ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • খাঁচার ময়না


    দীপান্বিতা রায় (July 31, 2021)
     

    ময়না, ও ময়না, হলনি এখনও তোর…’ বাইরে থেকে ললিতার খ্যানখেনে গলার ডাকটা শুনে দ্রুত হাতে কাপড়টা পরতে পরতেই গলা তুলল ময়না, ‘যাই গো দিদি, হয়ে গেছে…’

    একটা ছোট বস্তায় পটলগুলো ভরে রেখেছে রমেশ। আর একটাতে লাউ আর পেঁপে। কাঁচালঙ্কাগুলো ডালায় মেলে রেখেছিল শাশুড়ি। রাতে বস্তায় ভরে দিলে পচ ধরে যায়। গায়ে কালো দাগ লাগলে নিতে চায় না খরিদ্দার। সকালে উঠে সেগুলো একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে নিয়েছে ময়না। চুলে চিরুনি দেওয়ার সময় নেই আর। কোনওরকমে একটা হাতখোঁপায় জড়িয়ে নিয়ে, টাকার ছোট ব্যাগটা ব্লাউজের মধ্যে গুঁজে নিল ময়না। একটা প্লাস্টিকে লালফুল-ছাপ শাড়ি, লাল ব্লাউজ আর দাঁতভাঙা চিরুনিটা ঢুকিয়ে নিয়ে দৌড়ে বেরোল। ললিতার সঙ্গে হাতে-হাতে বস্তাগুলো তুলল ভ্যান রিকশায়। তারপর দুজনে মিলে উঠে বসতেই ভ্যান ছেড়ে দিল পতিত। 

    ‘লাউয়ের ডগাগুলো পারলে কেটে রেখো গো। আর শোনো, ছেলের টিপিনের জন্য একখান কেক কিনে এনেছিলাম কাল… মিটসেফের ওপর রাখা আছে…’

    বলতেই বলতেই ভ্যানটা এগিয়ে গেছে বেশ খানিকটা। শেষের কথাগুলো রমেশ শুনতে পেল কি না, ঠিক বুঝতে পারল না ময়না। শাশুড়িকে বলে আসলেই ভাল হত। কিন্তু শাশুড়ি সকালে উঠেই পুকুরঘাটে গেছে বাসনের পাঁজা নিয়ে। আর ছেলে তো এখনও ঘুমে কাদা। অগত্যা রমেশ। সে আবার এসব ব্যাপারে আনাড়ি। নিজের খেয়ালেই থাকে। দোষ দেয় না ময়না। পুরুষমানুষের অত সংসারের খুঁটিনাটি মনে থাকে নাকি! তবে মনটা খুঁতখুঁত করছে। ছেলেটা কেক খেতে ভালবাসে বলে কাল শখ করে কিনে এনেছিল। মুখ দেখে ময়নার মনের কথা ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে ললিতা। সে হেসে বলল, ‘অত মাতা ঘামসনি বাপু। যার ছ্যালে সে ঠিক বুঝে নেবে… নে পান খা এট্টা…’

    ললিতাদির পানের নেশা। কোমরের আঁচলে সর্বদা পানের পাতা, চুন, খয়েরের ডিবে মজুত। গালের মধ্যেও ঠোসা থাকে একখানা। অবরে-সবরে ময়নাও যে খায় না তা নয়। তবে এখন খালি পেটে ইচ্ছে করল না। ললিতাদিও আর চাপাচাপি না করে সবজির বস্তায় হেলান দিয়ে বসল। এখনও সূয্যি ওঠেনি ভাল করে। ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়ায় গা জুড়িয়ে ঢুল আসছে ময়নারও। ক’দিন ধরে বড্ড গরম পড়েছে। তাদের অ্যাসবেস্টাস চালের ঘর যেন তেতে আগুন হয়ে থাকে। ছেলেটার গা-ময় ঘামাচি বেরিয়েছে। 

    ভাবতে ভাবতেই নিজের শাড়ির আঁচলটা একটু ঠিকঠাক করে জড়িয়ে নিল ময়না। ব্লাউজটার বগলের নীচে সেলাই খুলে এসেছে। ভেবেছিল রাতে দুটো ফোঁড় দিয়ে নেবে, কিন্তু সে-কথা আর মনেই নেই। সকালে জামা পরার সময় মনে পড়েছিল, কিন্তু তখন আর সেলাইয়ের সময় নেই। আসলে বছরের তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই এমন রাত থাকতে উঠে বেরোতে হয় ময়নাকে, কিন্তু তবু এখনও যেন অভ্যাস হয়নি। রোজই ইচ্ছে হয় আরও পাঁচটা মিনিট বেশি ঘুমিয়ে নিতে। তাও তো এখন গ্রীষ্মকাল। চারটের সময় ময়না যখন ওঠে, তখন চারধার ফর্সা হয়ে আসছে। এদিক-ওদিক দু’একটা পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু শীতকালে তো ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। কুপি জ্বালিয়ে তৈরি হতে হয়। ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে ভ্যান রিকশাখানা যখন আসে, তখন ভয়-ভয় লাগে। চারিদিক শুনশান। রাস্তায় একখানা কুকুর পর্যন্ত নেই। আর তারা দুটো মেয়েছেলে চলেছে ভ্যানে চেপে। শীতও লাগে খুব। একখানা মোটা ফুলহাতা উলের ব্লাউজের ওপর চাদর জড়িয়েও শীত মানে না। হাতে-পায়ে যেন খিল ধরে যায়।

    অথচ উপায়ও তো নেই। ময়নাদের এই গ্রাম লক্ষ্মীনারায়ণপুর থেকে ভ্যানে চেপে বড় রাস্তায় উঠতে সময় লাগে প্রায় আধঘণ্টা। মোড়ের মাথায় মুসুর মিঞা দাঁড়িয়ে থাকে ছোটা হাতি নিয়ে। সবার সবজির বস্তা, ঝুড়ি ওঠে তাতে। মাল তুলতে তুলতে পাশের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা চা আর দুটো করে লেড়ো বিস্কুটও খেয়ে নেয় সবাই। তারপর গাড়ি ছাড়ে মুসুর মিঞা। বাঘাযতীন বাজারের রাস্তায় সবজি নিয়ে বসে ময়নারা। ঘুটিয়ারি শরিফ থেকে সেখানে পৌঁছতে একঘণ্টা পুরো লাগে। ছ’টার মধ্যে না পৌঁছলে চলে না। জিনিস নামিয়ে, প্লাস্টিক পেতে গুছিয়ে বসতে-বসতে তো আরও আধঘণ্টা। সাড়ে ছ’টা থেকে লোকের আসা-যাওয়া শুরু হয়ে যায়। তাই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা যাই-ই হোক না কেন, ময়নাকে সেই ভোর চারটেয় উঠে ভ্যান রিকশায় পা ঝুলিয়ে বসতে হয়।

    ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে ভ্যান রিকশাখানা যখন আসে, তখন ভয়-ভয় লাগে। চারিদিক শুনশান। রাস্তায় একখানা কুকুর পর্যন্ত নেই। আর তারা দুটো মেয়েছেলে চলেছে ভ্যানে চেপে। শীতও লাগে খুব। একখানা মোটা ফুলহাতা উলের ব্লাউজের ওপর চাদর জড়িয়েও শীত মানে না। হাতে-পায়ে যেন খিল ধরে যায়। 

    মুসুর মিঞার ছোটা হাতিতে অবশ্য শুধু মাল যায় না। তারাও ওঠে গাদাগাদি করে। ভিতরের দিকে ঠেসে-গুঁজে ঢুকতে পারো। আর নাহলে পিছনের খুলে দেওয়া পাটাতনের ওপর পা ঝুলিয়ে রড ধরে বোসো। প্রথম-প্রথম ভয় লাগত ময়নার। এখন আর লাগে না। বরং এক-একদিন ঝুড়িতে হেলান দিয়ে একঘুম ঘুমিয়েও নেয়। তবে মদন পিছনে উঠলে আগে চোখ বুজত না ময়না। বড্ড মেয়েদের গা ঘেঁষা স্বভাব লোকটার। দ্যাখো না দ্যাখো গায়ে গা ঠেকিয়ে বসল। ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দিতে ইচ্ছে করে এক-একদিন। কিন্তু লোকটার ক্ষমতা আছে। পিছনে লাগলে অসুবিধায় পড়তে হবে। তাই চুপ করে থাকে। অবশ্য এটাও ঠিক, প্রথম-প্রথম মদন এরকমটা করে যখন দাঁত বের করে হাসত, গা জ্বলে যেত ময়নার। এখন অনেকটাই অভ্যাস হয়ে গেছে। 

    আসলে ময়না তো আগে কখনও ভাবেনি যে, তাকে এভাবে সবজির বস্তা নিয়ে বাজারের রাস্তায় এসে বসতে হবে। তাই প্রথম-প্রথম একটু অসুবিধাই হত। গরীবের ঘরের মেয়ে। খাটাখাটনি অভ্যাস আছে ছোটবেলা থেকেই। পাঁচ কেলাসের পর আর ইস্কুলে যাওয়া হয়নি। বাড়িতে থেকে মায়ের হাতে হাতে কাজ করেছে। এন্ডি-গেন্ডি ভাইবোনগুলোও ছিল ওরই ঘাড়ে। বাবা ভাগচাষি। চাষের সময় সারাটা দিনই মাঠে পড়ে থাকে। শুধু তো আর বছরে একবার ধান বোনা নয়, একটা ফসল উঠতে না উঠতে আর একটার তোড়জোড় শুরু করে দিতে হয়। তারপর আগাছা নিড়ানো, পোকা মারা ওষুধ দেওয়া, গোড়ায় জল জমলে নালা কেটে বার করা, কাজের কোনও শেষ আছে নাকি! মুনিশ রাখার সামর্থ্য তো আর নেই, তাই নিজেরাই গায়ে-গতরে খেটে যতটুকু পারা যায়! মাও মাঠে খাটত বাবার সঙ্গে। তারপরেও ধানসেদ্ধ, ঘর নিকানো, কাপড়-চোপড় কাচাকুচি এসবও তো আছে। ময়না একটু বড় হওয়ার পর রান্নাটা তার ঘাড়েই চেপেছিল। কাঠের জ্বালে রান্না। কালিপড়া মস্ত ভাতের হাঁড়িখানা উপুড় দিতে প্রথম-প্রথম ভয় লাগত, তারপর অভ্যাস হয়ে গেল। 

    রমেশের সঙ্গে যখন বিয়ে হল, ময়না তখন সবে আঠারো পেরিয়েছে। রং ময়লা হলেও, গড়ন-পেটন তার চিরকালই ভাল। অভাবের সংসারে বড় হয়েও খেতে না পাওয়া সিঁটকেপানা চেহারা নয়। বুক-পাছা দিব্যি ভরন্ত। রাস্তায় যেতে-আসতে পাড়ার ছেলেদের যে চোখ টানে, বুঝতে পারত ময়না। তবে রমেশকে তার পছন্দ হয়েছিল। শক্ত চেহারা, একমাথা চুল, দাঁতগুলিও বেশ ঝকঝকে। তাছাড়া বাড়িতে দেওর-ননদ কেউ নেই, মা-ছেলের সংসার জেনে অনেকটা আশ্বস্তও হয়েছিল। খাটনি অবশ্য এই সংসারেও কিছু কম নয়। বিঘে দুয়েক জমি আছে রমেশের। ভাগে নয়, নিজের। তাতে সম্বচ্ছরই ধান থেকে শুরু করে ডাল-সবজি সবরকমের চাষ হয়। সেই সবজি ভোরবেলা ভ্যান রিকশায় চাপিয়ে বাঘাযতীন বাজারে নিয়ে যেত ময়নার শাশুড়ি। দুপুরে ফিরে মাঠের কাজে লাগত। শাশুড়িও চাষের কাজ জানে ভালই। ময়নার আসার পর সংসারে সুবিধা হয়েছিল খুব। সকালে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সংসারের সব কাজ সামলাত ময়নাই। শাশুড়িকে আর কিছুটি দেখতে হত না।এমনকী বাক্সে করে একগোছা রুটি-তরকারিও ময়না গুছিয়ে দিত জলখাবারের জন্য। রমেশ চিরকালই পান্তা খেয়ে মাঠে যায়। তবে আগে নিজেকে বেড়ে খেতে হত। বিয়ের পর ময়না সকাল-সকাল কাঁচা লঙ্কা-পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা বেড়ে দিত বরের জন্য। দুজন বেরিয়ে গেলে, উঠোন নিকিয়ে, বাসন ধুয়ে রান্না বসাত।

    সংসার চলছিল গড়গড়িয়ে। দু’বছর পর যখন ছেলে হল, তখনও কোনও অসুবিধা হয়নি। ময়না তো আর বাবুঘরের মেয়ে নয় যে, পেটে বাচ্চা এসেছে বলে সংসারের কাজ বন্ধ দেবে! ছেলেকে মাই দিতে দিতেও খুন্তি নেড়েছে কড়ায়। ছেলে যখন পাঁচ বছরের, তখন আর একবার পেটে বাচ্চা এসেছিল। কিন্তু নষ্ট হয়ে গেল। এখন মাঝে মাঝে ময়নার মনে হয়, ভগবান যা করেন বোধহয় মঙ্গলের জন্যই। ঘরে ছোট বাচ্চা থাকলে কি আর ময়না এরকম ভাবে বাইরে কাজে বেরোতে পারত? তার বছরখানেক পরেই তো দুর্ঘটনাটা ঘটল। বর্ষার দিন ছিল। মাঠ থেকে কাজ সেরে ফেরার সময় বেকায়দায় গর্তে পড়ে পা ভাঙল রমেশের। এখানকার হেল্‌থ সেন্টার থেকে পাঠিয়ে দিল কলকাতার বড় হাসপাতালে। অপারেশনও হল। কিন্তু সারল না রমেশ। ডান পা-টা মুড়তে পারে না। কমজোরিও হয়ে গেছে। বিপদের ওপর বিপদ। সন্ধেরাতে হঠাৎ মাথা ঘুরে গেল শাশুড়ির। ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়ে সারল ঠিকই, কিন্তু ভারী জিনিস তোলা বারণ হল। একবছরের মধ্যে ময়নার সংসারের গড়গড়িয়ে চলা চাকাটা কেমন যেন উল্টো দিকে ঘুরতে লাগল। বাড়ির মধ্যে একমাত্র সক্ষম মানুষ সে নিজে। তাই সব কাজের দায় এবার তার কাঁধে। প্রথমটায় বাঘাতীন বাজারে সবজি নিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রামেরই নিতাই মণ্ডলকে ঠিক করেছিল রমেশ। কিন্তু নিতাই এমন টাকা মারতে লাগল যে, ঢাকের দায়ে মনসা বিকোনোর জোগাড়। সবজির বস্তা নিয়ে ময়নাকেই তাই উঠতে হল ভ্যান রিকশায়। ঘরের কাজ শাশুড়ি সামলায়। বিক্রিবাট্টা সেরে ফিরে মাঠের কাজে লাগে ময়না। রমেশ সঙ্গে থাকে। কিন্তু সে আর কতটুকুই বা পারে! এদিকে চাষের কাজে ময়না তেমন পোক্তও নয়। অথচ রোগ-ভোগ, ওষুধের খরচ সামলে একটা মুনিশ যে রাখবে তারও সাধ্যি নেই। সবজি উঠছিল আগের থেকে অর্ধেক। তিনটে মানুষের পেট চালানো দুষ্কর। আধপেটা খেয়ে কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে যাচ্ছিল ময়নার। ছেলেটার সব ক’টা পাঁজরা গোনা যায়। দেখলে চোখে জল আসে। ঘরে বসে থেকে থেকে খিটখিটে হয়ে গেছে রমেশ। সব মিলিয়ে এক-এক সময় যেন পাগল-পাগল লাগত ময়নার। সে-সময়ই একদিন রাস্তা দেখাল গৌড়দহের মালতী। ময়নার মতো সেও বাঘাযতীন বাজারে সবজি নিয়ে বসে। রঙিন ছাপা শাড়ি আঁট করে পরা। তেল চপচপ চুলে টেনে একখানা খোঁপা বাঁধা। খরিদ্দারের সঙ্গে এমন গা ঢলিয়ে হেসে কথা বলে যে, পাঁচ টাকা বেশি দামে তার তুঁতেমাখানো পটলও বিক্রি হয় হু হু করে। সেই মালতী একদিন সকালে চা খেতে খেতে ময়নাকে বলল, ‘এসেছিলি যখন তখন তো দিব্যি চ্যায়রাখানা ছিল। একন দিনে দিনে এমন প্যাঁকাটি মেরে যাচ্ছিস কেন?’

    ‘কী করব দিদি! বরটা পায়ে চোট পেয়ে বসে গেল। শাশুড়িও কমজোরি হয়ে গেছে। একার ঘাড়ে সংসার। রোজগার নেই। এই সবজি বিক্রির ক’টা টাকায় সংসার চলে…’

    ‘তা রোজগার বাড়া না বাপু। না খেয়ে মরলে কি সংসারের কোনও সুসার হবে?’

    ‘কী করে রোজগার বাড়াব গো? পুরুষমানুষ যা পারে, তা কি আর আমি পারি! আমার একার সাধ্যি কী অতখানি জমিতে চাষ দিই!’

    ‘মেয়েমানুষ যা পারে সেটাই কর…’

    কথগুলো বলেই গলা নামিয়ে মালতী বলেছিল, ‘রাজি থাকিস তো বল, কথা বলি। যেদিন যেদিন খদ্দের থাকবে, ফেরার পথে এক-আধঘণ্টা দেরি হবে। দূরে যেতে হবে না। এই বাঘাযতীন স্টেশনের পাশেই ব্যবস্থা আছে। হাতে-হাতে টাকা।’

    অতিরিক্ত পরিশ্রম আর আধপেটা খেয়ে তারও তো শরীর ভাঙছে। আর সতীপনা ধুয়ে যে জল খাবে, তারও উপায় আছে নাকি? ভোরবেলা ছোটা হাতিতে যাওয়ার সময় মদন তো আজকাল বেশিরভাগ দিনই তার গা ঘেঁষে বসে। ঘুমের ভান করে খোলা কোমরে হাত রাখে। আড়তদার ভানুবাবু সবজি দেখার নাম করে বুক ছুঁয়ে দেয়। ময়না কি কিছু বলতে পারে? মুখ বুজে তো সইতেই হয় সব। 

    কথাগুলো শুনেই বুকের ভিতরটা শিরশির করে উঠেছিল ময়নার। গেরস্তঘরের বউ। এসব শোনাও তো পাপ। কিন্তু খিদের জ্বালায় ছেলের শুকিয়ে যাওয়া মুখটা মনে পড়ায় মুখের ওপর না বলতে পারেনি। 

    ‘একনই কিছু বলতে হবেনি বাপু। তুমি ভেবে-চিন্তে দ্যাকো…’ কথাগুলো বলে নিজের খদ্দের সামলাতে মন দিয়েছিল মালতী। 

    সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত নিজের বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সত্যিই কথাগুলো ভেবে দেখেছিল মালতী। রমেশ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আগের মতো কাজকর্ম করতে পারবে তেমন কোনও আশা নেই। শাশুড়ির বয়স দিনে দিনে বাড়ছে। ওদিকে ছেলেটা বড় হচ্ছে। বাড়ন্ত ছেলে, সারাক্ষণ খাই খাই করে। ইস্কুলে দিয়েছে। জামা-জুতো লাগে। দু’দিন বাদে মাস্টার রাখতে হবে। কোথায় পাবে ময়না? অতিরিক্ত পরিশ্রম আর আধপেটা খেয়ে তারও তো শরীর ভাঙছে। আর সতীপনা ধুয়ে যে জল খাবে, তারও উপায় আছে নাকি? ভোরবেলা ছোটা হাতিতে যাওয়ার সময় মদন তো আজকাল বেশিরভাগ দিনই তার গা ঘেঁষে বসে। ঘুমের ভান করে খোলা কোমরে হাত রাখে। আড়তদার ভানুবাবু সবজি দেখার নাম করে বুক ছুঁয়ে দেয়। ময়না কি কিছু বলতে পারে? মুখ বুজে তো সইতেই হয় সব। তাহলে আর এত ছোঁয়াছুঁয়ি বাতিক রেখে লাভ কী? আগের থেকে অনেকটা ভেঙে গেলেও এখনও ময়নাকে দেখে পুরুষের চোখ টানে। শরীর ছাড়া আর কিছু যখন নেই, তখন সেটাকেই নাড়াঘাঁটা করতে দিয়ে যদি কিছু পয়সা ঘরে আসে, তাহলে তো অন্তত সংসারটা বাঁচে। সারাদিন খাটনির পর একঘটি জল গলায় ঢেলে শুতে যেতে হয় না বুড়ো মানুষটাকে। 

    প্রথমদিন মালতীই নিয়ে গেছিল সঙ্গে করে। স্টেশনের ওপারে একটা গলির ভিতর দিয়ে কিছুটা গেলে একটা আধা-বস্তি এলাকা। তারই একপাশে পর পর গোটা তিনেক বেড়ার ঘর। ভিতরে একটা চৌকির ওপর তেলচিটে তোশক আর চাদর পাতা। মোটামতো একজন মহিলা, যাকে মালতী ক্ষুদিদিদি বলে ডাকছিল, সে-ই কথাবার্তা বলল। 

    ‘দ্যাকো বাপু, তোমাদের মতো গেরস্তঘরের বউ-ঝিদের নিয়ে বড় জ্বালা। সারাক্ষণই লুকোছাপি করে চলতে হয়। যাই হোক, মালতী আমাকে সব কতা বলেছে। একানে এলে কাকপক্ষীটিও টের পাবে না। এ পাড়ার মস্তান-গুন্ডা ক্ষুদিদি বলতে অজ্ঞান। সময়মতো পেন্নামী দিতে কখনও ভুল হয় না কিনা… যাক গে শোনো, কাজের কতা বলি। খদ্দের অমন হুট বলতে এখানে আসে না। আমাকে আগে খপর দেয়। আমিও তোমাকে খপর দেব। মোবাইল তো নেই শুনলাম। মালতীকে ফোন করে দেব আগেরদিন। তুমি একখানা পরিষ্কার কাপড় আর বেলাউজ সঙ্গে আনবে। আমার এখানে চ্যান করার ব্যবস্থা আছে। চ্যান করে, পোষ্কের কাপড় পরে খদ্দের নেবে। তারপর কাজকম্ম সেরে নিজের কাপড় পরে চলে যাবে। নতুন মেয়ের বাজার ভাল থাকে। তিনশো টাকা রেট। তার থেকে পঞ্চাশ টাকা আমাকে দেবে। ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা কোরোনি, বিপদে পড়বে। আর শোনো, আগে টাকা নিয়ে তারপর খদ্দের বিছনায় তুলবে… নইলে ব্যাটাছেলেরা ফাঁকি দিয়ে পালানোর ধান্দা করে।’ 

    ক্ষুদিদির কথা শুনে কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল ময়নার। প্রথমদিন ভয়ও লাগছিল খুব। বুক কাঁপছিল। হাত-পাও যেন ঠিক বশে ছিল না। বাড়িতে বলেছিল ফেরার সময় বাপের বাড়ি হয়ে আসবে। তাই কেউ কিছু বলেনি। শুধু বাড়ি ফিরে সবুজ নাইলনের শাড়িটা যখন কেচে দিল, তখন শাশুড়ি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘শাড়িটা তো ময়লা হয়নি রে বউ। কাচলি কেন?’

    গুমসানি গন্ধ বেরোচ্ছিল বলে এড়িয়ে গেছিল ময়না। আসলে যে-শাড়ি পরে খদ্দেরের সঙ্গে বিছানায় উঠেছে, সেটা আবার তোরঙ্গে তুলে রাখতে গা ঘিনঘিন করছিল তার। অবশ্য আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেল সবই। সপ্তাহে দু থেকে তিনদিন আর মুসুর মিঞার গাড়িতে ফেরে না ময়না। মান্থলি কেটে রেখেছে। ঘণ্টা দুয়েক পরে ট্রেনে ফিরে আসে। বাড়িতে বলা আছে, বাঘাযতীনের বাজার উঠে গেলে ভিতর দিকের ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে ঝুড়িতে করে সবজি নিয়ে যায়। রোজগার এক লাফে অনেকটাই বেড়ে গেছে। দু’বেলা ভাতের সঙ্গে আজকাল মাছ কিংবা ডিমও হয় মাঝে মাঝে। ছেলের জন্য দুধের প্যাকেট কিনে আনে ময়না। রমেশ আর তার মা দুজনেরই শরীর সেরেছে। গায়ে মাংস লেগেছে ময়নারও। আঁটোসাঁটো চেহারাখানা দেখে লোভে চোখ চকচক করে খদ্দেরদের। তাই খাতির বেড়েছে ক্ষুদিদির কাছে। খাতির বেড়েছে সংসারেও। আজকাল শাশুড়ি নিজে ভাত বেড়ে দেয় ময়নাকে। সন্ধের পর রমেশ বউয়ের পাশটিতে বসে গল্পগাছা করে। 

    সব ঠিক আছে, তবু খটকা লাগে ময়নার। বাপ বেঁচে থাকতে বাজারে সবজি বেচতে যেত রমেশ নিজে। তারপর কাজটা শাশুড়ি করলেও তাকেও মাঝেসাঝেই যেতে হত মহাজন আর আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলতে। বাজারের আটঘাট তাই রমেশ খুব ভালমতোই জানে। সে কি বুঝতে পারে না যে, ফ্ল্যাটবাড়িতে ঝুড়ি করে সবজি বেচে এত রোজগার হওয়া সম্ভব নয়? রমেশ কি বুঝেও না বোঝার ভান করে? কিন্তু বুঝলে কি আর এ বাড়িতে পা রাখতে দিত ময়নাকে? ললিতা হয়তো কিছু কিছু আন্দাজ করে। কিন্তু সে কিছু বলবে না ময়না জানে।

    রোজগার এক লাফে অনেকটাই বেড়ে গেছে। দু’বেলা ভাতের সঙ্গে আজকাল মাছ কিংবা ডিমও হয় মাঝে মাঝে। ছেলের জন্য দুধের প্যাকেট কিনে আনে ময়না। রমেশ আর তার মা দুজনেরই শরীর সেরেছে। গায়ে মাংস লেগেছে ময়নারও। আঁটোসাঁটো চেহারাখানা দেখে লোভে চোখ চকচক করে খদ্দেরদের। 

    এরকমই সব নানা আবোল-তাবোল চিন্তা মাথায় নিয়ে সেদিন বাঘাযতীন স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল ময়না। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ডাকল, ‘আমাদের ময়নাপাখি নাকি রে! তা এদিকে কোথায়?’

    চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে ময়না দ্যাখে, গৌরদা। তার বাপের বাড়ির পাড়ার ছেলে। বয়সে ময়নার থেকে বছর চার-পাঁচের বড়ই হবে। গায়ের রংখানা ধপধপে ফর্সা বলে আদর করে নাম রাখা হয়েছিল গৌরাঙ্গ। তবে সবাই ‘গৌর’ বলেই ডাকে। গৌরদাকে দেখে অনেকদিন পর মনটা ভারি খুশি হয়ে উঠেছিল ময়নার। শুধু যে বাপের বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে তা নয়, গৌরদার সঙ্গে তার চিরকালই ভারি মিঠে সম্পর্ক। চমৎকার গান গায় গৌরদা। নতুন কোনও গান তুললেই শোনাতে আসত তাকে। ময়নারও গানের গলা ছিল খুব মিষ্টি। দুজনে মিলে কত সময় নদীর ধারে বসে গান গেয়েছে। গৌরদা এমন একটা মানুষ যে, তার সঙ্গে খোলামেলা মেশা যায় দিব্যি। নিন্দেমন্দর কথা মাথায় আসে না কারুর। যদিও ময়না মনে মনে বুঝত গৌরদা তাকে ভালবাসে। মুখে কিছু বলেনি কোনওদিন। আসলে গৌরদা ঠিক বিয়ে-থা করে সংসারী হওয়ার মানুষ যে নয়, সেটা ময়নাও বুঝেছিল। তাই নিজে থেকে এগোয়নি। ময়নার বিয়ের দিন খাটাখাটনি করেছিল গৌরদা। বাসরে গানও গেয়েছিল। তবে সে-গানে যে প্রাণ নেই, বুঝতে অসুবিধা হয়নি ময়নার।

    আশ্চর্য ব্যাপার, বিয়ের পর থেকে এতবার গৌড়দহ গেছে কিন্তু গৌরদার সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি। তবে খবর পেত মায়ের কাছে। কাজকর্ম তো কোনওকালেই কিছু করে না। যাত্রাপালায় গান গেয়ে বেড়াত। জমিজমা অল্প কিছু আছে। মা-ছেলের চলে যায় কোনওরকমে। ইদানীং নাকি আবার কোন আখড়ায় ঢুকেছে। সেখানেই গান গায়। অনাথ ছেলেপুলেরা থাকে সেখানে। তাদের দেখাশোনা করে। রাতে কোনওদিন ফেরে, কোনওদিন আবার ফেরেও না। ময়নাদের বাড়িও আজকাল আর বিশেষ আসে না।

    তবে সেদিন স্টেশনে দেখা হওয়াতে কিন্তু ভারি খুশি হয়েছিল গৌরদা। লেডিসে না উঠে গৌরদার সঙ্গে জেনারেলেই উঠেছিল ময়না। তারপর কত গল্প! ময়নার বরের খবর শুনে দুঃখও করল খুব। ছেলের জন্য দু’খানা পাকা পেয়ারা দিল। ওদের আখড়ার গাছপাকা পেয়ারা। গৌরদাকে দেখে মনে হচ্ছিল, খুশিতে আছে মানুষটা। চোখের পাতায়, ঠোঁটে হাসি চিকমিক করছিল। আখড়ার ছেলেপুলেদের দুষ্টুমির গল্প করছিল হাত নেড়ে নেড়ে। গৌরদার সঙ্গে কথা বলে অনেকদিন বাদে ময়নারও যেন মনটা হালকা লাগছিল। বাড়ি ফিরে রমেশকে বলেছিল গৌরদার কথা। প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। তারপরে অবশ্য চিনল। তবে খুব একটা খুশি হল বলেও মনে হল না। 

    ‘আধদামড়া একটা লোক। কাজকর্ম করে না। আখড়ায় গান গেয়ে বেড়ায়। নির্ঘাত কোনও ধান্দাবাজি আছে…’

    রমেশের কথাগুলো ভাল লাগেনি ময়নার। সব মানুষই যে একরকম হবে, তার কী মানে আছে। কেউ কেউ তো অন্যরকমও হতে পারে। তবে মুখে কিছু বলেনি। চুপচাপ চলে গেছিল কাপড় ছাড়তে। 

    তারপর থেকে মাঝে মাঝেই দেখা হত গৌরদার সঙ্গে। আখড়ার ছেলেপুলেদের জন্য জিনিস কিনতে শিয়ালদা কিংবা যাদবপুরে যায় গৌরদা। ফিরতি পথে দেখা হয়। কথাও হয়। ভাল লাগে ময়নার। খদ্দেরের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কাটানোর পর মনটা যেরকম তিতকুটে হয়ে ওঠে, সেটাও যেন কেটে যায়। আজকাল তাই মনে মনে গৌরদার সঙ্গে অপেক্ষাই করে ময়না। 

    তা গেল হপ্তায় গৌরদার সঙ্গে দেখা হতে হঠাৎ বলল, ‘হ্যাঁ রে ময়না, সেই যে গানটা আমরা গাইতাম, ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর, সেথা এক পড়শি বসত করে…’ মনে আছে তোর?’

    গৌরদাকে দেখে মনে হচ্ছিল, খুশিতে আছে মানুষটা। চোখের পাতায়, ঠোঁটে হাসি চিকমিক করছিল। আখড়ার ছেলেপুলেদের দুষ্টুমির গল্প করছিল হাত নেড়ে নেড়ে। গৌরদার সঙ্গে কথা বলে অনেকদিন বাদে ময়নারও যেন মনটা হালকা লাগছিল। বাড়ি ফিরে রমেশকে বলেছিল গৌরদার কথা।

    বড় প্রিয় গান ময়নার। মনে তো আছেই। তবে গলায় এখন আর সুর নেই তেমন। কথাটা বলতেই ঘাড় নাড়ল গৌরদা, ‘উঁহু, সুর আছে। তুই জানিস না। সুর তো আসলে গলায় থাকে না রে ময়নাপাখি, সুর থাকে মনে…। শোন, আগামী হপ্তায় আখড়ায় গানের আসর বসবে। তোকেও আসতে হবে। গান গাইবি আমার সঙ্গে।’ 

    ময়না তো অবাক। সে আবার হয় নাকি! কতকাল গান গায় না সে। তাছাড়া বাড়ি ফিরতে হবে। সংসারে শতেক কাজ থাকে। শাশুড়ি একা পেরে ওঠে না। কিন্তু গৌরদা ছাড়ল না কিছুতেই। আসতেই হবে ময়নাকে। পরে ভেবেচিন্তে ময়না দেখল, ঘণ্টা দুয়েকের তো মামলা। ক্ষুদিদির ওখানে খদ্দের থাকলে যে-সময় বাড়ি ফেরে, তার থেকে বড়জোর আধঘণ্টা দেরি হবে। তবে বলি বলি করেও কথাটা আর রমেশকে বলা হয়ে ওঠেনি। ঠিক করেছিল ফিরে এসে বলে দেবে। 

    কেমন করে যেতে হবে বুঝিয়ে দিয়েছিল গৌরদা। বাঘাযতীন বাজারের সুলভ শৌচালয়ে কাপড় আর ব্লাউজখানা বদলে পৌঁছেও গেছিল ঠিক সময়ে। কিন্তু ফেরা হল না তাড়াতাড়ি। একে তো গৌরদার সঙ্গে বসে গান গাইতে হল গোটা চার-পাঁচ, তারপর আবার আখড়ার বাবা বললেন, ‘পেসাদ না পেয়ে যাওয়া যাবে না।’ সব মিটিয়ে ময়না যখন বাড়ি পৌঁছল, তখন বেলা প্রায় তিনটে। দরজার মুখেই দাঁড়িয়েছিল রমেশ। ময়নাকে দেখেই চড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘এত দেরি হল যে! কোথায় গেছিলি?’

    মনটা ভারি খুশি-খুশি ছিল ময়নার। তাই গায়ে না মেখে হাসিমুখেই, ‘বলছি, বলছি’ বলে ঘরে ঢুকে চটিটা ছেড়ে কাপড় বদলাতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই খোঁড়া পায়ে হড়বড় করে ঘরে ঢুকে বউকে এক ধাক্কা মেরে চেঁচাল রমেশ, ‘এখনই বল। আগে উত্তর দিবি, তারপর ঘরে ঢুকবি তুই…’

    অবাক হয়ে যায় ময়না। ‘অমন করছ কেন? বাইরের কাপড়টাও ছাড়তে দেবে না নাকি…’

    ‘কথা ঘোরাবি না ছেনাল মাগী। সত্যি করে বল, কোথায় গেছিলি তুই?’

    ‘গৌরদার আখড়ায় গান গাইতে গেছিলাম। ওখানে পেসাদ পেতে দেরি হয়ে গেল তাই…’

    রমেশের চড়টা এত আচমকা এল যে, আর একটু হলে টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল ময়না। হিংস্র জন্তুর মতো মুখখানা হয়ে গেছে রমেশের, ‘কেন গেছিলি তুই ওখানে? গৌরদা তোর রসের লোক তাই না?’

    ‘ছোটলোকের মতো কথা বোলো না। বাড়িতে ছেলে রয়েছে…’

    ‘চুপ করে থাক। তোর রস আমি ঘুচিয়ে দেব। আর কোনওদিন যদি ওদিকে পা বাড়িয়েছিস তো…’

    মার খেয়ে প্রথমটায় একটু থতোমতো খেয়ে গেছিল ময়না। কিন্তু এবার তার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, আগ-পাছ না ভেবেই চেঁচায়, ‘কেন যাব না শুনি? বেশ করব যাব। আমার ইচ্ছে হলেই যাব। অন্যদিন যখন ফিরতে দেরি হয়, কখনও তো জানতে চাও না কেন দেরি হল? গাণ্ডেপিণ্ডে যে দু’বেলা খাচ্ছ, কখনও জানতে চেয়েছ কোতা থেকে আসছে টাকাগুনো… তখন কি বোঝো না কিছু? নাকি বুঝেও চোক বন্ধ করে থাকো…’

    কথাটা শুনে থমকে যায় রমেশ। তারপর কয়েক সেকেন্ডে সাপের মতো ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে, দু’পা এগিয়ে ময়নার চুলের মুঠিটা ধরে মুখটা নিজের মুখের কাছে নামিয়ে আনে। হিসহিসে গলায় বলে, ‘সব জানি। আমাদের সুখের জন্যি শরীর বেচতে যাস তুই। কিন্তু আজ গেছিলি নিজির সুখের জন্যি। সেটি আমি হতে দেব না… জেনে রাখ মাগী, সেটি হওয়া চলবে না।’

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook