গঙ্গা যেখানে এসে যমুনায় মিশেছে, এলাহাবাদের কাছে সেই প্রয়াগ হিন্দুধর্মের এক পবিত্র তীর্থস্থান। কিন্তু প্রয়াগ বিশেষভাবে পবিত্র হয়ে ওঠে মাঘ মাসের (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) অমাবস্যা তিথিতে, যখন বৃহস্পতি গ্রহ কুম্ভ নক্ষত্ররাশিতে এবং সূর্য মেষ নক্ষত্ররাশিতে অবস্থান করে। বারো বছরে মাত্র একবার এই মহাকাশীয় সমাপতনটি ঘটে। তারা এবং গ্রহের এই নির্দিষ্ট সমাপতনটি ঘটলে প্রয়াগের জল হয়ে ওঠে বিশেষভাবে পবিত্র, লাখে লাখে মানুষ তখন সেই নদীতে স্নান করতে আসেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন একটিবার ডুব দিতে পারলেই সমস্ত দিক থেকে তাঁদের কপাল খুলে যাবে। বলা বাহুল্য, এটা নিছকই বিশ্বাসের ব্যপার। তবে যে জিনিসটি তলিয়ে ভাবার মতো, সেটি এই যে নদীর পবিত্রতাটি তা হলে সময়নির্দিষ্ট। গ্রহ-নক্ষত্রের সমাপতনের আগে এবং পরে সে কেবলই সাধারণ নদী থাকে, কেবল ওই ‘মুহরত’-এ বা লগ্নে সে হয়ে ওঠে অনন্য।
হিন্দু-বাড়িতে বিভিন্ন ঠাকুর-দেবতাদের নামে যে পুজো-অর্চনা চলে, তাতেও এ-জিনিসটি লক্ষ করা যায়। বৈদিক প্রথা অনুসারে দেবতাকে ‘আহ্বান’ করা বা ডাকা হয়, তারপরে নৈবেদ্য দিয়ে তাঁকে তুষ্ট করা হয়, এবং শেষে তাঁকে ‘বিসর্জন’ রীতির সাহায্যে বিদায় জানানো হয়। এ প্রক্রিয়াগুলি বিশেষভাবে নির্দিষ্ট সময় মেনেই করা হয়, ঠিক যে-লগ্নে আমাদের ইচ্ছেগুলো পূর্ণ করার এবং আশীর্বাদ করার জন্য দেবতার ক্ষমতাটি সবচেয়ে বেশি থাকবে।
নদীতে স্নান এবং বাড়ির পুজো, এই দুটি উদাহরণেই ‘মুহরত’ বা লগ্নের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কর্পোরেট দুনিয়াতেও তো তাই। সবাই আসলে বিশেষ মুহরতওয়ালা দেবতা, কোম্পানির কাছে সেই মানুষটার গুরুত্ব এবং দাম কেবল একটি নির্দিষ্ট লগ্নে, তার আগেও নয়, পরেও নয়। প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি সদস্যই দেব-দেবতা হিসেবে পূজিত, কিন্তু বাজারের নিয়মে অথবা শেয়ারহোল্ডারদের মর্জিমাফিক যখন কোনও একজন ব্যক্তির বা একটি পদের ‘মুহরত’ তৈরি হয়, যে-লগ্নে সেই পদটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন হু হু করে সেই ব্যক্তির দর বেড়ে যায়।
এই যেমন, বাজার যখন সংকুচিত হচ্ছে, তখন মার্কেটিং-এর কাজ হয়ে ওঠে বেজায় গুরুত্বপূর্ণ। তখন মার্কেটিং-এর কর্তাকে কোম্পানির সবচেয়ে বড় কর্মী বলে খাতির করা হয়, তোয়াজ করা হয়। তা দেখে তাঁর আগের পুরনো দেব-দেবতারা খুশি হন না নিশ্চয়ই! আবার যখন খরচ কমানোর দরকার পড়ে, তখন ফিনান্স বা ব্যয় বিভাগের কর্তা হয়ে ওঠেন শুভ লগ্নের মুহরতওয়ালা দেবতা। ফিনান্সিয়াল ইয়ার বা অর্থ-ভিত্তিক বছরটি যখন শেষের দিকে, তখন ব্যয় বিভাগের চেয়ে বিক্রয় বিভাগ বা সেলস ডিপার্টমেন্টের দর বেড়ে যায়। এদিকে ব্যবসা যখন ডিজিট্যাল দুনিয়ায় প্রবেশ করে, তখন যে পড়ুয়া গোছের কর্মীরা ভাল ইন্টারনেট বা সফটওয়্যার বোঝে, তারাই হয়ে ওঠে কোম্পানির নয়নের মণি। আর লাইসেন্সের সওয়াল যখন ওঠে, তখন সরকার-প্রশাসনের সাথে যে লিইয়েজন ডিপার্টমেন্ট যোগাযোগ রাখে, সে হয়ে ওঠে পবিত্র তস্য পবিত্র!
যজমানের ভক্তিতে দেবতার কখনওই বেশি গলে গেলে চলবে না। তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে, এই ভক্তির মূলে আছে ভক্তের কোনও বিশেষ চাহিদা, যার উদ্রেক হয়েছে কোনও বিশেষ একটি পরিস্থিতির থেকে। যে মুহূর্তে সেই পরিস্থিতি পালটে যাবে, যখন সেই চাহিদা আর থাকবে না, তখনই ভক্তির স্রোতে ভাঁটা পড়বে, বন্ধ হয়ে যাবে পুজো-অর্চনা। একটু অন্যভাবে বলতে গেলে, দেবতার প্রতি ভক্তির নির্ধারিত সময়সীমা আছে। ভক্তের সাথে দেবতার সম্পর্ক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে, তা কখনওই চিরস্থায়ী নয়। এ-কথাটি যদি দেবতা ভুলে যান, তবে পরে বড়ই পীড়া ভোগ করবেন। যজমানের আদর-যত্নে গলে যাওয়া খুব সহজ, তখন মনে হতে পারে এ ভালবাসা বুঝি আজীবন অটুট থাকবে। আদতে তা হয় না।
অতএব যে সমস্যা দূর করতে দেবতাকে আহ্বান করা হয়েছে, বহু দেবতাই প্রাণপণ চেষ্টা করেন যাতে সেই সমস্যার আসলে সমাধান না হয়। সমস্যাটি তাঁরা টিকিয়ে রাখেন, কারণ সমস্যা থাকলে যজমানের ভক্তিও থাকবে। অতএব ‘মুহরত’-এর শুভ লগ্ন যাতে দীর্ঘজীবি হয়, শেয়ারহোল্ডাররা যাতে বার বার তাঁকে এক্সটেনশন দিয়ে উচ্চপদে বহাল রাখেন, এই উদ্দেশ্যেই সিইও সাহেবরা ইচ্ছে করে আগুন জ্বালিয়ে রাখেন।
নব্য দেবতারা যজমানের আদরে-ভালবাসায় ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেন, তারপরে আচমকাই একদিন টের পান, উচ্চ আসন থেকে কবে তাঁদের দূর করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ভক্তও মুখ ফিরিয়ে চলে যায়, দুঃখে দেবতারও বুক ফেটে যায়। কিন্তু কুম্ভের মেলা অথবা হিন্দু-বাড়ির রীতি-রেওয়াজ আমাদের সর্বদাই মনে করিয়ে দেয় যে আবার এমন সময় জীবনে আসবে যখন ফের দেবতার প্রয়োজন হবে। মানুষের চাহিদা আসলে চক্রাকার, বার বার ফিরে আসে। মুহরত শেষ হয় বটে, তবে আবার একদিন অনিবার্য ভাবেই ফিরে আসে। বারো বছর পরে হলেও ভক্তেরা প্রয়াগে ফিরবেই।