রাজধানীতে লকডাউনের ষষ্ঠ সপ্তাহে হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধের দোকান, অক্সিজেন-সরবরাহ, টিকাকরণ ইত্যাদি কোভিড সংক্রান্ত কার্যকলাপ বাদ দিলে প্রধানতঃ দু ধরনের কাজ পুরোদমে চলেছে। এক, তথাকথিত সেন্ট্রাল ভিস্তার নির্মাণ, আর দুই, রেস্তোরাঁ থেকে বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেওয়া। সুইগি-জোম্যাটোর কর্মীরা অক্লান্ত ভাবে শহর চষে বেড়াচ্ছেন যে যা ফরমায়েশ করেছে সেই মতো বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে। দিন নেই রাত নেই, তাঁদের কাজের শেষও নেই।
এমনই একজনের সঙ্গে কথা হল, তিনি জানালেন, ‘‘কোভিডের ভয় মাথা রাখলে কাজ করা সম্ভব নয়। আর কাজ না করলে …’’ বাকিটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে হেসে যোগ করলেন ‘‘লকডাউনে কিন্তু আমাদের জন্য পোয়া বারো, ব্যবসা বেড়ে গেছে বিপুল ভাবে, আর তার প্রধান কারণ কি অপনি জানেন?’’ মাথা নাড়লে তিনি বললেন, ‘‘রান্নার লোক আসছে না যে। গত বছর সবার খুব উৎসাহ ছিল বাড়িতে নতুন জিনিস তৈরি করার, এ বছর…’’ নীরবতা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন পরিস্থিতি কী। টিকা? ‘‘সে প্রশ্ন করবেন না।’’
তবে এ-ও বললেন, ‘‘এসব অভিজাত পাড়ার ব্যাপার, আমি যেখানে থাকি এসে দেখুন, লকডাউন মানে বেশির ভাগ লোক কাজে যাচ্ছে না এই যা, নয়তো ফ্লাইওভারের নিচে খাবার দোকান আগের মতোই চালিয়ে যাচ্ছে, লোকে ভীড় করে খাচ্ছেও।’’
ভারতের যে কোনও শহরের তুলনায় দিল্লিতে সম্ভবত বিত্তের ওজন অনুযায়ী আবাসিক বিভাজন সবচেয়ে বেশি। একেক পাড়ায় একেক শ্রেণীর লোক, কলকাতা মুম্বাই ব্যাঙ্গালুরু চেন্নাইয়ের মতো সহাবস্থান খুব একটা চোখে পড়ে না। সুতরাং বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন রেওয়াজ।
তা দিল্লির লোক রেস্তরাঁ থেকে খাচ্ছে কী? একজন মাত্র সরবরাহকারীকে জিজ্ঞেস করে এই প্রশ্নের জবাব আদায় করার থেকে অবৈজ্ঞানিক প্রণালী আর কিছুই হতে পারেনা ঠিকই, কিন্তু বাজারে নেমে সমীক্ষা করার উপায় তো আর নেই। উত্তরে জানা গেল সেই পিৎজা এবং বাটার চিকেনের সাম্রাজ্য জারি আছে, খাওয়া নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার মেজাজও লোকের নেই।
যে হৃদয়বিদারক দৃশ্য খুব কম লোকই দেখতে পাচ্ছেন, তা হল উপবাসী গৃহহীন লোকেরা খাবারের ট্রাকের পেছনে ছুটছেন, যদি কিছু পাওয়া যায়। গত বছর খাবার সরবরাহ করা হয়েছিল বহু রোজগারহীন মানুষকে, এ বছর সেই তুলনায় ঢালাও ব্যবস্থা নেই, যদিও যথারীতি শিখ সম্প্রদায়ের সদস্যরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।
মনে হতে পারে লকডাউনের দরুণ লোকেও ডাউন থাকবে, খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বেরোবে না। টিকা নেওয়ার জন্য অবশ্য যেতেই হবে আশেপাশের হাসপাতালে বা সরকারি স্কুলে, কিন্তু দেখা গেল কোনও অজ্ঞাত কারণে বড় রাস্তায় গাড়ির অভাব নেই, হুস হুস করে চলেছে সবাই। যাচ্ছে কোথায়? বলা মুশকিল, কিন্তু একেক সময়ে মনে হচ্ছে এত লোক বাড়ির বাইরে থাকলে ফল কি ভাল হবে?
দিল্লিবাসীদের অবশ্য কোনও কিছুতেই সেরকম বিশ্বাস নেই। প্রত্যেক দিন দিল্লি সরকারের মন্ত্রীরা নিয়ম করে এসে স্বাস্থ্যের পরিকাঠামো, টিকাকরণ আর, এখন, দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা নিয়ে ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে তথ্য প্রচার করছে, আর বহু লোক এসে অনুনয় বিনয় থেকে হুমকি, সব রকম অস্ত্রের সাহায্যে দাবি করছে লকডাউন তুলে দিতে।
এছাড়া গোপন পার্টি তো আছেই, যদিও লোকমুখে যা শোনা যাচ্ছে সেগুলো সেরকম গোপন আর নয়। একটু বেশি রাতের দিকে হয় এগুলো, সারা রাত চলে, তবে গানবাজনা একটু আস্তে চালানো হয় যাতে প্রতিবেশীরা খেপে গিয়ে পুলিশে খবর না দিয়ে দেন। পুলিশের অবশ্য খুচরো ঝামেলায় যাওয়ার সময় নেই, তাদের কাজের জন্য দিল্লিতে রাজনৈতিক নির্দেশই প্রধান।
এদিকে টিকার হাহাকার জারি আছে। বিত্তবান প্রভাবশালী লোকজন সুবিধে করে উঠতে পারছেন না এখন। হোয়াটস্যাপে হোয়াটস্যাপে জবর তথ্য আদানপ্রদান চলছে, কোথায় গেলে নথিকরণ ছাড়াই টিকা পাওয়া যেতে পারে। কেউ কেউ বলছেন ভোর সাতটা থেকে গিয়ে ধর্ণা দিতে, যা দিনকাল পড়েছে তাতেও অনেকে রাজি। বিদেশ যাত্রা আপাতত স্থগিত। গ্রীষ্মে পশ্চিমী দেশের দোকানে দোকানে যে ‘সেল’ দেওয়া হয় তার সুবিধে নেওয়া যাচ্ছে না, অবশ্য নতুন পোশাক দেখানোর সুযোগও নেই।
গ্রীষ্মের আগে বসন্তের আসার কথা, তবে দিল্লিতে সাধারণত: এই ঋতুর খুব একটা দৌরাত্ম্য দেখা যায়না। ঠান্ডা চলে যাওয়া আর গরম পড়ার মাঝে বড়োজোর দু তিন সপ্তাহ পাওয়া যায়। কিন্তু গত বছরের মতো এ বছরও এই সময়টায় রাস্তাঘাটে লোকজন কম বলে পাখির ডাক সমেত বসন্তের ছোঁয়া পুরস্কার, এবং ফুলও ফুটছে।
সোনালি অমলতাস গাছের ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার ধূম লেগেছে, এ বলে আমারটা দেখ তো ও বলে আমারটা দেখ। দিল্লির বহু রাজপথে তথা পাড়ায় পাড়ায় এই গাছ আছে, সুতরাং প্রতিযোগিতা কেউই জিততে পারছে না। অমলতাসও কি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল? রবীন্দ্রনাথে এর নতুন নামকরণ করার আগে নাম ছিল বাঁদরলাঠি, কবি পরিবর্তন না করলে এত ছবি তোলা হতো কিনা কে জানে?
দিল্লিতে বর্ষাকাল বলেও সেরকম কিছু নেই, যদিও জুলাই অগস্টে বৃষ্টি হয়। কিন্তু সেই সারাদিন ঝিরঝিরে বর্ষা, মনটা খিচুড়ি মাছভাজা করছে, সেরকম কিছুর বালাই নেই। তবে এবার সুদূর পশ্চিম উপকূলে সাইক্লোনের ফলে মে মাসে অভূতপূর্ব বৃষ্টি। কস্মিনকালে এই সময়ে দিল্লিতে এত বৃষ্টি হয়নি। লকডাউনের দৌলতে জল জমা রাস্তায় গাড়ি চালানোর চেষ্টা করে অনেককে মেজাজ গরম করতে হয়নি, বরঞ্চ বারান্দায় বসে বর্ষার গানের ইউটিউব লিঙ্ক পোস্ট করা গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু গরম এবং লকডাউনের ইতি, দিল্লিতে দুইই আসন্ন। জুন মাস রাজধানীবাসীদের জন্য পরীক্ষার মাস হয়ে দাঁড়াবে। এরই মধ্যে চলে গেলেন পিতাপুত্র দেবু চৌধুরী ও প্রতীক চৌধুরী। দুই সেতার বাদকেরই বাজনা বন্ধ হয়ে গেল কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে। পারদ কতটা উঠবে? আর কোভিড?