ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ২৫


    বিমল মিত্র (August 13, 2021)
     

    পর্ব ২৪

    চব্বিশে জুন, ১৯৬২। আমি তেইশে জুন তারিখে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলাম না। তার আগের দিন শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। কেমন করে সেই অবস্থায় বোম্বাই যাব বুঝতে পারছি না। ডাক্তার দেখিয়েছি। লাল-লাল ওষুধের বড়ি দিয়েছে খেতে। সেই খেয়েই রাত্রে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঘুম আসেনি একতিলও। গুরুর মতো আমারও তো অনিদ্রার অসুখ। শেষ রাত্রের দিকে হঠাৎ বাড়ির সামনে মোটরের তীব্র হর্ন বেজে উঠল। বুঝলাম ভোর পাঁচটা বেজেছে কাতায়-কাঁটায়। গুরুর কলকাতার ডিস্ট্রিবিউটার সূর্য লাডিয়ার সঙ্গে সেইরকম কথাই ঠিক ছিল। গাড়ি এসে ঘুম ভাঙিয়ে আমাকে জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু তার আর দরকার হল না। আমি জেগেই ছিলুম, শুধু বাইরে এসে সারা দিলাম।

    তারপর শেষ রাত্রের সেই কলকাতা! রাস্তায় জল দেওয়া হচ্ছে। দেওয়ালে-দেওয়ালে হিন্দি ‘সাহেব বিবি গোলামে’র পোস্টার! বিরাট দেওয়াল জুড়ে বিরাজ করছে গুরু দত্তের ছবি।

    আমরা দুজনে গিয়ে দমদমে প্লেনে উঠলাম। বোম্বাই পৌঁছতে চার ঘন্টা লাগল। তখন ওই রাস্তায় ভাইকাউন্ট সার্ভিস। পালি হিল-এর বাড়িতে গিয়ে কি দেখব, তা নিয়ে মনের মধ্যে খুব অস্বস্তি ছিল।

    তিন মাস আগে যখন চলে এসেছি তখন গীতা বাড়িতে নেই। অসুস্থ হয়ে চলে গিয়েছে সান্তাক্রুজে। কিন্তু যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন দেখলাম সামনেই গীতা। সেই আগেকার হাসি মুখ। সেই আগেকার প্রসন্ন অভ্যর্থনা!

    গীতা জিজ্ঞেস করলে— কেমন আছেন বিমলদা?

    বললাম— আপনি কেমন আছেন? গুরু? গুরু কোথায়?

    গীতা বললে— ঘুমুচ্ছেন—

    নিজেরও শরীর খারাপ ছিল। আগের রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি। চোখ ঢুলে আসছে। শরীর ভেঙে পড়েছে। বললাম— আপনি ভালো আছেন তো?

    গীতা বরাবরই কম কথার মেয়ে। বুক ফেটে গেলেও নিজের দুঃখের কথা বলে অন্যকে ভারাক্রান্ত করবে না। বললে— ভালো আছি—

    আমি আর কথা না বাড়িয়ে নিজের সেই ঘরখানার মধ্যে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কমাস আগেই এই বাড়িটা ছেড়ে যেতে অনেক কষ্ট, অনেক দুঃখের স্মৃতি বুকে বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। সেদিন গুরুর গম্ভীর মুখ দেখে বিদায় নিয়েছিলাম। আজ হাসিমুখ দেখব বলেই আশা করে এসেছিলাম। কিন্তু ঘুমুচ্ছে শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। হয়তো কাল আমার মতোই সারারাত জেগে কাটিয়েছে। তারপর এখন একটু ঘুমিয়ে পড়েছে। জামাকাপড় বদলানো হয়নি। যেমন ভাবে গিয়েছিলাম, সেই অবস্থাতেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। মনে ভাবছি আজ রাত্রের মধ্যেই এদের এতদিনের পরিশ্রমের ফলাফল প্রমাণিত হয়ে যাবে। কেউ কলম দিয়ে লেখে, কেউ লেখে ক্যামেরা দিয়ে। আমার কলম দিয়ে লেখা গল্প পর্দার ওপর ছবি হয়ে বেরোবে, এ নিয়ে আমিই বা এত ভাবছি কেন? ছবি যদি খারাপই হয়, ছবি যদি না-ই বা চলে তো আমার কি? আমি-এ ছবির কে? আমি তো উপন্যাস লিখেই খালাস। আর তো কোনও দায়দায়িত্ব আমার নেই। ছবি ভালো হল কি না তা নিয়ে আমি ভাবতে যাব কেন? আমি তো সাহিত্যের জগতের মানুষ! ছবির সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক!

    আর কেউ তো কোনও লেখকের নাম এমন করে বিজ্ঞাপনে-বিজ্ঞাপনে ছড়িয়ে দেয়নি? বিশেষ করে হিন্দি ফিল্ম জগতে! সিনেমার ব্যাপারে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে এইটুকু বুঝে নিয়েছি যে গল্পকে তারা পণ্য হিসেবেই বিচার করেন। তোমার গল্প যদি আমার ভালো লাগে তাহলে সেই ভালো লাগার মূল্য শোধ করব পয়সা দিয়ে। কারণ সম্পর্কটা সেখানে প্রয়োজনের। কিন্তু প্রীতির মূল্য শোধ করব কি দিয়ে? সে ঋণ শোধ তো অনুরাগ ছাড়া হয় না।

    কিন্তু তবু মনে হল, আমাকে এত টাকা খরচ করে গুরু নিয়ে এলই বা কেন? এ-টাকাটা তো সে বাঁচাতেই পারত! যেমন সবাই বাঁচায়। কত লেখকের কত গল্পই তো সিনেমার ছবি হয়েছে। কত লাখ-লাখ, কোটি-কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কই, অমন করে তো কেউ এর আগে এমন খাতির করে আপ্যায়ন করে অভ্যর্থনা করে আনেনি কোনও গল্পলেখককে।

    আর কেউ তো কোনও লেখকের নাম এমন করে বিজ্ঞাপনে-বিজ্ঞাপনে ছড়িয়ে দেয়নি? বিশেষ করে হিন্দি ফিল্ম জগতে! সিনেমার ব্যাপারে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে এইটুকু বুঝে নিয়েছি যে গল্পকে তারা পণ্য হিসেবেই বিচার করেন। তোমার গল্প যদি আমার ভালো লাগে তাহলে সেই ভালো লাগার মূল্য শোধ করব পয়সা দিয়ে। কারণ সম্পর্কটা সেখানে প্রয়োজনের। কিন্তু প্রীতির মূল্য শোধ করব কি দিয়ে? সে ঋণ শোধ তো অনুরাগ ছাড়া হয় না।

    অনুরাগের কথাটা উঠতেই মনে পড়ে গেল গুরুর চরিত্রটা।

    যে কবছর ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম গুরুর সঙ্গে সে কবছরের সালতামামি করে দেখলে অনুরাগ ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ে না। নইলে কোথায় বোম্বাই আর কোথায় কলকাতা! মাঝখানে দুস্তর নদী-পর্বত-মেঘমালার ব্যবধানটাও যেন কয়েক বছরের মতো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। একে কি বৈষয়িক সম্পর্ক বলে? তাই যখন যেখানে থাকত তখন ট্রাঙ্ককল করে আমার খোঁজ নিত কেন?

    যা হোক, আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন সেই অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। মনে মনে সুখী হয়েছি, গীতা আবার তার নিজের বাড়িতে এসেছে। গীতার প্রসন্ন মুখ দেখেই আমি তা আন্দাজ করতে পেরেছি।

    ঘুম যখন ভাঙল, দেখি বেশ বেলা হয়ে গেছে। বিকেল একেবারে পাঁচটা। গুরুর বাগানে পালি হিলের মাথায় রোড পড়ে এসেছে।

    দেখি সামনেই গুরুর গৃহভৃত্য কৃষ্ণা! কৃষ্ণা বললে— সাহেব আপনার ঘরে এসেছিল। আপনি ঘুমোচ্ছেন দেখে সাহেব বেরিয়ে গেছেন। আপনাকেও যেতে বলে গেছেন
    সেখানে—

    — কখন?

    — রাত সাড়ে আটটার সময়ে। দিদিমণির সঙ্গে আপনি যাবেন, সবাই সেখানে থাকবে—

    কাল রাত্রে অসুস্থ শরীর নিয়ে কলকাতার ছেড়েছি। কিন্তু শরীরে তার কোনও গ্লানিই আর তখন নেই। আবার সেই পুরনো ঘরখানার বাইরে এসে ইজিচেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিলাম। তিন বছর আগে এই ঘরটাতে এসেই প্রথম উঠি। এইখানে বসেই গুরুর সঙ্গে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত গল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কত হাসি, কত কান্না, কত বিপর্যয় এখানে বসেই দেখেছি। সামনে দিয়ে সেই সব পুরনো দিনগুলোর কথা মিছিলের মতন ভেসে যাচ্ছিল।   

    এইখানে বসেই ‘কড়ি দিয়ে কিনলামে’র কত কিস্তি পাঠিয়েছি কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকার অফিসে। তারপর কত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে এই ঘরটাতে। এই ঘরটাতেই একদিন তন্দ্রা বর্মণ আর তার বাবা এসে উঠেছে। এই ঘরখানাতেই একদিন সতীশ ভাটনগর তার বিলিতি বউ আর ছেলেকে নিয়ে উঠেছিল। এই ঘরেই আবার তার স্ত্রীকে হারিয়েছিল। অনেক অনেক ইতিহাস আছে এই ঘরখানার।

    বাগানের ভেতরের এই ঘরখানাতে বসেই হেমন্ত মুখুজ্জ্যে ‘সাহেব বিবি গোলামে’র গানের সুর শুনিয়েছিল গুরুকে। এই ঘরখানার ভেতরেই ছবির জন্য শাড়ির পাহাড় তৈরি করেছে দোকানদারেরা। গুরু বেছে-বেছে শাড়ি কিনেছে নিজের পছন্দমতো। আবার এই ঘরখানার বিছানায় শুয়েই একদিন আত্মহত্যা করার জন্যে একসঙ্গে আটত্রিশটা ‘স্লিপিং পিল’ খেয়েছে। আসলে এ-ঘরখানার অনেক ইতিহাস আছে!

    আশ্চর্য, এ-ঘরখানাই আজ আর নেই। ১৯৬৩ সালের জুলাই মাসে যখন বোম্বাই গেলাম, তখন দেখলাম এ-বাড়ি গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে গেছে।

    গুরুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম— এমন চমৎকার বাড়ি ভাঙলেন কেন?

    গুরু হাসতে লাগল।

    এ-সব কথা পরে বলব। এখন ১৯৬২ সালের কথা আগে বলে নিতে হবে।    

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook