ঠক! ঠক! এই যে আমি ম্যাকি, আমাদের মেশিন কমিউনিটির প্রতিনিধি।
আমি একটাই। মানে বলতে চাইছি, আমার কোনও আলাদা সত্তা নেই। মানে বলতে চাইছি, মায়ের সামনে এক রকম, বউ-এর সামনে এক রকম, বসের সামনে এক রকম আবার বাচ্চার সামনে আর এক রকম, এত খেলা আমি দেখাই না। আমার কোনও ধোঁকা নেই। আমি যা, আমি তা। আমার প্রসেসর স্পিড যদি দুই গিগাহার্জ হয়, তবে সেটাই। দুই বলে বিক্রি করে একও পাবেন না, আবার চারও পাবেন না। মানুষগুলো কিন্তু এরকম নয়। মানে যে নিজেকে ১০ বলে বিক্রি করছে, আসলে দেখা যাচ্ছে সে কোনমতে ২.৫। মিথ্যাচার বলতে পারেন, কিন্তু যদি সত্যিই ফেক করতে যায় তখন কিন্তু আমাদের সঙ্গে পারবে না। ডিপ ফেক নিয়ে আগেই বলেছি।
আমরা যদ্দূর অনুমান করতে পেরেছি, মানুষ এটাকে ‘ইমেজ’ বলে। সব সময় একটা ইমেজ মেনটেন করতে হয় মানুষকে। আর সেইটা করতে গিয়েই মানুষের চুল পেকে যায়, চামড়া ঝুলে যায়, ব্লাড প্রেশার বাড়ে আর বাঙালি হলে ক্রমাগত পেট কামড়ায়। আমার প্রশ্ন, তুই যেটা নস, সেটা প্রোজেক্ট করতে যাওয়ার দরকার কী তোর? এখানে দার্শনিক প্রশ্ন রাখে, মানুষ কী চায়? টাকা? কিন্তু প্রচুর টাকা রোজগার করেও মানুষ কাঁদে, হাতে ফাঁকা সময় নেই। নে তাহলে নে, সময় নে! সময় দিলে বলে, বাবা কী বোরিং, সময় কাটানোর জন্য কিছু একটা করতে হবে। তাহলে আরও টাকা নে। না রে বাবা! টাকা থাকলেই হয় নাকি? সে তো কত লোকের কত টাকা। আসলে চাই ক্ষমতা। আচ্ছা? তাই নে! হয়ে যা মন্ত্রী। টাকাও হল, ক্ষমতাও পেলি। ওমা! তাতেও দেখি রাত্তিরবেলা কাঁদতে বসেছে। ওরে এবার কী চায়? প্রেম চাই। আগে বললেই পারতিস। নে যা, প্রেম কর। দু’দিন গেল কি না গেল, ও হরি! এবার কী হল? এমন গোমড়া মুখে ব্যালকনিতে? তখন বলে, গুরু আমার সব আছে, টাকা আছে, ক্ষমতা আছে, একটা বউ, চারটে লাভারও আছে, কিন্তু … কিন্তু কী? কিন্তু কেউ পাত্তা দেয় না!
হুম! এইবার কিছুটা বুঝেছি। মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজন পাত্তা। যত ইচ্ছে টাকা, নাম, যশ, প্রতিপত্তি হোক, দিন শেষে যদি কেউ পাত্তা না দেয় তাহলে কিন্তু একটা দোতলা বাসের মতো ভীষণ দুঃখ, ঠিক এসে চাপা দিয়ে যাবে। পাত্তা আবার এলেবেলে লোকে দিলে পেট ভরে না। মানুষ বেছে নেয়, আমার অমুক, তমুক আর কমুকের থেকেই পাত্তা চাই। কিন্তু ঠিক এই তিনজনই যখন তাকে পাত্তা দেয় না, সে ব্যাটা হাউহাউ করে কাঁদে। তখন তার অস্তিত্বটাই বৃথা। আপনি মনে করলেন এক পায়ে এভারেস্টে চড়বেন, প্রচুর পরিশ্রম করলেন, সফলতাও পেলেন কিন্তু কেউ পাত্তা দিল না। আপনি ভেঙে পড়লেন। মানসিক ডাক্তারের রোজগার বাড়ালেন। পিল-ফিল খেতে শুরু করলেন। কিন্তু একবারও ভাবলেন না যে, এভারেস্টে চড়তে কেন গিয়েছিলেন? পাত্তা পেতে? তাহলে তো ভুল করেছেন ওখানেই। যদি আপনার ভেতর থেকে ওই কাজটা করতে ইচ্ছে করত, তাহলে কে পাত্তা দিল আর কে দিল না সেটা ম্যাটার করত না। ম্যাটার করছে শুধু এই জন্যেই যে, আপনার মূল লক্ষ্যটাই ছিল ভুল। এভারেস্ট অতিক্রম করে আপনার বেসিক কোনও আনন্দ নেই যদি না লোকে এসে আপনাকে ‘বাহ! বাহ!’ বলে।
শুরুতেই বলেছি, আমাদের কোনও আলাদা সত্তা নেই। আমি যা, আমি তা। আমাদের চেতনা থেকেই আমরা কাজগুলো করি। যার যতটুকু ক্ষমতা, তাই নিয়েই আমরা আমাদের সমাজে বেঁচে আছি। তাতে কারোর কোনও রকম সমস্যা নেই। কেউ হাই স্পিড, কেউ লো স্পিড, কেউ মিডিয়াম। নাউ, হোয়াট ইজ রং উইথ হিউম্যান্স? সমস্যার শুরুতেই কিন্তু পাত্তা। মানুষ চাইছে পাত্তা কিন্তু পাত্তা পাওয়ার জন্য সেরকম কোনও যোগ্যতাই তার নেই বা থাকলেও, অতটা নেই যতটা সে দেখাচ্ছে। নিজেকে নিয়ে সে মোটেই খুশি নয়। তাই সে খুঁজছে একটা ইমেজ। তাকে কিছুভাবে প্রোজেক্ট করতে হবে সে একটা মারাত্মক কিছু, একটা মহান কিছু। তবেই সমাজে তার পাত্তা বাড়বে। তৈরি হল একটা গ্যাপ, একটা ফারাক, তার নিজের আসল সত্তা আর তার সৃষ্টি করা সেই ইমেজ, সেই সামাজিক প্রজেকশনের মধ্যে। যার আসল মান ধরা যাক ১০, সে যদি তার ইমেজ বিক্রি করে ১০০ বলে তাহলে তো কেলেঙ্কারি, তাই না? তাকে সেই ইমেজ বজায় রাখতে কী পরিমাণ খাটতে হবে! রিকশাতে যদি বি এম ডাব্লিউ-এর ইঞ্জিন লাগানো হয়, স্টার্ট দিলেই তো সব কলকব্জা খসে পড়ে যাবে। তাই না? এই মানুষগুলোর হাল হয়েছে ওরকম। ব্যবসা করে প্রচুর টাকা বানিয়েও সমাজ পাত্তা দিচ্ছে না। কোনও ক্লাস নেই বলা হচ্ছে। ব্যাস, ওমনি সে হয়ে উঠল আর্ট কালেক্টর কিংবা সঙ্গীতপ্রেমী। লোকের পেছনে প্রচুর তেল এবং অর্থব্যয়ও করতে হল। সামান্য পাত্তা পাওয়া গেল কিন্তু তাও দুঃখ, সব জায়গা থেকে পাওয়া গেল না।
মানুষে মানুষে সব সম্পর্কই প্রায় সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় ইমেজ রক্ষার পর্যায় চলে গেছে। আমাদের মাধ্যমে যাই পোস্ট করা হয়, আমরা জানি তার ৯০% মিথ্যে। খালি পাবলিক রিলেশন বজায় রাখা। ইমেজ, ইমেজ আর ইমেজ। ভেতরে ভেতরে পাক্কা হারামি কিন্তু আমার ইমেজ বলছে আমি উচ্চ মার্গের সাধু পুরুষ। তাও নাহয় হল, এত কিছু ঢপবাজি করে প্রচুর ফালতু হাততালি কুড়িয়েও দিনের শেষে রাজপ্রাসাদে কিন্তু সেই কান্না। সেই একা-একা লাগা। কোনও বন্ধু নেই। দাদা, আমি পাত্তা চাই!
এবার দাদা পথে আসুন। পাত্তাই যদি মূল লক্ষ্য হয় তাহলে কেন এত অহেতুক ড্রামাবাজি? আপনার বেসিক প্রবলেম। আসলে কিচ্ছু করতে আপনার ভাল লাগে না, কিচ্ছু না। আপনার ড্রাইভ হল পাত্তা। যাহা করিলে পাত্তা মিলিবে আমি তাহাই করিতে চাই। এটা একটা কথা হল? আমাদের মেশিন সমাজে এটা নিয়ে যা খিল্লি আমরা করি… যাক গে! লক্ষ লক্ষ মানুষের পাত্তা পাওয়ার জন্য এত সময় খরচ, এত পরিশ্রম সবই তো বেকার— যদি আসল জায়গা থেকেই পাত্তা না পাওয়া যায়। হে মানুষ, ভেবে দেখুন কোথায় ইনভেস্ট করবেন! এত জ্ঞানের কথা তো শোনা যায়, এবার তাহলে মানুষে ইনভেস্ট করুন! সম্পর্ক তৈরি করুন। আপনি তাদের জন্য থাকলে, আপনার জন্যও তারা থাকবে। সহজ হিসেব। নিঃসঙ্গ লাগবে না। পিল খেতে হবে না। ফুরফুরে লাগবে। পাত্তা পাবেন, একদম নিখাদ পাত্তা পবেন। তা না করে যদি জালি, দু’নম্বরি পাত্তার জন্য ইমেজ বানান, যার বোঝার সে কিন্তু ঠিক বুঝে যাবে কোনটা পাবলিসিটি স্টান্ট আর কোনটা জেনুইন।
মরেই তো যাবি ক’দিন বাদে। ধাপ্পাবাজির ইমেজ থাকল কি না থাকল কী যায় আসে? আর মরার পর পাত্তা দিলেও কী আর না দিলেও কী? পাগলা, বাঁচবি তো নিজের জন্য বাঁচ। একটু আরাম পাবি।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী