‘সুন্দর হে সুন্দর’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আশি বছরের জীবনে যে-কয়েকটা অভ্যাস খুব জোরের সঙ্গে আমাদের রক্তে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাদের একটা হল, সুন্দর একটা রুচিবোধ গড়ে তোলা। সৌজন্য আর নির্বিকল্প রুচিবোধের পরিচয় আজও বিরল নয় শান্তিনিকেতনে। তবে, তার অনেক কিছু শুধু হারানোর মুখে, সময়ের নিয়মে।
আশ্রমে আজও দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টাঘর। চালু নাম, সিংহসদন। এই ঘড়িঘরের ঘণ্টার ধ্বনি নিয়ন্ত্রণ করে শান্তিনিকেতনের আশ্রমজীবন। এক কথায় শান্তিনিকেতনের ‘বিগ বেন’। ঘণ্টা তিনবার বাজা মানে পঠনপাঠন শুরু অথবা শেষ, চারবার বেজে ওঠা মানে কোথাও সমবেত হবার ডাক, আর পাঁচবার বাজা মানে বিপদ একেবারে শিয়রে। যেমন আগুন লাগল, বৃষ্টিতে বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ল— ইত্যাদি।
এখনও দেখা হলে করজোড়ে নমস্কারের প্রথা রয়েছে, সঙ্গে কুশল বিনিময়। আছে বড়দের দেখে উঠে দাঁড়ানোর প্রথা। আশ্রম বিদ্যালয়ে প্রথম পর্বের ক্লাসের শিক্ষকদের জন্য আমরা অনেকেই নিয়ে যেতাম একটা করে ফুল। বাড়ির বাগানের অথবা নিতান্তই পথ-কুড়ানো ফুল। যখন সাইকেলে, শিক্ষকদের দেখে হঠাৎ গতি কমিয়ে নেমে পড়ার চল ছিল। স্বাধীন আর স্বাভাবিক চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটিয়ে শিক্ষকদের শ্রদ্ধা জানাবার এই ব্যাপারটা ছিল কিছুটা বেমানান, এমনকী বিপজ্জনক। এই চল এখনও আছে তবে স্কুটি আর মোটরবাইকের দাপটে, ওগুলো থেকে না নেমে, আপাতত শুধু মাথা ঝুঁকিয়ে এগিয়ে যাবার প্রথাই প্রচলিত।
শান্তিনিকেতনে কাউকে ‘স্যার’ অথবা ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকতে বরাবর ভয়ঙ্কর একটা জড়তা আর অনীহা ছিল। এখনও আছে। এতটাই ছিল সেই অনভ্যাস, একবার দিল্লি থেকে আসা জনৈকা কেন্দ্রীয় সচিবকে এক শিক্ষক চাপের মুখে ‘ম্যাডাম’ বলতে গিয়ে বসেছিলেন ‘মিসেস’। বয়সে বড়দের দাদা এবং দিদি বলার চল রয়েছে এখানে। একবার বোলপুরের এক নবাগত, মেজাজি নাক-কান-গলার ডাক্তারের কাছে গেছি। তাঁর স্ত্রী সুস্মিতাদি তখন পাঠভবনে আমাদের ভূগোলের শিক্ষিকা। শান্তিনিকেতনের ধারায় আমি আমার প্রিয় শিক্ষিকার ডাক্তার স্বামীকে ডাক্তারখানার একটা আধো-অন্ধকার ঘরে বললাম, ‘আশিসদা কানটা ফড়ফড় করছে, মনে হচ্ছে একটা ফড়িং ঢুকে আছে।’ উনি একটা টর্চ জ্বেলে আমার কানের কাছে আসছিলেন। হঠাৎ থেমে টর্চ বন্ধ করে বললেন, ‘আমি আপনার দাদা নই।’ আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। এরপর থেকে আমি তাঁকে যে কোনও সম্বোধন করা থেকে বিরত থাকতাম। বহু বছর পর তাঁকে আর একবার ‘আশিসদা’ বলে ডেকেছিলাম। তিনি আর রুখে দাঁড়াননি, কিন্তু এত করুণ ভাবে তাকালেন, মনে হল কোনও মহাযুদ্ধে এক তুচ্ছাত্মা বেয়াদপের কাছে পরাজিত হয়েছেন। এক প্রবীণ অধ্যাপককে স্বাভাবিক প্রথায় আমরা বলতাম দাদা আর তাঁর মাকে দিদি। কলকাতা থেকে আসা এক ভদ্রলোক একবার এসব দেখে খুব বিরক্ত। বললেন, ‘দিদির ছেলে দাদা হয় কোন নিয়মে?’ বিশেষ আমল দিলাম না। উপাচার্য থেকে পিওন সবাই হয় দাদা না হয় দিদি আমাদের শান্তিনিকেতনে। ইদানীং ওই ‘স্যার’ আর ‘ম্যাডাম’ ঢুকে গেছে। ওই ডাক্তারের মতো জাঁদরেল কেউ হলে, তাঁকে চট করে আজকাল দাদা বলতে অনেকে ভয়ও পাচ্ছে।
