ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শুভযাত্রা বন্ধু


    রাস্‌কিন বন্ড (Ruskin Bond) (August 13, 2021)
     

    প্যাঁচাদের অস্তিত্ব আনন্দের বিষয়, থরো লেখেন তাঁর জঙ্গলকুটিরে। থরো প্যাঁচাদের রাতের ডাকাডাকিকে সুমধুর কলকল নামে বর্ণনা করেছেন; শহর থেকে বহুদূরে, নিবিড় বনানীর মাঝে বাস করার দরুন তিনি বহু প্যাঁচার সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। আমি পেয়েছিলাম মাত্র একটির।

    বহু বছর, চার দশক আগে, দিল্লির জীবনযাত্রায় ব্যাতিব্যস্ত হয়ে আমি মুসৌরির উপকন্ঠে একটি কটেজ ভাড়া করি, এবং কিছুদিনের মধ্যেই আমার টাইপরাইটার, এক-সুটকেস বই এবং অন্য এক সুটকেস ভর্তি মোজা-শার্ট-পাজামা– এক কথায় আমার যাবতীয় স্থাবর ও পার্থিব সম্বল নিয়ে সেখানে উঠে আসি।

    প্যাঁচার সাথে আমার প্রথম আলাপ আমার পৌঁছনোর দিন বিকেলবেলায়, কটেজ প্রবেশের মুখে। বৃহদাকার এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, তিনি আমাকে কটেজের এক ঢালু টালির উপর থেকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছিলেন, হয়তো বা বিশ্লেষণই করছিলেন।

    ‘আরে, প্যাঁচা!’ বলে ওঠেন আমার বন্ধু, আমায় কটেজে পৌঁছনোর সঙ্গী। ‘এ তো সুলক্ষণ নয়! তার উপরে আজ আবার Friday the 13th!’

    প্যাঁচাদৃষ্টি যে অশুভ ছিল না, তার প্রমাণ এই সন্ধ্যার পরের ন’বছর, যে সময়টায় ওই কটেজবাসী হয়ে আমি আমার জীবনের কিছু অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখা লিখি। কটেজের চারপাশের পাহাড়, জঙ্গল, বন্যপ্রাণী ও নীচে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর মাঝে আমায় লেখার রসদ খুঁজে বেড়াতে হয়নি, গল্পেরা এসে পড়েছে একে-একে এবং বহুল প্রকাশিত হয়েছে। এর মাঝে আমার নিজস্ব ব্যক্তিজীবনে বহু টানাপড়েন ঘটে যায়, কিন্তু তা বোধহয় আমি ফকল্যান্ড বা জান্জিবারে থাকলেও হত। আমরা আমাদের প্রকৃতি সাথে নিয়ে চলি।

    আমি কটেজে উঠে আসার বহু আগেই প্যাঁচা মহাশয় চিলেকুঠুরিতে আস্তানা গেড়েছিলেন এবং ওই ন’বছর তিনি সেখানেই কাটান। কড়িকাঠ ও ছাদের মাঝে তাঁর নিজস্ব যাতায়াতের একফালি রাস্তা ছিল। প্যাঁচার উপস্থিতিতে ইঁদুর-বাদুড় এবং অন্যান্য অনাহূত অতিথিদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকায় আমি তাঁর চিলেকোঠার অবাধ স্বাধীনতায় কোনদিন বাধ সাধিনি।

    মুসৌরি টাউন থেকে ঘুরে ফেরার পথে প্রায়শই প্যাঁচা মহাশয়কে তাঁর পছন্দসই নজরদারির জায়গায় বসে থাকতে দেখা যেত। আমার নিশ্চিত ধারণা, এই মোলাকাতগুলিতে কখনও-কখনও উনি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপতেন– যেন কোনও গোপন তথ্য জানাতে। আগেই বলেছি, ওঁর ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারায় বেশ একটা হাকিমি ভাব ছিল, এবং আমি ওঁকে ‘ধর্মাবতার’ নামে সম্বোধন করতে শুরু করি। সকালে ‘সুপ্রভাত ধর্মাবতার’ এবং সন্ধ্যায় ‘শুভ শিকার ধর্মাবতার’ বলাটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে দাঁড়ায়। কখনও নিছক মজার ছলে ‘বলেন কী!’ সম্ভাষণেও প্যাঁচা মহাশয় বিরক্ত হননি, বরং গম্ভীর ভাবে, চিন্তান্বিত মুখে মাথা নাড়িয়েছেন। আর ওই চোখ টেপা! ও কি নেহাত প্রতিবর্ত ক্রিয়া, না কি কোনও গভীর ইঙ্গিত…

    প্যাঁচা মহাশয় ছিলেন আমারই মতন, একা। যতদূর বুঝি, শ্রীমতী প্যাঁচার কোনও অস্তিত্ব ছিল না, যেমন ছিলেন না শ্রীমতী বন্ড। কখনও-সখনও, বিশেষত গ্রীষ্মকালে, কোনও বন্ধু এসে উপস্থিত হতেন কটেজে, কিছুদিন থেকে যেতেন। কিন্তু বছরের অধিকাংশ সময়ই আমি একা কাটাতাম। শীতের নিঃসঙ্গ রাতে প্যাঁচার মৃদু ডাক যেন সান্ত্বনাবার্তা বয়ে আনত। যোগ্য সঙ্গী পেয়েছিলাম বটে– কোথাও কোনও হস্তক্ষেপ নেই, অথচ উপস্থিতি আছে। শেক্সপিরের কথায়, ‘Tu whit, tu whoo’.

    প্যাঁচা মহাশয় আমাকে ঠিক দেখেছিলেন। ‘সুপ্রভাত ধর্মাবতার’, আমি স্বর তুলে বলি। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি। তারপর, ঠিক আগের মতই, প্যাঁচা মহাশয় মাথা নাড়লেন, ধীরে-ধীরে। আর ডানা মেলে নিঃশব্দে উড়ে গেলেন, যেন উপত্যকা পেরিয়ে কুয়াশায় মিলিয়ে যাওয়ার জন্য।

    সময়ের সাথে-সাথে এই অবিবাহিত লেখকেরও একটি ছোট পরিবার গড়ে উঠেছিল, প্রধানত কটেজটিকে কেন্দ্র করে একটি পাহাড়ি পরিবার। ছোট্ট রাকেশ ও তার ভাই আর বোনেদের হাসিতে কটেজ হেসে উঠত, কখনও তাদের পাহাড় জুড়ে খেলায়, কখনও আখরোট বা বরই গাছ বাওয়ার খুনসুটিতে। বাচ্চাদের এই খেলাধুলায় যথেষ্ট শব্দ হত, কিন্তু তা যেন কখনই চিলেকোঠার ধর্মাবতারকে বিরক্ত করেনি।

    তারপর একদিন রাস্তা বানানোর মজুরেরা জঙ্গল সাফ করার নির্দেশাবলি নিয়ে হাজির হল। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ রাস্তা তৈরি হতে চলেছিল, বোধহয় স্বর্গপানেই। রাতারাতি, গাছগুলো হারিয়ে যেতে শুরু করল, ভীষণ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল পাহাড়, আমাদের কটেজের ছাদে ভেঙে পড়তে থাকল বোল্ডার।

    প্যাঁচা মহাশয় এত কিছু আর সহ্য করতে পারলেন না, ডানা মেলে উড়ে গেলেন পরের পাহাড়ে। পাখিদের জন্য পরের পাহাড় বিকল্প হিসাবে থেকেই যায়।  

    আমার পক্ষেও এত কিছু সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। একদিন সকালে দেখি বাগানে একটা বুলডোজার এসে দাঁড়িয়ে, আর আমাদের আখরোট গাছ, যে আমাদের এত বছর ধরে ভরে-ভরে ফল দিয়ে এসেছে, মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। কটেজটি যেন এক নিমেষে পাহাড়ের গায়ে উন্মুক্ত, অরক্ষিত, দুর্বল হয়ে উঠল।

    আমরা আর দাঁড়াইনি। অস্থির হয়ে স্থাবর-অস্থাবর গুছিয়ে সেইদিনই পালাই নতুন আস্তানায়, ল্যান্ডরে। সেই থেকে আমরা এখানেই আছি, এবং এর বেশি উচ্চতায় আর ওঠা সম্ভব নয়।

    তবে যেখানেই যাই, রাস্তা থেকে পালানো অসম্ভব। ল্যান্ডরে আমার জানলার ঠিক নীচেই একটি রাস্তা বেঁকে চলে যায়– যদিও প্যানডেমিকের জন্য তা এখন কিছুদিন একটু নিস্তরঙ্গ, একটু শান্ত। রাস্তায় এখন গাড়ি কম, মানুষজনের আনাগোনা কমে এসেছে। মুসৌরিকে হয়তো বসন্তকাল অবধি অপেক্ষা করতে হবে তার ব্যস্ত পর্যটক মেলাকে ফিরিয়ে আনতে, যেমন বুনো হাঁস ঠিক ফিরে আসে তাদের পছন্দের আস্তানায়।

    এই নৈঃশব্দ্যের অন্যদিকে এখন মুসৌরি জুড়ে পাখিদের সমাগম। পাখিরা যেন এই শান্ত পৃথিবীকে, এই একাকিত্বকে ভীষণভাবে উপভোগ করছে। তারা ভোরের প্রথম আলোয় আমার জানলায় আসে, আমি তাদের চিনি তাদের আলাদা আলাদা ডাকে।

    আজ সকালে জানলার বাইরে চোখ যেতেই দেখি, নীচে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টটিকে দিব্যি দাঁড় বানিয়ে বসে একটা বড় প্যাঁচা! আমার বন্ধু চিলেকোঠার ধর্মাবতার না কি? উনি কি আমার খোঁজ নিতে এসেছেন, দেখতে এসেছেন আমার এই বাড়ির চিলেকুঠুরিতে তাঁর বার্ধক্যের ঠাঁই হবে কি না?

    প্যাঁচা মহাশয় আমাকে ঠিক দেখেছিলেন। ‘সুপ্রভাত ধর্মাবতার’, আমি স্বর তুলে বলি। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি। তারপর, ঠিক আগের মতই, প্যাঁচা মহাশয় মাথা নাড়লেন, ধীরে-ধীরে। আর ডানা মেলে নিঃশব্দে উড়ে গেলেন, যেন উপত্যকা পেরিয়ে কুয়াশায় মিলিয়ে যাওয়ার জন্য।

    ‘যাত্রা শুভ হোক’, আমি আবার ডাকলাম, ‘যাত্রা শুভ হোক, বন্ধু!’পৃথিবীটা ভেঙে পড়ছে, কিন্তু আমরা, চিলেকোঠার ধর্মাবতার আর আমি, আমরা জীবন ভাল কাটিয়েছি। প্যাঁচা মহাশয় তাঁর বরাদ্দ ইঁদুর যথেচ্ছ ভক্ষণ করেছেন, আর আমি কোফতা কারি সহযোগে ভাত। বহু Friday The 13th এসেছে ও গেছে। হয়ত এখনও, জীবনের শেষ অঙ্কের পর্দা নেমে আসার আগে আমরা আরও কিছু শুক্রবার উপভোগ করে যাব। উল্লাস!

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook