আপনি রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে বিস্তারিত ভাবে লেখালিখি করেছেন। আপনার মতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওঁর শিল্পের, বিশেষ করে পাবলিক স্পেসে ওঁর যে শিল্প রয়েছে, এমন কোনও বৈশিষ্ট্য আছে যা ওঁকে এরকম একজন উদ্দীপক, কালজয়ী শিল্পী করে তুলেছে?
কালকে জয় কিছু শিল্পীরা করতে পারেন, আবার কিছু শিল্পীদের আমরা ভুলে যাই। এরকম কেন হয়, তা বলা মুশকিল। অবশ্যই অনেকটা নির্ভর করে তাঁদের কাজগুলোর অন্তর্নিহিত শৈল্পিক গুণের উপর। গুণ বলতে আমি শিল্পীর দক্ষতার কথা বলছি না, বলছি এক-একটা যুগের যে শৈল্পিক ও মানবিক মূল্যবোধ, শিল্পকর্মের নিজের বাস্তবিকতার আখরে সেগুলো আমাদের কাছে পৌঁছে দেবার ক্ষমতার কথা। যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সেই শিল্পকর্মের জন্ম দিয়েছিল, কালের নিয়মে সেই প্রেক্ষাপট মিলিয়ে যাবার পরেও এ-ক্ষমতা অটুট থাকে।
যে-শিল্প নিজের আখরে কোনও গভীর বোধ বা ভাবকে ধরার চেষ্টা করে, আর যে-শিল্প নেহাতই তার সমকালের সুরে সুর মেলাতে চায়, যে কোনও একটা বিশেষ যুগে এই দু’ধরনের শিল্পই সমান সাফল্য পেতে পারে। কিন্তু যে-শিল্প অন্তরে ধারণ করে রেখেছে কোনও নিবিড় সত্যের সন্ধান, একমাত্র সেই শিল্পই নিজের সমকালের বাইরেও অন্য কোনও যুগের দর্শকের কাছে হয়ে উঠতে পারে প্রাসঙ্গিক। এর মানে এই নয় যে, সেই শিল্পীর সমস্ত কাজের কোনও না কোনও সমকালীন বিষয়বস্তু থাকতেই হবে, কিন্তু তাঁর শিল্পে এক রকমের বলিষ্ঠ ও সৎ শৈল্পিক প্রকাশ যেন আমরা সর্বদাই দেখতে পাই। রামকিঙ্করের শিল্পের ক্ষেত্রে এ- কথাটি খাটে। তাঁর শিল্পকর্ম দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে, তাঁর নিজের যুগের ও নিজের কর্মস্থানের কিছু সামাজিক ও শৈল্পিক সম্ভাবনাকে তিনি নিজের সৃষ্টিতে ধরে ফেলেছেন, এবং সমকালীন বা সম-মতাদর্শের যে-শিল্পীদের সাথে তাঁকে এক গোত্রে ফেলা হয়, তাঁদের অনেকের চেয়েই বেশি অন্তর্দৃষ্টির সাথে, জটিল ভাবে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
রামকিঙ্করকে বাউণ্ডুলে হিসেবে, বা প্রতি-সংস্কারী শিল্পী হিসেবে দেখার একটা ঝোঁক লক্ষ করা যায়। আবার কে কী বলছে না বলছে সে-বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে তিনি শিল্পের ক্রিয়ায় নিমজ্জিত থাকতেন, এ বিষয়েও অনেক গল্প শোনা যায়। এর মধ্যে কোনওটাতে, অথবা দুটোতেই কি খানিকটা সত্যি কথা রয়েছে?
দুটোই সত্যি।
নিছক উচ্চমানের কারিগর বা একটি ধারার বাহক যে-শিল্পীরা নন, যাঁদের পরিসর আর একটু বেশি, তাঁদের প্রত্যেকজনকেই কিছুটা হলেও উদ্ভাবক বা, আপনি যেমন বললেন, প্রতি-সংস্কারী হতেই হয়। বিশেষ করে সেই শিল্পী যখন প্রথাগত সমাজের গণ্ডির ভিতরে কাজ করছেন না। শিক্ষক হিসেবে নন্দলাল প্রথা, প্রকৃতি ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মধ্যে একরকমের ভারসাম্য বজায় রাখারই উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর মতে একজন শিল্পী কিছু শৈল্পিক পূর্বসূরিদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রেই নিজের দক্ষতার ভাণ্ডার গড়ে তোলেন। প্রকৃতির সাথে যোগাযোগের মধ্যে দিয়ে তিনি পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজে পান, তারপরে শিল্প ও বাস্তব থেকে যা সঞ্চয় করলেন তাকে নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ছোঁয়ায় সজীব করেই তিনি গুরুত্ব অর্জন করেন। এই ভারসাম্যটি ঠিক গাণিতিক মধ্যক নয়, এই ভিন্ন আঙ্গিকগুলোর মধ্যে এক ধরনের সক্রিয় লেনা-দেনার ফসল।
শান্তিনিকেতনে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের মতোই রামকিঙ্কর স্থানীয় প্রকৃতির সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, তবে তিনি সেই প্রকৃতিকে দেখেছিলেন এক ভিন্ন শিল্পবোধের দৃষ্টিতে, ভিন্ন শৈল্পিক প্রথার থেকে তিনি পেয়েছিলেন নিজের কলাকৌশল। সে-কারণে এই সর্বজনীন জগৎটাকে তিনি দেখেছিলেন খুব ব্যক্তিগত ভাবে। বলতে পারেন এভাবেই তাঁর প্রতি-সংস্কারী পরিচিতির জন্ম।
এ ছাড়াও নিজের কিছু কাছের সহকর্মীদের মতো তিনিও ছিলেন কাজপাগল মানুষ। শিল্পের বিনিময়ে সামাজিক বা অর্থনৈতিক পারিশ্রমিক কী পেলেন বা পেলেন না, সেই নিয়ে খুব একটা হেলদোল ছিল না। শিল্পকে তিনি পেশা হিসেবে দেখতেন না, দেখতেন জীবনবোধ হিসেবে, এই বিশ্ব ও সমাজকে দেখার-বোঝার একটা মাধ্যম হিসেবে। ফলে, তাঁর প্রকৃত পারিশ্রমিক সর্বদাই নিহিত কেবল ভবিষ্যতের সম্ভাবনায়। বর্তমান পুরস্কার-সম্বর্ধনা যা তাঁর জুটেছে, তা নিছকই ক্ষণস্থায়ী বিক্ষেপমাত্র— বলা যায়, জোয়ার-ভাঁটার বৃহত্তর আখরে নেহাতই খুচরো ঢেউ।
শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখার সময়ে রামকিঙ্করের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতোই। ওখানে তাঁর যে-শিল্পকর্মগুলো প্রদর্শিত রয়েছে, তার ব্যাপারে একটু বলবেন?
হ্যাঁ, চারপাশের দৃশ্যপট পালটে গেলেও ওগুলো এখনও নজর টানে। যে-সময়ে ওগুলো বানানো, তখন বাড়িঘর অনেক কম ছিল, ওগুলোও আরও প্রকট ভাবে চোখে পড়ত।
যদি কাজগুলোকে কালানুক্রমিক ভাবে দেখি, শিল্পী হিসেবে রামকিঙ্করের বিবর্তন এবং তাঁর চারপাশের জগতে যে পরিবর্তনগুলো, দুটোরই প্রতিফলন দেখা যায়। প্রথম কাজ ‘সুজাতা’, সেটি যেন ঋজু বৃক্ষের মতো মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এখন চারিদিকে বাড়িঘর আর গাছের ভিড়ে বন্দি হয়ে পড়েছে বটে, তবে একসময়ে একটা খোলা, অনির্মিত জায়গায় মাত্র একটা চারাগাছ পাশে নিয়ে সে রাজকীয় ভাবে একাই বিরাজ করত। রামকিঙ্করের এর পরের কাজ ‘শ্যামলী’-র গায়ে রিলিফ বা খোদাই শিল্প; এই ‘শ্যামলী’ নামে মাটির বাড়িটি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং নিজের জন্য প্রস্তুত করিয়েছিলেন। এখানে তাঁর শিল্পে সাঁওতালদের প্রবেশ, বাড়ির প্রবেশপথের দু’ধারে তাদের আকৃতি যেন পাতালবাসী দ্বারপালকদের মতো। দিল্লির রিজার্ভ ব্যাংকের প্রবেশপথে রামকিঙ্করের পরবর্তীকালের সৃষ্টি ‘যক্ষ ও যক্ষী’-র এ যেন পূর্বাভাস। এর কিছুদিন পরেই তাঁর সৃষ্টি ‘সাঁওতাল পরিবার’, সেখানে প্রান্তবাসী আদিবাসী কৃষকের যে বিরাট রূপ, তা এতদিন কেবল রাজা-রাজড়াদের জন্যেই সংরক্ষিত ছিল। ভারতীয় শিল্পে প্রান্তবাসীর এই যে বিজয়ী প্রবেশ, তা কিন্তু আমাদের সম্মিলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতায় তাঁদের প্রবেশেরই সমান্তরাল। রামকিঙ্করের এর পরের কাজ মানুষ, পাখি ও গাছের একটি বিরাট কম্পোজিট, তাদের সবকিছুকে একত্রিত করে বড় সজীব একটি বিমূর্ত শিল্প। এর পরে এল মন্বন্তরের সময়ে তৈরি শিল্পকর্ম ‘থ্রেশার’। সুউচ্চ, কিন্তু মস্তকহীন— বাস্তব এবং বিমূর্ততার মধ্যে অসহায় ভাবে আটকা পড়ে যাওয়া কৃষকের রূপক। পরে রামকিঙ্কর বলেন, এই শিল্পকর্মটি ছিল তাঁর অচেনা রাজনৈতিক বন্দি। পরিশেষে, ‘সুজাতা’ সৃষ্টির কুড়ি বছর পরে ক্যাম্পাসে তাঁর শেষ বড় কাজ হচ্ছে ‘মিল কল’— কলের প্রলেতারিয়াত শ্রমিক হয়ে ওঠা আদিবাসী কৃষকের হই হই করে বিজয়মিছিল।
কালানুক্রমিক ভাবে দেখলে, এই কাজগুলো একটা যাত্রাপথের সন্ধান দেয়; লিরিক্যাল থেকে বাস্তব, সেখান থেকে মহাকাব্য, সেখান থেকে সজীবতা, সেখান থেকে অশান্ত প্রতিবাদ, এবং সর্বশেষে আলঙ্কারিক বক্তব্য। এর থেকে রামকিঙ্করের বিষয়ে, এবং আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের একটা বিশেষ দিকের বিষয়ে, আমরা যতটা জানতে পারি, অন্য কোনও শিল্পীর কাজ দেখে পারি না।
কলাভবনের গোড়ার দিকের বছরগুলোয় একজন শিক্ষক হিসেবে রামকিঙ্করের অবদান কী ছিল?
তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল কলাভবনে ভাস্কর্যশিল্পের সূচনা। রামকিঙ্করের আগে ভারতবর্ষে ভাস্কর্য ছিল ঔপনিবেশিকচর্চার একটা অংশবিশেষ। তিনি একা হাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একদিকে দেশজ প্রথা এবং অন্যদিকে আধুনিক পাশ্চাত্য উদ্ভাবনার থেকে রসদ নিয়ে সেটা পালটে দিতে পেরেছিলেন।
কলাভবনে যে-শিক্ষাব্যবস্থা তখন ছিল, তা এ-বিষয়ে রামকিঙ্করকে অনেকটা সাহায্য করেছিল বটে। তাও, আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যশিল্পের ইতিহাসে এ এক অসামান্য কীর্তি, এক মোড়-ঘুরিয়ে-দেওয়া অবদান। শিক্ষক হিসেবে তিনি বিনোদবিহারীর মতো অত গুছিয়ে নিজের মতামতগুলো কথায় বলতে পারতেন না, বা নন্দলালের মতো অত নিপুণ ভাবে সেগুলো নিয়ম বা রীতির রূপে প্রথাবদ্ধ করতে পারেননি। তাঁর ছাত্রদের তিনি নিজের ভাবনাগুলো বোঝাতেন উদাহরণ দিয়ে, বা অনতিদীর্ঘ বাণী বা মন্তব্যের সাহায্যে। তবে তাঁর এই বক্তব্যগুলোর পিছনে একটি সুনিশ্চিত দর্শনের কাঠামো রসিক ছাত্ররা ঠিকই খুঁজে পেয়েছিলেন।
রামকিঙ্করের কাজের মধ্যে জলরং বা তেলরঙের ব্যবহার নিয়ে অতটা চর্চা হয় না। তাঁর এই গোত্রের কাজের উপর কী ধরনের প্রভাব ছিল?
এ-কথা ঠিকই যে, ভাস্কর্যশিল্পে তাঁর যুগান্তকারী কীর্তির কারণে ওই আখরেই তাঁকে নিয়ে বেশি চর্চা হয়। তবে তাঁর চিত্রশিল্প, বিশেষ করে তেলরঙে যে শিল্প— তা নিয়েও কিন্তু কথা হয়। এই দুই ধরনের শিল্পের কাজ যে আধুনিক শিল্পীরা একসাথে করেছেন, যেমন মাতিস বা পিকাসো, তাঁদের মতোই ভাস্কর্য এবং চিত্রশিল্পের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান তাঁর শৈল্পিক ক্রমবিকাশের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
তবে তাঁর জলরঙের কাজগুলোর যতটা সম্মান পাওয়া উচিত ছিল, ততটা পায়নি। এর মূলে হয়তো আছে আমাদেরই অভ্যেস— আমরা জলরঙকে একটু তাচ্ছিল্যের মাধ্যম হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত। তাঁর ভাস্কর্য এবং তেলরঙের চিত্রশিল্প যেমন চাক্ষুষ বিষয়বস্তু নিয়ে শুরু হয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার থেকে সরে এসেছে, তাঁর জলরঙের কাজগুলো আঁকার স্থানেই চটপট তৈরি করা ফেলা, অতএব তার আখরে ঢুকে পড়েছে সংবেদনশীলতা ও সংজ্ঞাবহ অভিজ্ঞতার এক স্বতঃস্ফূর্ত সংমিশ্রণ।
তাঁর তেলরঙের কাজগুলোয় আমরা পশ্চিমের বহু শিল্পীদের এবং শৈল্পিক ধারার সঙ্গে শৈলী বা ধাঁচের নৈকট্য দেখতে পাই— বিশেষ করে সেজান, পিকাসো, কিউবিজম, ফিউচারিজম, এক্সপ্রেশেনাজিম। কিন্তু তিনি এই ধারাগুলোকে ব্যবহার করেন একই ভাষার একাধিক শব্দরূপের মতো। জলরঙের ক্ষেত্রে তাঁর শৈল্পিক চরিত্রটি অনেক বেশি অনন্য, তাতে আমরা মিল পাই নন্দলাল, বিনোদবিহারী ও পূর্ব এশিয়ার ক্যালিগ্রাফির ধাঁচের সঙ্গে।
রামকিঙ্কর সাদামাটা গ্রামের বাড়ির ছেলে। এর ফলে কি তাঁর কাজে বাস্তবের একটা ছাপ পড়েছে, যেন মাটি নিজে উঠে এসেছে তাঁর ভাস্কর্যে নিজেকে রূপ দিতে?
হ্যাঁ, এবং না। আমাদের উৎস বা জীবনের শিকড় কোথায়, সেটার একটা গুরুত্ব আছে। কিন্তু একই সঙ্গে গুরুত্ব আছে আমাদের বাসনার, পছন্দ-অপছন্দের, পরিবেশের এবং সহযোগী হিসেবে কাদের পাচ্ছি, তার। অতএব সবকিছুর বিচার সেই উৎসের নিরিখে করাটা মাঝে মাঝে ভ্রান্ত হতে পারে। রামকিঙ্করের ক্ষেত্রে তাঁর সহজ-সরল বা সাদামাটা পারিবারিক ইতিহাসটাকে বড্ড বেশি জোর দেওয়া হয়। সমস্যা হচ্ছে, তাতে চাপা পড়ে যায় তাঁর বৌদ্ধিক চর্চার জায়গাগুলো, যার সঙ্গে বেশি মিল কিন্তু বিশ্বজনীন আধুনিকতারই। সাঁওতালদের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তাদের স্বাভাবিক মর্যাদাবোধ, কর্মনিষ্ঠা ও বুক চিতিয়ে বাঁচার ধর্মকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তাঁর শিল্পকর্মের কালানুক্রমিক যে-বিচার আমরা একটু আগেই অল্প করে করলাম, তার নিরিখে বোঝা যায় যে, সাঁওতালদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্থায়ী ছিল না, সবসময়েই তার বিবর্তন ঘটছিল। অন্যদের থেকে রামকিঙ্করকে তাঁর পারিবারিক ইতিহাসের বোঝা বেশি করে বইতে হবে কেন আমি জানি না।
আজকের দিনে জনসমক্ষে শিল্পকর্মের প্রদর্শন বা পাবলিক ইন্সটলমেন্ট আবার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। রাজ্য বা কেন্দ্রের সরকার নতুন করে সাংস্কৃতিক ফুটপ্রিন্ট নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছে। এই প্রসঙ্গে রামকিঙ্করের পাবলিক ইন্সটলমেন্ট থেকে আমাদের কী শিক্ষা নেওয়ার আছে? রাজনৈতিক আখ্যান বা এজেন্ডার থেকে শিল্পকে পৃথক ও স্বতন্ত্র কীভাবে রাখা যায়?
হ্যাঁ, সরকারি ভাবে স্বীকৃত পাবলিক-শিল্পকে পুনর্কল্পনা করার একরকমের ভাবনার উদ্রেক হচ্ছে। তবে এ ভাবনা যে একেবারে আনকোরা, তা নয়। ক্ষমতায় যারা আসীন, তাদের মতাদর্শকে বিধি ও রীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেবার কাজে শিল্পকে ব্যবহার করার এক সুদীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস রয়েছে। আমাদের এখন এটা চোখে পড়ছে, কারণ এ-উদ্দেশ্য সাধন করতে আজকাল একটু বিশেষ ভাবে উঠে পড়ে লাগা হয়েছে।
এবার আসি রামকিঙ্করের কথায়। শান্তিনিকেতনে তাঁর যা যা কাজ, তার জন্যে তাঁকে কমিশন করা হয়নি। এগুলো পাবলিক জায়গায় স্থাপিত তাঁর ব্যক্তিগত শৈল্পিক প্রকাশ, যে-সমাজে তিনি বাস করতেন, সে-সমাজের সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। এর একমাত্র ব্যতিক্রম রিজার্ভ ব্যাঙ্কের জন্য করা তাঁর কাজ— এ কাজ সুযোগের চেয়ে বেশি তাঁর কাছে অত্যাচার বা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিল্পকে তিনি স্বেচ্ছাচারী অভিযান বা অনুসন্ধান হিসেবে দেখতেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতের বিপরীতে গিয়ে এই কাজ তাঁকে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে পীড়া দিয়েছিল। নেতাজীর মনুমেন্ট নিয়ে তাঁর যে অভিজ্ঞতা, সেটাও এরকমই ছিল, তবে ভাগ্যবশত একেবারে গোড়াতেই তাঁর প্রস্তাবটি নাকচ করে দেওয়া হয়। এতে সরকারি বাঁধা গতে কাজ করার যন্ত্রণার হাত থেকে তিনি বেঁচেই গিয়েছিলেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ভাল পাবলিক-শিল্প সম্ভব নয়। আজ আমরা যে শিল্প দেখতে ভালবাসি, সম্মান দিই, তার মধ্যে একটা বড় অংশ পরিকল্পিত এবং পরিচালিত হয়েছিল পাবলিক/সরকারি প্রকল্প হিসেবেই। স্বৈরাচারী, একনায়কতান্ত্রিক, সর্বগ্রাসী শাসকের হয়ে স্বেচ্ছায় কাজ করেছেন এমন অনেক শিল্পীর সন্ধান পাওয়া যায়, আবার সেরকম শাসকেরই ইচ্ছের প্রতিবাদ করেছেন বা তাদের খর্ব করেছেন এমন শিল্পীও মেলে। অতএব শিল্পের অরাজনৈতিক হয়ে ওঠার কোনও দরকার নেই; শিল্পীদের দরকার নিজেদের অন্তরের প্রত্যয় অনুসারে নিজেদের সমকালের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। তাঁদের এই প্রত্যয় তাঁদের আমাদের সর্বজনীন মনুষ্যত্বের পক্ষ নিতেই বলুক, এটুকুই আমরা আশা করতে পারি।