শান্তিনিকেতনের উৎসব-অনুষ্ঠানগুলো চোখে পড়ার মতো স্বতন্ত্র, তাদের নান্দনিকতায়। ভাবা যায়, শুধু জাপানি শিক্ষকের জুজুৎসুর ক্লাসে গাইবার জন্য পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ একটা গান লিখেছিলেন! ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান’। শান্তিনিকেতনে উৎসবের পোশাক সব সময় সাদা। শাড়ি অথবা ধুতির পাড়ে সামান্য রং থাকলেও থাকতে পারে। না জেনে কেউ রঙিন পোশাকে অনুষ্ঠানে গেলে আশ্রমের প্রাচীনপন্থীরা এমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, দেখে বিশ্বামিত্র লজ্জা পাবেন। বিদ্যালয়ের সমাবর্তনে নবীনের হাতে প্রদীপ তুলে দেন কোনও প্রবীণ। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। শান্তিনিকেতনে প্রথম এসে রুক্ষ প্রান্তরে ছাতিম গাছের ছায়ায় বসে ধ্যান করে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন অপার শান্তি। এই ছাতিমগাছের বল্কলের উপর প্রাচীনকালে শিক্ষার্থীরা লিখতেন। হিন্দিতে এই গাছের নাম যতই ‘শয়তান কা পেড়’ অথবা ইংরেজিতে ‘ডেভিলস ট্রি’ হোক না কেন, ছাতিম অর্থাৎ ‘আলস্টনিয়া স্কলারিস’ শান্তিনিকেতনের ইতিহাসে এক পবিত্র তরুবর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তাই আচার্যের হাত থেকে স্নাতকেরা গ্রহণ করেন সপ্তপর্ণী, মামুলি শংসাপত্রের বদলে। বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানে সুসজ্জিত বরণ-দোলায় শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে নিয়ে আসা হয় এক চারাগাছ। ওই উৎসবে পঞ্চকন্যাদের সাজ, বিশেষত পাতার গয়না অবিশ্বাস্য সুন্দর! ‘সুন্দরী’ বালিকা পরিবৃত একটা সামান্য গাছের অত আদর দেখে মজা করে এই উৎসবের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ একবার একটা চিঠি লিখেছিলেন পুত্রবধূ প্রতিমাকে। লিখেছিলেন, হিংসে হয়! নববর্ষে সকালের উপাসনার পর ছিল হাতে আঁকা কার্ড দেওয়া-নেওয়ার আশ্চর্য আনন্দ। নন্দলাল, বিনোদবিহারী, অবন-গগন, রামকিঙ্কর— কে আঁকেননি আর অকাতরে বিলিয়ে দেননি তাক লাগিয়ে দেওয়া সব কার্ড!
আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ অথবা বিশিষ্টজনেদের কোনও মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একইভাবে, কারও প্রতিকৃতিতে ফুল নিবেদন, মাল্যদানের প্রথাও এখানে নিষিদ্ধ। কারণ ওই একটাই। মহর্ষির নির্দেশে এই আশ্রমে কোনও ব্যক্তির আরাধনা চলে না। শ্রীনিকেতনে শ্রাবণমাসের উৎসব হলকর্ষণে হল-চালনার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় এক প্রাজ্ঞ কৃষক ও দুই স্বাস্থ্যবান বলদকে। সীতাযজ্ঞের আদলে রচিত হলকর্ষণ অনুষ্ঠানের মতো, দুই বলদকে অত অপূর্ব সাজে সাজিয়ে সম্মানিত করার প্রথা পৃথিবীর আর কোথাও রয়ে গেছে কিনা কে জানে! যে কোনও অনুষ্ঠানের শেষে বাধ্যতামূলক শান্তিনিকেতনের আশ্রমসঙ্গীত। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গাইবেন। ‘আমাদের শান্তিনিকেতন, সে যে সব হতে আপন।’ ওই গানেই রয়েছে ‘নীল গগনের সোহাগ মাখা’ খোলা মাঠের কথা। শিল্পী সুধীর খাস্তগীরের কন্যা শ্যামলী খাস্তগীর একবার কোথাও লিখেছিলেন, তাঁর দেখা এক স্বপ্নের কথা। মহর্ষি তাঁকে যেন বলছেন, ‘শ্যামলী, শান্তিকেতনের দিগন্তটা কোথায়!’
রয়েছে পায়ে হাত দিয়ে প্রণামের চল। প্রণামটা আমিও একেবারে ছোটবেলা থেকে নিয়মিত করেছি। কোমরের একটা ব্যায়ামের জন্য এখন এটা আরও ভাল লাগে। অন্যকে উঁচু করতে নিজে নীচু হবার ভিতর একটা আনন্দও আছে। এক উপাচার্যের স্ত্রীকে একবার প্রণাম করতে সামান্য ঝুঁকেছি, তিনি পিছিয়ে গিয়ে বললেন, ‘পায়ে-টায়ে ধরবে না।’ আমি হাতটা সরিয়ে নিলাম। কথাটা শুনতে এত কুৎসিত, সেই প্রথম কাউকে প্রণাম করতে গিয়ে মনে হচ্ছিল পায়ে কিছু লাল পিঁপড়ে বিছিয়ে দিই। তাহলে অচিরেই তিনি নিজের মাথা নিজের পায়ের অভিমুখে ঝোঁকাবেন। শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহে কাউকে প্রণাম করা নিষেধ, কেননা ওখানে ‘এক এবং অদ্বিতীয়’ ব্রহ্মই শুধু প্রণম্য। ভিনদেশিরাও শান্তিনিকেতনে এসে প্রণামের ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে যেতেন, সম্ভবত অনেক বিড়ম্বনার ভিতর।
এত সুন্দর আলপনা শান্তিনিকেতনের উৎসব ছাড়া দেশের আর কোথাও দেখা যায় কি না সন্দেহ! বৃক্ষরোপণে গাছের জন্য খোঁড়া গর্তের চারপাশে বালির বেদিতে গুঁড়ো রঙের আলপনা, সমাবর্তনে মঞ্চে ওঠার লম্বা পথের দু’ধারে অপূর্ব আলপনা আর তার উপর গাছের ভিতর থেকে ঝরে পড়া আলোর আলপনা, ছাতিমতলায় পৌষ উৎসবে উপাসনা বেদি ঘিরে থাকা আলপনা প্রতিবারই মনে হয় অনন্য আর নতুন। উপাসনাগৃহে বর্ষশেষের উপাসনার আলপনার রং বরাবর সাদা। পরদিন নববর্ষের উপাসনায় আবার তা-ই হয়ে ওঠে রঙিন।
শান্তিনিকেতনের স্থাপত্য, ঘর সাজানো আর পোশাক-পরিচ্ছদেও রয়েছে পরিমিতিবোধ আর রুচির ছোঁওয়া। শান্তিনিকেতনের পুরনো বাড়িগুলো তৈরি হত এমনভাবে, যেন তা বড় গাছের মাথা না ছাড়ায়। ছিল না পাঁচিল। প্রবেশ-তোরণে খোদিত ছিল ধানের শিষ। সমস্ত বাড়িঘর আর বইয়ের প্রচ্ছদের রং ছিল হাল্কা বাসন্তী। অনুষ্ঠানে রয়েছে বাটিকের উত্তরীয় পরার চল, যা আজও তৈরি করে কারুসঙ্ঘ, কলাভবন আর শিল্পসদনের মতো প্রতিষ্ঠান। পরলোকগত আশ্রম-বন্ধুদের স্মরণ করে বছরের একটা দিন এখনও খাওয়া হয় হবিষ্যান্ন। বেদগান, মন্ত্রপাঠ শান্তিনিকেতনের আশ্রমজীবনের অঙ্গ। উপাসনাগৃহের প্রবেশ-তোরণে খোদিত উপদেশমালায় রয়েছে আশ্রমে মদ, মাংস আর কুৎসিত আমোদ-প্রমোদে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু মাংস তো অনেকেই খায়। তাহলে আশ্রম জায়গাটা কতদূর? ব্যাপারটা ভেবে দেখার মতো। খুব ছোট করে দেখলে ছাতিমতলা, উপাসনাগৃহ, আর পাঠভবন বিদ্যালয় মিলেই আসলে মূল ‘আশ্রম’। এর বাইরে আশ্রমের বিধিনিষেধ কার্যকরী নয়। তাই পৌষমেলায় মাংসের খাবার বিক্রিতে নেই কোনও নিষেধাজ্ঞা, যেমন সমস্যা নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে নিরামিষ আহারের। কিছু জায়গায় খালি পায়ে চলার চল রয়ে গেছে। প্রকৃতির কোলে গাছের নীচে ক্লাস আর মাটিতে বসে অনুষ্ঠান দেখাও এখানে এক রীতি।
শান্তিনিকেতনের অনেকেই দেখেছি দোকান-বাজার ছাড়া কাউকে কোথাও টাকা দিলে, সাধারণ হোক, সুন্দর হোক, সেটা অন্তত একটা খামে ভরে দিতে। দেখেছি, কাউকে কিছু পাঠালে অন্তত এক কলম তার সঙ্গে হাতে কিছু লিখে দিতে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আজও প্রদীপ জ্বালাবার প্রথা। ঠাকুরবাড়ির সদস্যা, শান্তিনিকেতনের মৃণালিনী আনন্দপাঠশালায় আমার শিক্ষিকা শুভ্রা ঠাকুরের সঙ্গে একটা ছোট প্রদীপ থাকত। প্রদীপ জ্বালাতে কেউ মোমবাতি অথবা দেশলাই নিয়ে এগোলেই তিনি বাড়িয়ে দিতেন একটা সহজ, সুন্দর, ছোট্ট প্রদীপ। বলতেন, ‘ছোট্ট প্রদীপ দিয়েই একটা বড় প্রদীপ জ্বালাতে হয়।’ যখনই আলো জ্বলে, ওই কথাটাই মনে পড়ে যায় আমার।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র