন তাঁর নাটকে। এ জাতীয় কোনও চেষ্টাই অ্যাবসার্ড নাট্যকারদের মধ্যে নেই। অতএব খুব সহজেই প্রমাণিত হল, এই দুই নাট্যধারা পরস্পর-বিরোধী। বিরোধ তো আছেই, কিন্তু দুই পক্ষেরই নাট্যদর্শনের আর একটু গভীরে গেলেই একটা উল্লেখযোগ্য মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। এটি আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। হয়তো এই দুই ধরনের নাটক ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতার ক্ষেত্রকে বেছে নিয়েছে, কিন্তু যে-ভাবনা থেকে ব্রেশট-এর বিখ্যাত ‘Alienation Effect’, অর্থাৎ দর্শককে নিছক হাসি-কান্না-মোহ-মায়ায় মুগ্ধ করে রাখা নয়, একইসঙ্গে মঞ্চে যেটা ঘটছে, সেটা সম্পর্কে সজাগ করে রাখা, ঘটনাটি বা চরিত্রগুলির সঙ্গে একাত্ম না হয়ে বুদ্ধি দিয়ে তাদের বিচার করা— এই ভাবনাটিকে সার্থক করে তুলতে পারে অ্যাবসার্ড নাটক।
সাধারণত নাটক-সিনেমা দেখার সময় ‘এরপর কী হবে’— এই ভাবনাটি চলতেই থাকে আমাদের ভেতরে। সেটি ব্রেশটের নাটকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু অ্যাবসার্ড নাটকের ক্ষেত্রে ‘এরপর কী হবে’-র চেয়েও ‘এটা কী হচ্ছে’ এই ভাবনাটি প্রাধান্য পায়। নাট্যকার হিসেবে ব্রেশট এতটাই উচ্চমানের যে, তাঁর সুনিপুণ গল্প-বিন্যাস, বলিষ্ঠ চরিত্র-নির্মাণ, ক্ষুরধার সংলাপ ইত্যাদি দর্শককে মুগ্ধতার দিকেই টেনে নিয়ে যায়। একইসঙ্গে তিনি সেই মুগ্ধতা থেকে দর্শককে সরিয়ে রাখতেও সচেষ্ট। কিন্তু অ্যাবসার্ড নাটক তার বিষয়বস্তু, সংলাপ, মঞ্চ, চরিত্র নিয়ে নিজেকে এমনভাবেই প্রকাশ করে, যে মোহাচ্ছন্নতার কোনও অবকাশই থাকে না। ইওনেস্কোর ‘আমেডি, অর হাউ টু গেট রিড অফ ইট’ নাটকে, আমেডি একজন লেখক যিনি পনেরো বছর ধরে দুটো বাক্য লিখেছেন। তিনি আর তাঁর স্ত্রী একটি ঘরেই থাকেন, পনেরো বছর ধরে তারা কেউ বাইরে যাননি। আমরা জানতে পারি, পাশের ঘরেই পড়ে আছে একটি যুবকের মৃতদেহ। সে পনেরো বছর আগে এ বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু যেটা মজার, ওই মৃতদেহটি নাকি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অর্থাৎ যুবকটি মারা গেছে, কিন্তু মৃতদেহটি বেঁচে আছে। বাড়তে বাড়তে একসময় দরজা ভেঙে মঞ্চে প্রবেশ করে তার জুতো পরা দীর্ঘাকার দুটি পা। মনে করা হয়, ওটি আসলে তাদের মৃত দাম্পত্য। যাই হোক, এই যে বীভৎসতা, চেনা অনুভূতির বাইরে নতুন একটা কিছু দেখা বা শোনার অভিজ্ঞতা, সেটা বাধ্য করে নাটকের কোনও মুহূর্তকেই ‘taken for granted’ হিসেবে না নিয়ে, সদা-সজাগ এক উৎকণ্ঠা নিয়ে কী হচ্ছে তা অনুধাবন করতে। তাই ‘এলিয়েনেশন’-এর মূল অভীষ্টের দিকে অ্যাবসার্ড নাটক বোধহয় একধাপ এগিয়েই শুরু করছে।
এই দুই নাট্য-ধরনের বৈপরীত্যের মধ্যেই লক্ষ করার মতো আর একটি বিষয় উঠে এল। জন আর্ডেন, এডওয়ার্ড বন্ড-এর মতো নাট্যকার এলেন, যাঁদের লেখায় এই দুই ধারারই সহাবস্থান দেখা গেল। দুটোর দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে নাটক এক নতুন ভাষা পেল। এইখান থেকে বাংলা নাটককে এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
১৯৭১ সালে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের রচনায়, বিভাস চক্রবর্তীর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হল নাটক ‘রাজরক্ত’। ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকায় এই নাটকটি প্রসঙ্গে লেখা হল, ‘Absurd in form and Brechtian in content’. উক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ। ব্রেশটের নাটকের রাজনীতি ও অ্যাবসার্ড নাটকের অভিব্যক্তি ছাপ ফেলল মোহিতবাবুর একের পর এক নাটকে। একটি নতুন শব্দ জন্ম নিল তাঁকে কেন্দ্র করে— ‘কিমিতিবাদ’ (কিম্ ইতি? অর্থাৎ, এটা কী?)। অ্যাবসার্ড থিয়েটারের অত্যন্ত উপযুক্ত বঙ্গীকরণ এটি। যদিও মোহিতবাবুর কিমিতিবাদী নাটকের সঙ্গে অ্যাবসার্ড নাটকের মিল খুব সামান্যই। ব্যক্তিগত ভাবে ওঁর সঙ্গে দু’একবার কথা বলার সুযোগে জানতে পেরেছি, উনি নিজেও ওঁর লেখা নাটককে অ্যাবসার্ড নাটক বলে মানতে রাজি নন। তবে সমালোচিত তিনি হয়েছিলেন। স্বয়ং উৎপল দত্ত ‘কিমিতি… জ্যামিতি…’ ইত্যাদি বলে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে রসবোধের পরিচয় দিয়ে এই ধরনের নাটকের সমালোচনা করেছিলেন।
মোহিতবাবু ছাড়াও আর একজন বাংলা নাট্যকার অ্যাবসার্ড নাটক নিয়ে আলোচনায় অবধারিত ভাবেই চলে আসেন। তিনি বাদল সরকার। ‘অ্যাবসার্ড থিয়েটার’ কথাটির জন্ম মার্টিন এসলিনের যে বইটি থেকে, সেখানে বাদল সরকারের নাম না থাকাটাই দুর্ভাগ্যজনক। তাঁর ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকে ইন্দ্রজিৎ ঝাঁকের কইয়ের মতো স্বাতন্ত্র্যহীন ভাবে মিলে যেতে চায় অমল, বিমল, কমল, নির্মলদের দলে। সে পড়ে থাকে এক উদ্বৃত্ত চরিত্র হয়ে এই উপলব্ধি নিয়ে: ‘… বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমার অস্তিত্ব একটা অদৃশ্য ধূলিকণার চেয়েও অর্থহীন।’ ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকে সীতানাথ জানায়, আমাদের অনেকেই ‘নিঃশব্দে নীরবে বাঁচা বন্ধ করে বসে আছে।’ জীবনের অর্থহীনতা, চরিত্রের বিচ্ছিন্নতা, এগুলিকে অ্যাবসার্ড নাটকের খুব কাছে নিয়ে যায়। মঞ্চ-নাটক লেখার অভূতপূর্ব দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে বাদলবাবুর নিজের নাটকের ধারা বদলে ফেলার ঘটনাটি মনে করায় আর এক বিখ্যাত ফরাসি নাট্যকার আর্থার অ্যাডামভের কথা। অ্যাবসার্ড নাটকের মূলস্রোতের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি তিনি। কিন্তু পরবর্তীকালে নিজের নাট্যশৈলী সম্পূর্ণ বদলে ব্রেশটের ‘এপিক থিয়েটার’-এর ধারাকেই সার্থক রূপ দেন তাঁর নাটকে।
কাজেই এই ব্যাপারটি খুবই পর্যবেক্ষণযোগ্য যে, অ্যাবসার্ডিটির তীব্রতার তফাতে, পৌনে অ্যাবসার্ড, সোয়া অ্যাবসার্ড, সাড়ে অ্যাবসার্ড— এরকম বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত হয়েছে এই নাট্যধারা। কামু বা সার্ত্র যেমন তাঁদের নাটকে অ্যাবসার্ড নাটকের দর্শনটুকুই তুলে ধরতে চেয়েছেন, কিন্তু নাট্যরচনার পরিচিত কাঠামোকে রক্ষা করেই। সেদিক থেকে ইউনেস্কো, বেকেট, জেনে হয়ে উঠেছেন সার্বিক ভাবেই অ্যাবসার্ড। এই দর্শনগত ভাবে অ্যাবসার্ড নাটক ও সার্বিক ভাবে অ্যাবসার্ড নাটকের মধ্যবর্তী কোনও একটা স্থানে রয়েছেন আমার অত্যন্ত প্রিয় নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার।অ্যাবসার্ড নাট্যকারদের দলে ফেলা হলেও, এক স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে তাঁর। বিষয়বস্তু, নাটকের গঠন, সর্বোপরি সংলাপ, সবেতেই তিনি পরিচিত কাঠামো থেকে সরে এসেছেন, কিন্তু কিছুটা। তাই তাঁকে কোনও বিশেষ শ্রেণিভুক্ত করা খুব কঠিন।
এবার নাটকের দর্শন, বিষয়বস্তু ইত্যাদিকে পাশে রেখে কেবল অভিনেতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখা যাক, কারণ একটি সফল প্রযোজনা অনেকাংশেই অভিনয়-নির্ভর। অভিনেতা তার অভিনেয় চরিত্রটিকে আপাদমস্তক বুঝে, চরিত্রের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে পর্যাপ্ত পর্যালোচনা করে, একটি সামগ্রিক রূপরেখা বিশ্বাসযোগ্য ও অর্থপূর্ণ ভাবে দর্শকের সামনে তুলে ধরবে। খুব একটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এটাই অভিনয়-শিক্ষার মূল ধারা। কিন্তু অ্যাবসার্ড নাটকের ক্ষেত্রে এই পথ অনুসরণ করতে গিয়ে এক বিড়ম্বনা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যে নাটক লেখাই হয়েছে চরিত্রকে পূর্ণাবয়ব না দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে, অর্থহীনতাই যখন চরিত্রগুলির ভিত্তি, সেক্ষেত্রে অভিনেতার করণীয় কী? অভিনয়ের প্রেক্ষিতে এ এক মজার অভিজ্ঞতা। ২০১৮ সালে বিভাস চক্রবর্তী যখন তাঁর নির্দেশিত ‘রাজরক্ত’ নাটকটিকে ৪৭ বছর পর পুনরায় মঞ্চস্থ করলেন, তাতে অভিনয় করার সুবাদে সেটা কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছি। মনে আছে, মহলার শুরুতেই আমাদের ভাল অভিনয় করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা দেখে নির্দেশক বলেছিলেন, ‘মেথড অ্যাক্টিং’ বা ‘রিয়েলিস্টিক’ অভিনয় করার যাবতীয় প্যাঁচ-পয়জার ভুলে যেতে। নাটকটিতে একজন অভিনেতাকে একইসঙ্গে ছ’টি ভিন্ন চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হচ্ছে। এই ছ’টি চরিত্র বাহ্যিক ভাবে সম্পূর্ণ আলাদা। আবার একইসঙ্গে নাট্যকার দর্শনগত ভাবে বোঝাতে চেয়েছেন, এই ছ’জনের মধ্যে আসলে একজন মানুষই সদাবিরাজমান। তাই একইসঙ্গে চরিত্রগুলোর খণ্ড খণ্ড বিভিন্নতা প্রকাশ ও একাত্মতা বজায় রাখার টানা-পড়েন, আমার মতো অভিনয়-শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ও প্রার্থনীয়। আমি মনে করি যথার্থ অ্যাবসার্ড নাটক অভিনেতাদের আরও সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় করে তুলতে পারে।
এই আলোচনার শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম যে, বাংলায় অ্যাবসার্ড নাটক খুব একটা আমল পায়নি, তার অন্যতম একটি কারণ হল, আমরা বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করিনি। তাই তার পরবর্তী সেরকম পরিস্থিতিও এখানে তৈরি হয়নি, যেখান থেকে অ্যাবসার্ড নাটক জন্ম নিয়েছিল। নিঃসংশয়ে বলতে পারি কারণ হিসেবে এটি সত্য। কিন্তু এখন প্রশ্ন তোলাই যায়, এই সত্য কি সময়ের সাথে সাথে তার শক্তি হারায়নি? আজ এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের বর্তমান, ক্রমশ গ্রস্ত হয়ে পড়ছে এক লক্ষণীয় শূন্যতাবোধে। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য হোক, বা রাজনৈতিক হতাশা হোক, বা ভয়াবহ অতিমারী হোক, বিবিধ কারণে ক্রমশ যেমন তীব্র হয়েছে মানুষের অসহয়তাবোধ, তেমনই শিথিল হয়ে আসছে বিশ্বাস। পাঁচ-ছ’বছর ব্যাপী বিধ্বংসী বিশ্বযুদ্ধের তীব্র ও প্রত্যক্ষ প্রভাব না থাকলেও, বছরের পর বছর ধরে একটু একটু করে বিশ্বাসহীন, মূল্যবোধহীন, আদর্শহীন এক অসহায় শূন্য সময় নিপুণতার সঙ্গে রচনা করে যেতে পারছি আমরা। সেই প্রবণতায় ভরসা রাখলে, জীবনের অর্থহীনতাই কিন্তু উঠে আসবে মঞ্চে। সময়ের অভিমুখ সেদিকেই।